গল্পঃ #নিশ্বাসে_তুমি ( ২য় পর্ব )
দুধ খেয়ে এসে নিলয় আনন্দে সাদিয়ার ওপর ঝাপিয়ে পড়বে এমন সময় সাদিয়া বললো– আরে আরে ধৈর্য ধরো জামাই সাহেব। এতটাও বা তাড়াহুড়ো কিসের। দুধটুকু পেটে হজম করার আগেই লম্ফঝম্প শুরু করলে বদহজম হয়ে যাবে তো।
– তা ঠিক– বলে নিলয় রুমের ভেতর পায়চারি করে জলদি দুধ হজম করার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তাই দেখে সাদিয়া হাসতে হাসতে শেষ।
সাদিয়া হাসছে কারণ নিলয় আশার আগেই সাদিয়া দুধে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল তাই। যে উত্তেজনায় নিলয় আনন্দে লাফাচ্ছে সেই উত্তেজনা একটু পরেই পানি হয়ে যাবে ভেবে হাসছে সাদিয়া মুখ চেপে।
কিছুক্ষণ পায়চারি করে ক্লান্ত হয়ে নিলয় গিয়ে খাটে শুয়ে পড়ে হাই তুললো। দুচোখে এক পৃথিবী ঘুম এসে ভর করেছে তার, চোখের পাতা লেগে যাচ্ছে বারবার।
সাদিয়া মুচকি হেসে বললো– কি ব্যাপার জামাই সাহেব কি হলো?
– ঘুম পাচ্ছে খুব – বললো নিলয়।
সাদিয়া হাসতে হাসতে বললো– আপনি ঘুমালে বিড়ালটা কে মারবে শুনি?
নিলয় চোখ বন্ধ করে অনড় হয়ে শুয়ে আছে।
সাদিয়া মুচকি হেসে বললো– যাক বাবা বিড়ালটা বেঁচে গেল এ যাত্রায়।
তারপর দুজন ঘুমিয়ে পড়লো।
বাসর রাত থেকেই মানে জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম রাত থেকেই এভাবে সাদিয়া ও নিলয়ের খুনসুটি শুরু হয়ে আজ পর্যন্ত চলছে।
দুজন স্বামী স্ত্রী হলেও স্বামী স্ত্রীর যে একান্ত মুহূর্তে কাছাকাছি আসা, শারীরিক মেলামেশা, এসব কিছুই হয়নি আজও। নিলয় কাছে আসতে চাইলেও সাদিয়া চালাকি করে ঠিকই এসব থেকে দূরে সরে থাকে।
যা-ই হোক আজ আবার গায়ে হাত পা ফেলা নিয়ে যুদ্ধ শেষে দুজন ঘুমিয়ে পড়েছে।
শেষ রাতের দিকে আকাশে মেঘ গুড়গুড় আর বিজলী চমকাতে শুরু করেছে।
ধীরে ধীরে বাতাসের গতিও প্রবল হচ্ছে। বাইরের গাছপালার শুকনো ডাল স্ব শব্দে ভেঙে পড়ছে এদিক সেদিকে। তারপর শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি সেই সাথে মেঘের ভয়ঙ্কর গর্জন।
বৃষ্টিভেজা শীতল হাওয়া জানালা দিয়ে রুমে ঢুকে পুরো রুম ঠান্ডা করে ফেলেছে। সাদিয়া গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। নিলয় পাতলা কম্বল টেনে সাদিয়ার গায়ে দিয়ে উঠে গিয়ে জানালার কপাট বন্ধ করে এসে আবার শুয়ে পড়লো।
মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছে বাইরে। সাদিয়া ঘুমের মধ্যেই নিলয়কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। অন্যরকম এক ভালোলাগার অনুভূতিতে ছেয়ে গেল নিলয়ের হৃদয়।
ডিম লাইটের আবছা আলোয় সাদিয়ার মুখটা ভীষণ মায়াবী লাগছে। সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট দুটো যেন মৃদু লাজ ও ভালোবাসার মিশ্র অনুভূতিতে ডেকে বলছে এমন ওয়েদার মিস করতে নেই নিলয়।
নিজের মনকে নিলয় শান্ত করলো এই বলে যে– ঠোঁটে চুমু খেতে গেলে যদি সাদিয়া টের পায় তাহলে ভবলীলা সাঙ্গ করে চুমুর অপরাধে চিরতরে পরপারে পাঠিয়ে দেবে। এখন চুমু খেতে না পারি অন্তত দেখতে তো পারি। তখন দেখার সুযোগও হারাবো।
হঠাৎ ভীষণ শব্দে মেঘ গর্জন করতেই সাদিয়া ঘুমের ঘরে নিলয়কে আরও শক্ত করে জড়িত ধরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল।
ঘুম ভাঙতেই নিলয়ের সাথে জড়িয়ে আছে দেখে বললো– কিরে তুই আবার কোন সাহসে আমাকে জড়িয়ে ধরলি, মরার জন্য প্রানটা খুব ছটফট করে তাইনা।
নিলয় ঘাবড়ে গিয়ে বললো– এ বাবা এদিকে গেলেও বাঁশ, ওদিকে গেলেও বাঁশ, তাহলে যাবো কোনদিকে!
সাদিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বললো– আগে দূরে সর তারপর বলছি কোনদিকে যাবি।
নিলয় মিনমিন করে বললো– সরবো কীভাবে, নিজেই তো আমাকে জড়িয়ে ধরে ফাঁসিয়ে এখন ফাঁসি দিতে চাইছো।
সাদিয়ার ঘুমের ভাবটা পুরোপুরি কেটে যেতেই সাদিয়া খেয়াল করলো আসলেই তো সে নিজে নিলয়কে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।
এবার সাদিয়া নিলয়কে ছেড়ে দিয়ে বললো– ঠিক আছে এবারের মতো ক্ষমা করে দিলাম।
নিলয় ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো– দোষ না করেও ক্ষমা বাহ! মানে ছুঁইলাম না জরিমানা দিলাম ফাও।
সাদিয়া খপ করে বালিশের নিচ থেকে চাকু বের করে বললো– বুঝলাম আমিই জড়িয়ে ধরেছি ঘুমের ঘরে। কিন্তু আপনি কেন সরিয়ে দিলেন না। আমি জড়িয়ে ধরার পরে কি করছেন সত্যি করে বলেন জনাব। নয়তো বউয়ের হাতে মরে ভূত হতে হবে বলে দিলাম।
মনে মনে ভাবছে এ মেয়ের মাথায় নির্ঘাত সমস্যা আছে, সত্যি সত্যি কিনা চাকু মেরে পটল তুলতে পাঠিয়ে দেয় আবার।
নিলয়কে চুপচাপ দেখে সাদিয়া বললো– কি ব্যাপার, নিরবতা পালন করা হচ্ছে বুঝি? চিরতরে নিরব করে দেবার আগে জবাব দিন বলছি।
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে নিলয় বললো– বউ জড়িয়ে ধরলে স্বামী যা করে তাই করেছি।
: স্বামী যা করে তাই করেছি মানে? তারমানে তুই…
: এই না না।
: তাহলে কি করছেন শুনি?
: ইয়ে…
: ইয়ে মানে? ঐসব।
: আরে না, প্রাণের ভয় আছে আমার।
: তাহলে কি?
: তুমি জড়িয়ে ধরার পরে অন্যকিছু করতে পারবোনা ভেবে শুধু কল্পনা করেছি।
: কল্পনায় কি করছেন হুম, ঐসব চুমাচুমি আকাম, যদি তাই হয় তাহলে আজকে আপনার খেল খতম মিস্টার নিলয়।
: এবাবা কল্পনায়ও বউকে আদর করা অপরাধ?
: না অপরাধ নয় কিন্তু কল্পনায়ও তো আমি নাকি।
: তো বউ তুমি, কল্পনায় কে থাকবে পরিমনি?
নিলয়ের কথা শুনে সাদিয়া হেসে ফেলে বললো– আচ্ছা কল্পনায় কি করা হয়েছে শুনি।
: কল্পনায় আমরা দুজন জানালার পাশে জড়াজড়ি করে গা ঘেঁষে একটা পাতলা কাঁথা জড়িয়ে বসে বাইরের বৃষ্টি উপভোগ করছিলাম। সাথে তোমার হাতের এক কাপ গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ে মজেছিলাম বেশ।
: বাহ বাহ বাহ, নিজে চা খাচ্ছিলেন আর আমার বেলায় এক কাপ চাও নেই?
: আরে ঐটা তো কল্পনা সাদিয়া।
: হোক কল্পনা, কল্পনায় তো চা আপনিই খাচ্ছিলেন আর আপনার পাশে আমি অসহায়ের মতো বসে সেই দৃশ্য দেখছিলাম তাইনা। পুরুষ জাত সত্যিই স্বার্থপর।
নিলয় ফ্যালফ্যাল করে সাদিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছে– বাপরে বাপ এ মেয়ে তো কল্পনায়ও ছাড় দিচ্ছেনা। এরকম হলে তো বাস্তবে, স্বপ্নে, কল্পনায় সবখানে এই বউয়ের হাতে ধোলাই খেতে হবে দেখছি।
সাদিয়া বললো– তা কল্পনায় আর কি হলো?
নিলয় মনে মনে ভাবলো– কল্পনার কথা কল্পনায় থাকুক, বললেই আরও ফেসে যেতে হবে।
নিলয়কে চুপ করে থাকতে দেখে সাদিয়া বললো– কি হলো চুপ কেন জামাই সাহেব?
নিলয় চালাকি করে বললো– কল্পনার আর কোন বিষয়বস্তু স্পষ্ট মনে পড়ছেনা এখন।
সাদিয়া মুখ চেপে হেসে বললো– তাহলে যেটুকু মনে আছে সেটুকু তো বাস্তবে রুপান্তর করতে হবে নাকি?
: মানে কি বউ?
: মানে এই মুহূর্তে কিচেনে গিয়ে গরম গরম দুকাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসেন।
: এখন?
: হুম এখনই, বাইরে তো বৃষ্টি হচ্ছে। কল্পনা বাস্তব করার সুযোগ এখন হাতছাড়া হয়নি।
নিলয় খাট থেকে নেমে কিচেনে যেতে যেতে মনে মনে বললো– এই কান ধরলাম, জীবনে আর যা-ই করি কোনদিন কল্পনা করবো না।
চা রেডি করে নিয়ে এসে এক কাপ সাদিয়ার হাতে হাতে দিয়ে নিলয় বললো– ম্যাডাম এবার কি কল্পনা কান্ড থেকে রেহাই পেতে পারি?
সাদিয়া বিছানার উপর থেকে কম্বল টেনে নিয়ে নিলয়ের হাত ধরে টেনে জানালার পাশে নিলয়ের গা ঘেঁষে দাড়িয়ে কম্বলটা দুজনের গায়ে জড়িয়ে চায়ের কাঁপে চুমুক দিয়ে বললো– যেসব কল্পনা বাস্তবে রুপান্তর করা সম্ভব সেসব করে নিতে হয় মিস্টার জামাই, নয়তো বুকে হতাশা বাসা বাঁধে। এই যে আমরা জানালার পাশে দাড়িয়ে চা খেতে খেতে বৃষ্টি উপভোগ করছি। হলো তো কল্পনা সত্যি?
নিলয় ভীষণ অবাক, সাদিয়ার কথায় গলে জল হয়ে কোনটা বলে আবার কেস খেয়ে যায় সেই ভয়ে চুপ। ঘড়ির সেকেন্ডের কাটার চেয়েও এ মেয়ের মুড দ্রুত বদলায়।
তবে সাদিয়ার এমন ব্যবহারে আজ নিলয় ভীষণ মুগ্ধ ও সুখী। জ্ঞানীরা বলেছেন যে যত কঠিন তার মন তত নরম বেশি। সাদিয়ার যা ইচ্ছা করুকনা, সময় নিয়ে বুঝতে হবে সাদিয়াকে।
দীর্ঘসময় জানালায় দাড়িয়ে থেকে এবার এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো দুজন।
সাদিয়া বললো– এখনও ওসব করতে মনে চায়?
নিলয়ের চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক, হাসিমুখে বললো– তুমি চাইলে করি চলো।
সাদিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো– আমি চাইলে মানে! আমার ইচ্ছে নেই আপনি করেন।
নিলয় মুখ গোমড়া করে বললো– ওসব একা একা করার জিনিস নাকি?
সাদিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বললো– এই যে, আমি কল্পনার কথা বলেছি মিস্টার, ওসব করতে কি দুইজন লাগে নাকি! মনের মধ্যে আবারও শয়তানি চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে তাইনা?
নিলয় মুখটা সেন্টি ইমোজির মতো করে বললো– ঐসব না বলে সোজাসুজি কল্পনা বললেই পারতে।
বালিশের নিচ থেকে চাকু বের করে নিলয়ের চোখের সামনে দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আবার বালিশের নিচে রেখে বললো– সাবধান, ঘুমিয়ে পড়ুন এবং গুড নাইট।
দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়লো।
সকালে চোখ খুলতেই নিলয়ের বুকটা ধক করে উঠলো। পাশে সাদিয়া নেই, সাদিয়া যেখানে শুয়েছিল সেখানে রক্তে মাখামাখি, কি হলো সাদিয়ার?…
চলবে…
লেখকঃ নিলয় আহমেদ।