নিভৃত রজনী পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

0
354

নিভৃত রজনী
| ৩০.১ | (১৭৫০+ শব্দ)

নম্রতা বাসায় পৌঁছেই মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। সাখাওয়াত, চাঁদনী আর মরিয়ম খাতুন তিনজনে হতভম্ব হয়ে গেল নম্রতার এমন আচরণে।

মরিয়ম খাতুন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সস্নেহে জিজ্ঞাসা করলেন,
“কী হয়েছে মা? কাঁদছিস কেন এভাবে?”

সাখাওয়াতকে ঠিক যা বলেছিল সেটা বলেই মাকেও বুঝ দিল নম্রতা।
“গতকাল রাতে তোমাকে নিয়ে খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখলাম। সেজন্য খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল আম্মু।”

“পাগল মেয়ে একটা। তাই বলে এভাবে কাঁদবি? এই যে আমি ঠিক আছি।”

মরিয়ম খাতুনের কোনো সান্ত্বনাই কাজে এলো না। নম্রতা কাঁদতেই থাকল অনেকক্ষন ধরে। সাখাওয়াত নম্রতাকে পৌঁছে দিয়েই বিদায় নিল। ব্যস্ততা থাকা স্বত্বেও শুধু নম্রতাকে দিয়ে যাওয়ার জন্যই এতদূর এসেছিল ও।

নম্রতাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে শুরু থেকেই সন্দেহ হয়েছিল চাঁদনীর। তাই অন্য সবাই বিশ্বাস করলেও চাঁদনী এটা বিশ্বাস হলো না যে শুধু মায়ের জন্য নম্রতা এভাবে কেঁদেছে। বিয়ের আগে থেকেই তানিম আর নম্রতার মধ্যে একটা তিক্ততার কথা ও জানত। সেজন্যই সন্দেহটা আরও জোরালো হলো।

নম্রতা রুমে যাওয়ার কিছুক্ষন পরে তার পিছুপিছু চাঁদনীও গেল। রুমে গিয়ে দরজা লক করে নম্রতার মুখোমুখি বসে সরাসরি প্রশ্ন করল, “আমার কাছে কিচ্ছু লুকাবে না নম্রতা আপু৷ সত্যি করে বলোতো কী হয়েছে?”

নম্রতা চাঁদনীকে আর মিথ্যে বলল না। তানিমের সাথে ওর সম্পর্কটা ঠিক কোন পর্যায়ে আছে সেটা পুরোটাই ব্যাখ্যা করে বলল।

চাঁদনী সব শুনে অবাক হল।
“কী বলছ? তোমাদের মধ্যে সবকিছু এখনও স্বাভাবিক হয়নি? বিয়ের পর যে একবার বাড়িতে গেলাম, তানিম ভাই তো তখন তোমার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহারই করছিল। আমি তাই ভেবেছিলাম তোমাদের মধ্যকার মনোমালিন্য সব ঠিক হয়ে গেছে। আর বাড়ির বাইরে বের হয়েছ, শুধু এইজন্য তানিম ভাই তোমাকে এতবড় একটা কথা বলেছে? দাঁড়াও, এক্ষুনি আমি কল করছি তাকে।”

“না, ভাবি। তুমি তাকে কিচ্ছু বলবে না।”
“কিন্তু…।”
“প্লিজ, আমার রিকোয়েস্ট এটা।”
“ওকে, বলব না কিছু। এখন তাহলে তুমি রেস্ট নাও। আবার পরে কথা হবে।”

নম্রতা ইচ্ছে করেই মুক্তার সাথে যে কথাবার্তা হয়েছিল, সেগুলো কিছু বলল না চাঁদনীকে। কেন জানি মন বলছে এখনই সবটা সবাইকে বলা ঠিক হবে না। ও জানে, তানিম ওকে পছন্দ করে না। তবুও বেহায়া মন মানতেই চায় না কেন জানি। সব বাস্তবতাকে ভুলে গিয়ে নম্রতা কল্পনার জগতে ভেসে থাকে। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায়, তানিম ওর অভিমান ভাঙাতে এসেছে।

মা যাতে কিছু বুঝতে না পারে, তাই নিজেকে স্বাভাবিক রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে নম্রতা। সবার মধ্যে থেকে অবশ্য কিছুক্ষনের জন্য নিজের মনের বেদনাগুলোকে ভুলে গিয়েছিল নম্রতা। কিন্তু রাতে একা ঘুমাতে গিয়ে বাঁধল বিপত্তিটা। তানিমের কথা মুক্তার কথা সব আবার মাথার মধ্যে ভজঘট পাকিয়ে ফেলল। ফলস্বরূপ সেদিন রাতটাও ঠিক আগের রাতের মতোই নির্ঘুম কাটল। বাধ্য হয়ে তাই পরের রাতে ঘুমানোর আগে মায়ের মেডিসিন বক্স থেকে একটা স্লিপিং পিল খেয়ে ফেলল নম্রতা।

নম্রতা জানে, এতে ক্ষতি তেমন হবে না। বরং চলমান সকল দুশ্চিন্তা, হতাশা থেকে কিছুক্ষনের জন্য রেহাই মিলবে। একটা শান্তির ঘুম হবে।

