নিভৃত রজনী
| ৯ | (১২০০+ শব্দ)
চাঁদনী হাফ ছেড়ে বাঁচল নম্রতা চলে আসায়। নম্রতার কথায় নিশ্চিত হলো, এটা নওয়াজেরই বন্ধু।
চাঁদনী কিছু বলার আগে আকরামই কথা বলল “আসলে অনেকক্ষন পড়তে পড়তে বোর হচ্ছিলাম। তাই ছাদের ফ্রেশ এয়ারে সময় কাটানোর জন্য এসেছিলাম। এখানে এসে ওনার সাথে দেখা হলো। কে ইনি? আগে তো কখনও তোমাদের বাসায় দেখিনি।”
“আম্মুর রিলেটিভ।”
“ও। বেড়াতে এসেছে।”
“মেডিক্যাল অ্যাডমিশন দেবে এবার। তাই গ্রাম থেকে ঢাকা এসেছে।”
“ও, তারমানে তো তোমারও জুনিয়র। তাহলে তুমি করেই বলা যায়। সো, হোয়াট ইজ ইওর নেম?”
“চাঁদনী।” প্রচন্ড অনিচ্ছাসত্বেও জবাব দিল চাঁদনী।
“ওয়াও, নাইস নেম। তুমি দেখতেও তোমার নামের মতই সুন্দর। এনিওয়ে, পড়াশোনা কেমন…”।
আকরামকে কথা বলার মাঝপথেই থামিয়ে দিল নম্রতা, “একচ্যুয়ালি আম্মু ওকে ডাকছে এখনই। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। আপনি রিল্যাক্স করুন এখানে কিছুক্ষন। আমরা আসছি। কই চাঁদনী, জলদি এসো।”
“ওহ, সিওর।” আকরাম কিছুটা পাশে সরে চাঁদনীকে যাওয়ার জন্য জায়গা দিল। চাঁদনী আর এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না। ঝড়ের বেগে নম্রতার সাথে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ওরা চলে যাওয়ার পর আকরাম চোখ বন্ধ করে জোরে নিশ্বাস টেনে নিল নিজের ভেতরে। বাতাসে এখনও চমৎকার মেয়েলি একটা সুবাস পাওয়া যাচ্ছে। আজ আর অন্য কোনো মেয়ের সাথে ফোনালাপে মত্ত হতে পারল না ও। ছাদ থেকে আবার সোজা নওয়াজের রুমে চলে এলো। মিশকাত ওকে দেখে হেসে বলল, “এরমধ্যেই চলে এলি! খাওয়া দাওয়া শেষ এত জলদি?”
ফাহিম উচ্চশব্দে হেসে উঠল মিশকাতের কথা শুনে। আকরাম ও সমান হেসে উত্তর দিল, “আজ থেকে অন্য সব চ্যাপ্টার ক্লোজ। নতুন মিশন শুরু করলাম আজ থেকে। মিশন চাঁদনী।”
এতক্ষন ওদের কথায় সেভাবে মনযোগ না দিলেও চাঁদনীর নামটা শুনে চমকে গেল নওয়াজ।
মিশকাত জিজ্ঞাসা করল, “সেটা আবার কে?”
“কিছুক্ষন আগে ছাদে গিয়ে দেখা হলো। নওয়াজদের কোনো আত্মীয় হবে মনেহয়। একেবারে ন্যাচারাল বিউটি বুঝেছিস। কোনো আর্টিফিশিয়াল কারুকার্য নেই চেহারায়। এটাকে আমার লাগবেই লাগবে।”
“আর একবার মেয়েটাকে বাজে নজরে দেখলে তোর চোখদুটো আমি উপড়ে ফেলব।”
শান্ত অথচ কঠিন গলায় থ্রেট দিল নওয়াজ। এবং এটা যে শুধু কথার কথা না সেটাও বোঝা গেল ওর বলার ধরন দেখে। সবাই কিছুটা থমকে গেল।
আকরামেরও ভ্রু কুঁচকে এলো কিছুটা। স্বল্পপরিচিত দুঃসম্পর্কের আত্মীয়াকে নিয়ে এত পজেসিভ কেন নওয়াজ? এরকম একটা থ্রেট অনেকদিন আগেও একবার ওকে দিয়েছিল নওয়াজ। প্রথমদিকে যখন আকরাম এই বাড়িতে আসত, তখনকার কথা এসব। এবাড়িতে প্রথমবার যখন এসেছিল তখন নম্রতাকেও ভালো লেগে গিয়েছিল ওর। নওয়াজ ব্যপারটা বুঝতে পেরে ঠিক আজকের মতো করেই শাসিয়েছিল আকরামকে। সত্যি বলতে নওয়াজকে ওরা চারজনই কিছুটা ভয় পেয়ে চলে। রেগে গেলে ওর মাথা ঠিক থাকে না।
ফাহিম পরিবেশ হালকা করার জন্য বলল, “কুল ব্রো। জানিস তো আকরাম এমনই৷ তুই এত রিয়াক্ট করিস না৷ কোথাকার কোন মেয়ে, তার জন্য নিজেদের মধ্যে প্রব্লেম ক্রিয়েট করিস না।”
আবির কৌতূহল থেকেই জিজ্ঞাসা করল নওয়াজকে, “তুই এত হাইপার হয়ে গেলি কেন মেয়েটার কথা শুনে। আকরামের চোখে যেহেতু পড়েছে, তাহলে বলা যায় মেয়ে সত্যিই সুন্দর। অনেকদিন যাবত আছে তোদের বাসায়, তাহলে কি তুইও…?”
