নিষ্প্রভ প্রণয় পর্ব-১৫+১৬

0
880

#নিষ্প্রভ_প্রণয়
#পর্ব_১৫
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

সবুজরাঙ্গা শাড়িটা বেশ সুন্দরভাবেই নীরুকে পরিয়ে দিল সেতু।চোখে গাঢ় কালো কাজল লাগিয়ে দিল।ঘাড় পর্যন্ত ছোট চুলগুলোয় ক্লিপ লাগিয়ে মিষ্টি হাসল সে।নীরুর থুতনিতে হাত রেখে আয়নায় মুখ দেখিয়ে বলে উঠল,

” বাহ!কি ভীষণ মিষ্টি লাগছে নীরুপাখিকে।আগে কখনো শাড়িতে দেখার সুযোগই হয়নি তোমায়।”

নীরু ডাগর চোখ মেলে আয়নায় তাকাল।নিজেকে কিয়ৎক্ষন পর্যবেক্ষন করেই অবুঝ বাচ্চার মতো বলে উঠল,

” তুমি সত্যি বলছো?সুন্দর লাগছে আমায় সেতু দি?”

সেতু নিঃশব্দে হাসল।ঠোঁট চওড়া করে বলল,

” খুব সুন্দর লাগছে নীরু।কোন ছেলে দেখলে নির্ঘাত মাথা ঠিক থাকবে না।টুপ করে পিঁছলে গিয়ে তোমার প্রেমে পড়ে যাবে।”

নীরু মলিন চাহনীতে তাকাল।মন খারাপের বিষন্নতায় নরম কন্ঠে শুধাল,

” যার জন্য সাঁজছি,সে বোধহয় সেসব ছেলেদের মধ্যে পড়ে না সেতু দি।সে আমায় এটুকুও পছন্দ করে না।তার অতি সুন্দর রূপবতী একটা প্রেমিকা আছে।স্যরি ছিল।আমি অবশ্য তার সেই প্রেমিকার মতো অতোটা সুন্দরী নই। ”

সেতু পাশে বসল।হাসিখুশি, চঞ্চল নীরুর হঠাৎ উদাস গলায় অবাক হলো। তবে কি নীরুর ভালোবাসা একপাক্ষিক?সেতু মুহুর্তেই প্রশ্ন ছুড়ল,

” ছেলেটা কে সেতু?কে এত নিষ্ঠুর ছেলে যার তোমার মতো মেয়েকে পছন্দ হয় না?”

নীরু উদাসীন ভাব ছেড়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।আয়নায় নিজেকে আরেক দফা দেখে নিয়ে বলল,

” উহ!ওসব ছেলেপেলে আমার জীবনে নেই সেতু দি।কে থাকবে বলো?কার আমাকে পছন্দ হবে?আমি তো মজা করে দেখছিলাম তোমার রিয়েকশন কেমন হয়।তুমি তো দেখি সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করে একদম দুঃখের সাগরে ভেসে গেলে সেতু দি।”

সেতু মানল না। আবারো প্রশ্ন করল,

” ছেলেটা কি রঙ্গন দা?আমি যদি খুব ভুল না হই তবে তোমার সেই অনুভূতির মানুষটা রঙ্গন দা।ঠিক বলছি?”

নীরু চমকাল।অবাক হয়ে বলল,

” তুমি উনাকে চেনো? কি করে বুঝলে মানুষটা সেই?”

সেতু মলিন হাসল।বলল,

” রঙ্গন দাকে ততদিনই চিনি যতদিন তোমার ভাইকে চিনি।আর বিষয়টা বুঝার কথা বলছো?না বুঝার তো কিছুই নেই নীরু।যে মেয়েটা কখনো শাড়ি পরেনি সে তার সাধের পুরুষটার জন্যই শাড়ী পরার বায়না ধরতে পারে।যে মেয়েটা ততোটা সাঁজে না সে মেয়েটা তার ভালোবাসার মানুষটার আকর্ষন লাভ করার জন্যই আয়োজন করে সাঁজতে বসে।তাই না?”

নীরু স্থির তাকিয়ে রইল।উদাস গলায় উত্তর দিল,

” জানি না।”

.

সোফায় সেতুর শ্বাশুড়ির সাথে যে মহিলাটি বসে আছে তাকে সেতু চেনে না।বয়সে তার গুরুজন হবে।চুলগুলো আধপাঁকা।পরনে হালকা রংয়ের শাড়ি।সেতু রান্নাঘরে পা বাড়াতে বাড়াতে তাকাল।মহিলাটািকে সে না চিনলেও মহিলাটির চাহনীতে স্পষ্ট, উনি সেতুকে চেনেন।সেতু রান্নাঘরে পা বাড়াল।হাত লাগিয়ে কাজ করতে গিয়েই কানে আসল,

” এই মেয়েটাই ছেলের বউ নাকি?তা শুনলাম মেয়েটার আগে এক বিয়ে ছিল?বাচ্চাটাও নাকি তোমাদের বাড়িতেই থাকে?মেয়ে দেখতে রূপবতী বলেই কি ছেলে এমন উম্মাদের মতো কাজ করে বসল নাকি দিদি?আর যায় হোক,নিষাদকে তো ভালো ছেলে জানতাম।সেই ভালো ছেলেকে এভাবে ফাঁসিয়ে ঠকিয়ে দিল?”

সেতুর মনোযোগ আর কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না।সম্পূর্ণ মনোযোগ গিয়ে জমল অচেনা মহিলাটির কথা শোনার ইচ্ছায়।সেতু কান খাড়া করল।পরবর্তী উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করতেই হঠাৎ নিষাদের কন্ঠ ভেসে আসল,

” কাকিমা, আপনার ঠিক কি কারণে মনে হচ্ছে আমি ঠকে গেলাম? বা আমায় ফাঁসানো হয়েছে?”

ভদ্রমহিলা কিঞ্চিত চুপসে গেল।নিষাদের কথার জবাবে ফোঁড়ন কেঁটে বললেন,

” তুমি না হয় বউয়ের রূপে অন্ধ হয়ে সব ভুলে বসেছো বাবা।আমরা কি আর অন্ধ নাকি?বুঝি না কোনটাকে ঠকানো বলে আর কোনটাকে ফাঁসানো বলে?”

নিষাদের চাহনী কিঞ্চিৎ তীক্ষ্ণ হলো।কন্ঠে একঝুড়ি ক্ষোভ ঢেলে শীতল কন্ঠে বলল,

” কোন এংগেল থেকে বলছেন কাকিমা?আমার মা তো এতগুলোদিন একসাথে সংসার করছে একসাথে। তার তো মনে হলো না তার ছেলে ঠকে গেছে।আপনার হঠাৎ এত কষ্ট হচ্ছে কেন বুঝলাম না।”

ভদ্রমহিলা এবার কপাল কুঁচকাল।অপমানে রেগে গিয়ে নিষাদের মায়ের দিকে তাকাল।ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলল,

” বাহ বাহ দিদি!বিয়ের কয়দিন যেতে না যেতেই ছেলের এই অবস্থা।সারাজীবন টিকে থাকতে পারবেন তো এই সংসারে?ছেলে তো বউয়ের কথা কিছু বললেই ছ্যাৎ করে উঠছে! ”

নিষাদের মা মুখ তুলে চাইল।কিঞ্চিৎ হেসে জবাব দিল,

” ছেলে আর ছেলের বউই তো সারাজীবন একসাথে থাকবে।সংসার করবে।আমি আর বাঁচব কয়দিন বলুন?ওদের মাঝে বন্ধনটা যদি সুন্দর হয় তাহলেই আমি সুখী।আমার ছেলেকে আমি ছোট থেকে আমার শিক্ষায় বড় করেছি।আর আমার শিক্ষা এতোটাও ঠুনকো নয় যে আমার ছেলে আমার জীবদ্দশায় আমায় বাড়ি থেকে বের করে দিবে।আমার ঐটুকু বিশ্বাস আছে ওর প্রতি।”

ভদ্রমহিলা সেই জবাবে খুশি হলো না।ধারালো চাহনী ভোঁতা করেই বলল,

” এত বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত টিকবে তো দিদি?কত দেখলাম এমন!”

নিষাদের মা গলা ঝেড়ে উত্তর দিলেন,

” আমি আশা করি টিকবে।নিলি, নিষাদ, নীরু এদের কাউকেই আমি কোনদিন কোনকিছুতে বাঁধা দিইনি।সবসময় আমি ওদের ইচ্ছাটাকে গুরুত্ব দিয়েছি।কারণ আমার কাছে আমার সন্তানদের সুখ আগে।নিলির বিয়ের সময়ও আমি নিলিকে একবার ও বারণ করিনি।ছেলেকে সে নিজেই পছন্দ করেছে।নিষাদের ক্ষেত্রেও করিনি।কারণ সংসারটা সারাজীবন নিষাদ করবে।আর না তো নীরুর ক্ষেত্রেও নিষেধ করব।আমি একটা জিনিস মানি, আমি যতটুকু দিব অপরপাশ থেকেও ততটুকুই পাব।যেহেতু তাদের আমি কোনদিক দিয়ে কষ্ট দিইনি আমি আশা রাখতেই পারি, তারাও আমায় কষ্ট দিবে না।তাই না দিদি?”

ভদ্রমহিলা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল।বসা ছেড়ে উঠতে উঠতেই বলল,

” দোষটা ছেলেকে দিয়ে তো লাভ নেই।দোষটা আসলে আপনার মধ্যে দিদি।ছেলেমেয়েদের এত স্বাধীনতা দেওয়াও ভালো নয়।যেমন কর্ম তেমনই তো ফল পাবেন।তাই না?”

নিষাদের মা হাসল, বলল,

” হ্যাঁ। যেন তেমনই ফল পাই।আশীর্বাদ করবেন।”

নিষাদ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল।মায়ের উত্তরে মুগ্ধ হলো।মনের ভেতর অানন্দ হলে।ছোটবেলা থেকেই নিলি আর নিষাদ ছিল প্রচন্ড জেদি আর রাগী।অন্যদিকে নীরু ছিল হাসিখুশি আর চঞ্চল।নিষাদের কঠিন রূপটা মিলে নিলির সাথে, আর চঞ্চল রূপটা মিলে নীরুর সাথে।সেই ছোট থেকে কত ঝগড়া, কত মারামারি, কত অভিমান, কত অভিযোগ তিনভাইবোনের।অথচ মা কোনদিন তাদের একটা মারও দেয়নি।তার মা ভীষণ শান্তিপ্রিয় মানুষ।হয়তোবা শান্তিলাভের জন্যই ছেলেমেয়েদের সাথে কোনদিন ঝামেলা করেননি।

দূর থেকে সবটাই খেয়াল করল সেতু।শ্বাশুড়ির জবাবে মুগ্ধ না হয়ে পারল না।এই পরিবারের মানুষগুলো এত ভালো কেন?এত ভালোবাসা কেন এখানে?সেতুর চোখ ঝাপসা হয়ে আসল। এত সুখ আসলেই সইবে তো তার?কষ্টে জীবন পার করা সেতু বিশ্বাস করতে চাইল না তার জীবনে এত এত সুখের অস্তিত্বকে!যেন বিশ্বাস করে উঠলেই কর্পূরের ন্যায় হাওয়া হয়ে যাবে সেই সুখ!

.

রঙ্গন আসল দুপুরের আগে আগে।সবার সাথে বেশ স্বাভাবিক ভাবে কথা বলেই ভাব বিনিময় করল।নীরু সবটাই খেয়াল করল দরজার আড়াল থেকে।বিয়ের প্রস্তাব রাখতে আসলে কেউ একা একা আসে?রঙ্গন কি নিজের বিয়ের প্রস্তাব নিজেই রাখবে?নীরু লজ্জ্বায় লাল হলো।সারাক্ষন হৈ চৈ করা নীরু অজানা কারণে আজ রঙ্গনের সামনেই যেতে পারছে না।রঙ্গনের সামনে গেলেই যেন বুকের ভেতর হাতুড়ি ফেঁটানো শুরু হবে।মাথা ঘুরিয়ে পড়ে টড়েও যেতে পারে অতিরিক্ত খুশিতে। এত এত ভাবনার মাঝেই বসার ঘর থেকে রঙ্গনের মধুর কন্ঠে ভেসে আসল,

” নিষাদ, নীরু কোথায়?দেখছি না তো।”

নীরু টুপ করে চোখ বন্ধ করল মুুহুর্তেই।বুকের ভেতর অস্থিরতার ঝড় বাড়ল।আবারও চোখ মেলে উঁকি মারল দরজার কোণা দিয়।বসা অবস্থায় রঙ্গনকে দেখেই আবারও চোখ বন্ধ করল।বুকের উপর হাত রেখেই মিহি সুরে গাইল,

” আমার হৃদয় যাহা চায়,
তুমি তাই- তুমি তাইগো
আমার হৃদয় যাহা চায়…”

ভুল লিরিক্সেও নীরুর গলায় গানটা সুন্দর শোনাল। ।চিকন মিহি কন্ঠে এলোমেলো শব্দে ভুল লিরিক্সে তা গাইতে গাইতেই বেলকনিতে পা বাড়াল।মনে মনে শপথ করল, আজ কিছুতেই রঙ্গনের সামনে যাবে না।কিছুতেই না!কিন্তু সেই শপথ বেশিক্ষন টিকল না।দুপুরের খাওয়ার জন্য ডাক পড়ল।নীরু নাকোচ করল সেই ডাক।দরজা আটকে তব্দা মেরে বসে বসে ভাবতে লাগল।ভাবনা শুধু একজনকেই ঘিরে। মানুষটা হলো রঙ্গন, রঙ্গন আর রঙ্গন।এত এত ভাবনার মাঝেই দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হতেই নীরুর নাম ধরে আবারো ডাক পড়ল।নীরু জবাব দিল না।পরমুহুর্তেই দরজার কাছাকাছি সেতু মিনমিনে গলা ভেসে উঠল,

” নীরু?যার জন্য এত সাঁজলে তাকে নাই যদি দেখালে সাঁজার কোন মানে ছিল?রঙ্গন দা তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে।তুমি কি কথা বলবে না?”

নীরু উচ্ছ্বাসিত চাহনীতে তাকাল।চোখ চকচক করে উঠল।রঙ্গন কথা বলতে চাইছে?কি আশ্চর্য!যে ছেলেটা কোনদিন নিজ থেকে কথা বলে না, সে ছেলেটাই নিজ থেকে তার সাথে কথা বলতে চাইছে?বুকের ভেতর প্রেম প্রেম অনুভূতি টের পেল। চঞ্চল নীরু খাটে বসে পা দুলাল।বেশ কিছুটা সময় পরই বলল,

” যাব না।কি এমন বলবে সে গাঁধা?”

” সেটা আমি কি করে জানব?তবে মনে হলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ কথোপকোতন সারবে।তুমি কি ইন্টারেস্টেড না?”

নীরু খিলখিলিয়ে হাসল। কি বুঝে উঠে গিয়ে দরজা খুলল।উঁকিঝুকি দিয়ে বলল,

” কোথায় সে গাঁধা?”

সেতু মৃদু হাসল।জবাবে বলল,

” ছাদে আছে তোমার ভাইসহ।তুমি গেলে তোমার ভাই চলে আসবে।দ্রুত যাও।”

নীরু সেতুর দিকে তাকাল।নরম গলায় শুধাল,

” যাব?কি বলতে পারে সে?”

” সেটা না গেলে কি করে বুঝবে? ”

নীরু মাথা দুলাল।সেতুর দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলানো এক হাসি উপহার দিয়ে বলল,

” গেলাম সেতু দি।”

কথাটা বলেই পা বাড়াল নীরু।কোনদিন শাড়ি না পরা নীরুর শাড়ি সামলাতে কষ্ট হলো।তাও জোরে জোরে পা বাড়াল প্রিয় মানুষটার সাথে কথা বলার উচ্ছ্বাসে।হুড়মুড় করে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের ফ্লোরে পা রাখতেই ঘটে গেল বিপত্তি।সবুজ রাঙ্গা শাড়িটা সামলাতে না পেরেই ঝুঁকে পড়ে গেল ছাদের ছাঁইরাঙ্গা খসখসে ফ্লোরে।ড্যাবড্যাব করে তা অবলোকন করল সামনের মানুষ দুটো।পরমুহুর্তেই হেসে উঠল দুইজন মানুষই।নীরুর ঠোঁট ভেঙ্গে কান্না আসল।এত এত কষ্ট করে শাড়ি পরে কোন লাভ হলো?উল্টে উপহাসের সম্মুখীন হলো।এমনটা জানলে সে কোনদিনই শাড়ি পরত না।নিষাদ হাসতে হাসতেই এগিয়ে আসল।নীরুর মাথায় টোকা দিয়ে বলল,

” তোকে শাড়িতে বাচ্চা থেকে মহিলা মহিলা লাগছিল।কিন্তু আমি তো ভুলেই গেছিলাম তুই তো সেই বাচ্চাই!হাঁটতে না পেরে ধপাস ধপাস পড়ে যাওয়া নীরুবাচ্চা!”

নীরুর চোখ টলমল করল।নিজের ভাইও এভাবে অপমান করবে?তার এই দুর্দশায় মজা লুটবে? মানতে পারল না সে।নিষাদ হাত এগিয়ে দিল উঠার জন্য।কিন্তু সে ছুঁয়ে ও দেখল না হাতটা।নিজে নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে সন্দেহভরা চোখে ফ্লোরে তাকাল।সুচাল গলায় বলল,

” আমি ঠিকঠাক মতো হাঁটতে পারি নিষাদ গরু।নির্ঘাত তোমরা গরু আর গাঁধা মিলে কোন কিছু ঢেলে রেখেছিলে ফ্লোরে।তাই এমন দশা!”

নিষাদ আর রঙ্গন আবারও আওয়াজ তুলে হেসে উঠল।রঙ্গন শার্টের হাতা গুঁটিয়েই বলল,

” একদম ভালো হয়েছে!বড়দের যে সম্মান করিস না তার ফল।”

নীরু গাল ফুলিয়ে রাখল। কোন কথা না বলে ফের আবারও পিঁছু ঘুরল।পা বাড়াতে নিতেই রঙ্গন বলে উঠল,

” দাঁড়া নীরু, কথা আছে তোর সাথে।”

নীরু দাঁড়াল।বলল,

” কি কথা?”

” দরকারি কথা।”

নীরু চুপ রইল।নিষাদ পা বাড়িয়ে চলে যাওয়ার আগে রঙ্গনকে বলে গেল,

” আমি তোকে বিশ্বাস করি রঙ্গন।আশা করি তুই এমন কিছু বলবি না যাতে নীরু কষ্ট পায়।আমি কিন্তু দিদি,নীরু কারোরই চোখের জল সহ্য করতে পারি না রঙ্গন।”

রঙ্গন বিপরীতে কিছু বলল না।তার আগেই নিষাদ চলে গেল।নীরুর দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে পর্যবেক্ষন করল।উজ্জ্বল শ্যামলা শরীরে শাড়িটা মানিয়েছে বেশ।ঘাড় পর্যন্ত চুলগুলো বাতাসে হালকা নড়ছে।হয়তো বেশ সুন্দরও লাগছে মেয়েটাকে।কিন্তু রঙ্গনের কাছে তেমন বিশেষ মনে হলো না সাঁজটা।দিয়ার সাথে প্রেম চলাকালীন দিয়াকে দেখলে যেমন পলক না ফেলে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকত তেমন আকর্ষণ নীরুর প্রতি কাজ করল না।বিপরীতভাবে ভাবলে নীরুর আচার, আচরণ, ব্যবহার, চঞ্চলতা তার ভালো লাগে। এই যে প্রতিরাতে একঝুড়ি কথা শোনায এসব শুনে তার মন ভালো হয়। অথচ দিয়ার কথায় এখন আর আনন্দ খুঁজে পায় না সে।দিয়ার সাথে এখনও মাঝেমাঝে ম্যাসেজে কথা হয়। কিন্তু তার কথায় আজকাল আর মন ভালো হয় না।আনন্দরা তার দরজায় কড়া নাড়ে না।এইদিক থেকে নীরুকে বাছাই করা হলে সেটা শুধুমাত্রই নিজের ভালো থাকার জন্য বাছাই করা হবে।নিজের মন ভালো রাখার জন্য বাছাই করা হবে।সেটা হবে নির্মম স্বার্থপরতা।রঙ্গন সেই স্বার্থপরতা করতে পারল না।ভরাট গলায় নীরুকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” নীরু?তোকে কিছু কথা বলব।আমি আশা রাখি তুই খুব মনোযোগ দিয়ে সেসব শুনবি।প্রত্যেকটা মানুষের দুটো রূপ থাকে নীরু।একটা তার চঞ্চলতা, অপরটি তার পরিপক্ব মানসিকতা।আমি আশা করি তুই তোর পরিপক্ব মানসিকতা দিয়ে কথা গুলো বুঝবি।”

নীরু হঠাৎ থমকে গেল রঙ্গনেন ভরাট গলায়।এতক্ষন আনন্দ বয়ে চলা হৃদয় হঠাৎ দমবন্ধ অনুভব হলো।অজানা ভয়ে ভীত হলো।চঞ্চলতা বাদ দিয়ে মাথা নাড়াল। নরম গলায় বলল,

” হ্যাঁ, বলো।”

রঙ্গন হালকা হাসল। ঠোঁট গোল করে লম্বা শ্বাস টেনে বলে উঠল,

“তুই খুব ছোট নীরু।অনেকটা অবুঝ বাচ্চাদের মতো।আমি জানি আমার কথাগুলোয় তুই কষ্ট পাবি, কান্না করবি।তবুও তোকে সত্যগুলো মেনে নিতে হবে।দিনশেষে ভালো থাকতে হবে।এখন যেমনটা হেসেখেলে চলছিস ঠিক তেমনই হেসেখেলে থাকবি।মনে থাকবে?আমি আর যায় হোক, আমি সবসময়ই চাই তুই ভালো থাক নীরু।অনেক অনেক ভালো থাক।”

নীরু অজানায় শঙ্কায় থমকে রইল।ঝিমঝিম করা মস্তিষ্ক নিয়ে হঠাৎই স্পষ্ট কন্ঠে বলে উঠল,

” অতোসব ভাবতে হবে না।সরাসরি বলো কি বলবে।”

“পারলে আমায় ক্ষমা করিস নীরু।আমি এই নিয়ে অনেক ভেবেছি। দিনশেষে আমি নিরুপায়।বাবা মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।আশীর্বাদের অনুষ্ঠান হবে সপ্তাহখানেক পর।”

রঙ্গনকে অবাক করে দিয়ে নীরু কষ্ট পেল না।খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।চঞ্চল গলায় বলল,

” তোমাকে তোমার মা বাবা হাত পা বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে গাঁধা?এই জন্য নিরূপায়?”

রঙ্গন চাপা স্বরে উত্তর দিল,

” বিয়েতে আমি নিজেই মত দিয়েছি নীরু।তুই হাসি,চঞ্চলতার মাঝখানে অস্বীকার করলেও তোর অনুভূতি সম্পর্কে আমার খুব ভালোভাবে জানা আছে নীরু।তোর ভালোবাসা, অভিমান সবটাই বোধহয় আমার জানা। তবুও আমি তোর দিকে ঝুকতে পারব না নীরু।তোর বয়সটা এখন আবেগের। একটা সময় পর দেখবি এই আবেগটা কেঁটে যাবে।আমার থেকেও দশগুণ ভালো ছেলে তোর জীবনসঙ্গী হবে নীরু।”

নীরুর চোখ টলমল করল।তবুও ঠোঁট চওড়া করে হাসল।ফিচেল গলায় বলল,

” উহ!আমার তো দশগুণ ভালো ছেলের দরকার নেই গাঁধা।তোমাকে বর হিসেবে মেনেছি তোমাকেই মেনে নিব সারাজীবন।আরেকটা বিয়ে নাহয় করলেই তুমি,ক্ষতি নেই।আমি নাহয় বিয়ে না করেও তোমার বউ হবো,তোমার বাচ্চার মা হবো, তোমার সাথে সংসার করব।নো দুঃখ, অনলি চিল!”

রঙ্গন হাসল৷ বলল,

” তুই সত্যিই আলাদা!এমন একটা সিরিয়াস মোমেন্টেও তোর ফ্লার্টিং চলবেই?”

নীরু খিলখিলিয়ে হেসে শুধাল,

” আলাদা হয়ে কি লাভ হলো?তোমার মনে তো জায়গা হলো না গো। ”

রঙ্গন কিছু বলতে পারল না।নীরু আবারও বলল,

” বিয়ে কবে গাঁধা?”

” জানি না।জানাব পরবর্তীতে। আপাদত আশীর্বাদের অনুষ্ঠান হবে। দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে বিয়ে হবে।”

নীরু অবাক হলো।জিজ্ঞেস করল,

” দেশ ছেড়ে যাবে মানে?”

রঙ্গন মৃদু হেসে জবাব দিল,

” পনেরো দিন পর ফ্লাইট।বিজন্যাসের জন্যই যাওয়া।যদি ওখানে বিজন্যাসে প্রোপারলি সামলাতে পারি তো ওখানেই স্যাটেল হওয়ার প্ল্যান আছে।”

নীরুর কষ্ট হলো।ইচ্ছে হলো বাঁধা দিতে। কিন্তু পারল না।মুখে বলল,

” ভালোই তো।এখানকার বিজন্যাস কে সামলাবে?”