স্লিপিং পিলটা সত্যিই কাজে দিল। সেদিন রাতের খাবার খেয়ে একটু আগেভাগেই শুয়ে পড়ল নম্রতা। শুয়ে পড়ার কিছুক্ষনের মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়েও গেল। শেষরাতের দিকে গভীর ঘুমের মধ্যে খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখল ও। পুরো স্বপ্নটাই ওর কাছে একবারে বাস্তব বলে মনে হচ্ছিল।

স্বপ্নের মধ্যেও নম্রতা দেখল যে ও ওর নিজের রুমের খাটে শুয়ে আছে। তানিম ওর পাশে বসে আছে। নম্রতা তানিমকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি! এখানে?”
“হ্যা, আমি এসেছি। আচ্ছা নম্রতা, আমি যদি তোমাকে এখন একবার স্পর্শ করি, তাহলে কী তুমি আমাকে আবার ক্যারেক্টারলেস বলবে?”

তানিমের এই প্রশ্নে নম্রতা ফুপিয়ে কেঁদে উঠল।
“না বুঝে সেই প্রথম পরিচয়ের দিন আমি একটা ভুল করে ফেলেছিলাম। তারজন্য আপনি আমাকে আর কত শাস্তি দেবেন? আর কতবার আমাকে পালটা অপমান করলে আপনার মনের জমে থাকা রাগ আর ক্ষোভ মিটবে? আর কতবার আপনার সামনে অনুতপ্ত হয়ে গিয়ে দাঁড়ালে আমার জন্য আপনার মনে একটু মায়া জন্মাবে?
কতবার স্যরি বলার জন্য আপনার কাছে সেধে গিয়েছি, আপনি পাত্তা দেননি। ভেবেছিলাম বিয়ের পর হয়তো আমার চোখের ভাষা দেখে হলেও বোঝার চেষ্টা করবেন, আমি কী চাই। কিন্তু আপনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন তখনও। বারবার চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়ে গেলাম। ইভেন এখন স্বপ্নের মধ্যেও আপনি সেই একই কথা নিয়ে খোঁচা দিচ্ছেন আমাকে।

কী করব আমি, বলুন তো। আপনার পা ধরে মাফ চাইতে বললে আমি সেটা করতেও রাজি আছি। বলুন এখন কি তাহলে সেটাই…।”

“হুশ!” নম্রতার ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে ওকে থামিয়ে দিল তানিম।”এসব কথা আর একদম বলবে না। আর এটা কোনো স্বপ্ন নয়। আমি সত্যিই এসেছি তোমার কাছে।”

“হ্যাঁ, আমার কাছেও স্বপ্নটাকে একেবারে সত্যি বলেই মনে হচ্ছে।”

কথাটুকু বলে, যেটুকু দুরত্ব ছিল, সেটুকুও ঘুচিয়ে দিল নম্রতা। তানিমের উপর ঝাপিয়ে পড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল ওকে।

এইতো সেই চেনা পরিচিত শরীরের ঘ্রানটা পাওয়া যাচ্ছে। না, নম্রতা কখনও তানিমের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পায়নি। কিন্তু তানিমের অনুপস্থিতিতে ওর সবগুলো শার্ট নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে করতে পুরুষালী ঘ্রাণটা ওর রন্ধ্রে রন্ধ্যে গেথে গেছে।

স্বপ্নটা এত বাস্তব কেন লাগছে কে জানে৷ তাহলে কি সত্যিই তানিম এসেছে? নম্রতার মস্তিষ্কে তখন ভাবনার ঝড়।

তানিম শক্ত করে জাপটে ধরে নম্রতার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোয়ালো। নম্রতা এবার নিশ্চিত হয়ে গেল, এটা আসলেই স্বপ্ন। স্বপ্ন ভেবেই পরবর্তী কথাগুলো অকপটে বলে গেল ও,
“আপনি তো আস্ত একটা বেরসিক লোক। এই যে আপনার একটু কাছাকাছি যাওয়ার জন্য কত চেষ্টা করি অথচ আপনি ফিরেও তাকান না। রিয়েল লাইফে না হোক, অন্তত এই স্বপ্নেই একবার আমাকে আদর করে দিন না প্লিজ।”

তানিম ঘায়েল করা সেই হাসি হেসেই যাচ্ছে, “আদর করলে যদি তুমি আবার আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলো।”
“উফ! আবার এক কথা। এখন আর কথা বলে সময় নষ্ট করবেন না প্লীজ। যেকোনো সময় আমার ঘুমটা ভেঙ্গে যেতে পারে। আমাকে এক্ষুনি অনেকগুলো চুমু দিন। এখানে, এখানে আর সবখানে।” নিজের কপাল,গাল আর ঠোঁট দেখিয়ে বলল নম্রতা।
“শুধু চুমু? আর কিছু চাও না?”
“চাই তো। আরও অনেক কিছু চাই।”
“আর কী চাই?
” ভালোবাসা চাই। যতভাবে ভালোবাসা যায়, ঠিক ততভাবেই চাই।”

“দেব তো। সবরকমভাবে ভালোবাসা দেব৷ কিন্তু সেটা স্বপ্নে নয়। আগে তুমি এই স্বপ্ন স্বপ্ন ভাবনাটা থেকে বের হও৷ আজ যা হওয়ার সব বাস্তবেই হবে।”