মাঝপথে কথা থামিয়ে দিলেও ইঙ্গিতটা ধরতে অসুবিধা হলো না কারও।
“মেয়েটা সুন্দর কিংবা অসুন্দর, এই সবকিছুর উর্ধ্বে হলো, মেয়েটা আমাদের বাড়ির গেস্ট এখন৷ ওর সাথে আন-এক্সপেক্টেড কিছু ঘটে গেলে তার জবাবদিহিতাও আমাদেরই করতে হবে৷ বিশেষ করে আমার মায়ের উপর আঙুল তুলবে ওর পরিবার। তাছাড়া চাঁদনী একেবারেই অন্যরকম। এখনকার আধুনিক মেয়েদের মতো নয় একদমই।”
কথাগুলো বলতে বলতে নওয়াজের স্বর কিছুটা কোমল হয়ে এলো। চাঁদনীর মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। শেষে আবার কঠোর হয়ে আসলো ওর কন্ঠস্বর, “তাই ওয়ার্নিং দিচ্ছি। এরপর থেকে চাঁদনীর দিকে আর চোখ তুলেও তাকাবি না।”
টুলুর মা সবার জন্য নাস্তা নিয়ে আসায় আপাতত আলাপ থেমে গেল৷ কিন্তু আকরামের মনের মধ্যে গেঁথে রইল চাঁদনী৷ নওয়াজের বোন বলেই নম্রতাকে ছেড়ে দিয়েছিল ও, কিন্তু চাঁদনীকে ছাড়া অসম্ভব।
নম্রতা চাঁদনীকে ডেকে ওর রুমে নিয়ে এলো। চাঁদনী আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ভিতরে ঢুকল। আজ দ্বিতীয়বার এই রুমে এলো ও৷ প্রথমকবার এই রুমে আসার অভিজ্ঞতা একেবারেই সুখকর ছিল না ওর জন্য৷
“বসো।”
নম্রতা বিছানার একপাশ ইশারাই দেখিয়ে বলল চাঁদনীকে। চাঁদনী বসতেই প্রশ্ন করল আবার,
“আমি ছাদে যাওয়ার আগে তোমাকে কি বলছিলেন আকরাম ভাই?”
“কিছুই না। যা বলার আপনার সামনেই বলেছেন।”
“বুঝলাম। তোমাকে আগেই বলে রাখি শোনো, ভাইয়ার অন্য ফ্রেন্ডগুলো যথেষ্ট ডিসেন্ট হলেও আকরাম ভাই একেবারে অন্যরকম। বিশেষ করে মেয়েদের ব্যাপারে৷ আমি কী মিন করতে চাইছি, বুঝতে পারছো তো?”
“জি।”
“গুড। এখন থেকে তাকে যথাসম্ভব এভয়েড করে চলবে। সে আসলে রুমের দরজা লক করে রাখবে প্রয়োজনে।”
“আচ্ছা আপু। মাগরিবের আজান দিয়েছে, নামাজ পড়তে হবে। আমি আসি এখন।”
“হুম।”
চাঁদনী দরজা পর্যন্ত যাওয়ার পরে নম্রতা আবার ডাকল ওকে। “চাঁদনী। আরেকটা কথা।”
“বলুন।”
“সেদিনের মিথিলা আর রিতিমার ব্যাপারটা নিয়ে আমি স্যরি৷ ওরা যে ওভাবে কথা বলবে, সেটা আমি বুঝতে পারিনি। তুমি কিছু মনে কোরো না।”
“ঠিকাছে।”
ছোট্ট জবাব দিয়ে চাঁদনী নিজের রুমে চলে এলো। এই প্রথমবার চাঁদনীর মনে হলো, নম্রতাকে ও ঠিক যতটা অহংকারী ভেবেছিল ততটা সে নয়৷ উপরের এই ইগোর খোলসের আড়ালে কোথাও একটা সুন্দর মনও আছে তার। মরিয়ম খাতুনের মেয়ে বলেই মনেহয় এই ভালোটুকু পেয়েছে সে।
১৬.
সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে বিরামহীন। এক্সাম হল থেকে বের হয়ে নওয়াজ অনুভব করল, এই মেঘলা দিনেও ভ্যাপসা গরমে ঘেমে উঠছে ও। এই ধরনের ওয়েদারে প্রচন্ড বিরক্ত লাগে ওর। বাসায় ফিরে আগে গোসলে ঢুকল নওয়াজ। গোসল সেরে বের হওয়ার সাথে সাথেই নম্রতা এসে ডেকে গেল দুপুরের খাবার খেতে। খাওয়া শুরু করার কিছুক্ষন পরে নওয়াজ খেয়াল করল অপজিটের ডানদিকের চেয়ারটা আজ খালি। সাথে সাথেই প্রশ্ন করল ও, “আম্মু, আজ চাঁদনীকে দেখছি না যে। ও খেয়েছে?”
“চাঁদনী তো নেই বাড়িতে।”
“নেই মানে? কোথায় গিয়েছে?”
“ওর ভাই এসেছিল সকালে। গতকাল চাঁদনীর উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট আউট হয়েছে। খুব ভালো রেজাল্ট করেছে ও। সেজন্যই সাখাওয়াত মানে ওর বড় ভাই মিষ্টি নিয়ে এসেছিল। চাঁদনীর কোচিং দিন দুয়েকের জন্য বন্ধ বলে ওকেও সাথে করে নিয়ে গেছে। পরশু আবার এসে পড়বে।”
“ও।”
নওয়াজ আর তেমন কিছু জিজ্ঞাসা করল না। চুপচাপ খেয়ে সোজা নিজের রুমে চলে গেল। খাওয়ার পরে অভ্যাসবশত পায়চারি করতে করতে নওয়াজ টের পেল, মনের ভেতর কোথাও একটা সূক্ষ্ম শূন্যতা তৈরি হয়েছে ওর। মনকে প্রভাবিত করার মতো তেমন কিছুই নয় এটা, কিন্তু একেবারে এড়িয়েও যাওয়া যায় না। নওয়াজ বোকা বা অবুঝ নয়৷ এই চিনচিনে অনুভূতিটির সূত্রপাত যে চাঁদনীর চলে যাওয়ার খবরটা শোনার পরেই হয়েছে, সেটা বুঝতে খুব একটা সমস্যা হলো না ওর। প্রথমে মনে হলো, নিজের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো মনেহয় নিজেই আজকাল বুঝতে পারছে না। নইলে চাঁদনীর চলে যাওয়ার খবর শুনে এমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেন?
কিছুক্ষন ভেবে নিজের মনোমতো যে ব্যাখ্যাটা তৈরি করল ও সেটা অনেকটা এমন, সেদিন গাড়িতে সরাসরিই চাঁদনীকে কিছু কথা বলা হয়েছিল। চাঁদনী যে সেই কথাগুলো খুব একটা সহজভাবে নিতে পারেনি সেটা ওর চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। ঠিক তখন থেকেই একটা অপরাধবোধ তৈরি হয়েছিল নওয়াজের মধ্যে৷ বাসায় ফিরেও অনুশোচনায় ভুগেছে ও। সেদিন চাঁদনীর সাথে ওভাবে বলাটা যে ভুল হয়েছে সেটাও উপলব্ধি করেছিল নওয়াজ। তারপর চাঁদনীর সাথে আগের মতো টুকটাক কথাবার্তা হলেও ওই টপিকটা আর তোলা হয়নি ইচ্ছে থাকা সত্বেও। কয়েকবারই নওয়াজ ওইদিনের কথাগুলোর জন্য স্যরি বলবে ভেবেছিল, কিন্তু কি বলে যে কথা শুরু করবে সেটাই বুঝতে পারছিল না ও। সেই কথা বলার চেষ্টা থেকেই বোধহয় আজকের শুন্যতাটার উৎপত্তি।
আপাতত চাঁদনীকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পরবর্তী এক্সামের প্রিপারেশন নিতে স্টাডি টেবিলে বসে গেল ও। কিন্তু চাইলেই কি সব এড়িয়ে যাওয়া যায়? বোধহয় না। সেজন্যই চাঁদনী নামের গ্রাম্য মেয়েটার অনুপস্থিতিতে তৈরি হওয়া শূন্যতার ঘুনপোকা কুটকুট করে চলল ওর মস্তিষ্কে।
১৭.
অনেকদিন পর আজ চাঁদনীর ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। প্রায় তিন মাস আগে এই বাড়ি ছেড়ে ও ঢাকা গিয়েছিল। অথচ আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে ওর মনে হলো, নিজের গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার পর একযুগ পার হয়ে গেছে। যান্ত্রিক শহরের দূষিত ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে আসত ওর, যানবাহন চলাচলের বিকট শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম হতো। আজ তাই ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায় করেই বারান্দায় গেল।
চাঁদনী বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুকভরে বিশুদ্ধ বাতাস টেনে নিল নিজের মধ্যে। তারপরে তাকাল সামনের ফুলের বাগানের দিকে। নানা রকম ফুল ফুটে আছে সেখানে। চাঁদনীর অবর্তমানেও গাছগুলোর যত্নের এতটুকু কমতি হয়নি।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
নিভৃত রজনী
| ১০ | (১৮০০+ শব্দ)
চাঁদনী বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুকভরে বিশুদ্ধ বাতাস টেনে নিল নিজের মধ্যে। তারপরে তাকাল সামনের ফুলের বাগানের দিকে। নানা রকম ফুল ফুটে আছে সেখানে। চাঁদনীর অবর্তমানেও গাছগুলোর যত্নের এতটুকু কমতি হয়নি।
কিছুক্ষন বারান্দায় সময় কাটিয়ে নিচে নেমে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল চাঁদনী। রান্নাঘরে সকালের নাস্তা তৈরির তোড়জোড় চলছে। চাঁদনীকে দেখে সাখাওয়াতের স্ত্রী নায়লা বলল, “উঠে গেছ! ক্ষিধে পেয়েছে নিশ্চই? টেবিলে গিয়ে বসো, আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
“না, ক্ষিধে পায়নি। সবাই আসুক, একসাথে খাব।”
“আচ্ছা।”
নায়লা আবার ভাজির কড়াইয়ে ব্যস্ত হাতে খুন্তি নাড়তে শুরু করল। চাঁদনী জিজ্ঞাসা করল, “ভাইজান কোথায়?”
“উত্তরপাড়া গেল নামাজ পড়ে। সেদিকের জমির ইজারা নিয়ে কী একটা যেন গন্ডগোল হয়েছে। সেটারই মিমাংসা করতে গেছে।”
“ও।”
অল্প সময়ের মধ্যেই খাবার ঘর লোকজনে ভর্তি হয়ে গেল। সকালের নাস্তা করতে করতে টুকটাক আলাপে মেতে উঠল সবাই। চাঁদনীও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করল তাতে। শহরের ওই ডুপ্লেক্স বাড়িটার ডাইনিং রুমের স্বচ্ছ কাঁচের টেবিলে রোবটের মতো বসে খাওয়ার সময় এই উৎসব মুখরিত পরিবেশটির শূন্যতা খুব করে অনুধাবন করেছে চাঁদনী।
বাবা, চাচা আর ভাইয়েরা সবাই চাঁদনীকে এটা সেটা প্রশ্ন করল। পড়াশোনা কেমন চলছে, ওবাড়িতে থাকতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাকি এসব। চাঁদনী জানাল, সব ঠিকঠাকই চলছে। নাস্তা শেষে চাঁদনী আবার নিজের রুমে চলে এলো। সাথে করে কিছু বই নিয়ে এসেছিল। সেগুলোই উলটেপালটে দেখতে থাকল। কিছুক্ষন পরেই পিঠা নিয়ে এলেন চাঁদনীর মা রেবেকা বেগম। চাঁদনী অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “পিঠা কখন বানালে, মা?”
“সকালেই বানিয়েছি। আমার হাতের পাটিসাপটা তো তুই খুব পছন্দ করিস।”
“তোমার শরীর তো ইদানিং এমনিতেই ভালো যাচ্ছে না। এত কষ্ট করার কী দরকার ছিল এখন?”
“এটা আর এমন কী কষ্ট! নায়লা আর তোর ছোটআম্মু তো রান্নাঘরে তেমন যেতেই দেয় না আমাকে। নিজেরাই সব সামলে নেয়। এতটুকু করতে তেমন পরিশ্রম হয়নি। আর তাছাড়া এতদিন পর বাড়ি এসেছিস। দুদিন পর তো আবার চলে যাবি। কতদিনে আবার আসতে পারবি না, কে জানে। নিজের হাতে কিছু তৈরি করে আমারও তো খাওয়াতে ইচ্ছে করে। কতগুলো দিন বাইরে। কী খাস না খাস কে জানে।”
চাঁদনী একটা পাটিসাপটা তুলে খেতে খেতে বলল,
“বাইরে কোথায়! ওখানেও একটা বাড়িতেই আমি থাকি মা। তছাড়া মরিয়ম আন্টি খুব ভালো একজন মানুষ। যথেষ্ট যত্ন করে আমার। অনেকটা তোমার মতোই। ক্ষিধে লাগার আগেই খাবার পৌঁছে যায় আমার রুমে। মাঝে মাঝে তো আমি নিজেই নিষেধ করি খাবার দিতে। তখন ঠিক তোমার মতই জোর করেন তিনি। বোঝাতে থাকেন, পড়াশোনায় মনযোগ ধরে রাখতে গেলে খেতে হবে বেশি করে। খালি পেটে থাকা যাবে না একদম। মানুষটা এত আন্তরিক, বলে বোঝানো যাবে না।”
“সেটা তোর বলতে হবে না, আমি জানি। আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসত। খুব মিষ্টি একটা মেয়ে ছিল। তোর বাবাকে খুব সুন্দর করে ভাইজান বলে ডাকত, তুই এখন যেমনভাবে সাখাওয়াত কে ডাকিস, অনেকটা সেরকম। আমাকে সারাক্ষন ভাবি ভাবি বলে ডেকে অস্থির করে ফেলত। এটা সেটা আবদার করত। আমার হাতে বানানো আম কিংবা চালতার আচার খুব পছন্দ করত। ছাদের উপরে রোদে দেওয়া আচারের বৈয়ম খুলে পা দুলিয়ে দুলিয়ে আচার খেত। আমাদের পরিবারের সাথে একসময় মরিয়মদের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ওর উপরে ভরসা করেই তো তোর বাবা ওবাড়িতে পাঠিয়েছে তোকে।”
রেবেকা বেগম অতীতের কিছু স্মৃতিচারণ করে চলে গেলেন। তিনি চলে যাওয়ার ঘন্টাখানেক পরে এলো নায়লা। তার হাতে বাটিভর্তি চালতা মাখানো। শিলপাটায় ছেচে শুকনো মরিচ, লেবুপাতা, লবন আর চিনি দিয়ে মাখানো হয়েছে। চাঁদনী প্রায় হামলে পড়ল বাটির উপর। খেতে খেতে বলল, “তোমরা তো দেখি প্রচুর আয়োজন করে রেখেছ আমার জন্য।”
“গতকাল সকালেই তোমার ভাই ফোন করে জানিয়েছিল, তোমাকে নিয়ে ফিরছে, তখনই পাশের বাড়ির রফিককে দিয়ে আনিয়ে রেখেছিলাম। আমি তো জানি, ম্যাডাম চালতা বলতে অজ্ঞান।”
চাঁদনী হাসল, “অনেক ধন্যবাদ ভাবি।”
“হয়েছে, আর ফর্মালিটি করতে হবে না।”
“ওকে। করলাম না ফর্মালিটি।”
দুজনেই হাসল ওরা। তখনই দরজার পাশ থেকে ছোট্ট একটা মুখ উঁকি দিল, “এক্সকিউজ মি। আমি কি একটু রুমে আসতে পারি?”
চাঁদনী হেসে দিল কথা শুনে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সাখাওয়াত আর নায়লার একমাত্র ছেলে নাভিদ। মাত্র পাঁচ বছর বয়স নাভিদের কিন্তু কথাবার্তা বলার ধরন একেবারেই বড়দের মতো। চাঁদনী হেসে বলল, “আরে আব্বা, আসো এদিকে। রুমে আসতে অনুমতি নিতে হবে না।”
“কিন্তু অনুমতি না নিলে সবাই আমাকে অভদ্র ভাববে।”
এই অনুমতি নেওয়ার ব্যাপারটা কিছুদিন আগে ওকে শিখিয়েছে তানিম। হুট করে কারও রুমে ঢুকে যাওয়াটা অভদ্রতা। তাই ঢোকার আগে অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে। তাই এখন বাড়ির সবার রুমে ঢুকতে গেলেই সে অনুমতি নেয়।
চাঁদনী আবারও হাসল।
“অন্য সবার হিসাব আলাদা। আমার রুমে আসতে তোমার কখনও অনুমতি নিতে হবে না। এখন আমার কাছে আসো তো। তোমাকে একটু আদর করে দেই। খুব মিস করেছি আমার বাবাটাকে এতদিন।”
“আমিও খুব মিস করেছি তোমাকে। তোমাকে ছাড়া আমার একদমই ভালো লাগে না। আম্মু তোমার মতো ভালোবাসে না আমাকে। গল্প করে ভাতও খাইয়ে দেয় না৷ সারাক্ষন শুধু বকাঝকা করে।”
“ভেরি ব্যাড। যাওয়ার আগে আমি আম্মুকে বকে দিয়ে যাব। কিন্তু আম্মু বকাঝকা করে কেন? তুমি কি খুব বেশি দুষ্টুমি করো?”
“একদমই না। এখন আর আমি কোনো দুষ্টুমি করি না। তোমার বাগানের ফুল ছিঁড়ি না, এমনকি একা একা পুকুর পাড়েও যাই না। আমি এখন গুড বয়। সবার সাথে ভালো ব্যবহার করি।”
“হঠাৎ এত ভালো ব্যাবহারের কারনটা কী শুনি!”
“কারন এখন আমি জানি, সবসময় ভালো হয়ে থাকলেই আমি গুড বয় হতে পারব। তাছাড়া আমার স্কুলের টিচার বলেছে, ব্যবহারেই বংশের পরিচয়।”
নায়লা আর চাঁদনী দুজনেই উচ্চস্বরে হাসল নাভিদের কথা শুনে।
১৮.
তানিম আজ সারাদিনই ব্যস্ত ছিল। আম পাকার এই সময়টাতে স্বাভাবিকভাবেই ব্যস্ততা থাকে। কাজ করে দেওয়ার জন্য কয়েকজন লোকজন রাখা থাকলেও, গাছ থেকে আম পাড়া থেকে শুরু করে সেগুলো প্যাকেট করে ডেলিভারি দেওয়া পর্যন্ত সবকিছুর তদারকিই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে করতে হয়। সব কাজ শেষ করে ফ্রি হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল।
মাগরিবের নামাজ আদায় করে তানিম রেডি হয়ে নিল গঞ্জে যাওয়ার জন্য। চাঁদনী এসে দরজায় নক করল তখন, “ভাইয়া কি বাজারে যাচ্ছ?”
“হ্যাঁ। কেন? কিছু লাগবে? খেতে ইচ্ছে করছে কিছু?”
“না, খাবো না কিছু।”
“কেন?”
সারাদিন ধরে সবাই খালি খাইয়েছে। এখন আর পেটে জায়গা নেই একদম৷ আমি এসেছিলাম মোবাইলটা দিতে। আজ সকাল থেকেই লোডশেডিং। মোবাইলে চার্জ নেই একদমই৷ তুমি কি একটু বাজার থেকে চার্জ দিয়ে আনতে পারবে?”
“আচ্ছা, দিয়ে আনব। আর কিছু বলবি?”
“না। আমি আসছি।”
“শোন।”
“বলো।”
“না, থাক। তুই যা।”
প্রশ্ন করতে চেয়েও নিজেকে সামলে নিল তানিম। ওই অহংকারী বদমেজাজি মেয়েটার কথা মনেও করতে চায় না ও আর।
চাঁদনী সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “কিছু একটা বলতে চেয়েও বলছ না। ব্যাপারটা কী, বলো তো?”
“ওবাড়ির কেউ কোনো বাজে ব্যবহার করে না তো তোর সাথে?”
“আশ্চর্য! বাজে ব্যবহার কেন করবে? মরিয়ম আন্টি তো খুব ভালোবাসেন আমাকে।”
“জানি। অন্যদের কথা বলছি। মানে, ওই মেয়েটা তোর সাথে ভালো আচরণ করে তো?”
চাঁদনী বুঝেও না বোঝার ভান করল, “কোন মেয়েটা?”
“মরিয়ম আন্টির মেয়ের কথা বলছি।”
“ও, নম্রতা আপু। সে কেন খারাপ ব্যবহার করবে?”
“না মানে, চালচলন দেখে সেরকমটাই মনে হলো।”
“তানিম ভাই, তুমি তাকে একদিন শুধু কিছু সময়ের জন্য দেখেছ। এত জলদি একটা মানুষকে জাজ করে ফেলা একেবারেই ঠিক নয়। আমি কিন্তু নেগেটিভ কিছু পাইনি তার মধ্যে। হ্যা, কিছুটা মুডি টাইপের। তবে বাইরের দিক থেকে কিছুটা কঠিন হলেও মনের দিক থেকে ভালোই। তোমার মনেহয় তাকে বুঝতে ভুল হচ্ছে কোথাও।”
“হয়তো হচ্ছে ভুল। তবুও, কখনও যদি ওখানে কেউ তোর সাথে কোনো বাজে আচরণ করে তাহলে সাথে সাথে আমাকে জানাবি।”
“আচ্ছা, জানাব।”
তানিম বাজারে গিয়েই আগে চাঁদনীর আর নিজের ফোন চার্জে লাগাল একটা দোকানে। প্রায় ঘন্টাখানেক নিজের কাজ সেরে গেল ফোন আনতে। চাঁদনীর মোবাইল হাতে নেওয়ার সাথে সাথেই কলটা এলো। স্ক্রিনে নাম সেভ করাই আছে। মরিয়ম আন্টি। তানিম ইচ্ছে করেই ফোনটা রিসিভ করল না। কিন্তু একের পর এক কল বেজেই যাচ্ছে। তিনবারের সময় কিছুটা বাধ্য হয়েই ফোনটা রিসিভ করল ও।
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে?”
“জি, আমি তানিম। চাঁদনীর ফোনটা আসলে আমার সাথে এখন। বাজারে নিয়ে এসেছি চার্জ দেওয়ার জন্য। বাড়ি গিয়ে চাঁদনীকে বলে দেব যে আপনি ফোন করেছিলেন।”
“চাঁদনীর সাথে আমি পড়ে কথা বলে নেব। এখন তোমার সাথে কথা বলে নেই কিছুক্ষন। আপত্তি আছে কথা বলতে?”
“না না। কি বলছেন? আপত্তি থাকবে কেন?”
“থাকতেও তো পারে। সেই যে একবার এলে আমাদের বাসায় তারপর আর কোনো খোঁজ নেই। সাখাওয়াত, সাদমান, তামজীদ ওরা সবাই আসে আমার বাসায় চাঁদনীর সাথে দেখা করতে। একমাত্র তুমিই আসো না। শুনেছি কোচিং থেকে চাঁদনীর সাথে দেখা করে আবার চলে যাও। এখানে কেন আসতে চাও না বলোতো? এখনও কি আমাদের আপন ভাবতে পারনি?”
“আন্টি প্লিজ, এভাবে বলবেন না। আলাদা করে আপন কেন ভাবতে হবে, আপনি তো আমাদের আপনজনই। আসলে খুব অল্প সময়ের জন্য যাই তো ঢাকাতে। তাই আর বাসায় যাওয়া হয় না।”
“কোনো অযুহাত শুনবো না আর। এরপর ঢাকায় এলে আমার বাসায় আসতেই হবে কিন্তু।”
“চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ। ”
“তোমরা আসলে আমার খুব ভালো লাগে। আমার আব্বা ছিলেন তোমাদের পাশের গ্রামেরই একজন স্কুলমাস্টার। আব্বা অর্থিক দিক থেকে একেবারেই অসচ্ছল ছিলেন। বলা যায় গ্রামের সবচেয়ে গরিব দশটি পরিবারের মধ্যে আমরাও ছিলাম। অন্যদিকে চাচাজান মানে তোমার দাদা ছিলেন আশেপাশের চার পাঁচটা গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী। এত উচ্চবিত্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজে সেধে এসে বন্ধুত্ব করেছিলেন আব্বার সাথে৷ খুব ভালোবাসতেন তিনি আমাকে। একেবারে নিজের মেয়ের মতো করে।
আমার আর কোনো ভাইবোন নেই। মা মারা গিয়েছিল ছোটোবেলাতেই। বাবা আর আমি ছোট্ট একটা কাঠের ঘরে থাকতাম। সম্বল বলতে আমাদের ওইটুকুই ছিল।
চাচাজান বলতেন, আমি মরে গেলেও তালুকদার বাড়ির কথা ভুলে যেও না, মা। মনে রাখবা তালুকদার মঞ্জিলে তোমার দুইটা ভাই আছে।
তোমার বাবা আর চাচাও তোমার দাদার যোগ্য উত্তরসূরী। তার মতই উদার মনের মানুষ। তোমার দাদার মৃত্যুর পরেও আমাকে আগের মতোই সমাদর করেছেন তারা। নিজের বোনের চেয়ে কম কিছু ভাবেনি কখনও।
তোমার দাদা মারা গেলেন৷ তার কয়েকবছর পরে হুট করেই আমার বিয়ে হয়ে গেল। তার কিছুদিন পরে আব্বাও মারা গেলেন। আব্বা মারা যাওয়ার পর গ্রামে যাওয়া একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। এখন মনেহয় ভিটেটুকুও অন্যের দখলে চলে গেছে।
তবুও মাঝে মাঝে তোমার দাদাজানের কথা কানে বাজে। তালুকদার বাড়িতে আমার দুটো ভাই আছে। অনেকগুলো বছর তোমাদের সাথে যোগাযোগ ছিল না। এখন যেহেতু আবার যোগাযোগ শুরু হয়েছে,এটা আর আমি নষ্ট করতে চাই না। আমার বাপের বাড়ির দিকের কোনো আত্বীয়স্বজন নেই বললেই চলে। অনেকগুলো বছর যোগাযোগ ছিল না ঠিকই, কিন্তু নিজের আত্মীয়স্বজনের কথা উঠলে সবার আগে তাই তালুকদার মঞ্জিলের কথাই মনে পড়ত৷
তাই তোমরা যদি মাঝেমধ্যে আসো। আমার খুব ভালো লাগবে।
কিছু মনে কোরো না। অনেক কথা বলে ফেললাম। তুমি বিরক্ত হচ্ছ নাতো?”
তানিম মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল মরিয়ম খাতুনের বলা কথাগুলো। তার করা শেষ প্রশ্নটির জবাবে তানিম বলল, “একদমই বিরক্ত হচ্ছি না। বরং আপনার মুখে কথাগুলো শুনতে খুব ভালো লাগছে। এবার চাঁদনীর সাথে আপনি আসলেন না কেন? বাবা আর বড়আব্বু আপনাকে দেখলে খুব খুশি হতো।”
“তোমার বাবা আর চাচাও অনেকবার করে যেতে বলেছেন। যাব ইনশাআল্লাহ। তুমি কিন্তু এরপরেরবার আমাদের এখানে আসবেই। ”
“যাবো ইনশাআল্লাহ।”
মরিয়ম খাতুন ফোন কেটে দিলেন। রাতের নিস্তব্ধ রাস্তায় টর্চ জ্বেলে হাঁটতে হাঁটতে তানিম ভাবনায় ডুবে গেল। এত চমৎকার মনের একজন মানুষ। এত আন্তরিক কথাবার্তা যার। তার মেয়েটি এত উগ্র আর বদমেজাজি হলো কী করে। চাঁদনী বলছিল, বাহ্যিকভাবে কিছুটা বদমেজাজি হলেও মনের দিক থেকে ভালো। আসলেই কি তাই। হঠাৎ করেই সেই প্রথমদিনের প্রথম দেখার কথা মনে পড়ে গেল ওর। সাথে সাথেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো৷ সেদিন মেয়েটির উচ্চারণ করা প্রত্যেকটি শব্দ এখনো ওর মাথায় গেঁথে আছে। চাইলেও যেগুলো ভোলা যাবে না খুব সহজে। সেদিন নম্রতার বলা সেই কথাগুলো মনে করতে করতে তানিম বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল।
১৯.
নম্রতার মাথাধরাটা ইদানিং বেড়েই চলেছে। সন্ধার পরে পড়তে বসে কিছুতেই বইয়ের পাতায় মনোযোগ দিতে পারল না ও। চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে মেডিসিন বক্স হাতে নিল পেইনকিলার খাওয়ার জন্য। হঠাৎ করে মনে পড়ল, ওর বক্সে পেইনকিলার নেই। কয়েকদিন আগেই ফুরিয়ে গেছে এবং সেটা রিস্টক করা হয়নি। অগত্যা নম্রতা মেডিসিনের খোঁজে মায়ের রুমের দিকে গেল। তার কাছে ওষুধটা পাওয়া গেলেও যেতে পারে।
মরিয়ম খাতুনের রুমের সামনে গিয়েই নম্রতা টের পেল মা ফোনে কথা বলছে। কথা শুনেই ও কিছুটা আন্দাজ করতে পারল যে কার সাথে কথা হচ্ছে মায়ের। মরিয়ম খাতুন একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে।
নম্রতা কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় বসে রইল খাটের এককোনে। কান পেতে ওপাশের কন্ঠস্বর শোনার চেষ্টাও বোধহয় করছিল একটু-আধটু।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)