গল্পঃ #নিশ্বাসে_তুমি ( ৫ম বা শেষ পর্ব )
সাদিয়ার কোমরের কাছ থেকে কাপড় টেনে সরাচ্ছে নিলয় এমন সময় খপ করে নিলয়ের হাত ধরেই অন্য হাত দিয়ে বালিশের নিচ থেকে চাকু বের করে সাদিয়া উঠে বসে বললো– আমার পিরিয়ড চলাকালীন সময়েও তোমার এই জঘন্য নোংরা মানসিকতা দেখে সত্যি অবাক হচ্ছি।
নিলয় থতমত খেয়ে বললো– আরে আগেই রেগে যাচ্ছো কেন কি করতাম সেটা তো দেখে নিতে পারতে।
সাদিয়া বললো– হুম তুই আমার সর্বনাশ করতি আর চুপচাপ সেটা আমি দেখে নিতাম তাইনা।
নিলয় বললো– সর্বনাশ ছাড়া করার মতো কি আর কিছু নেই না-কি?
: থাকলেও আপনার মাথায় ঐসব যুদ্ধ বিগ্রহ এবং বায়োলজি বিষয় ছাড়া যে আর কিছু নেই সেটা অন্তত আমি ভালো করেই জানি।
: আরে ধুর কি যে বলো। যুদ্ধ বিগ্রহ এবং বায়োলজি যে পিরিয়ডের কাছে ধরাশায়ী তা আমিও জানি।
: জানলেও বিশ্বাস করা যাচ্ছেনা জামাই, কতদিনের অভুক্ত, তাই চান্স পাইলে পিরিয়ড ফিরিয়ড দেখার টাইম আছে।
: ছিঃ ছিঃ বউ, আমি অতটা অধৈর্য হলে এতদিনে তোমার কোলে একটা বাচ্চাকাচ্চা ওয়া ওয়া করতো।
: ইশ সখ কতো ওনার।
নিলয় বিড়বিড় করে বললো– সখের তো অভাব নাই কিন্তু প্রকাশ করলেই তো বউয়ের হাতের চাকুর ভয়।
সাদিয়া নিলয়ের গলায় চাকু ধরে বললো– সত্যি করে বল তোর মতলবটা কি নয়তো দিলাম ঢুকিয়ে এক্ষুনি।
জলদি করে একটা বোতল বের করে সাদিয়ার চোখের সামনে ধরে নিলয় বললো– সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম তাই।
সাদিয়া বললো– কেন বোতলে কি ভূত বন্দী করে আনছেন যে সেটা দেখিয়ে সারপ্রাইজ দিবেন।
নিলয় বললো– ভূত আনলেও ভূত তোমার রাগ দেখে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে পালাতো গো বউ।
সাদিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বললো– ইয়ার্কি মারা হচ্ছে তাইনা।
নিলয় বললো– জীবনে একটা মশা মারিনি কোনদিন, ইয়ার্কি তো দূরের কথা।
নিলয়ের কথা শুনে সাদিয়া হেসে ফেললো।
বোতলটা সাদিয়ার হাতে দিতেই সাদিয়া সত্যি সারপ্রাইজড।
নিলয় বললো– ব্যথায় তুমি ঘুমাতে পারছোনা আমি ঘুমাই কি করে বলো। তুমি তো আগেই বলে দিয়েছো পিরিয়ডের ব্যাথার ওষুধ খাবেনা। তাই নেটে ঘাটাঘাটি করে দেখলাম পানি কুসুম গরম করে বোতলে ভরে তলপেটে সেঁকা দিলে ব্যথার উপশম হয়। সেটার ব্যবস্থাই করলাম।
সাদিয়া ভীষণ অবাক, মানুষটা এতটা কেয়ারিং।
সাদিয়া বললো– তো সেটা আগে বললেই পারতেন জনাব।
নিলয় মুখ ভার করে বললো– তার আগেই তো চাকু-টাকু দেখিয়ে তুমি আমাকে ভয়ঙ্কর সারপ্রাইজ দিয়ে দিলে।
সাদিয়া হাসতে হাসতে শেষ।
নিলয় বললো– ঠিক আছে এবার তুমি শুয়ে পড়ো আমি সেঁক দিয়ে দিচ্ছি, ভালো লাগবে তোমার।
সাদিয়া বললো– ঠিক আছে কিন্তু আমার শরীরে যেন বোতলের স্পর্শের সাথে আপনার হাতের স্পর্শ না লাগে খবরদার।
তারপর সাদিয়া শুয়ে পড়লো। নিলয় বোতলটা দিয়ে সাদিয়ার তলপেটে ধীরে ধীরে সেঁক দিচ্ছে আর সাদিয়ারও ভালো লাগছে। এভাবে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়লো সাদিয়া।
সকালে ঘুম থেকে নিলয় উঠলো সাদিয়ার অনেক পরে। সাদিয়া ব্যালকনিতে দাড়িয়ে আকাশ দেখছে। নিলয় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে এসে পেছন থেকে হঠাৎ করে সাদিয়াকে জড়িয়ে ধরে বললো– আমার বউটা কী করে হুম।
সাদিয়া ঘুরে দাড়িয়ে নিলয়ের গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মেরে বললো– কতবার বলেছি আমার এসব একদম অপছন্দ, আপনার লজ্জা যদি থাকতো তবে নির্লজ্জের মতো বারবার একই আচরণ থেকে বিরত থাকতেন। আর সহ্য হচ্ছে-না এসব একদম। বাবার বাসায় চলে যাবো।
নিলয় একেবারে থ মেরে রইলো। মনে হতে লাগলো পৃথিবীর সবথেকে কঠিন আঘাত এটাই। তবুও শুকনো ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে নিলয় ধীর পায়ে চলে এলো।
এরপর থেকে নিলয় যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে চললো দুদিন। তবুও নিজে সামনে না এলেও পিরিয়ডের ব্যাথার জন্য পানি গরম করে দাদির মাধ্যমে পাঠিয়েছে, সকালের নাস্তা থেকে সবকিছুই নিলয় আড়ালে থেকে খেয়ালে রেখেছে।
সাদিয়ার পিরিয়ড শেষ হয়ে এখন স্বাভাবিক।
দুপুরের পরে নিলয় বাসা থেকে বেরিয়েছে আর ফেরেনি।
সাদিয়াকে ডেকে ড্রইং রুমে মা দাদী গল্প করছে এমন সময় নিলয় ঢুকলো হাতে শপিং ব্যাগ নিয়ে।
মা বললো– কিরে কি কিনে আনলি নিলয়?
নিলয় মুচকি হেসে বললো– মা চিন্তা করেছি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এর পাশেই একটা ফ্ল্যাট নিয়ে আমার কয়েকজন ব্যাচমেট থাকে ওদের সঙ্গে থেকে স্টাডি কমপ্লিট করবো। কাল সকালেই ওখানে চলে যাচ্ছি।
মা বুঝতে পারলো নিশ্চয়ই নিলয় আর সাদিয়ার মাঝে কিছু ঘটেছে, তাই আর কথা বাড়ালো না।
নিলয় সোজা রুমে চলে এসে কাপড় ভাজ করে ব্যাগে ভরছে।
সাদিয়া এসে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে থেকে বললো– কি হচ্ছে এসব নিলয়?
নিলয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো– আমার কোনো আচরণে কষ্ট পেয়ে আমার প্রিয়জন এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে সেটা আমি চাইনা। তাই আমিই নাহয় সরে যাই।
সাদিয়া এগিয়ে এসে নিলয়ের হাত ধারণা টেনে সোজা ব্যালকনিতে নিয়ে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালো।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সাদিয়া বলতে শুরু করলো– নিলয় আমাদের জীবন একটাই, ছোট্ট এই জীবন সুখের হবে নাকি কষ্টের সেটা ঐ একজন মানুষের ওপর নির্ভর করে, সে হলো স্বামী। সব মেয়েরাই ঠিক তোমার মতো একজন কেয়ারিং হাসব্যান্ড চায় কিন্তু সবার ভাগ্যে জোটেনা জানো? বেশিরভাগ মেয়ে হুটহাট প্রেমে জড়িয়ে পড়ে প্রেমিক সম্পর্কে পুরোপুরি না জেনে, যাচাই-বাছাই না করে এবং পরে পস্তাতে হয় সারাজীবন। এদিকে একজন কেয়ারিং হাসব্যান্ড এর স্বপ্ন দেখা একটা মেয়ের যখন বিপরীত টাইপের কারো সঙ্গে বিয়ে হয় তখন তার জীবনটাও দুঃখ হতাশায় তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যায়। আমার মতে যদি কোনো মেয়ের মনে হয় সে তার স্বামীকে নিয়ে সুখী নয় তাহলে তার সুখের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার তার আছে। কিন্তু বেশিরভাগ মেয়ে চুপ থেকে যায় এই ভেবে যে সমাজ কি বলবে লোকজন কি বলবে। আমার কথা হলো নিজের সুখের জন্য আমি সেটাই করবো যেটা আমার করনীয়, আমি সমাজের কথায় বা লোকের কথায় কান দিয়ে সময় কেন নষ্ট করবো।
নিলয় মন দিয়ে শুনছে সাদিয়ার কথাগুলো।
সাদিয়া আবার বললো– আমি এতদিন পর্যন্ত আমাকে স্পর্শ করতে দেইনি, তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি একটা কারণেই। সেটা হলো তোমার ধৈর্যের পরিক্ষা, তোমার কাছে আমার গুরুত্বের পরিমাণ, আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা এবং কেয়ারিং কতখানি বোঝার জন্য। যদি মনে হতো তুমি সঠিক মানুষ নও তাহলে আমরা আলাদা হয়ে গেলেও আমি গর্ব করে বলতে পারতাম আমাকে কোনো পুরুষ ছুতে পারেনি। সব শেষে যা বুঝলাম তোমার থেকে যতটা আশা করিনি তুমি তারচে বেশি ভালোবাসা দিয়েছো, যত্ন নিয়েছো।আমার ভুলগুলো শুধরে দিয়ে কাছে টেনে নিয়েছো বারবার। একটা সংসার সুখের হতে এটাই দরকার নিলয়। যাকে আজীবনের জন্য আপন করে নিশ্বাসে পরিনত করে নেবো তাকে একটা যাচাই করে নেবার অধিকার সব মেয়েরই থাকে। আর এই পরিক্ষা নিতে গিয়ে তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য আমি সত্যি স্যরি নিলয়, প্রয়োজনে তুমি যে শাস্তি দেবে মাথা পেতে নেবো।
নিলয় চুপ করে সাদিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে ভাবছে– সাদিয়া তো ভুল কিছু বলেনি, একজন বুদ্ধিমতী মেয়ের পরিচয় দিয়েছে। আসলেই কাউকে নিশ্বাসে পরিনত করে নেবার আগে যাচাই করে নিয়ে হয়, নয়তো ভুল মানুষের পাল্লায় পড়ে গেলে ছোট্ট এই জীবনটা তিলে তিলে ক্ষয়ে যায় নিশ্বাস হারায়। আর নিশ্বাস ছাড়া তো মানুষ বাঁচেনা।
নিলয়কে চুপ দেখে সাদিয়া বললো– কি হলো কি শাস্তি দেবো বলো।
নিলয় মুচকি হেসে বললো– কান ধরো।
সাদিয়া এগিয়ে এসে দুই হাত দিয়ে নিলয়ের দুই কান ধরে বললো– এই যে ধরলাম।
নিলয় হা হা করে হেসে বললো– আরে আমার কান ধরতে বলিনি তোমার কান ধরতে বলেছি।
সাদিয়া মিষ্টি হেসে নিলয়কে বললো– তুমি তো আমার স্বামী, তোমার কান মানেই আমার, আমার কান মানেই তোমার।
নিলয় হাসছে।
সাদিয়া নিলয়কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিলয়ের ঠোঁটে লম্বা একটা চুমু খেয়ে বললো– এখন থেকে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমাকে ছেড়ে যাবেনা কথা দাও, কারণ তুমি মিশে আছো নিশ্বাসে আমার। তুমি দূরে সরে গেলে মরে যাবো আমি।
নিলয় সাদিয়ার কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বললো– কথা দিতে হবেনা বউ আমার নিশ্বাসেও তুমি, তোমাকে হারালে আমিও যে মরে যাবো।
সাদিয়া মুচকি হেসে বললো– বিশাল সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।
নিলয় বললো– জলদি বলো লক্ষী বউ আমার।
সাদিয়া বললো– আজকে বায়োলজি ক্লাস করার ইচ্ছে হচ্ছে জামাই।
নিলয় পাজাকোলা করে সাদিয়াকে কোলে নিয়ে বললো– জলদি চলো বউ শুভ কাজে দেরি করতে নাই।
তারপর…
থাক তারপর ওরা বায়োলজি ক্লাসে বিজি আমাদের আর ওদিকে নাক গলিয়ে কাজ নেই।
এভাবেই দুজন দুজনের নিশ্বাসে পরিনত হয়ে সুখে দিন কাটাতে লাগলো।
সমাপ্ত।
লেখকঃ নিলয় আহমেদ।