“আপনি খুব খারাপ। স্বপ্নেও আমাকে ফিরিয়ে দিলেন।”

সুন্দর স্বপ্নটা ওখানেই শেষ। নম্রতা আবার গভীর ঘুমের দেশে চলে গেল। তারপর ওর ঘুম ভাংল বেশ বেলা করে। তলপেটে প্রচন্ড চাপ নিয়ে ঘুমটা ভেঙেছে। সারারাত স্লিপিং পিলের জন্য গভীর ঘুমে থাকায় ওয়াশরুম যাওয়া হয়নি। নম্রতা ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে ওয়াসরুমের দিকে গেল। তারপর ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে এসে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। লম্বা সময় ঘুমিয়ে সেই রেশ এখনও পুরোপুরি যায়নি ওর।

“তোমার বোধহয় শীত লাগছে নম্রতা। কম্ফোর্টারটা গায়ে দিয়ে দেই? তাহলে আরাম করে ঘুমাতে পারবে। নাকি আরেকবার আমার কাছাকাছি আসবে?”

এক, দুই, তিন সেকেন্ড সময় নিল নম্রতার মস্তিষ্ক সিগন্যালটা ক্যাচ করতে। তারপরেই ধরফর উঠে বসে পাশের দিকে তাকাল নম্রতা। তানিম ফোন হাতে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। নম্রতা চোখ কচলে আবার তাকাল।
তানিম হেসে বলল, “এবার কি স্বপ্ন আর সত্যির মধ্যে তফাৎটা বুঝতে পারছ? নাকি এটাকেও স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে?

যা যা ঘটছে সেটাকে এখনও বাস্তব বলে মেনে নিতে পারছে না নম্রতা। বিশেষ করে তানিমের আচরণে হঠাৎ এই পরিবর্তনের জন্য।

হঠাৎ তানিমের ফোন বেজে উঠল। তানিম ফোনে কথা বলা শুরু করল সবসময়ের মত যান্ত্রিক ভাষায়। ব্যবসায়িক কলগুলো অ্যাটেন্ড করার সময় এভাবেই কথা বলে তানিম। নম্রতা এবার নিশ্চিত হলো, তানিম সত্যিই এসেছে ওর কাছে।

“ও মাই গড!” চাপা স্বরে আর্তনাদ করে উঠল নম্রতা। তারমানে শেষরাতের দিকে তানিমের সাথে কাটানো সময়টুকু স্বপ্ন ছিল না। সত্যিই ও তানিমকেই বলেছিল কথাগুলো। সেজন্যই কি স্বপ্নটা এত বাস্তব বাস্তব লাগছিল। কী কী বলেছিল সেটা মনে করার চেষ্টা করল নম্রতা। আদর, চুমু চাওয়া সব এক এক করে মনে পড়ছিল ওর। আর সেই সাথে লজ্জাও বেড়ে যাচ্ছিল সমানুপাতিক হারে।

নম্রতা নড়াচড়া করতেও ভুলে গেল হঠাৎ। কী করবে এখন ও? আচ্ছা এখনই একছুটে রুম থেকে পালিয়ে গেলে কেমন হয়? কিন্তু পালাবেই বা কোথায়?

তানিম ওর চোখের সামনে এসে দুই আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে বলল, “কোথায় হারালে?”

নম্রতা হুঁশে এলো এবার। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে এক্সপ্লেইন করার চেষ্টা করল তানিমকে, “দেখুন আমি আসলে তখন ঘুমের ঘোরে ছিলাম। কি বলেছি না বলেছি সেটা আমার নিজেরও মনে নেই।”

“সত্যিই কি তাই? আমার তো মনে হচ্ছে তুমি কিছুই ভুলে যাওনি।”

নম্রতা মুখে কুলুপ আঁটল আবার৷ কী চাইছে এই লোক, ওকে লজ্জা দিয়ে মেরে ফেলতে! প্রসঙ্গ বদলানোর চেষ্টা করল নম্রতা, “আপনি এখানে কেন এলেন?”
“দরকার আছে তাই এসেছি।” সাথে সাথেই উত্তর দিল তানিম।

দরকার! নম্রতা আবার ভাবতে শুরু করল। কী দরকারে এসেছে তানিম? নম্রতা আশেপাশে থাকলে তো সমসময় বিরক্তবোধ করত ও। এখন চলে আসায় তো আরও সুবিধা হয়েছিল। তাহলে তানিম নিজের অসুবিধা করে কী এমন দরকারে এসেছে। আচ্ছা সেই চিঠি, সেটা কি পেয়েছে তানিম? চিঠিতে তো নম্রতা লিখে রেখে এসেছিল ওকে ডিভোর্স দিতে। ও মাই গড! তানিম কি তাহলে ডিভোর্সের জন্যই এসেছে? শীট! এই কথাটা আগে কেন ওর মাথায় এলো না। এতক্ষন কিনা বোকার মতো ও ভাবছিল, তানিম মিটমাট করে নেওয়ার জন্য এসেছে।

নম্রতার মুখে ভেসে ওঠা লাজুক আভাটা সরে গিয়ে মুখটা বিবর্ণ হতে শুরু করল। তানিম খেয়াল করল এই বদলে যাওয়াটা। সিরিয়াস গলায় এবার ও বলল, “নম্রতা, তুমি কি আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাও?”

নম্রতা বসে থাকল চুপ করে। ওর দুচোখে তখন মেঘের ঘনঘটা। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামল বলে। তানিম আবারও জিজ্ঞাসা করল, “চুপ করে আছ কেন?”

“আমার কিছু জিজ্ঞাসা করার নেই।”
“ভেবে বলো।”
“ভেবেছি, আমার সত্যিই কিছু জিজ্ঞাসা করার নেই। আপনার জীবনের যেকোনো সিদ্ধান্ত আপনি নিতেই পারেন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলার রাইট আমার নেই। শুধু এতটুকুই বলতে চাই, চাঁদনী ভাবির কথায় নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে এতবড় সিদ্ধান্ত নেওয়া আপনার উচিৎ হয়নি। যাই হোক, যেটা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন আপনার পছন্দের মানুষটি মানে মুক্তার সাথে আবার নতুন করে শুরু করুন।”

“এক মিনিট, তোমাকে কে বলল যে মুক্তা আমার পছন্দের মানুষ? আর চাঁদনীর কথায় আমি কোন সিদ্ধান্তটা নিয়েছি?”

“না,মানে… মুক্তা নিজেই তো বলল…।”
“মুক্তা ওর নিজের কথা বলেছে। কিন্তু তার জন্য তুমি এটা ভেবে নিতে পারো না যে আমি মুক্তাকে পছন্দ করি। আর প্রথম সাক্ষাতেই তুমি মুক্তার কথাগুলো কীভাবে বিশ্বাস করে নিলে? মুক্তা মিথ্যেও তো বলতে পারে।”

নম্রতা কী একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। তানিম আবার বলল, “শোনো নম্রতা, আজকে পর্যন্ত আমার জীবনে আসা প্রথম এবং সর্বশেষ নারীটি তুমি। মুক্তাকে পছন্দ করা তো দুরের কথা, ওর দিকে ভালো করে আমি কখনও তাকাইনি পর্যন্ত।”

নম্রতার খুব ভালো লাগল তানিমের মুখের কথাগুলো। কিন্তু আবার কিছু একটা মনে হতেই গুটিয়ে গেল ও।
“হ্যা, আমি আপনার জীবনের প্রথম নারী। কিন্তু আপনার পছন্দের নারী নই। শুধু চাঁদনী ভাবি যাতে কষ্ট না পায় তাই তো অপ্রিয় হওয়া স্বত্বেও আপনি বিয়েটা করেছেন।”

“বোকা মেয়ে, এতো আবোল-তাবোল ভাবনা তোমার মাথায় এলো কী করে? চাঁদনী আমাদের পাঁচ ভাইয়ের খুব আদরের একটা মাত্র বোন। ছোটবেলা থেকে ও যেটা চেয়েছে আমরা সবাই সেটাই ওকে দিয়েছি। কিন্তু তাই বলে ওর কথায় নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করার কথা তো কল্পনাও করতে পারি না। এটা করলে তো একপ্রকার ক্রাইম করা হয়ে যাবে তোমার সাথে। চাঁদনীও নিজেও গিল্ট ফিল করবে এসব শুনলে। এমনকি নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়েটা করলে সেটা নিজের সাথেই প্রতারনা এবং প্রবঞ্চনা করা হতো। এসব আমার এথিক্সের মধ্যে পড়ে না নম্রতা।

সজ্ঞানে আমার জীবনে এরকম গুরুতর অন্যায় করা তো দূর, কখনও অন্য কারও ক্ষেত্রেও এমন কোনো অন্যায়কে সমর্থন করিনি আমি।”

তানিমের বলা কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে প্রথমে যে প্রশ্নটা নম্রতার মাথায় এলো, সেটাই মুখ ফসকে বলে ফেলল ও,
“তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, আপনি আমাকে পছন্দ করেন।”

প্রশ্নটা করে নিজেই হকচকিয়ে গেল নম্রতা। এটা কী বেরিয়ে এল মুখ ফসকে!

তানিম হাসল আবার। অকপটে উত্তর দিল, “হ্যাঁ। করি তো।”

তানিমের জবাব শুনে নম্রতার মুখটা বোয়াল মাছের মতো হা হয়ে গেল। আজ যেন ওর শুধু অবাক হওয়ার দিন। তানিম নিজের মুখে ওকে পছন্দ করার স্বীকারোক্তি দিচ্ছে! এটাও সম্ভব!

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

(প্রাপ্তবয়স্ক সতর্কতা)
নিভৃত রজনী
| ৩০.২ | (শেষ) (১৮০০+ শব্দ)

তানিমের জবাব শুনে নম্রতার মুখটা বোয়াল মাছের মতো হা হয়ে গেল। আজ যেন ওর শুধু অবাক হওয়ার দিন। তানিম নিজের মুখে ওকে পছন্দ করার স্বীকারোক্তি দিচ্ছে! এটাও সম্ভব!

পরের প্রশ্নগুলোও ঘোরের মধ্যেই বের হয়ে এলো ওর মুখ থেকে,
“কবে থেকে হলো এসব? আপনি তো আমাকে দুচোখে দেখতেই পারতেন না। তাহলে কীভাবে..?”

“তুমি প্রথমবার যখন তালুকদার মঞ্জিলে গেলে তখন থেকেই শুরু হয়েছিল। সারাক্ষন আমাকে লুকিয়ে দেখতে তুমি, আশেপাশে ঘুরঘুর করতে একটু কথা বলার জন্য। সম্ভবত তোমার প্রথমদিনের করা ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে স্যরি বলতে। কিন্তু আমি প্রত্যেকবারই সুকৌশলে তোমাকে এড়িয়ে যেতাম। তখন পর্যন্ত তুমি শুধুই আমার বিরক্তির কারন ছিলে। তারপর ওখান থেকে ফিরে আসার দিন তুমি সেধে আমার সাথে কথা বলতে গেলে। আমি কথা বলতে চাইলাম না তোমার সাথে। বরং ইনসাল্ট করলাম তোমাকে। আমার সামনে দাঁড়িয়েই তুমি কাঁদলে।

ব্যাস সেদিন থেকেই শুরু হলো ব্যাপারটা। তুমি চলে যাওয়ার পর মনে হলো, তোমার সাথে ওরকম ব্যাবহারটা না করলেই হতো।

আরও একটা বিষয়ে খটকা লাগছিল আমার। মনে হচ্ছিল অনুতপ্ত হওয়ার সাথে সাথে আমার প্রতি কোনো অনুভূতি হয়তো বাসা বাঁধছে তোমার মনে। তারপর চাঁদনী যেদিন সবার সামনে তোমার সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাবটা রাখল, সেদিন একেবারে নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে আমার ধারনা ভুল নয়।”

নম্রতা অপ্রস্তুত স্বরে বলল, “নিশ্চিত হয়েছেন মানে? প্রস্তাবটা চাঁদনী ভাবি রেখেছিল, আমি নই।”

“শোনো নম্রতা। জন্মের পর চাঁদনীকে সবার আগে আমার কোলে দেওয়া হয়েছিল। নিজের আপন ভাইদের চেয়েও আমার কাছে বেশি আবদার করত ও। চাঁদনীকে আমি খুব ভালো করে চিনি। যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে ও। তোমার কোনোরকম মতামত না নিয়ে হুট করে এত বড় একটা প্রস্তাব রাখার মতো মেয়ে অন্তত নয় চাঁদনী। সবার সামনে প্রস্তাব রাখার পর তুমি যদি না বলে দিতে, তাহলে আমাকে ওখানে সবার সামনে ছোট হতে হতো। নিজের তানিম ভাইয়ের ব্যাপারে সেই রিস্ক চাঁদনী কখনও নেবে না। আর তাছাড়া আমাকেও চাঁদনী খুব ভালো করে চেনে। এমনকি মুক্তাকে যে আমার পছন্দ নয়, সেটাও ও বুঝেছিল। সেজন্যই সবার সামনে প্রস্তাবটা রেখেছিল ও।

নম্রতা, আমার যতদূর ধারনা, তুমি নিজের মনের কথাগুলো শেয়ার করেছিলে ওর সাথে। যার প্রেক্ষিতেই ও প্রস্তাবটা রেখেছিল। আমার ধারনা ভুলও হতে পারে। তুমি যদি আমার চোখে চোখ রেখে শুধু একবার ‘না’ বলতে পারো, তাহলেই আমি বুঝে নেব আমি যা ভেবেছি সব আমার ভুল।”

নম্রতা বুঝল, ধরা পড়ে গেছে ও। এখন আর অস্বীকার করার জো নেই কোনো। ওর মনের গোপন কথাগুলোর ব্যাপারে অনেক আগেই ওয়াকিবহাল ছিল তানিম। নীরব হয়ে থাকা ছাড়া অগত্যা নম্রতার আর কোনো উপায় রইল মা।

তানিম বলল, “তুমি চুপ করে আছো, তাহলে কি আমার ধারনাই ঠিক ছিল।”

আরও কিছুক্ষন অপেক্ষা করল তানিম। নম্রতার তরফ থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে পুনরায় বলল, “তারমানে উত্তরা নিবাসী, নম্রতা নামের বদমেজাজি মেয়েটি সত্যি সত্যিই হলুদিয়া গ্রামের নাকউঁচু স্বভাবের তানিম তালুকদারের প্রেমে পড়েছিল।”

নম্রতা চমকে উঠল।

“একদিন সকালে রুম থেকে বের হওয়ার সময় মোবাইল নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। যখন মোবাইলটা নিতে আবার রুমে ঢুকতে যাব, তখন দেখলাম আপনমনে একজন বিড়বির করে বলছে, আমার উঁচু নাকটা সে কাচি দিয়ে ঘ্যাচ করে কেটে দিতে চায়।” এতটুকু বলে তানিম উচ্চস্বরে হেসে উঠল।

লজ্জার চূড়ান্ত সীমাটাও এবার মনেহয় পার করে ফেলল নম্রতা। একে তো নম্রতার মনের কথাগুলো সব বুঝে ফেলেছে তানিম। তারউপর মাঝে মাঝে তানিমের নির্লিপ্ত আচরণে অভিমান করে যেসব আজেবাজে কথাগুলো একা একাই বলত তানিমকে উদ্দেশ্য করে, সেগুলোও আড়ি পেতে শুনে ফেলেছে তানিম। নম্রতা ওড়নার এককোনো তুলে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। তানিমের হাসি বিস্তৃত হলো আরও,
“তো ম্যাডাম। আপনার সব কনফিউশান ক্লিয়ার হয়েছে এখন? আপনার হাজবেন্ডের হৃদয়ে আপনি ছাড়া আর কেউ নেই।”

নম্রতা মুখ ঢেকেই অভিমানী স্বরে বলল, “আরও একটা প্রশ্ন আছে। সেদিন আমার সাথে ওরকম বাজে ব্যবহার কেন করলেন? সামান্য বাড়ির বাইরেই তো একটু গিয়েছিলাম। তাতেই আপনার মনে হলো, আমি বাইরের লোকের কাছে নিজের শরীর…।”

আবারও নম্রতাকে থামিয়ে দিল তানিম, “ব্যাস নম্রতা, আর বলতে হবে না। সেদিন আসলেই অকারণে আমি তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছিলাম। সেজন্য আমি মন থেকে স্যরি বলছি তোমাকে।”

“কিন্তু হঠাৎ ওরকম কেন করলেন।”
তানিম নম্রতার কাছে ব্যাখ্যা করল পুরো ব্যাপারটা। নম্রতা সব শুনে বলল৷ “কিন্তু আমি তো শালীন ভাবেই বের হয়েছিলাম।”
“আমি জানি। আসলে ছেলেগুলোই খারাপ। বোরখা পড়ে এমন মেয়ে হেটেঁ গেলেও তাদের দিকে বাজে নজরে তাকায়। তোমার কোনো দোষ নেই জেনেও, তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছিলাম। বাইরের কিছু ছেলে আমার স্ত্রী সম্পর্কে বাজে কমেন্ট করছে, এটা কেন জানি মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই খুব রাগ উঠে গিয়েছিল। আই অ্যাম স্যরি।”

“আমি বুঝতে পেরেছি। আর স্যরি বলতে হবে না।”

“তারমানে সবকিছু ক্লিয়ার এখন তোমার কাছে। অতীতের আলোচনা এই পর্যন্তই। এখন থেকে আমরা বর্তমান নিয়ে কথা বলব। বাই দ্যা ওয়ে, একটা প্রশ্ন করার ছিল তোমাকে?”
“কী?”

“এতদিনে যা বুঝেছি, তোমার ঘুম খুব পাতলা। অল্প আওয়াজেই তুমি জেগে যাও। আজ এত গাড় ঘুম হলো কেন? এমনকি ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন আর বাস্তবের তফাতটাও বুঝতে পারলে না।”

“না মানে, মায়ের তো ইনসনোমিয়া আছে। তাই স্লিপিং পিল খেতে হয়। সেখান থেকে কাল রাতে…।”

“আল্লাহ! তুমি স্লিপিং পিল খেয়েছ? কয়টা? বাই এনি চান্স, সুইসাইড করতে যাচ্ছিলে না তো?” নম্রতার পুরো কথা না শুনেই আতঙ্কিত হুয়ে পড়ল তানিম।

“আপনি এত ব্যস্ত হবে না তো। একটা ট্যাবলেট খেয়েছি। ঘুম হচ্ছিল না রাতে, তাই খেয়েছি। এতটুকুতে ক্ষতি হবে না কোনো। ভেবেছিলাম ভালো একটা ঘুম হবে। কিন্তু এই প্রথমবার খেলাম তো, তাই ওটার এফেক্ট একটু বেশিই হয়েছে।”

তানিম ওর কানের কাছে মুখ এনে বলল, “ভালোই হয়েছে তাহলে ওটা খেয়ে। যা যা বলেছে আমাকে তখন৷ সজ্ঞানে থাকলে তো ওগুলো কখনও শোনাই হতো না তোমার মুখ দিয়ে।”

নম্রতা অসহায় কন্ঠে বলল, “আমার সত্যিই কিছু মনে নেই।”

“কিন্তু আমার সব মনে আছে। তুমি আমার কাছে চুমু, আদর, ভালোবাসা এসব চেয়েছ। কোথায় কোথায় চুমুগুলো দিতে হবে সেটাও দেখিয়ে দিয়েছে। আর…।”
“চুপ করুন, প্লিজ।” দুহাতে কান চেপে আকুতিভরা স্বরে বলল নম্রতা।
“আজ আর চুপ থাকা চলবে না। দরকারি কথা আছে।”
“বলুন।”
“অনেক হয়েছে দূরে থাকা। একটা সম্পর্কে যখন আমরা বাঁধা পড়েই গেছি, এভাবে দুরত্ব তৈরি করে আমি আর রাখতে চাইছি না। আজ, এই মুহুর্তে আমাদের বৈধ সম্পর্কটাকে পূর্ণতা দিতে আমি যদি তোমার কাছাকাছি আসি, তাহলে কি তোমার কোনো আপত্তি আছে।”

তানিমের কথা শুনে নম্রতা বরফের মতো জমে গেল। শিরা-উপশিরায় ঝিমঝিমে একটা রেশ ছড়িয়ে পড়ছিল ক্রমশ। অবশেষে সেই সময়টা এলো তবে। অনেকক্ষন চেষ্টা করেও নম্রতা ওর মুখ থেকে একটা শব্দ উচ্চারন করতে পারল না। তানিম বলল, “সবসময় চুপ থাকলে তো হবে না।”

“আমি কিছু বলতে পারব না। আপনি বুঝে নিন।”
“একদম না। আমি এখন কিছু বুঝে নিতে পারব না। এখন আমি বুঝে নিয়ে এগিয়ে গেলে, পরে যদি আবার চরিত্রহীন বলে খোঁটা দাও আমাকে।”

“এক কথা আর কতবার বলবেন।”

“তুমি মতামতটা জানাও। প্রমিস করছি, এরপর থেকে আর এই প্রসঙ্গ তুলব না।”

“আমার খুব লজ্জা লাগছে। আমি কিছু বলতে পারব না।”
“তাহলে আর কিছুই করার নেই। আমি চলে যাচ্ছি এখনই।”
নম্রতা চমকে উঠে বলল৷ “চলে যাচ্ছি মানে! যাবেন না প্লীজ। বলছি, আমার কোনো আপত্তি নেই।”

সম্মতি পেয়ে আর সময় ব্যায় করল না তানিম। নম্রতার কাছাকাছি এগিয়ে গেল।
নম্রতা আঁতকে উঠে বলল, “কী করছেন?”
“আশ্চর্য! তুমি না এইমাত্র বললে আপত্তি নেই।”
“হ্যা, বলেছি। কিন্তু তাই বলে এখন?
“এখন হলে কী প্রব্লেম?”
“সকাল হয়ে গেছে। কেউ যদি ডাকতে আসে?”
“বোকা মেয়ে, তুমি যদি একা থাকতে তাহলে হয়তো ডাকতে আসত। কিন্তু এখন তোমার হাজবেন্ড আছে তোমার সাথে। সারাদিন রুমের দরজা বন্ধ করে থাকলেও কেউ তোমাকে ডাকতে আসবে না। তারা জানে নতুন বিবাহিত কাপলকে নিজের মতো করে সময় কাটানোর জন্য স্পেস দিতে হয়।”
“কিন্তু তাই বলে এই সকাল বেলা?” মিনমিন করে আপত্তি জানাতে চাইল নম্রতা।

“নম্রতা, এতদিন আমাদের সম্পর্কটা রাতের অন্ধকারের মতো ছিল। দীর্ঘ তিনমাস পরে সেই অন্ধকার শেষে নতুন সুর্যোদয় হয়েছে। অবশেষে আমাদের সম্পর্কটা রাত পেরিয়ে সকালের দেখা পেয়েছে। তাই এই শুরুটাও নাহয় আমরা আজকের এই সুন্দর সকালটাইতেই করলাম।”

নম্রতা লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নিল। তানিম আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে এগিয়ে গেল ওর দিকে।

★★★

পরিশিষ্ট:-

মা হওয়া যে ঠিক কতটা কঠিন, সেটা প্রেগন্যান্সির লাস্ট মান্থে এসে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে নম্রতা। কিছুক্ষন আগে হাত থেকে ফোনের চার্জারটা ফ্লোরে পড়ে গেছে। শুধু একটু নুয়ে সেটাকে তোলাও নম্রতার কাছে বিশ্বযুদ্ধের মতো লাগছে।

অনেক কসরত করে চার্জারটা তোলার জন্য ঝুঁকতে যাচ্ছিল ও, তার আগেই তানিম রুমের মধ্যে ঢুকল। তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এসে নিজেই চার্জারটা তুলে মোবাইল চার্জে লাগিয়ে দিল। তারপর নম্রতার কাছে এসে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল, “এখন কেমন লাগছে শরীর?”

নম্রতার গা গুলিয়ে উঠল সাথে সাথে। নিজেকে তানিমের বাহুবন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মেজাজ তুঙ্গে তুলে বলল, “তোমাকে কতবার বলেছি, এই পারফিউমটা লাগাবে না। আমার তাতে…”

কথা শেষ করার আগেই হরহর করে বমি করে তানিমের শার্ট মেখে ফেলল ও।

তানিম হতাশ দৃষ্টিতে তাকাল নিজের দিকে। ভুল হয়ে গেছে আসলেই। পারফিউমটা নম্রতা নিজেই পছন্দ করে কিনে দিয়েছিল ওকে। অথচ কনসিভ করার পর থেকে এটার স্মেল সহ্যই করতে পারে না নম্রতা।

প্রেগন্যান্সির লাস্ট মান্থে যেকোনো সময় কিছু একটা হয়ে যেতে পারে বলে নম্রতা ঢাকায় চলে এসেছে। তানিমও বেশিরভাগ সময় স্ত্রীর সাথে থাকলেও মাঝে মাঝে হলুদিয়া যেতে হয় নিজের কাজের প্র‍য়োজনে। আজ সকালে নম্রতা ফোন করে বলেছিল, ওর শরীরটা বেশি ভালো যাচ্ছে না। চিনচিনে ব্যাথ্যা হচ্ছে তলপেটে। অগত্যা তানিম সব কাজ ফেলে তখনই রওয়ানা হয়েছিল গ্রাম থেকে। তাড়াহুড়োয় রেডি হতে গিয়ে পারফিউম যেটা সামনে পেয়েছে সেটাই স্প্রে করে চলে এসেছে। তাই অঘটনটা ঘটল।

তানিম বলল, “স্যরি একদম খেয়াল ছিল না। আমি এখনই গোসল সেরে আসছি।”

নম্রতাকে খাটের এককোনে বসিয়ে তানিম ওয়াশরুমের দিকে ছুটল। এই স্মেল যতক্ষন নম্রতা পাবে, ততক্ষন বমি হতেই থাকবে ওর।

সেরাতেই নম্রতার পেইন উঠল। রাত তখন প্রায় তিনটা বাজে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো সাথে সাথেই। অনেক যুদ্ধের পর অবশেষে সকালবেলা নম্রতা একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দিল।

পরিবারের সকলেই উপস্থিত ছিল সেখানে। নার্স বাচ্চা নিয়ে বের হওয়ার পর তানিম বলল, “আমার মেয়েকে সবার আগে কোলে নেবে চাঁদনী।”

চাঁদনী উৎফুল্ল হয়ে এগিয়ে গেল। পিটপিট করে তাকানো চোখদুটো দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকল।

তানিম নার্সের কাছে গেল নম্রতার শারিরীক অবস্থার খোঁজ নেওয়ার জন্য। নার্সের সাথে কথা বলে ফোন করল বাড়িতে, সবাইকে খুশির খবরটা দেওয়ার জন্য।

চাঁদনী, নওয়াজ আর মরিয়ম খাতুন ততক্ষনে নতুন অতিথিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে। চাঁদনী বাচ্চাকে কোলে নিয়ে তানিমের কাছে গিয়ে বলল, “ভাইয়া, তুমি এখন একবার কোলে নাও।”

নম্রতাকে কেবিনে শিফট করা পর্যন্ত সবাই হাসপাতালেই ছিল। নম্রতার সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার পর চাঁদনী ওর শ্বাশুড়িকে বলল, “মা, আপনি আর তানিম ভাই এখানেই থাকুন। আমি বরং বাড়ি যাই। দুপুরের খাবার নিয়ে আবার আসব।”

“কিন্তু তোমার তো কলেজ যেতে হবে।”

“দুই একদিন কলেজে না গেলে তেমন কিছু হবে না মা। আমি ম্যানেজ করে নেব।”

ফেরার পথে চাঁদনী কিছুক্ষন উশখুশ করে নওয়াজকে বলল, “আমিও বেবি নিতে চাই।”

নওয়াজ অবাক হয়ে বলল, “কী বলছ তুমি? এখন বেবি? তোমার এমবিবিএস শেষ হতে এখনও প্রায় দুবছর বাকি। এখন বেবি নিলে তোমার পড়াশোনার কী হবে?”

“কিছুই হবে না। আমাদের বিয়েটা তো আগে হয়েছে। অথচ ওরা আগে বাবা-মা হয়ে গেল। আমারও বাচ্চা চাই।”

“এটা ছেলেমানুষী করার সময় নয় চাঁদনী। আল্লাহ চাইলে অনেক সময় আছে আমাদের হাতে। এখন বাচ্চা নিলে দুদিক সামলানো তোমার জন্য অনেক কঠিন হয়ে যাবে। তাছাড়া তোমার তো ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার।

“জানি কঠিন হবে, কিন্তু আমি সামলে নেব ইনশাআল্লাহ। তাছাড়া আপনি আছেন, মা আছেন। আপনারা পাশে থাকলে ততটাও সমস্যা হবে না আশা করি। প্লিজ আপনি রাজি হয়ে যান।”

“ভেবে কথা বলো চাঁদনী। এখন ঝোঁকের মাথায় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে পরে সেটার জন্য আবার আফসোস করবে নাতো?”

“মাথা খারাপ আপনার? মা হতে পারাও আল্লাহর তরফ থেকে কত বড় একটা নেয়ামত, আমি কিনা সেটার জন্য আফসোস করব? কখনও নয়। আমার পাশে আপনি থাকলে সব ঠিক হবে ইনশাআল্লাহ। শুধু ক্যারিয়ারের জন্য আমি মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে চাই না প্লিজ।”

নওয়াজ ভেবে যাচ্ছিল তখনও। চাঁদনী আবার প্রশ্ন করল, “কী হলো? আপনি রাজি তো?”

“তুমি যখন চাইছ, রাজি না হয়ে তো উপায় নেই।”

চাঁদনী হাসল। আদুরে স্বরে বলল, “আপনি অনেক ভালো।”

নওয়াজও হেসে ফেলল ওর সাথে। রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করে, চাঁদনীকে টেনে নিল নিজের কাছে। কপালের মাঝখানে ছোট্ট করে একটা চুমু দিয়ে আবার গাড়ি স্টার্ট দিল।

ওদের দুজনের চোখেই তখন স্বপ্ন। সুন্দর আগামীর স্বপ্ন।

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে