নির্ভরতার হাত

0
816

আমার ছেলের ঘরের নাতি রিশাদ ছোটবেলা থেকেই দারুন দুষ্টু। যখন একটু একটু করে হাঁটতে শিখলো তখন আর দশটা বাচ্চার মতো সবকিছু এলোমেলো করতো, ভেঙে ফেলতো, হুটহাট করে এখান সেখান থেকে লাফ দিতো। সবাই ওর নতুন নতুন কাজ কারবার দেখে দারুন মজা পেতাম। ওর বাবা, মা, আমি তিনজনই কাজ করতাম দেখে ও মূলত ওর নানুর কাছে থাকতো ছোটবেলাটা। কাছাকাছি বাসা হওয়াতে কারোই আপত্তি ছিলনা এই ব্যবস্থায়। আমরা যে আগে কাজ থেকে ফিরতাম সে ওকে বাসায় নিয়ে আসতাম।

এ বছর আমার রিটায়ারমেন্টের পর থেকে আমার কাছেই থাকে এখন। এ বছর স্কুল শুরু করেছে তাই বাড়িতেই আমি একটু আধটু পড়তে বসাই। কিন্তু নাতির মন যে কই থাকে আল্লাহ জানে। জোরজবরদস্তি করে দশ মিনিট বসাতেই জীবন চলে যাবার যোগাড়। সাথে আছে সেই অতিরিক্ত চঞ্চলতা। আগে তাও সোফা থেকে লাফ দিত এখন সেটা পারলে আলমারির ওপর থেকে দেয়। পারলে কি দিয়েছে ও এক আধবার। মনে চাইলো তো ফ্রিজের দরজা ধরে ঝোলা শুরু করলো। নয়তো দেখা গেল টিভি ধরে ঝাকাচ্ছে। ধুমধাম ব্যথা ও পায় সারাদিন। নিজের যে কোন বিপদ হতে পারে এটা যেন সে বোঝেইনা।

ওর বাবামাকে বললে যদি মন খারাপ করে তাই কিছু বলিনা। আর সারাদিন অফিস শেষে ঘরে ফিরে ছেলের নামে অভিযোগ শুনতে কারই বা ভালো লাগে? একদিন একা পেয়ে শাম্মীর মা মানে রিশাদের নানুকে জিজ্ঞেস করলাম, রিশাদ ওনাদের বাসায় ও এমন করতো কি না? জবাব এলো বাচ্চারাতো এমনই। আমি আর কথা বাড়াইনি। তবে একদিন ছুটির দিনে আমি কথা তুললাম, ছেলে আর তার বৌয়ের কাছে। ছেলের বৌ তো বলেই বসলো, ‘কই আমার মা তো কিছু বলেনি? আপনার আসলে সেভাবে বাচ্চা পেলে অভ্যাস নেই তো। তাই বোধহয় এমন ভাবছেন।’ এমন কথার পরে আর কিছু বলাটা বাড়াবাড়ি মনে হয় আমার কাছে বলে চুপ করে যাই।

…………..

গতকাল রিশাদের স্কুল থেকে চিঠি এসেছে রিয়াদ, শাম্মী দুজনের নামেই। বিষয় ছেলের পড়াশোনায় নিদারুন অমনোযোগ এবং অতিরিক্ত চঞ্চলতা। চিঠি নিয়ে ঘরের মধ্যে রীতিমত ঝগড়া লেগে গেলো রিয়াদ আর শাম্মীর। মানুষ হিসাবে আমাদের স্বভাবই হচ্ছে কোন সমস্যাকে মেনে না নিয়ে আগে অন্যের ওপর দোষ চাপানো। আমার ঘরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রিয়াদ, শাম্মী দুজন দুজনকে দুষে যাচ্ছে সমানে। কোনরকমে থামিয়ে ওদের বুঝিয়ে রিশাদকে নিয়ে যাওয়া হয় শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে।

সব কথা শুনে ডাক্তার জানতে চায় পরিবারে কারো এ ধরনের কোন সমস্যা ছিল নাকি? শাম্মী, রিয়াদ দুজনে নেই বলে মাথা নাড়লেও আমি চুপ করে থাকি। যে লোকটার অস্তিত্ব এখন আর পৃথিবীতে নেই, শুধুমাত্র নিজের পর্যবেক্ষনের ওপর নির্ভর করে মনে করা রোগে তাকে অসুস্থ করতে ইচ্ছে হলোনা। তার ওপর আমিতো আর ডাক্তার নই। আমার কোন স্বীকারোক্তির জেরে না আবার রিয়াদ শাম্মীর সম্পর্কে অশান্তি হয় ভেবে আমি চুপ করেই থাকি। মনে পরে যায় অতীতের কত কথা।

‘হীরের আংটি বাঁকাও ভালো অর্থাৎ ছেলেমানুষের এক আধটু সমস্যা বিয়ের বাজারে কোন বড় ব্যাপারই ছিলনা সেসময়। লোকমুখে শোনা ভীষণ রকম বদরাগী আর অস্থির স্বভাবের রহমানের সাথে আমার বিয়েটা হয় তাদের বংশ পরিচিতির কারণেই। আমার শ্বশুরের ছিল অঢেল সম্পদ। ইন্টারের পরপর বিয়ে হয়ে যাওয়া এই আমি যখন পড়তে চাই আর কেউ না চাইলেও আমার শ্বশুর ব্যবস্থা করে দেন। দিনে দিনে আমাকে ওনাদের ব্যবসার হিসেবনিকেশ শেখান। ওনার ছেলের যে খানিক মানসিক সমস্যা আছে সেটা উনি বেশ বুঝতে পারলেও কোথায় চিকিৎসা করাবেন বা লোকে জানলে কি বলবে সেজন্য কখনোই কোন উদ্যোগ তারা নেননি। ভীষণ অস্থিরমনা রহমান কোন কাজে পূর্ণ মনোযোগ দেয়ার আগেই খেই হারিয়ে ফেলতো। পারতোনা জটিল কোন হিসাব মেলাতে। শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া ব্যবসার হিসেব আমাকেই রাখতে হতো। যদিও সামনে সবাই জানতো রহমানই সব দেখাশোনা করে।’

ডাক্তার সাহেব বেশ অনেকক্ষণ রিয়াদ শাম্মীর সাথে কথা বলে রিশাদের রোগটার একটা গালভরা নাম বললেন, ‘এটেনশন ডেফিসিট হাইপারএকটিভিটি ডিজঅর্ডার।’ বলে দিলেন কি করা উচিত কি করা উচিত না। ওকে একটু শান্ত রাখার জন্য ঔষধও দিলেন। আরো জানালেন খুব সুক্ষ্ম বা অনেক মনোযোগের কোন কাজে বা বিষয়ে সে ভালো না করার সম্ভাবনা বেশী। আমরা যেন তাকে কোন ব্যাপারে জোর না করি কিন্তু তাই বলে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিতেও মানা করলেন। আরো বললেন যেন আমরা আমাদের প্রত্যাশার পারদটাকে নামিয়ে রেখে ওর যে কোন অর্জনে বাহবা দেই।

‘আমার ছেলে স্কুলে ভালো রেজাল্ট করবেনা, ভবিষ্যতে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবেনা’ এই দুঃখে রিয়াদ, শাম্মী দুজনেই যখন মূহ্যমান আমি তখন ওদের বোঝাই, ‘পৃথিবীতে সবাই কি আইনস্টাইন বা নিউটন হয়? অনেক ভালো চাকুরী করলেই কি অনেক সুখে থাকা হয়? তবে তোমাদের ছেলে সাধারণ জীবনযাপন করলে তোমাদের সমস্যা কোথায়? আর তোমরা দুজনেই কি কেউ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়েছো? আমরা কি মেনে নেইনি? আমি ওর যত্ন নেবো এখন থেকে তোমরা মন খারাপ করোনা এটা নিয়ে।
রিশাদকে নিয়ে নিয়মিত কাউন্সেলিং করানো, নিয়মের মধ্যে চালানোসহ ওর পছন্দের কাজে সার্বক্ষনিক আমি খেয়াল রাখতে শুরু করি। ও খুব ছবি আঁকতে পছন্দ করতো আমি সেদিকে তার পূর্ণ মনোযোগ দেয়ার ব্যবস্থা করি। এক প্রজন্ম চিকিৎসা পায়নি অজ্ঞতার আর না মেনে নেয়ার জেরে তাই বলে নতুন প্রজন্মকে আমি সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে চাইনি কোনভাবেই।

…………….

দাদী, তুমি এখনো তৈরী হওনি? ভাইয়া কিন্তু রেগে যাবে তুমি সময়মত না গেলে। মা বাবা অফিস থেকে চলে যাবে।

– রায়না, তুই যা না। রিশাদ কে বুঝিয়ে বলিস। আমার পায়ে ব্যথা নিয়ে এখন হাঁটতে কষ্ট হয়, বুঝিসই তো।

অসম্ভব দাদী, তুমি না গেলে ভাইয়া এগজিবিশন ছেড়েই চলে যাবে। তুমি জোঁকের মতো তার পেছনে লেগে থেকে এতোদূর এনেছো। এখন তুমি না গেলে কিভাবে কি?

আমার হুইল চেয়ার ঠেলে রিশাদ নিয়ে যায় প্রথম ছবির সামনে।
‘এই ছবিটা আমি তোমার জন্য এঁকেছি দাদী। আইডিয়া দিয়েছে মা।’
ছবিটিতে একজন নারীর হাত ধরে আছে এক শিশুর হাত। ছবির নীচে ক্যাপশনে লেখা, ‘ নির্ভরতার হাত, যে প্রথম বুঝতে পেরেছিল আমার সীমাবদ্ধতা আর এগিয়ে দিয়েছিল সম্ভাবনার পথে।’

ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে