নিভৃত রজনী
| ৬ | (১২৬০+ শব্দ)
নম্রতার কাটাকাটা কথায় অপমানে রিতিমার মুখ থমথমে হয়ে উঠল। হঠাৎই সবার মধ্যে নিস্তব্ধতা নেমে এলো যেন। শুধু নিকিতা চামচ দিয়ে ফ্রাইড রাইস নাড়তে নাড়তে মুচকি হাসল।
১১.
জুনের প্রায় শেষের দিক চলছে এখন। দেখতে দেখতে চাঁদনীর ঢাকায় আসার একমাস পেরিয়ে গেছে। আজকাল সময় খুব একটা খারাপ কাটছে না ওর। বেশিরভাগ সময় তো পড়াশোনার পিছনেই চলে যায়। বাকী সময়টুকুতে মরিয়ম খাতুনের সাথে গল্প করে অথবা ব্যালকনিতে লাগানো ফুলগাছগুলোর যত্ন করে কাটিয়ে দেয় চাঁদনী।
তাছাড়া ভাইদের সাথেও দেখা হচ্ছে নিয়মিত। শুধু তুরাগ বাদে বাকি চারজন অর্থাৎ সাখাওয়াত, তামজীদ, সাদমান এবং তানিম একের পর এক পালাবদল করে দেখা করতে আসে কয়েকদিন পরপরই। সাখাওয়াত, তামজীদ আর সাদমান মরিয়ম আন্টির বাসাতে এলেও তানিম সেই প্রথমদিনের পর থেকে আর একবারের জন্যেও মরিয়ম আন্টিদের বাসায় আসেনি। গ্রাম থেকে এসে হোটেলেই ওঠে সে। চাঁদনীর কোচিং-এর পর ওর সাথে দেখা করে আবার চলে যায়।
চাঁদনী অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছে, কেন সে বাসায় যায় না। প্রত্যেকবারই সেই প্রশ্ন এড়িয়ে গেছে তানিম। সেদিন নম্রতার রুমের কথা কেন জানতে চেয়েছিল, সেটাও জিজ্ঞাসা করেছে চাঁদনী। তানিম উত্তর দিয়েছে, ওর সাথে ধাক্কা লেগে নাকি নম্রতার হাতের ফোনটা পরে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। সেজন্যই ক্ষতিপূরণ হিসেবে একটা ফোন কিনে সেটা দিতে গিয়েছিল নম্রতার রুমে।
তানিম শুধু এতটুকু বললেও চাঁদনীর মনের সংশয় যায়নি। ওর ধারনা আরও বেশি কিছু হয়েছে ওদের মধ্যে, হয়তো কথা কাটাকাটি অথবা নম্রতা হয়তো কোনো অপমানজনক কথা বলেছে। এতদিনে নম্রতার আচার আচরণে ওর সম্পর্কে ভালোই একটা ধারনা হয়ে গেছে চাঁদনীর। তাই চাঁদনীর দৃঢ় বিশ্বাস, ওর তানিম ভাইয়ের এবাড়িতে না আসার পিছনে নম্রতারই হাত রয়েছে।
চাঁদনীর সখ্যতা মরিয়ম খাতুনের সাথে থাকলেও পরিবারের বাকি তিনজন সদস্যকে ও খুব যত্ন করে এড়িয়ে যায়। বিশেষ করে নওয়াজ এবং নম্রতাকে।
নম্রতার খোঁচা দিয়ে কথা বলার একটা অভ্যাস আছে বোধহয়। মাঝে মাঝে ওর সাথে যতটুকু কথা বলে পুরোটাতেই যেন তাচ্ছিল্য মিশে থাকে। সত্যি কথা বলতে চাঁদনীর সাথে আগে কখনোই কেউ এভাবে কথা বলেনি।
নওয়াজ অবশ্য কখনও খোঁচা দেয় না। তবে তার চোখের দৃষ্টিই অন্যরকম। মনে হয় যেন একেবারে অন্তর্ভেদী।
লোকটার সাথে প্রথম দেখাতেই কিছু একটা ফিল করেছিল চাঁদনী, সেটা অস্বীকার করতে পারবে না। সুন্দর যেকোনো কিছুর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে সেদিন প্রথম দেখার পর নিজের রুমে এসেই নিজের অনুভূতির লাগাম টেনেছিল ও। নিজেকে বুঝিয়েছিল, ও এখানে এসেছে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। একমাত্র সেটার দিকেই ফোকাস করতে হবে ওকে। অন্য কোনো দিকে নিজেকে ইনভলভ করলে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।
তাছাড়া পুরো ব্যাপারটাই হারাম। এভাবেই তো শয়তান ওয়াসওয়াসা দেয়, কুমন্ত্রনার ফাঁদ তৈরি করে মানুষের জন্য। চাঁদনীর কানে বাজতে থাকে বাবার বলা কথা। ‘হারাম কখনও মানুষের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। হারাম সাময়িক শান্তি দিলেও তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল হয় ভয়াবহ।’
নিজের মনকে বোঝানোর সবরকম চেষ্টাই করে চাঁদনী। তবু মনের মধ্যে কোথাও বিন্দু পরিমাণ হলেও অনুভূতি থেকে যায় নওয়াজের প্রতি। কিন্তু বাইরের দিক থেকে চাঁদনী একেবারেই স্বাভাবিক।
মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যায় তার সাথে। নাস্তার টেবিলে, লাঞ্চ টাইমে কিংবা শেষ বিকেলে মরিয়ম আন্টির সাথে ছাদে হাঁটাহাঁটি করার সময়। নওয়াজ মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করে, “কী খবর চাঁদনী? পড়াশোনা কেমন চলছে?”
চাঁদনী স্বাভাবিক গলায় ছোট্ট করে উত্তর দেয়, “জি, ভাইয়া। ভালো।”
“শুধু কি মেডিকেলেই দিতে চাচ্ছ? পাবলিকে ট্রাই করবে না?”
“না।”
“যদি মেডিক্যালে চান্স না হয়?”
“প্রাইভেটে ভর্তি হবো।”
“তারমানে ডাক্তারিই পড়তে চাইছ। ভালো। এক্সাম হবে কবে, জানতে পেরেছ কিছু?”
“এখনও নয় তবে শুনেছি অক্টোবরে হতে পারে।”
পুরো কথপোকথনে স্বাভাবিক থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করে চাঁদনী। তবুও কেমন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হয় ওর। চাঁদনী দিন গুনতে থাকে, এইতো আর কিছুদিন। একবার এক্সামটা হয়ে গেলেই বাড়ি চলে যাওয়া যাবে।
১২.
নওয়াজ আজকাল প্রচন্ড ব্যস্ত থাকে। ব্যস্ততাটা অবশ্যই পড়াশোনা নিয়ে। প্রায়ই রাতজাগা হচ্ছে আজকাল। তাই আজ দুপুরে খাওয়ার পরেই ভাতঘুম দিয়েছিল। দীর্ঘ সেই ঘুম ভাঙল সন্ধারও পরে। ঘুম থেকে উঠে নিচে নামল ও। কিচেনের দিক থেকে শব্দ পেয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল টুলুর মায়ের খোঁজে, তবে আজ আর আগেরবারের মতো ভুল করল না। আগেই কিচেনের ভেতরে উঁকি দিয়ে কনফার্ম হয়ে নিল এটা সত্যিই টুলুর মা কিনা। টুলুর মা নওয়াজকে দেখে বলল, “ভাইজান আপনি? কিছু লাগবে?”
“আজ এখনও চা দাওনি কেন?”
“নিয়ে তো একবার গিয়েছিলাম আপনার রুমের সামনে। অনেকবার নক করে আপনার সাড়া না পেয়ে আবার চলে এসেছি।”
“ওকে। এখন আবার গিয়ে আমার রুমে রেখে এসো ফ্লাস্কটা।”
“আচ্ছা।”
কিচেন থেকে মায়ের রুমের দিকে গেল নওয়াজ। অনেকদিন যাবত মায়ের সাথে সেভাবে কথা হচ্ছে না। মায়ের রুমে ঢুকতে গিয়েও পা থেমে গেল ওর। ভিতরে চাঁদনী নামের মেয়েটি বসে আছে। দুজনেই হাসছে আর গল্প করছে। চাঁদনীর মুখে কথার ফুলঝুরি ছুটেছে। হাত নাড়িয়ে কথা বলে যাচ্ছে সে। এতটা স্বতঃস্ফূর্ত আগে কখনোই চাঁদনীকে দেখেনি নওয়াজ। কেমন একটা গুটিয়ে রাখে নিজেকে সবসময়। নওয়াজ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে চুপচাপ সরে গেল।
নওয়াজ রুমে এসেও চাঁদনীকে সরাতে পারল না মস্তিষ্ক থেকে। সেই প্রথম দিন দেখেই ও বুঝে গিয়েছিল যে মেয়েটার ওর প্রতি একটা মুগ্ধতা কাজ করছে।
সেদিন রাতে প্রচন্ড রাগ আর বিরক্তি নিয়ে বারবার কলিংবেল চেপেই যাচ্ছিল ও। অনেকক্ষন পার হয়ে যাওয়ার পর যখন দরজা খোলার আওয়াজ পেয়েছিল, তখন ভেবেছিল ঘরে ঢুকে একটা লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে দেবে। কিন্তু দরজার ওপাশে হঠাৎ অপরিচিত মুখ দেখে থতমত খেয়ে গিয়েছিল ও। মেয়েটা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে৷ কেন জানি ও নিজেও ওই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিল বেশ খানিকটা সময়। সেই সময়েই নওয়াজ মেয়েটির চোখে ওর প্রতি মুগ্ধতা আবিষ্কার করেছিল।
তারপর যখন ও পরিচয় জিজ্ঞাসা করল, তার জবাব না দিয়েই একপ্রকার দৌড়ে পালাল মেয়েটা। কিন্তু শুধু ওই একদিনই অস্বভাবিক আচরণ করেছিল চাঁদনী। তারপর থেকে সে একেবারেই স্বাভাবিক। বোঝা যায় নিজের অনুভূতি সামলাতে সে যথেষ্টই দক্ষ।
এটাই অবশ্য ভালো হয়েছে। মেয়েটি যদি হ্যাংলার মতো বার বার ওর সামনে আসত সেটা সত্যিই খুব বিরক্তির কারণ হয়ে যেত নওয়াজের জন্য। যত যাই হোক, এরকম একটি মেয়ের সাথে তো আর রিলেশনে যাওয়া যায় না।
না, চাঁদনী মেয়েটি অসুন্দর নয়। ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ, টিকালো নাক, পাতলা দুটি ঠোঁট, থুতনি কিছুটা খাঁজকাটা। মেয়েটি নিজেকে আপাদমস্তক প্যাকেট করে রাখলেও সৌন্দর্য লুকাতে পারেনি একবিন্দুও। চাঁদনীর মুখের সবটাই নিঁখুতভাবে দেখেছে নওয়াজ। তবে শুধু চুলটাই দেখতে পারেনি। সবসময় এমনভাবে ওড়না পেঁচিয়ে রাখে যে কপালের পাশের ছোট কিছু চুল বাদে আর কিছুই দেখা যায় না।
কিছুটা সাজগোজ করে যদি এই মেয়ে বাইরে বের হয় তাহলে শ’খানেক ছেলের লাইন লেগে যাবে নিশ্চিত। কিন্তু তবুও কেন জানি মেয়েটাকে একেবারেই পারফেক্ট মনে হয় না নিজের জন্য৷ নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে ও সবসময় অন্য ধরনের একটি মেয়েকে ভেবে রেখেছে। যে ঘরে বাইরে সমানভাবে তাল মিলিয়ে চলবে। আধুনিক মানসিকতার হবে। নওয়াজ নিজের ভাবনায় নিজেই হঠাৎ থমকে গেল। আশ্চর্য! মেয়েটিকে নিয়ে এতই বা ভাবছে কেন ও? একেবারে বিয়ে অব্দি চলে গেল? প্রথম দেখায় ওর প্রতি মেয়েটির একটা অ্যাট্রাকশন তৈরি হয়েছে, এবং মেয়েটি সেটা খুব ভালোভাবেই সামলে নিয়েছে। তাহলে ও কেন অযথা মেয়েটিকে নিয়ে ভাবছে। আপাতত সব চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে নওয়াজ বইয়ের পাতায় মন দিল।
১৩.
নম্রতার আজ সকাল থেকে কিছুটা মাথাব্যাথা ছিল। সেজন্য আজ ভার্সিটিতে যাওয়া হয়নি। সারাদিন রুমের মধ্যেই কাটল ওর।
সারাদিনে খোঁজ না পেয়ে নিকিতা, রিতিমা আর মিথিলা এসে হাজির হলো সন্ধ্যাবেলাতে। ওরা মাঝেমধ্যেই এরকম বিনা নোটিশে এসে হাজির হয় আড্ডা দেওয়ার জন্য। নম্রতা ওদের বসিয়ে রেখে টুলুর মাকে গিয়ে নাস্তা দেওয়ার জন্য বলে এলো। রুমে এসে দেখল নিকিতা বুকশেলফ থেকে একটা বই নিয়ে পড়তে শুরু করে দিয়েছে, রিতিমা আর মিথিলা কী একটা বিষয় নিয়ে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
হুট করে মিথিলা নিকিতার হাত থেকে বইটা নিয়ে নিল, “এখানে তুই বিদ্যাসাগর হতে আসিস নাই বইন, এখন কোনো বইটই চলবে না। এখন শুধু আমরা আড্ডা দেব।”
নিকিতা হেসে বলল, “আচ্ছা, ধরব না বই।”
মিথিলা উঠে দাঁড়াল বইটা বুকশেলফে রেখে আসতে। বই রেখে ফিরে আসতে গিয়েই চোখে পড়ল ব্রাউন কালারের ব্যগটা৷ ব্যাগ থেকে মোবাইলের বক্সটা বের করে চিঠিটা পড়তে পড়তে নম্রতার পাশে এসে বসল ও।
“হ্যারে নম্র, এই তানিমটা কে? এরকম জ্বালাময়ী চিঠি লিখেছে তোকে।”
নম্রতা হঠাৎ করে নামটা শুনে চমকে উঠল। তারপর মিথিলার হাতের দিকে তাকিয়ে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারল। গতকাল ও নিজেই আলমারি থেকে ব্যাগটা বের করে কিছুক্ষন ভিতরের জিনিসপত্র নেড়েচেড়ে দেখে বুকশেলফের একটা তাকে রেখেছিল। সময়ের সাথে সাথে যেন তানিমের প্রতি রাগটা না কমে যায় সেজন্যই এই কাজটা করে নম্রতা।
মিথিলা চিঠিটা হাতে নিয়ে উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে নম্রতার দিকে। অগত্যা বাধ্য হয়েই ওদের সবটা খুলে বলতে হলো নম্রতার।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
নিভৃত রজনী
| ৭ | (১৬০০+ শব্দ)
মিথিলা চিঠিটা হাতে নিয়ে উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে নম্রতার দিকে। অগত্যা বাধ্য হয়েই ওদের সবটা খুলে বলতে হলো নম্রতার।
সব শুনে নিকিতা বলল, “এটা একদমই ঠিক করিসনি। হয়তো অসাবধানতায় হয়ে গেছে ব্যাপারটা। প্রথম দেখায় একটা মানুষ সম্পর্কে কিছু না জেনে এভাবে জাজ করাটা ঠিক হয়নি তোর। তাছাড়া সে তোদের বাসার গেস্ট ছিল। যত যাই হোক, তার সাথে এরকম আচরণ একেবারেই কাম্য নয়। নিজের এই বদমেজাজের জন্যই একদিন তুই পস্তাবি দেখিস।”
মিথিলা কৌতুকের স্বরে বলল, “এইযে, আমাদের নিকিতা আন্টির ফ্রীতে অ্যাডভাইজ দেওয়া শুরু হয়ে গেছে।”
রিতিমা বলল, “ছাড় তো ওর কথা। নম্র যা করেছে ঠিক করেছে।”
মিথিলা বলল, “তবে একটা কথা কিন্তু না বলে পারছি না।”
নম্রতার চোখে প্রশ্ন, “কী কথা?”
“সেদিন তুই পারফেক্ট ম্যাচের কথা বললি না, এই তানিম ছেলেটা কিন্তু তোর জন্য পারফেক্ট ম্যাচ হতে পারে। তোর করা ইনসাল্টের যোগ্য জবাব দিয়ে গেছে, তারমানে আতিকের মতো মেরুদণ্ডহীন নয় একেবারেই। তুই যেমনটা চাইতি, মানে সেল্ফ-রেস্পেক্টও আছে খুব। স্মার্ট অ্যান্ড ইমপ্রেসিভ ক্যারেক্টার।”
যদিও ওদের কথার ধরন শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে ওরা ইয়ার্কি মারছে। তবু নম্রতার বুক ধ্বক করে উঠল। কানের ভিতর দিয়ে ঢুকে একেবারে শিরা উপশিরায় ঘুরে বেড়াতে লাগল মিথিলার বলা কথাগুলো।
নম্রতা বলল, “কিপ ইওর মাউথ শাট আপ। এইসব ননসেন্স কথাবার্তা একদম বলবি না।”
রিতিমা হেসে বলল, “আরে, হাইপার হয়ে যাচ্ছিস কেন? উই আর জাস্ট জোকিং।”
“তবুও ওই অসভ্যটার কথা আমি আর শুনতে চাই না।”
মিথিলা বলল, “আরে হয়, বেশিরভাগ লাভস্টোরি ঝগড়া থেকেই শুরু হয়। আমার তো এই কয়েক লাইনের চিঠি পড়েই কেমন প্রেম প্রেম পাচ্ছে। আচ্ছা ছেলেটা দেখতে কেমন বল তো।”
মিথিলার প্রশ্ন শুনে নম্রতার কল্পনায় সুদর্শন সেই মুখটি ভেসে উঠল। লোকটার প্রতি প্রচন্ড রাগ জমে আছে এটা সত্যি, কিন্তু তাই বলে তার সৌন্দর্য কে অস্বীকার করার অবকাশ নেই। উচ্চতায় পাঁচ ফিট নয় কিংবা দশ হবে বোধহয়। শক্তপোক্ত পেটানো শরীর। খুব বেশি রোগাও নয় আবার অনেক বেশি মোটাও না। খুর সুন্দরভাবে উচ্চতার সাথে মানিয়ে গেছে শারীরিক আকৃতি। শ্যামলা গায়ের রং। তবে সেই রঙটা যেন সৌন্দর্য বাড়িয়েছে আরও। প্রথমবার ঝগড়ার সময় যদিও এতকিছু ভালো করে খেয়াল করেনি নম্রতা, তবে পরে দুপুরে ডাইনিং রুমে, এবং খাওয়ার কিছুক্ষন পরে যখন লোকটা ওর মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে কী একটা কথা বলে যাচ্ছিল, তখনই তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে ও।
মিথিলা আবার জিজ্ঞাসা করল, “কী হলো! বললি না তো, দেখতে কি খুব বাজে কিংবা গেঁয়ো?”
কল্পনার জগত থেকে বেরিয়ে জবাব দিল নম্রতা, “না। দেখতে বাজে না মোটেও। স্মার্ট এবং ম্যানলি। ইনফ্যান্ট দেখে বোঝার উপায় নেই যে গ্রাম থেকে এসেছে। একবারে শহুরে ছেলেদের মতোই চলাফেরা।”
নম্রতার কথা শেষ হতে না হতেই মিথিলা বলল, “তাহলে তো হয়েই গেল। আচ্ছা, করে কী লোকটা, জানিস?”
“না, জানি না। আর জানতেও চাই না।” নম্রতার কাটকাট জবাব।
মিথিলা বলল, “জানিস না ঠিক আছে। তবে জেনে নিতে তো দোষ নেই।”
“মানে!”
“তুই তো বললি, ওর বোন নাকি এখন তোদের এখানেই আছে। ওকেই ডেকে নিয়ে আয়। ওর থেকে সব ইনফরমেশন নেওয়া যাবে।”
রিতিমা হঠাৎ কথা বলে উঠল, “কী ব্যাপার রে মিথি? তোর তো দেখছি খুব ইন্টারেস্ট লোকটার ব্যাপারে। কাহিনি কী?”
মিথিলার স্বাভাবিক উত্তর, “শুধুই কৌতূহল।”
ওদের জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়ে চাঁদনীকে ডাকতে গেল নম্রতা। চাঁদনী অবাক হলো খুব। প্রয়োজন ব্যাতীত যে একটা কথা পর্যন্ত বলে না ওর সাথে, সে হঠাৎ আজ বন্ধুদের সাথে পরিচয় করাতে চাইছে কেন? চাঁদনী কিছুটা ইতস্তত করে উঠে দাঁড়াল যাওয়ার জন্য, দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার ফেরত এলো ফোনটা নেওয়ার জন্য। নম্রতা জিজ্ঞাসা করল, “কী ব্যাপার? আবার ফেরত যাচ্ছ কেন?”
“ফোনটা নেব। আসলে এই সময়টাতে বড় ভাইজান বা তানিম ভাই ফোন দেয় মাঝেমধ্যে।”
“ও।”
চাঁদনীকে দেখে সবার প্রথমেই কথা বলল নিকিতা, “কেমন আছো চাঁদনী?”
“জি, আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছি। আপনি?”
“ভালো। তুমি কিন্তু খুব মিষ্টি দেখতে।”
চাঁদনী এবার আর কোনো জবাব দিল না। নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।
মিথিলা বলল, “শুনলাম তুমি এমবিবিএস অ্যাডমিশনের জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছ?”
“হ্যাঁ।”
“তোমার সাথে কিছুক্ষন গল্প করার জন্য ডেকেছি আসলে। এতে তোমার পড়ার কোনো ক্ষতি হবে না তো?”
“না, আপু। সমস্যা নেই।”
শুধু নিকিতা আর মিথিলাই এটা সেটা গল্প করে যাচ্ছিল চাঁদনীর সাথে। রিতিমা খাটের এককোনে থম মেরে বসেছিল। ওর ধারনা ছিল চাঁদনী অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা গ্রাম্য অসুন্দর একটি মেয়ে হবে হয়তো। কিন্তু চাঁদনীকে সামনাসামনি দেখে ওর সব ধারনাই পালটে গেল। এই মেয়ে সৌন্দর্যে শহরের যেকোনো আর্টিফিশিয়াল সুন্দরীকে টেক্কা দিতে পারবে। কেন জানি, ওর হঠাৎই খুব ইর্ষা হলো চাঁদনীর প্রতি।
মিথিলা একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে, “আচ্ছা চাঁদনী, তোমাদের বাড়িতে কে কে আছে?”
“আমাদের একান্নবর্তী পরিবার। আমার বাবা আর চাচা একসাথেই থাকেন।”
“ও, তোমরা কয় ভাইবোন?”
“ছয়জন। আমি সবার ছোট। আমার বড় আরও পাঁচজন ভাই আছে।”
“হোয়াট! এতগুলো ভাই তোমার?”
“আসলে তারা সবাই আমার আপন ভাই না। আমরা মূলত তিন ভাইবোন। বড় ভাইজান, সাদমান ভাই এবং আমি। বাকী তিনজন মানে তামজীদ ভাই, তানিম ভাই এবং তুরাগ ভাই আমার ছোটচাচার ছেলে। তাদের কোনো বোন নেই বলে তারাও আমাকে ঠিক আপন ছোটবোনের মতোই ভালবাসে।”
“ও। আচ্ছা, তোমার ভাইয়েরা কে কী করে?”
চাঁদনী থেমে গেল কিছুক্ষনের জন্য। একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে মেয়েটা। পরিবারের লোকজন সম্পর্কে জানতে চাওয়া অব্দি ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু ভাইদের পেশা সম্পর্কে জানতে চাওয়ায় কিছুটা অন্যরকম লাগল ওর। চাঁদনী বুঝতে পারল কোনো একটা খটকা আছে। কিছু একটা প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেল চাঁদনী। যেহেতু এরা সবাই বয়সে বড় এবং নম্রতার ফ্রেন্ড, এদের পালটা প্রশ্ন করলে সেটা নম্রতার খারাপ লাগতে পারে। তাই ও বলে গেল, “বড় ভাইজান মানে সাখাওয়াত ভাইয়ের বরফ কল আছে। সদরেও ব্যাবসা আছে। পাশাপাশি আমাদের জায়গাজমির তদারকি করে।
তামজীদ ভাই ঢাকাতেই থাকে। এখানকার একটা কলেজের লেকচারার সে।
সাদমান ভাই এখনও সেভাবে কিছু করে না, সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে আপাতত।
তানিম ভাইয়ের চাকরি পছন্দ নয় বলে সে গ্রাজুয়েশনের পরে ব্যবসা শুরু করেছে গ্রামেই। প্রায় এক একর জায়গা জুড়ে বিশাল আমবাগান আছে তানিম ভাইয়ের নামে। এছাড়াও মাছের ঘের, এবং গঞ্জের বাজারে স্টল আছে অনেকগুলো।
আর তুরাগ ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, এইতো।”
“বাহ, বেশ ভালো৷ তোমাদের ফ্যামিলির লোকজনদের ফটো নেই তোমার ফোনে? তোমার মুখে তাদের কথা শুনে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।”
“আমি তো আগে ফোন ইউস করতাম না। এখানে আসার পরে তানিম ভাই এটা কিনে দিয়েছিল। তাই এটাতে তেমন কোনো ফটো নেই বললেই চলে।”
“ওকে, ফাইন।”
আপাতত যা জানার জেনে থেমে গেল মিথিলা। চাঁদনীর দিকে ভালো করে তাকিয়ে কী একটা মনে করে আবার প্রশ্ন করল, “তোমার গায়ের এই গ্লিটারি ওড়নাটা খুব সুন্দর লাগছে। কোথা থেকে নিয়েছ এটা?”
“আমারও এটা খুব পছন্দের। ঢাকা আসার কয়েকদিন আগে ছোটআব্বু মানে আমার চাচা নিজে গঞ্জের বাজার থেকে আমার জন্য পছন্দ করে এটা…।”
কথা শেষ না করেই থেমে গেল চাঁদনী। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল, এরা মোটেও ওর পোশাকের প্রশংসা করছে না। বরং ওর পোশাকটা নিয়ে ঠাট্টা করছে। মিথিলা আর রিতিমার মুখের বিদ্রুপাত্মক হাসি দেখে আরও বেশি নিশ্চিত হয়ে গেল চাঁদনী।
নম্রতার খুব একটা ভালো লাগল না বিষয়টা। ও বিরক্ত স্বরে বলল, “তোরা থামবি এবার, প্লিজ।”
দুজনের কেউই নম্রতার কথা কানে তুলল না। রিতিমা হেসে বলল, “মিথিলার কথার মানে তুমি মনেহয় ঠিক ধরতে পারনি চাঁদনী৷ আজকালকার সময়ে তোমার গায়ের এই ড্রেসের ডিজাইনটি একেবারেই বেমানান। এই ড্রেসটায় তোমাকে একেবারে গেঁয়ো ভুতের মতো লাগছে। সত্যি বলতে, কেউ যে আজকাল এসব জঘন্য দেখতে ড্রেস পড়তে পারে, সেটা আমি ভাবতেও পারিনি। আমার মনেহয় সময়ের সাথে সাথে তোমারও আপডেট হওয়া উচিত। কিছু মনে কোরো না প্লিজ, যেটা সত্যি সেটাই বললাম আমি।”
রিতিমার কথাগুলো শুনে চাঁদনী কথা বলার ভাষাই হারিয়ে ফেলল। বিনা কারণে কোনোরকম শত্রুতা ছাড়াই প্রথম দেখায় একটা মেয়ে আরেকটা মেয়েকে যে এমন বিশ্রীভাবে কথা করতে পারে, সেটা চাঁদনী এর আগে কল্পনাও করতে পারেনি কখনও। মনেহয় এই প্রথমবার কেউ ওর সাথে এত বাজে ভঙ্গিতে কথা বলল। তীব্রভাবে অপমানিত বোধ করল ও। ছোট আব্বুর ভালোবেসে কিনে দেওয়া পোশাকটাকে খারাপ বলায় মন খারাপ হলো খুব। চাঁদনী চোখের পানি আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করল।
নিকিতা এতক্ষন চুপচাপ এককোনে বসে ওদের কার্যকলাপ দেখছিল। এবার আর ওর সহ্য হলো না। উত্তেজিত হয়ে বলল,
“এনাফ। অনেক বলে ফেলেছিস। সবারই নিজের রুচি অনুযায়ী পোশাক পড়ার স্বাধীনতা আছে। সেজন্য তুই ওকে যা খুশি তাই বলতে পারিস না। তাছারা ওকে পিতৃতুল্য একজন ভালোবেসে পোশাকটা কিনে দিয়েছে। সেটাকে অন্তত সম্মান করতে শেখ৷ তুই কোনো রিজন ছাড়াই মেয়েটাকে এতক্ষন অপমান করেছিস এবং ওর সাথে মিসবিহেভ করেছিস। সেজন্য এখনই ওর কাছে তোর স্যরি বলা উচিত।”
“ইমপসিবল। গ্রাম থেকে উঠে আসা ক্ষ্যাত একটা মেয়ে। দেখ গিয়ে, চাষাভুষা ফ্যামিলি থেকে উঠে এসেছে হয়তো, একে স্যরি বলব আমি! নো, নেভার। আর তাছাড়া আমি ভুল কিছু বলিনি যে ওকে স্যরি বলতে হবে।”
চাঁদনী বাকরুদ্ধ হয়ে রিতিমার করা অপমান হজম করছিল।
নিকিতা বলল,
“হ্যা সেটাই। ভুল করেও অনুতপ্ত না হওয়া, তোর মতো মেয়ের থেকে এটাই আশা করা যায়।”
“আমার মতো মেয়ে মানে? তুই কী মিন করতে চাইছিস?”
“সেটা তুই খুব ভালো করেই বুঝতে পারছিস।”
দুজনের মধ্যে ক্রমশই ঝগড়া বেঁধে যাচ্ছে বলে মিথিলা আর নম্রতা ওদের থামাতে ব্যস্ত হয়ে গেল। ততক্ষনে চাঁদনী চুপচাপ চলে গেছে নম্রতার রুম থেকে।
অনেক চেষ্টার পর পরিবেশ একসময় শান্ত হলো। ওরা তিনজন নম্রতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। চাঁদনীকে বলা রিতিমার কথাগুলো নিয়ে নম্রতাও কিছুটা অপরাধবোধে ভুগল। দ্বিধা-দ্বন্দ্বে কাটল কিছুক্ষন। একবার কি চাঁদনীকে গিয়ে স্যরি বলা উচিৎ ওর? মন সায় দিলেও ইগোতে লাগছে স্যরি বলতে। অনেকক্ষন ভাবার পরে সিদ্ধান্তটা নিল নম্রতা। মনের ইচ্ছেটা শেষপর্যন্ত হেরে গেল ইগোর কাছে। চাঁদনীর কাছে ওর আর যাওয়া হলো না।
আপাতত চাঁদনী আর রিতিমার ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল নম্রতা। স্বাভাবিকভাবেই পড়তে বসল। তারপর রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল।
কিছুক্ষন ফোন স্ক্রল করে যখন চোখ বন্ধ করল, তখনই হঠাৎ করে মনে পড়ল মিথিলার ইয়ার্কির ছলে বলা কথাগুলো। স্বগোতক্তি করল ও “ওই অসভ্য লোকটা নাকি আমার জন্য পারফেক্ট ম্যাচ হবে। ননসেন্স কথাবার্তা সব।”
না চাইতেও তানিমের মুখটা ভেসে উঠল ওর মনের মধ্যে। এবং এই প্রথমবার নম্রতা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করল, ঠিক প্রথমদিনের মত তীব্রভাবে লোকটাকে ঘৃণা করতে পারছে না ও। বরং কেমন জানি একটা অন্যরকম নাম না জানা ফিলিংস কাজ করছে। নম্রতা বুঝতেও পারল না, নিজের অজান্তেই ওর উর্বর মস্তিষ্কে খুব যত্ন করে ভালোলাগার একটা ছোট্ট বীজ বপন করা হয়ে গেছে। এই বীজ থেকে কিছুদিন পর চারা বের হবে। তারপর সেটা ধীরে ধীরে বড় হয়ে ডালপালা ছড়িয়ে সদর্পে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। একসময় ভালোলাগার ছোট্ট চারাগাছটি রুপান্তরিত হবে ভালোবাসার এক বিশাল বটবৃক্ষে।
১৪.
কোচিং থেকে বের হয়ে অবাক হয়ে গেল চাঁদনী৷ টানা বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট ভিজে একাকার হয়ে আছে।
ক্লাসরুমের ভিতরে বসে বাইরের আবহাওয়া একদমই বোঝা যায়নি এতক্ষন। আজ সকালে যখন বাসা থেকে বের হয়েছিল, তখন জুলাই মাসের চমৎকার রৌদ্রজ্জ্বল একটি সকাল ছিল।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)