” দাদাভাই।”

নীরু চুপ রইল কিয়ৎক্ষন।তারপর কি বুঝে রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে রইল।জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,

” আচ্ছা,আমার বেলায় তুমি তো দিয়া দি কে ভালোবাসতে বলেছিলে।এখন বিয়ে করার বেলায় সব ভালোবাসা উবে গেল?বিয়ে যখন করছোই, আমাকেও তো করতে পারতে। আমি কি এতটাই অযোগ্য?”

রঙ্গন কিয়ৎক্ষন চুপ থাকল।তারপর গম্ভীর কন্ঠে শুধাল,

” তোকে তোর পরিবার এখনই বিয়ে দিয়ে দিবে না নীরু।তাছাড়া ভালোবাসাবিহীন সংসার করে কিইবা করতি?নিষাদ কখনোই এমন একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এ তোকে ঠেলে দিত না।ও চায় ওর মতোই কেউ একজন তোকে ভালোবাসবে।নিজের সবটুকু উজাড় করে দিবে।আমিও তাইই চাই নীরু।তুই এমন কারোর সাথে সংসার গড়বি যার কাছে তুই থাকবি অমূল্য।আমার কাছে তুই শুধু অপশন।আমি নিজেই স্বীকার করছি তা।দিয়া ছেড়ে যাওয়ার পর অনেকগুলো দিন আমি বিষন্নতায় ডুবে ছিলাম।তারপর তোর পাগলামোর সম্মুখীন হলাম।আমি কিন্তু তোর পাগলামো প্রথমদিকে উপভোগ না করলেও পরের দিকে উপভোগ করতাম বেশ।তোর কথায় মাঝেমাঝে হাসতাম, খুশি হতাম।এই যে দেরিতে হলেও কল তুলতাম, কারণটা আসলে আমার নিজের স্বার্থ।আমি চাই না তুই সারাজীবন সেই স্বার্থ আর সুখের খোরাকের অপশন হয়ে থাকিস।যদি ভালোবাসার অনুভূতি জম্মাত তবে আমি তোকেই সর্বপ্রথম জানাতাম।”

নীরু মৃদু হাসল।সুরেলা গলায় সুর তুলে গাইল,

তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো নীড়
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো নীড়
তোমার নৌকোর মুখোমুখি আমার সৈন্যদল
বাঁচার লড়াই
আমার মন্ত্রী মারা গেছে একটা চালের ভুল…

রঙ্গন চাপাস্বরে বলল,

“উফফ!মন্ত্রী মারা যায় না, খোয়া যায়।নীড়ের জায়গায় ঘর হবে। এই ভুল লিরিক্সে গান গাওয়া যাবে না তোর?গান পরিস না তো গাইতে হবে কেন?”

নীরু হেসে উঠল ঝংকার তুলে।যেন কোন দুঃখ নেই, কোন কষ্ট নেই তার মধ্যে।কি ভীষণ প্রাণবন্ত হাসি।রঙ্গনের দিকে দু পা বাড়িয়েই ফিসফিসিয়ে বলল,

“উহ!ভুল শব্দে গান গাইলে সৃজনশীলতা প্রকাশ পায় গাঁধা।তুমি জানো না?যেমন ভুল মানুষে অনুভূতি দান করলে জীবনে অদলবদল আসে৷ তেমনই!সবশেষে শুভকামনা নতুন জীবনের জন্য,নতুন মানুষের জন্য।খুব সুখী হও।আমার ভাগের সুখটাও তোমায় দিলাম।হুহ?”

কথাগুলো বলে পিঁছু ফিরল নীরু।বুকের ভেতর অসম্ভব যন্ত্রনা সহ্য করে মুখে হাসিটা আটকে রাখল দক্ষভাবে। দ্রুত দূরত্ব বাড়িয়ে এগিয়ে চলল।পেঁছনের মানুষটির আর একটা কথাও শোনার ইচ্ছা হলো না।হৃদয়ের সকল ইচ্ছা, সকল অনুভূতি আজ থেকে পরিত্যাক্ত তার কাছে!

#চলবে….

#নিষ্প্রভ_প্রণয়
#পর্ব_১৬
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

রঙ্গনের আশীর্বাদের অনুষ্ঠানের কথাটা শুনেই সবাই স্তব্ধ হলো।নিষাদ অবাক করা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।নীরুর মতো মনে মনে সেও অন্যকিছুই ভেবে রেখেছিল।নিজের এত কাছের বন্ধুর বিয়ে ঠিক হলো, আশীর্বাদের অনুষ্ঠানের তারিখ ঠিক হলো অথচ সে কিছুই জানে না?আশ্চর্য!নিষাদ চোখ ঘুরিয়ে বোনের দিকে তাকাল।কোথাও দুঃখের কোন রেশ নেই।উচ্ছল প্রাণবন্ত হাসি তার মুখে।নিষাদ নীরুর সে হাসির মানে খুব সহজেই ধরতে পারল।তবুও কিছু বলতে পারল না।রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে ভরাট গলায় বলল,

” আশীর্বাদের অনুষ্ঠানে ইনভাইট করার জন্য এভাবে বাড়িতে আয়োজন করে আসার কি ছিল?তুই তো চাইলে কলেও ইনভাইট করতে পারতি।”

রঙ্গন না চাইতেও হালকা হাসল।বলল,

” উহ!সামনাসামনি ইনভাইট করা আর কলে ইনভাইট করায় তফাৎ আছে না?বিয়ে তো একবারই করব। সুন্দরভাবে ইনভাইট করে গেলে তো ক্ষতি নেই।”

নিষাদ আর কিছু বলতে পারল না।আরো কিছুটা সময় পরই নিষাদের মায়ের সাথে কথা বলে রঙ্গন বাড়ি ছাড়ল।নিষাদ ছোট্ট শ্বাস ফেলল।নীরু ততক্ষনে ঘরে চলে গিয়েছে।নিষাদও পা ফেলে বোনের ঘরে গেল।খাটে চিৎ হয়ে চোখ বুঝে শুঁয়ে আছে নীরু।হাত গুলো দুইপাশে মেলে দেওয়া।পা জোড়া ঝুলছে।নিষাদ চেয়ার টেনে বসল।নীরু আগের মতোই চোখ বুঝে রেখে বলল,

” কিছু বলবে দাভাই?দয়া করে যা কিছুই বলো, সান্ত্বনা দিও না দাভাই।”

নীরুর মুখে “দাভাই” শব্দটা শুনে নিষাদ অবাক হলো।গরু শব্দটা দাভাই শব্দে পরিণত হতেই নীরুর কষ্টের পরিমাণটা বুঝে উঠল সে।বুকের ভেতর ভার অনুভব হলো।তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,

” স্যরি নীরু।যদি জানতাম রঙ্গন এমন কিছুই বলতে আসবে বাড়িতে তাহলে কখনো আলাদা করে তোদের কথা বলার সুযোগ করে দিতাম না। ”

নীরু চোখ মেলে চাইল।উঠে বসে নিষাদের দিকে তাকিয়ে মলিন কন্ঠে বলল,

” তাও কথাটা তো আমার কানে আসতই। আমি তো জানতামই কোন না কোনদিন সে অন্যের হচ্ছে।বাদ দাও।যা হয়েছে ভালো হয়েছে।আমি খুশি হয়েছি।”

নিষাদ সরু চোখে চাইল।বলল,

” আমার সামনে অভিনয়টা করতে হবে না নীরু।খাস নি কিছু।খাবার আনছি৷ চুপচাপ খেয়ে নিবি।”

নীরু হালকা হাসল৷ বলল,

” তুমি কি আমায় টিপিক্যাল গার্লফ্রেন্ডদের মতো ভেবেছো গরু?প্রেমিক ছেড়ে গেলেই যেসব প্রেমিকারা খাওয়া তাওয়া বন্ধ করে সুইসাইড টুইসাইড করে বসে। তাদের মতো ভেবেছো?”

” না, আমি জানি তুই কেমন।খুব ভালো করেই চিনি তোকে।আমি জানি তুই তেমন কিছু করবি না।তোর হাসিটাও উবে যাবে না।হয়তো সবার সামনে কান্নাও দেখাবি না।কিন্তু তোর কষ্টটা আমি ফিল করতে পারছি নীরু।আমার খুব অসহায় লাগছে। রঙ্গন যেমন আমার বন্ধু, তুই ও আমার বোন।আমি চাইনি তোর অনুভূতি এভাবে খু’ন হোক।আমি সত্যিই চাইনি।”

নীরু স্বাভাবিক হয়ে আগের রূপে ফিরে আসল।বসা ছেড়ে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। নিজের ঘাড়সমান ছোট ছোট চুলগুলো থেকে ক্লিপ খুলল।আয়নার সামনে গিয়ে চোখের কাজলটা কাপড় দিয়ে দ্রুত তুলে খিলখিলিয়ে হাসল।চঞ্চল গলায় বলল,

“বাদ দাও তো এসব।আবেগের বয়সে আছি তো তাই একটুআধটু আবেগ তো কাজ করবেই।দুইদিন পর দেখবে সব ভ্যানিশ!তোমার বন্ধুর থেকে শতসহস্রগুণ ভালো ছেলেকে বিয়ে করব আমি।দেখে নিও।”

নিষাদ মৃদু হাসল। বলল,

” চল খাবি।”

নীরু আর কিছু বলল না।পা বাড়িয়ে খাবার টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসল।খালি প্লেট সামনে রেখে চেঁচিয়ে নিষাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

” এতক্ষন যে খেয়ে নে খেয়ে নে বললে।খাবারটা বেড়ে দেবে কে?তুমিই বেড়ে দেবে।সেতু দি বা মা বেড়ে দিলে আমি খাব না বলে দিলাম।”

নিষাদ ঠোঁট গোল করে শ্বাস টানল।পা ফেলে টেবিলের সামনে বসে থাকা নীরুর দিকে তাকাল।কেমন জানি কষ্ট হচ্ছে, অস্থির লাগছে।হয়তো এই কষ্টটা সেও পার করে এসেছে বলে।বয়সে বেশ ছোট আর চঞ্চল বোনটি সেই তীব্র শোক সইতে পারবে তো?যতোটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছে সব ততোটাই স্বাভাবিক থাকবে তো সব?চিন্তা হলো।তবুও সেই চিন্তা প্রকাশ করল না।কোনদিন খাবার না বাড়তে পারা নিষাদ অদক্ষ হাতে ভাতের বাটি হাতে নিল।চামচ দিয়ে ভাত তুলতে গিয়েই অল্পকয়েক ভাত পড়ে গেল টেবিলের মসৃন তলে।নীরু কপাল কুঁচকাল।আওয়াজ তুলে বলল,

” এত বড় ছেলে হয়েছো, কি পারো তুমি?বয়স কত হুহ?ছিঃ!ছিঃ!ভাতটাও বেড়ে দিতে পারছো না গরু?সুন্দর করে দাও।নাহলে খাব না কিন্তু।”

নিষাদ অসহায় চোখে তাকাল। পরেরবার সুন্দর করেই চামচে ভাত তুলল।তারপর নীরুর প্লেটে রাখল।কিন্তু তরকারি দিতে গিয়ে আবারও বিপদে পড়ল।চামচে যেন তরকারি উঠছেই না।কি আশ্চর্য!অনেক কষ্ট করে চামচে তরকারি তুলে নীরুর প্লেটে রাখতে গিয়েই তরকারির ঝোল গিয়ে পড়ল নীরুর শাড়ির আঁচলে।নীরু ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না তুলল।ঠোঁট উল্টে বলতে লাগল,

” তুমি কি এইসব ইচ্ছে করেই করছো গরু?তোমার কাছে ভাত খেতে চেয়েছি বলে এভাবে অপমান করে খাবার বেড়ে দিচ্ছো তুমি?ভাত দিলে তুফানের মতো করে, এখন তরকারি দিচ্ছো জলোচ্ছ্বাসের মতো করে? খাব না আমি।”

নিষাদের মুখটা আরো অসহায় হলো।অন্য সময় হলে বোনের সাথে ঝগড়া করত।আজ ঝগড়া করার জন্য কোন কথা আসছে না মুখে।পাশে চেয়ার টেনে বসেই হাত ধুঁয়ে নিল।প্লেটটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে খাবার মাখল।নীরুর দিকে হাত বাড়িয়ে খাবার এগিয়ে দিতে দিতেই বলল,

” খাবি না মানে?তোর চৌদ্ধগোষ্ঠী খাবে।হা কর।”

নীরু কান্নার নাটকে ইতি টানল।মুহুর্তেই চমৎকার হাসল।মুখ এগিয়ে দ্রুত মুখে ফুরল খাবার।নাক ফুলিয়ে মুখ কুঁচক বলল,

” ছিঃ!কি বিচ্ছিরি খেতে।খাবারটা তুমি মেখেছো বলেই এতোটা বিচ্ছিরি স্বাদ।”

নিষাদ সরু চোখে তাকিয়ে শুধাল,

“কথা না বলে তাড়াতাড়ি খা বলছি।”

নীরু গাল ফুলিয়ে রাখল।চুপচাপ ভাইয়ের হাতে খেতে লাগল।

.

সেতু বিছানায় বসে ছিল। বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।পরিবেশটা কেমন ঠান্ডা।নীর ঘুমাচ্ছে। নীরুও আজ বেশ চুপচাপ।সেতুর মন খারাপ হলো প্রাণবন্ত নীরুর কথা ভেবে।এত চেয়েও মানুষটাকে পেল না?এত উচ্ছ্বাস নিয়ে শাড়ি পরল, সাঁজল।অথচ তার প্রিয় মানুষটা তাকে এমন এক উপহার দিয়ে বসবে যেটা সে আশাই করেনি।সেতু চুপচাপ ভেবে গেল সেসব।ভাবনার মাঝেই টের পেল কেউ একজন তার কোলে মাথা রেখেছে।অপলক তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

” আজকে আমার মন খারাপ সেতু। আমার মন খারাপ কাঁটিয়ে দাও প্লিজ।”

কি সুন্দর অধিকার দেখিয়ে কথাটা বলে ফেলল নিষাদ!কি নির্দ্বিধায় আবদার রাখল!সেতু চোখ নামিয়ে নিষাদের চোখের দিকে তাকাল।কি ভীষণ গহীণ চাহনী।সে চাহনীতে একরাশ বিষন্নতা। সেতু নিজের নরম হাত নিষাদের চুলে রাখল।বলল,

” আমি যে মন খারাপ কাঁটাতে পারি না নিষাদ।”

নিষাদের মুখ উদাস হলো।চোখ বুঝে থেকে ভরাট গলায় শুধাল,

” খুব মাথা ধরেছে। বুকের ভেতর কষ্ট হচ্ছে। ভালোবাসা শব্দটা কষ্টের খুব। শব্দটা ভীষণ যন্ত্রনার।কাউকে ভালোবাসলেও কষ্ট পেতে হয়।কারো ভালোবাসা ভেঙ্গে যেতে দেখলেও কষ্ট পেতে হয়।”

সেতু চুপ রইল।হাত দিয়ে নিষাদের ঘন ঝাকড়ানো চুলে হাত বুলাল।নিষাদ আবারও বলল,

” নীরুর কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি। খুব করে টের পাচ্ছি ও আমার মতোই ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে।কিন্তু আমি কিছু করতে পারছি না সেতু।আমার বোনটা কষ্ট পাচ্ছে। অথচ হাসছে কি সুন্দর।”

সেতু ঠোঁট ভিজাল জিহ্বা দিয়ে। বলল,

” যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে পা বাড়িয়ে লাভ নেই। শুধুই অবহেলা পাওয়া যায়। এই ধ্রুব সত্যটা জেনে মানুষ সেই মানুষটারই প্রেমে পড়ে যে মানুষটা তাদের সারাজীবন অবহেলায় ডুবিয়ে রাখে। নীরুর ভালোবাসা সত্যি ছিল।অনুভূতি গুলো বাস্তব ছিল।তবুও যদি মানুষটা তার কপালে না জুটে তাহলে বুঝবেন, সেই মানুষটার থেকেও উত্তম কেউ ওর জীবনে আসবে।”

” আমি জানি না ওর জীবনে আর কে আসবে, কখন আসবে।কিন্তু ও তো আমারই বোন।আমি জানি ও অন্য কারো প্রতি খুব সহজেই অনুভূতিপ্রবণ হতে পারবে না।আমিও তো পারিনি সেতু।তুমি আমায় বলেছিলে, যতদিন না প্রতিষ্ঠিত হয়ে তোমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব ততদিন যেন তোমার পিঁছু পিঁছু না ঘুরি।তুমি প্রেম করবে না,একেবারেই বিয়েই করবে।আমিও মেনে নিলাম।বিনিময়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম,’ ততদিনে যদি তুমি অন্য কারো হয়ে যাও?’ তুমি সেদিন আমায় ঠান্ডা স্বরে কথা দিয়ে বলেছিলে, ‘ হবো না অন্য কারো।আমি অপেক্ষায় থাকব।’ তোমার সেই কথা তুমি রাখলে না সেতু।আমি তোমার থেকে দূরত্ব টানলাম সেই কতবছর আগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লোভে।তারপর?তারপর একদিন জানতে পারলাম তোমার বিয়ে হয়ে গেছে।কি ভীষণ যন্ত্রনায় ছটফট করেছিলাম আমি সেদিন।কি ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম।তোমার বিয়ের হওয়ার আগেও দুইবছর আমি তোমাকে দেখিনি।তোমার সাথে সরাসরি কথাও বলিনি।এতগুলো দিন তোমার থেকে দূরত্বে থাকার পরও তোমার প্রতি আমার অনুভূতি এইটুকুও কমল না। যখন জানলাম তুমি অন্য কারো হয়ে গেছো আমার কলিজা ছিড়ে যাচ্ছিল।নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।বার তিনেক সুইসাইডের চেষ্টা করেছি তোমার প্রতি ঘৃণা রেখে।কিন্তু লাভ হলো না।আমি দিনশেষে ব্যর্থ হলাম তোমার থেকে অনুভূতি সরাতে।তখন তো আমি মেনে নিতে পারিনি, সৃষ্টিকর্তা যা করেছেন ভালোর জন্যই করেছেন।আমার জীবনে আরো উত্তম কেউ আসবে এটাও মেনে নিতে পারিনি।নীরুও পারবে না মানতে।কিছুতেই পারবে না।”

সেতু মৃদু হাসল।স্পষ্ট ভাবে বলল,

” আপনি ভুল নিষাদ।নীরু পারবে মানতে।আর আপনি সেটা দেখে বিস্মিত হবেন। মেয়েরা সব পারে নিষাদ।যেমন ভালোবাসার মানুষটাকে ভালোবাসতে পারে, তেমনই ভালোবাসার মানুষকে ছাড়া বাঁচতেও পারে।রাতদিন যেমন প্রিয় মানুষটার সাথে সংসার বুনার স্বপ্ন দেখতে পারে? তেমনই প্রিয় মানুষকে ছেড়ে অন্য কারো সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারে হাসিমুখে।খুব কম মেয়েই বোধ হয় পারে না।”

নিষাদ কৌতুহলী চোখে তাকাল।প্রশ্ন ছুড়ল,

” তুমিও কি ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে হাসিমুখে বিয়ের পিড়িতে বসেছিলে সেইবার?ভালোবাসতে কি আমায় সেতু?”

সেতুর চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হলো।কথার প্রসঙ্গ ছিল অন্য।সে প্রসঙ্গ থেকে কথা টেনে নিষাদ এমন প্রশ্ন করবে ভাবে নি সে।ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কিয়ৎক্ষন চুপ থাকল।তারপর বলল,

” আপনি ব্যাতীত আর কেউ কোনদিন আমার কাছে প্রেমপ্রস্তাব রাখেনি নিষাদ।প্রেম জিনিসটা আমার কাছে নিষিদ্ধ বস্তুর ন্যায় ছিল।আর মানুষের প্রবল কৌতুহল থাকে সেই নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই!আমি ও ব্যাতিক্রম নই।কিশোরী বয়সে প্রথম প্রেম বুঝতে শিখলাম আপনার পাগলামোতে।আপনার উম্মাদনায় প্রেমের অস্থিরতা টের পেলাম।তারপর যখন নিজের মুখেই নিষিদ্ধ প্রেমের স্বীকারোক্তি স্বরূপ ” ভালোবাসি ” শব্দটা বলে বসলেন তখন থেকেই আমার প্রবল আগ্রহ জম্মাল আপনার প্রতি।তখন আমি আপনার প্রেমে পড়িনি ঠিক তবে আমি ভীষণ কৌতুহলী ছিলাম আপনার সেই প্রেমানুভূতি নিয়ে।আসলেই কি প্রেম নিয়ে প্রেমিক পুরুষ সাত সমুদ্র পাড়ি দিতে পারে?আসলেই প্রেম একজন প্রেমিক পুরুষকে যত্ন, মমতা, বিশ্বাস ইত্যাদি শেখায়?তারপর থেকে আপনি সামনে আসলে চার পাঁচবার আড়চোখে দেখতাম। বুকের ভেতর অনুভব হতো আপনার প্রেম আমায় কড়া নেড়েছে।আমার আপনার যোগাযোগ ছিল এতটুকুই।”

নিষাদের ভালো লাগল কথাগুলো শুনতে।চোখ বুঝে রেখে আবারও প্রশ্ন ছুড়ল,

” তারপর?যোগাযোগের ইতি টানার পরের অংশে কি ছিল সেতু?”

সেতু বলল,

” আমার বাবা মারা গিয়েছিল ছোটবেলায়।মা মারা গিয়েছিল যখন আমার বয়স বারো!এর পরবর্তী জীবনটা সম্পূর্ণই কেঁটেছিল দাদা আর বউদির অধীনে।দাদা কম বেতনের চাকরী করত।সংসার চলত সেই কম রোজগারেই।মাসের শেষে টানাফোড়ন চলত।বউদির মুখে প্রায়সময়ই নানা ধরণের, নানা রকমেন কথা শুনেছি আমি।দাদা বউদির অধীনে বড় হওয়া সেই আমির কাছে প্রেম করা ছিল আকাশ ছোঁয়ার মতো।এদিকে ক্রমশ আপনি উম্মাদ হয়ে উঠছিলেন।পাগলামো বাড়ল।দাদাও খেয়াল করল তা।একদিন আপনাকে ডেকে নিয়ে বেশ কিছু কথাও শোনাল।আমার বউদির মুখ বেশ ধারাল।আমার পিঁছু পিঁছু আপনার ঘোরার বিষয়টা জানতে পেরে সেই ধারালো মুখ আরো ধারালো হলো।আমি তখন বাধ্য হয়েই আপনাকে দূরে সরানোর জন্য সেই শর্ত রাখলাম।আপনিও রাজি হলেন।ব্যস!তারপর আর দেখা হলো না, কথা হলো না,প্রেমানুভূতি জানানো ও হলো না।”

“উহ!পরের ঘটনা শুনতে চেয়েছি সেতু।”

সেতু হালকা হাসল।বলল,

” পরের ঘটনা আপনার জানা। সেখানে বিশেষ জানার মতে কোন তথ্য নেই।”

নিষাদের গলা আরো খানিকটা ভরাট হলো।বিষন্নতা ছুঁয়ে গেল কন্ঠে।বলল,

” জানা নেই।অনেক কিছুই জানা নেই।।তোমার বিয়ে হলো।কেন বিয়েতে রাজি হয়েছিলে?কেন বিয়ে করে অন্যের হয়ে গিয়েছিলে আমায় কথা দিয়েও?কেনই বা বিয়ে করছো এটা একবারও জানালে না আমায়?”

“একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব আসল নিষাদ।শেষমেষ বিয়েটা ঠিক হয় গেল।আমার দায়িত্ব ছিল দাদা বউদিদের হাতে।আপনার কথা জানানোর সাহসই হয়ে উঠেনি আমার।জানালেও যে বিশেষ লাভ হতো তেমন নয়।আপনাকে কথা দিয়েছিলাম অন্য কারো হবো না, তবুও কথা না রেখে অন্য কারো হয়েছি।মেয়েদের জীবন অদ্ভুত নিষাদ! কথা দিলেও কথা রাখা হয়ে উঠে না সবসময়।আমি হয়তো চাইলে পারতাম কথা রাখতে।কিন্তু আমার যে অতো অধিকার ছিল না পরিবারে, আমার কথার যে অতো প্রাধান্য ছিল না নিষাদ।আর রইল কেন জানাইনি?জানালে কি হতো নিষাদ?আপনি তখন বেকার।আমার পরিবার বিয়ে দিত না আপনার সাথে।উল্টে সমস্যা হতো। তাই আর জানানো হয়নি।”

নিষাদ মৃদু আওয়াজ তুলেই বলল,

” ভালো করেছো।”

নিষাদের কথাটায় চাপা রাগ।সেতু তা বুঝতে পারল।বুঝেও কিছু বলল না আর আগ বাড়িয়ে।

.

নীরুর হাতে মোবাইল।মোবাইলের স্ক্রিনে এক যুবকের ছবি।একটা না, অনেকগুলো।নীরু একে একে সবগুলো ছবি দেখল।তারপর হঠাৎ ই সবগুলো ছবি ডিলিট করতে লাগল।ছবি, নাম্বার, ম্যাসেজ সহ যাবতীয় যত তথ্য ছিল রঙ্গন সম্পর্কিত সবগুলো ধীরে ধীরে মুঁছে দিল।হৃদয়ে তরতাজা দুঃখের সাথে সাথে প্রশান্তির হাওয়া বইল।যে স্মৃতি রাখা কেবলই দুঃখ পোষা, সেই স্মৃতি বেশিদিন না পুষে মুঁছে দেওয়া উচিত।ইশশ!মোবাইলফোনের মতো যদি তার মন থেকেও এইভাবে মানুষটাকে মুঁছে দেওয়া যেত।

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে