নিভৃত রজনী পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
170

নিভৃত রজনী
| ২৫ | (১৪০০+ শব্দ)

নম্রতা এসে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়াল এককোনে। হঠাৎ করেই কেন জানি ওর ভয় লাগছিল খুব।

সবার সামনেই নম্রতার মতামত জানতে চাওয়া হলো। জীবনে এতটা নার্ভাস আগে কখনও লাগেনি নম্রতার। শহুরে স্মার্ট মেয়ে ও। মাঝে মাঝে মরিয়ম খাতুনের সাথে মজা করে বলতো, “মা, সবসময় পাত্রপক্ষ পাত্রী দেখতে আসে। কিন্তু আমার বেলায় হবে উলটো। আমি নিজে যাব পাত্রকে দেখতে।”

এতটা ডেস্পারেট ছিল সে। অথচ আজ কিনা সামান্য একটু মত জানাতে হাত-পা কাঁপছে। তানিম তালুকদার নামের লোকটা সামনে বসে আছে বলেই কি এতটা নার্ভাস লাগছে!

কিছুক্ষন চুপ করে থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে নম্রতা জানাল, মুরুব্বিরা যা সিদ্ধান্ত নেবে তাতে ওর কোনো আপত্তি নেই৷

তানিম বোধহয় এই কথাটুকু শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিল এতক্ষন ধরে। নম্রতা ওর কথা শেষ করার সাথে সাথেই উঠে দাঁড়াল তানিম। সবার আগেই বের হয়ে গেল রুম থেকে৷

নম্রতার সম্মতি পেয়ে মরিয়ম খাতুন আনন্দে প্রায় কেঁদেই ফেললেন। তিনি ভেবেছিলেন তার মেয়ে হয়তো মুখের উপরে না করে দেবে। মাঝখান থেকে বেচারি চাঁদনীর মনটা খারাপ হয়ে যাবে। কিন্তু তার বদমেজাজি মেয়েটা যে বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে সেটা তিনি কল্পনাও করেননি।

চাঁদনীকে নিজের রুমে ডেকে এনে ওর হাতদুটো ধরে বললেন, “তোমাকে যে কী বলে আমি ধন্যবাদ জানাব জানি না। আমার এই উড়নচণ্ডী, বদমেজাজি মেয়েটাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম এতদিন। তুমি আজ আমাকে নিশ্চিন্ত করলে।”

চাঁদনী মনে মনে বলল, “আমি কিছুই করিনি, আপনার মেয়ে নিজেই আমার ভাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।”

কিন্তু মুখে কোনো জবাব না দিয়ে শুধুই হাসল চাঁদনী৷

তারপরের দিনগুলো সবার প্রচন্ড ব্যস্তটায় কাটল। সাদমানের বিয়ের পরপরই তানিমের বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সাদমানের বিয়ের পরের সপ্তাহেই তানিমের বিয়ের কাজটাও সেরে ফেলা হবে। সবই যেহেতু ঠিকঠাক তাই অহেতুক দেড়ি করতে চাইছিল না কেউই৷

অবশেষে চলে এলো সেই বিশেষ দিনটি। বরযাত্রী এসে যখন কমিউনিটি সেটারে পৌঁছাল তখন প্রায় সন্ধ্যা। সব ফর্মালিটি সেরে বিয়ের কাজ কমপ্লিট করতে রাত প্রায় দশটা বেজে গেল। আর তার পরপরই নতুন বউ নিয়ে নিয়ে বরযাত্রীরা পুনরায় হলুদিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল।

৪০.
সাধারনত বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে মেয়েরা অন্য একটা জগতে বিচরণ করে। নতুন পরিবেশে কিভাবে মানিয়ে নেবে, একই কক্ষে নতুন একজন মানুষের সাথে কীভাবে এডজাস্ট করবে এসব নিয়ে চিন্তা হয়। পাশাপাশি সেই বিশেষ একজনের কথা ভেবে অদ্ভুত একটা শিহরণ বয়ে যায় মনের মধ্যে। আচমকা দমকা হাওয়ার মতো লজ্জারা এসে জড়ো হয় মনে।

কিন্তু নম্রতার ক্ষেত্রে পুরো ব্যাপারটাই কেমন একটা অন্যরকম হচ্ছে। নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া নিয়ে ওর যতটা না টেনশন হচ্ছে, তারচেয়ে অনেক বেশি টেনশন হচ্ছে হবু বরটিকে নিয়ে।

বিশেষ করে সেবার তালুকদার মঞ্জিল থেকে ফেরার দিনের সেই কথোপকথন মনে পড়লেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠছে। লোকটা বলেছিল, নম্রতার সাথে কথা বলতে সে বিরক্তবোধ করে। অর্থাৎ নম্রতা তার বিরক্তির কারণ। নম্রতা কি পারবে এই বিরক্তি ঘুচিয়ে তার ভালোলাগার কারন হয়ে উঠতে? এই চিন্তাতেই কেটে গেল নম্রতার পুরোটা সময়।

বিয়ে ঠিক হওয়ার পর সেই যে হলুদিয়া থেকে ফিরল নম্রতা, তারপর দেখা হওয়া তো দূরের কথা, সামান্য সময়ের জন্য মুঠোফোনে তার কন্ঠটাও শোনা হলো না। নম্রতা বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকল। একবার কয়েক সেকেন্ডের জন্য ফর্মালিটি করে হলেও হয়তো কল আসবে নির্দিষ্ট ফোন নাম্বারটি থেকে। কিন্তু না, ওর সকল আসা ধূলিসাৎ করে দিয়ে অপরপক্ষ একেবারেই নিস্পৃহ হয়ে রইল। বিয়ের দিন সকালে হঠাৎ নম্রতার মনে হলো, কোনো ভূল হয়ে যাচ্ছে না তো!

বিয়ের আগেই এত এত তিক্ততা ওর প্রতি লোকটার। বিয়ের পরে কি সেটা আদৌ কমবে? নাকি সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সেই তিক্ততা আরও বাড়বে?

একরাশ মনখারাপ আর হতাশা নিয়ে বিয়ের দিন সকালের নাস্তা করে চাঁদনী আর নিকিতাকে সাথে নিয়ে পার্লারে গেল নম্রতা৷ তারপরে সারাদিন কোথা থেকে যে চলে গেল, টেরই পেল না নম্রতা। এইপ্রকার ঘোরের মধ্যেই ছিল ও সারাদিন। ওর সেই ঘোর কাটল কমিউনিটি সেন্টারে বসে। আশেপাশের সবাই তখন বলাবলি করছে, “বর এসে গেছে, বর এসে গেছে…।”

বিয়ে পড়িয়ে যখন তানিম আর নম্রতাকে পাশাপাশি বসানো হলো, তখনও নম্রতার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে সত্যিই বিয়েটা হয়ে গেছে।

বিদায়ের সময় নম্রতা মাকে আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদল। কাঁদলেন মরিয়ম খাতুনও।

ফেরার পথে গাড়িতে বসেও একটা কথা হলো না সদ্য বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর। সারারাত জার্নি করে শেষ রাতের দিকে তালুকদার মঞ্জিলে পৌঁছাল বরযাত্রীরা।

সারাদিনের ধকল আর সারারাত নির্ঘুম থেকে জার্নি করে নম্রতার শরীর ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসতে চাইছিল। গাড়ি থেকে নামার সময় তাই বেখেয়ালেই শাড়িটা বেঁধে গিয়েছিল জুতোর সাথে। গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে যেতে দাত খিঁচে চোখ বন্ধ করে ফেলল নম্রতা। এইবার বুঝি মানসম্মান সব গেল।

কিন্তু পড়ে যাওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে ওকে ধরে ফেলল কেউ। চোখ খুলে তাকাল নম্রতা। তানিমের চোখদুটো তখন ওর দিকেই স্থির। শক্ত করে সে ধরে আছে নম্রতাকে। কয়েক সেকেন্ডে নম্রতা ধাতস্থ হতেই ওকে ছেড়ে দিল তানিম। খুব ক্ষীন কন্ঠে, যেন অন্য কেউ শুনতে না পায় এমনভাবে বলল, “সাবধানে নামো।”

নম্রতা ততক্ষনে অন্য কোনো জগতে হারিয়ে গেছে। বিশেষ মানুষটির একটু ছোঁয়া আর একটুখানি কথা ওর মনের মধ্যে দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল।

নম্রতাকে তানিমের রুমে নিয়ে গেল চাঁদনী। নম্রতাকে খাটের এককোনে বসিয়ে বলল,
“এখন থেকে এটাই তোমার রুম। তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। এইসব ভারী শাড়ি গয়না চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি তোমার জন্য নাস্তা নিয়ে আসছি।”

“আচ্ছা।”

চাঁদনী চলে গেল। নাস্তা নিয়ে ফিরে দেখল, নম্রতা মুখটা কাঁদকাঁদ করে চুলের জট ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। অগত্যা চাঁদনীই হেল্প করল ওকে। সবশেষে লাগেজ খুলে একটা সুতি কাপর এগিয়ে দিল নম্রতার দিকে।
“চেঞ্জ করে নাও এখন। সারারাত জার্নিতে ঘুমাতে পারনি। নাস্তা করে কিছুক্ষন ঘুমিয়ে নিও। এরপর নাহলে আর সুযোগ পাবে না। অনেক কাজ বাকী এখনও। বিকেলে সাদমান ভাইয়ের বউ সাজিয়ে দেবে তোমাকে। তারপর আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা সবাই নতুন বউ দেখতে আসবে। তাছাড়া আজ রাতেও তো ঘুমাতে পারবে না।”

শেষের কথাটুকু বলেই হেসে দিল চাঁদনী। ইঙ্গিতপূর্ন কথাটুকু বুঝতে অসুবিধা হলো না ওর। নিজেও তাই হেসে ফেলল চাঁদনীর সাথে।

তানিম যখন রুমে ঢুকল তখন নম্রতা কেবল নাস্তার প্লেট হাতে নিয়েছে। ওদের দিকে একপলক তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল তানিম। হাতঘড়ি, ওয়ালেট আর মোবাইলটা টেবিলের উপর রেখে আলমারির দরজা খুলে ট্রাউজার, টিশার্ট আর তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে গেল। ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে গোসল সেরে বের হয়ে পরিধেয় পোশাকগুলো বারান্দায় মেলে দিয়ে আবার ড্রেসিং টেবিলের সামনে এলো। তারপর ওয়ালেট আর মোবাইল নিয়ে বের হয়ে গেল ঘর থেকে।

তানিম যাওয়ার আগ পর্যন্ত পুরোটা সময় নম্রতা নাস্তার প্লেট হাতে আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকল। চাঁদনী এতক্ষন তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষন করছিল দুজনকেই। দুজনের হাবভাব দেখার পর চাঁদনী বুঝতে পারল যে দুজনের সম্পর্কটা এখনও একবিন্দুও স্বাভাবিক হয়নি।

নম্রতাকে এই বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করতে গিয়েও আবার থেমে গেল ও। কেবল বিয়েটা হয়ছে, এখনই বেচারিকে প্রশ্ন করে বিব্রত করার দরকার নেই। কিছুদিন সময় দিলে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে৷
চাঁদনী তাগাদা দিল,
“কই? জলদি খাও। খেয়ে ঘুমিয়ে নাও কিছুক্ষন। দুপুরে আমি তোমাকে ডেকে দেব। তার আগে আর কেউ তোমাকে ডিস্টার্ব করবে না।”

চাঁদনী চলে গেল। নম্রতা উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকাল। একদিন পরে বউভাত, তার আয়োজনেই ব্যাস্ত বাড়ির পুরুষরা। এককোনে বিশাল সাইজের চারটা গরু বেঁধে রাখা, তারপাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজন লোকের সাথে কথা বলছে সাখাওয়াত। নম্রতা চোখ সরিয়ে নিল। ওর অবচেতন মন অন্য কাউকে খুঁজছে। চোখদুটো এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে পেয়ে গেল তাকে।

গেটের দিকটায় দাঁড়িয়ে ছিল তানিম। হাত নেড়ে কিছু একটা বলছিল সামনের লোকগুলোকে। সম্ভবত ওই দিকটাতেই প্যান্ডেল করা হবে অতিথিদের খাবারের জন্য। নম্রতা দূর থেকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে তানিমের দিকে। ঠিক ততক্ষন পর্যন্ত দেখতে থাকল যতক্ষন তানিম ওর দৃষ্টির আড়ালে চলে না গেল।

গতকাল অব্দি মানুষটার প্রতি একটা স্ট্রং অ্যাট্রাকশন ছিল নম্রতার। কিন্তু আজ সেই অ্যাট্রাকশনের সাথে তীব্র একটা অধিকারবোধও ফিল করল। সে এখন ওর একান্তই আপনজন।

জানালা থেকে সরে এসে পুরো ঘরময় পায়চারি করল নম্রতা। এর আগেও ও দুইবার এসেছে তালুকদার মঞ্জিলে। প্রত্যেকবারই অদম্য একটা ইচ্ছে আসত ওর মনে। ইচ্ছে হতো একবার তানিমের রুমে ঢুকে দেখতে। কিন্তু সেই সাহসটা কখনোই করে উঠতে পারেনি নম্রতা। ভয় হতো, যদি কেউ দেখে ফেলে। যদি জিজ্ঞাসা করে, অচেনা একটা পুরুষের ঘরে ও কী করছে। তাহলে কী জবাব দেবে নম্রতা। ভয়ে আর সংকোচে তাই মনের ইচ্ছে মনের মধ্যেই চাপা দিয়েছিল নম্রতা।

অথচ আজ সময়ের সাথে সাথে ম্যাজিকের মতো সব বদলে গেল। অচেনা লোকটি এখন আর অচেনা নেই। এখন সে ওর স্বামী। এখন এই ঘরে দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা বসে থাকলেও কেউ কিছু বলতে পারবে না ওকে।

সারাঘরে কিছুক্ষন হেঁটে বিছানায় বসে ভেজা চুলের খোপাটা খুলে দিল নম্রতা। তারপর বালিশে গা এলিয়ে দিয়ে হারিয়ে গেল ঘুমের দেশে।

৪১.
বউভাতের পূর্বপ্রস্তুতির ব্যস্ততায় দুপুর পর্যন্ত রুমের বাইরেই ছিল তানিম। শাওয়ার নেওয়ার জন্য দুপুরের দিকে নিজের রুমে আসল ও। ঠিক সকালের মতোই হাতঘড়ি আর ওয়ালেট ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখতে গিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে বিছানার প্রতিবিম্বে চোখ আটকে গেল ওর। সাথে সাথেই পিছনে ফিরে বিছানার দিকে তাকাল ও। বহু বছরের পরিচিত রুমটাকে আজ হঠাৎ করেই অচেনা মনে হলো ওর।

বিছানার উপর আলুথালু হয়ে ঘুমিয়ে আছে নম্রতা। লম্বা আধভেজা চুলগুলো বিছানাময় ছড়ানো, কয়েকগাছি ছোট চুল গালে আর কপালে লেগে আছে। সদ্য ভাঁজভাঙা বেগুনি রঙের সুতি শাড়িতে ওকে দেখে তানিমের মনে হচ্ছিল, বিছানার উপরে সদ্য প্রস্ফুটিত ল্যাভেন্ডার ফুল সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

এই প্রথমবার তানিম পূর্ণদৃষ্টিতে তার বৈধ স্ত্রীর দিকে তাকাল। এবং আগের প্রত্যেকবারের মতো তাকানোর সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিল না। অনেকক্ষন ধরে তাকিয়েই থাকল। ঘুমন্ত মেয়েটিকে প্রচন্ড আদুরে লাগছিল ওর কাছে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
| ২৬ | (১২৯০+ শব্দ)

এই প্রথমবার তানিম পূর্ণদৃষ্টিতে তার বৈধ স্ত্রীর দিকে তাকাল। এবং আগের প্রত্যেকবারের মতো তাকানোর সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিল না। অনেকক্ষন ধরে তাকিয়েই থাকল। ঘুমন্ত মেয়েটিকে প্রচন্ড আদুরে লাগছিল ওর কাছে।

শাড়ি পড়ায় অনভ্যস্ত মেয়েটা, বোঝাই যাচ্ছে। হাঁটুর প্রায় কাছাকাছি উঠে গেছে শাড়ি। ফর্সা পা দুটো অনাবৃত। কোমরের দিকে গোজা কুচিগুলো এবড়ো থেবড়ো হয়ে আছে।

তানিম শাড়ি টেনে নম্রতার পা দুটো ঢেকে দিল। বিছানার পাশে ভাঁজ করে রাখা পাতলা কাঁথাটা মেলে নম্রতার পা থেকে গলা পর্যন্ত ঢেকে দিল। তারপর ওয়াশরুমে গেল গোসলের জন্য।

অপরিচিত জায়গাতে নম্রতার ঘুম কখনও গভীর হয় না। তানিম রুমে ঢোকার সাথে সাথেই ওর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে চোখ বন্ধ করেই শুয়ে ছিল ও।

ওয়াশরুমের দরজা আটকানোর শব্দটা কানে আসার সাথে সাথেই নম্রতা চোখ খুলে তাকাল।টের পেল, পুরো শরীর কাঁপছে ওর। আরেকটু হলে বোধহয় হৃদপিণ্ডের লাব-ডাব স্পন্দনও পৌঁছে যেত তানিমের কানে।

তানিম রুম থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত নম্রতা ঘুমের ভান করেই শুয়ে থাকল। তানিম চলে যাওয়ার পরে উঠে বসল ও। পুরো রুমে শাওয়ার জেলের একটা মিষ্টি স্মেল ছড়িয়ে আছে। নম্রতা জোরে নিশ্বাস টেনে সেই স্মেলটা ফিল করল।

ওর দুপুরের খাবারটাও রুমেই নিয়ে এলো চাঁদনী। নম্রতা তখন ফোনে মায়ের সাথে কথা বলছিল। চাঁদনী অপেক্ষা করল কথা শেষ হওয়ার। নম্রতা ফোনে কথা শেষ করে বলে উঠল, “ভাবি, তোমাকে শুধু শুধু আমার জন্য কষ্ট করতে হচ্ছে। আমি নিচে গিয়েও তো খেয়ে নিতে পারতাম।”

“এ আর এমন কী কষ্ট। নিচে সব মেহমানে গিজগিজ করছে। তাদের মধ্যে গিয়ে বসলে তুমি খেতে কম্ফোর্টেবল ফিল করতে না একদমই। সেজন্যই তোমার হাজবেন্ড স্পেশালি আমাকে বলে গেছে তোমার খাবারটা যেন ঘরেই দিয়ে যাই।”

নম্রতা মুচকি হেসে খাবারটা হাতে নিল। গায়ে কাঁথা দিয়ে দেওয়া, পাশে বসে তাকিয়ে থাকা, ওর সুবিধার কথা ভেবে চাঁদনীকে দিয়ে খাবার পাঠানো, এসবকিছু মিলিয়ে নম্রতার মাথায় পজিটিভ সিগন্যাল এলো। ওর প্রতি তানিমের রাগটা কি তাহলে আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে!

বিকেলে নম্রতাকে চাঁদনী নিজের রুমে নিয়ে গেল। সেখানে বসেই সাদমানের বউ রুশিতা সাজিয়ে দিল ওকে। সন্ধ্যার পরে পাড়া-প্রতিবেশী মহিলারা সবাই দেখতে এলো নতুন বউকে। রাতের খাবার খাওয়ারও অনেক পরে তানিমের রুমে নিয়ে যাওয়া হলো নম্রতাকে। রুমের মধ্যে ঢুকেই নম্রতার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। পুরো রুম জারবেরা, গোলাপ আর গাদা দিয়ে সাজানো হয়েছে। বিছানাতেও খুব সুন্দর করে ফুলের পাপড়ি দিয়ে হার্ট শেইপ করা হয়েছে।

নম্রতাকে বিছানায় বসিয়ে রেখে একে একে সবাই চলে গেল রুম থেকে। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলল, টিক-টিক। একসময় সেটা বারোটার ঘর পেরিয়ে গেল। একভাবে বসে থাকতে থাকতে নম্রতার পা-দুটো ব্যাথায় টনটন করে উঠল। একসময় যখন আর বসে থাকতে না পেরে উঠে দাঁড়াবার কথা ভাবল, ঠিক তখনই ঘরে ঢুকল তানিম। রাত তখন একটারও বেশি বাজে। তানিমের ঘরে ঢোকার শব্দ শুনে নম্রতা নড়েচড়ে বসল। কিন্তু ওর উপস্থিতিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তানিম একবারের জন্য ওর দিকে ফিরেও তাকাল না। বরং নম্রতা খাটের যেদিকটায় বসে ছিল, তার অপরপাশ থেকে খাটে উঠে দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ল।

নম্রতা তারপরেও কিছুক্ষন বসে থাকল। এরপর একসময় বুঝতে পারল, তানিম উল্টোদিকে মুখ করেই ঘুমিয়ে পড়েছে। এবার নম্রতা উঠে দাঁড়াল, ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে সমস্ত অর্নামেন্টস খুলে ফেলল, ওয়াশরুমে গিয়ে পড়নের টকটকে লাল জামদানিটা খুলে নরমাল একটা সুতি শাড়ি পড়ে বের হলো। আবার আয়নার সামনে গিয়ে খোপায় গোজা ফুলগুলো খুলে রাখল। আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল টপটপ করে পানি পড়ছে। ইচ্ছে করেই কান্নাটা আর আটকে রাখল না নম্রতা।

দুজনের সম্পর্কটা যেমনই হোক, আজকের রাতটা নিয়ে কিছুটা হলেও এক্সপেকটেশন ছিল নম্রতার। বিশেষ করে তানিমের দুপুরের আচরণের পর ভেবেছিল সবকিছু কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হয়েছে৷ কিন্তু না, কিছুই স্বাভাবিক হয়নি। বরং পুরো পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে গেছে ওর জনে।

বিয়ের পরে এই প্রথমবার নম্রতা উপলব্ধি করতে পারল, নাকউঁচু স্বভাবের ওই নিষ্ঠুর ছেলেটির মন জয় করা খুব একটা সহজ হবে না ওর জন্য।

৪২.
তানিম উল্টোদিকে মুখ করে শুয়ে ছিল। নম্রতার আর সহ্য হলো না এই নীরবতা। তানিমের হাত ধরে টেনে ওকে বসাল নম্রতা। তানিম ওর দিকে তাকিয়ে বিরক্ত স্বরে বলল, “সমস্যা কী তোমার? এভাবে টেনে তুলেছ কেন?”
“কথা আছে আপনার সাথে আমার।” জেদি স্বরে জবাব দিল নম্রতা।
“কিন্তু আমার কোনো কথা নেই তোমার সাথে। তোমার কি মিনিমাম লজ্জাটুকুও নেই? আগেই তো একবার বলেছি, তোমার সাথে কথা বলতে বিরক্তবোধ করি আমি।”

“তাহলে আমাকে বিয়ে কেন করেছেন।” প্রশ্নটা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল নম্রতা।

তানিমের কন্ঠেও তখন তেজ, “প্রতিশোধ নিতে।”
“প্রতিশোধ?” অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল নম্রতা।

“হ্যা, প্রতিশোধ। শুধু অনিচ্ছাকৃত একটু স্পর্শের জন্য একদিন আমাকে চরিত্রহীন উপাধি দিয়েছিলে তুমি। তাই সুযোগ পেয়ে সেটার প্রতিশোধ নিলাম। একটুখানি ছোঁয়া লেগেছিল বলে যা নয় তাই বলে অপমান করেছিলে একদিন৷ এখন তুমি আমার স্ত্রী হওয়া স্বত্বেও তোমাকে আমি ছোঁব না। দিনের পর দিন একই ছাদের নিচে থাকব আমরা কিন্তু আমাদের মধ্যে থাকবে যোজন যোজন দূরত্ব। সবার সামনে আর পাঁচটা স্বাভাবিক সুখী স্ত্রীর মতো অভিনয় করতে হবে তোমাকে৷ কিন্তু আদতে পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী নারীটি হবে তুমি, যাকে তার স্বামী স্পর্শ অব্দি করেনি। এভাবে তোমার প্রতি অবহেলা করে অপমানের শোধ তুলব আমি।”

কঠিন স্বরে কথাগুলো বলে আবারও শুয়ে পড়ল তানিম। নম্রতা এবার শব্দ করে কেঁদে ফেলল। ওর ভাবনাই তাহলে ঠিক ছিল। তানিম শুধু অপমানের প্রতিশোধ নিতে বিয়েটা করেছে।

নম্রতার কান্নার শব্দ শুনে উচ্চস্বরে ওকে একটা ধমক দিল তানিম। ঠিক তখনই চোখ খুলে তাকিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল নম্রতা। এসি চলা স্বত্ত্বেও পুরো শরীর ঘেমে গেছে ওর। নম্রতা চারদিকে তাকিয়ে দেখল ও তালুকদার মঞ্জিলে নেই। বরং ওর নিজের বাসায় নিজের সেই পুরোনো রুমে আছে। পরক্ষনেই মনে পড়ল নম্রতার, কাল বিকেলে বৌভাতের পরে তানিমকে নিয়ে ওদের বাসায় এসেছে নম্রতা।

তারমানে এতক্ষন স্বপ্ন দেখছিল ও। নম্রতা ওড়না দিয়ে মুখ আর গলার ঘাম মুছল। ঠিক তখনই ফজরের আজানের শব্দ কানে এলো ওর। পাশে তাকিয়ে দেখল তানিম নেই। ওয়াশরুম থেকে আসা শব্দ শুনে বুঝল, তানিম সেখানেই আছে।

বেডসাইড টেবিলে রাখা গ্লাসভর্তি পানি ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল নম্রতা। তারপর আবার বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। স্বপ্নটা এত বেশি জীবন্ত ছিল যে এখনও ওর বুক ধড়ফড় করছে। মা বলে, শেষরাতের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। এই স্বপ্নটাও কি তাহলে সত্যি হবে?

চোখ বন্ধ অবস্থতেই নম্রতা টের পেল, তানিম ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে। কিছুক্ষিন পরেও যখন তানিম খাটে এল না, তখন নম্রতা আবার চোখ খুলে তাকাল। রুমের এককোনে জায়নামাজ বিছিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করছিল তানিম তখন। তানিম নামাজ পড়ে উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই নম্রতা আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। তানিম খাটে এসে ঠিক আগের মতোই দুরত্ব বজায় রেখে একপাশে শুয়ে পড়ল৷ এরপর কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেল। কিন্তু পরের সময় টুকু নম্রতার আর এক ফোঁটাও ঘুম হলো না।

নম্রতার ভেতরে যে ঠিক কী হচ্ছে সেটা ও কাউকে বোঝাতে পারবে না৷ সবার সামনে তানিম একেবারেই স্বাভাবিক। নরমালি নতুন বিবাহিত স্ত্রীর সাথে মানুষ যেমন ব্যাবহার করে ঠিক তেমনই আচরণ তার। কিন্তু যখন শুধু দুজনে একত্রে থাকে তখন যেন ওরা দুই গ্রহের বাসিন্দা।

শেষে সকাল সকালই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল নম্রতা। নিচে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল মরিয়ম খাতুন, টুলুর মা আর চাঁদনী মিলে সকালের নাস্তার যোগার করছে।

ওদের সাথে টুকটাক কথা বলার পরে আবার নিজের রুমে ফিরে এলো নম্রতা।

নম্রতা আর তানিম, তালুকদার মঞ্জিলে ফিরল পরেরদিন সকালে।

তারপর কেটে গেল প্রায় মাসখানেক। নতুন পরিবেশে নম্রতার দিনগুলো খুব একটা খারাপ কাটছিল না। সারাদিন পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে গল্প করে আর টুকটাক কাজ করে সময় চলে যায়। নম্রতার সবচেয়ে বেশি সখ্যতা হয়েছিল সাদমানের বউ রুশিতার সাথে। কারণ দুজনে প্রায় সমবয়সীই ছিল। তবে বেশিদিন রুশিতা ওদের সাথে থাকতে পারল না। সাদমানের জবের পোস্টিং যেখানে হয়েছে, সেখানে নিয়ে গেল রুশিতাকে।

সব ঠিক থাকলেও তানিমের সাথে সম্পর্কটা ভীষণ রকম নিস্পৃহ রয়ে গেল ওর। ইদানিং কী একটা নতুন ব্যবসা শুরু করেছে তানিম৷ তাই বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরে বাইরেই থাকে। সারাদিন পর রাতে যেটুকুও বা দেখা সাক্ষাত হয়, কিন্তু কথা হয় না একদমই।

তানিম রুমে এসে উলটো দিকে মুখ করে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে৷ আর খাটের অপরপাশে নম্রতা একটু কথা বলার জন্য ছটফট করতে থাকে। সম্পর্কটা আর ঠিক কতদিন এমন বোবা থেকে যাবে নম্রতা জানে না। বিবাহিত জীবনের এই একমাসে অন্তত একশোবার নম্রতা আগ বাড়িয়ে কথা বলার কথা ভেবেছে। কিন্তু তানিমের ওই কঠোর আর গম্ভীর মুখখানার দিকে তাকিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারেনি।

৪৩.
ক্লায়েন্টদের সাথে দেড়ঘন্টার একটা লম্বা মিটিং সেড়ে নওয়াজ সাইলেন্ট মোডে থাকা ফোনটা হাতে নিল এবং অবাক হয়ে গেল। চাঁদনীর নাম্বার থেকে তিনটা মিসডকল।

যে মেয়ে সহজে একটা টেক্সট পর্যন্ত করে না, সে কল দিয়েছে, এটা নওয়াজের বিশ্বাস হতে চাইল না। পরের মোমেন্টে ওর মাথায় নেগেটিভ চিন্তাটাই এলো। চাঁদনীর কোনো বিপদ হলো না তো?

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
| ২৭ | (১৫৮০+ শব্দ)

যে মেয়ে সহজে একটা টেক্সট পর্যন্ত করে না, সে কল দিয়েছে, এটা নওয়াজের বিশ্বাস হতে চাইল না। পরের মোমেন্টে ওর মাথায় নেগেটিভ চিন্তাটাই এলো। চাঁদনীর কোনো বিপদ হলো না তো?

নওয়াজ সাথে সাথেই কলব্যাক করল, এবং কয়েকবার রিং বাজার সাথে সাথেই রিসিভ করল চাঁদনী,

“আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কী ব্যাপার চাঁদনী? সব ঠিকঠাক আছে তো?”
“কেন? ঠিকঠাক থাকার কি কথা ছিল না?” নওয়াজের প্রশ্নে উত্তরে পালটা প্রশ্ন করল চাঁদনী।

“না মানে, তুমি তো কখনও কল করো না তাই…।”

“কখনও করি না বলে এখন করা যাবে না, এমন তো কোনো কথা নেই। কল করায় কি আপনার খুব সমস্যা হয়ে গেল?”

“ধুর! সবসময় ঝগড়া করার জন্য একদম মুখিয়ে থাক। আমি কখন বললাম যে আমার সমস্যা হচ্ছে!”

চাঁদনী হেসে ফেলল এবার।
“আপনি তো আর আমার খোঁজখবর নেবেন না, তাই আমাকেই কল দিতে হচ্ছে।”

নওয়াজ বিড়বিড় করে বলল, “খোঁজ খবর নেওয়ার সুযোগটা পাচ্ছি কই। কথা বলতে গেলেই তো রেগে রেগে আগুন হয়ে যাও।”

চাঁদনী কথাগুলো শুনেও না শোনার ভান করে জিজ্ঞাসা করল, “কী বললেন?”

“কিছু না। অনেকদিন হয় বাসায় আসো না। আজ আসবে?”

“কেউ যদি নিতে আসে তাহলে যাব।”

নওয়াজের মনে হলো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। উচ্ছ্বসিত স্বরে ও বলল, “বিকেলে রেডি থেক তাহলে, আমি নিতে আসব।”

নওয়াজ ওর কথা রাখল। বিকেলেই নিতে এলো চাঁদনীকে। চাঁদনী ফিরে প্রথমেই গেল মরিয়ম খাতুনের রুমে। মরিয়ম খাতুন চাঁদনীকে পেয়েই অভিযোগের ডালি খুলে বসলেন,
“চাঁদনী, তুমি মনেহয় ভুলেই গেছ যে তোমার একটা শ্বশুড়বাড়ি আছে। তুমি বলেছিলে পড়াশোনায় কন্সেন্ট্রেশন রাখার জন্য তুমি হলে থাকতে চাও। আমি তাতে আপত্তি জানাইনি। কিন্তু তাই বলে আমাদের একদম ভুলে যাবে? গত দুই সপ্তাহ ধরে কোনো খোঁজ নেই তোমার।”

“আমি তো আপনাকে ফোন করি মা। আপনি ইদানিং আমার ফোনও ধরছেন না।”

“কেন ধরব? শুধু ফোন করলেই সব দায়িত্ব শেষ? আমি খুব রেগে আছি তোমার উপর।”

“খুব ভুল হয়ে গেছে মা। আসলে পড়ার এত প্রেসার যাচ্ছিল। এখন থেকে আর এমন হবে না।”

“শোনো মা, তোমার ভালোর জন্যই বলছি। পড়াশোনা করছ করো, তাই বলে বাকীসব হেলা করো না। সংসারের দায়িত্ব আমি তোমার উপর চাপিয়ে দিতে চাইছি না। শুধু এতটুকু বলব, আমার ছেলেটার ভালো থাকা না থাকাটাও কিন্তু তোমার সাথেই জড়িয়ে আছে।”
ইঙ্গিতটা ধরতে পারল চাঁদনী।

শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলে রুমে এসে চাঁদনী দেখল নওয়াজ ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। চাঁদনী বোরখা চেঞ্জ করে রান্নাঘরে গেল। মরিয়ম খাতুনের আপত্তি স্বত্ত্বেও নিজের হাতে সবার জন্য সন্ধ্যার নাস্তা বানাল। অনেকদিন পর হলের একঘেয়ে লাইফ থেকে মুক্তি পেয়ে সময়টা আনন্দেই পার হলো।

রাতে ঘুমানোর সময় আজ আর বিছানার মাঝখানে কোলবালিশ রাখল না চাঁদনী। অনেক হয়েছে নওয়াজকে শাস্তি দেওয়া৷ দুজনের মধ্যের এই দুরত্বটা আজকাল ওর নিজেরই ভালো লাগছে না।

নওয়াজের বোধহয় ব্যস্ততা যাচ্ছে খুব। রাতের খাবার খেয়ে আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেছে ও।

নওয়াজ বিছানায় এলো বেশ দেরি করে। চাঁদনী তখন অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়েই যাচ্ছিল প্রায়৷ নওয়াজ ঘুমাতে এসে খাটের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“চাঁদনী, আজকে তুমি দুজনের মধ্যে কোলবালিশ রাখতে ভুলে গেছ মনেহয়।”
চাঁদনী উঠে বসে কটমট করে তাকাল নওয়াজের মুখের দিকে। আগ বাড়িয়ে সম্পর্ক সহজ করতে চাওয়াটা মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে৷ এই মহাবদ ছেলের সাথে দুরত্ব বজায় রাখাই ভালো। কোনো কথা না বলে চাঁদনী বিছানার পাশে থেকে কোলবালিশ নিয়ে একেবারে মাঝ বরাবর দিয়ে দিল। তারপর উলটোপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল আবার৷

নওয়াজ খাটে উঠে এক ঝটকায় কোলবালিশ তুলে ফ্লোরে ফেলে দিল। তারপর বলল,
“উঠে বসো চাঁদনী। তোমার সাথে আমার কথা আছে।”

নওয়াজের কন্ঠে কিছু একটা ছিল। চাঁদনী তাই কোনো উত্তর না দিয়ে উঠে বসল। নওয়াজের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
“কী কথা?”
“এভাবে আর কতদিন চলবে?”
“কীভাবে?” আবারও প্রশ্ন চাঁদনীর।
“চাঁদনী, তুমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছ আমি কী মিন করতে চাইছি।”
চাঁদনী এবার কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল, “আমি তো আজ আমার মতো করে চেষ্টা করতে গিয়েছিলাম কিছুক্ষন আগে৷ এমনকি আজ এই বাড়িতে আমি নিজেই সেধে এসেছি। আর ঠিক কী করতে পারি আমি? আপনি একটু বলে দিন।”
“বুঝলাম, তুমি চেষ্টা করছ। কিন্তু কী লাভ এসব করে? আজকের রাতের কিছুটা সময় হয়তো ভালো কাটবে আমাদের। তারপর কাল থেকে আবার সব আগের মতো। দিনের পর দিন চলে যাবে তুমি একটা কল পর্যন্ত করবে না। আমি কল দিলেও কথা বলবে রেগে রেগে। শুধু কয়েকদিন পরপর ইন্টিমেট হওয়া ছাড়াও হাজবেন্ড ওয়াইফের মধ্যে আরও অনেক কিছুই থাকে। ফিজিক্যালের সাথে সাথে ইমোশোনাল অ্যাটাচমেন্ট থাকাটাও জরুরি। আচ্ছা, তুমিই বলো। আমাদের মধ্যে কি তেমন কিছু আছে?

রুমের মধ্যে আবারও নেমে এলো শ্মশানের নীরবতা। নওয়াজ আবারও বলল, “কিছু তো বলো চাঁদনী। এভাবে আর কতদিন চলবে?”

“আমি কী করব বলুন তো? চেষ্টা করলেও কেন জানি আমি ইজি হতে পারি না একদম। এখনও মনের মধ্যে সংশয় কাজ করে৷ সত্যিই আপনি মন থেকে মেনে বিয়েটা করেছেন তো! একসময় আপনি নিজেই বলেছিলেন, আপনার প্রতি আমার ফিলিংসগুলোকে যেন বাড়তে না দেই। তারপর আবার সেই আপনিই স্বেচ্ছায় বিয়েটা করলেন। নিজে থেকে আপনার কাছে আসতে গেলেও নিজেকে কেমন হ্যাংলা বলে মনে হয়। আপনার সেই প্রথমদিককার বলা কথাগুলো মনে হয়ে যায়। তখন ভাবি আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করছি না তো। আমার নেচারই এরকম। একবার নেগেটিভিটি মনের মধ্যে চলে আসলে সেটাকে খুব সহজে ভুলতে পারি না। বিশ্বাস করুন, আমি চেষ্টা করি। তারপরেও কেমন জানি সব ওলটপালট হয়ে যায়। আমি কি করব, আপনিই বলে দিন।”

বলতে বলতে প্রায় কেঁদেই ফেলল চাঁদনী। নওয়াজ আরেকটু কাছে এগিয়ে এসে চাঁদনীর ডানহাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল। কাতর স্বরে বলল,
“আমি প্রথমে ভুল করেছিলাম চাঁদনী৷ সেই ভুলের জন্য আমার মধ্যে সারাজীবনই হয়তো আফসোস থেকে যাবে৷ প্রথমবার যেদিন তোমার সাথে দেখা হলো, সেদিনই মনের মধ্যে তোমার জন্য একটা সফট কর্ণার তৈরি হয়েছিল। প্রত্যেকদিন তোমাকে চোখের সামনে দেখা একটা অভ্যাসের মতো হয়ে গিয়েছিল। মাঝেমাঝে তুমি তোমাদের বাড়ি যেতে। তখন কিছুটা বুঝতে পারতাম তোমার শূন্যতা। এরপর সেদিন যখন রুমে গিয়ে আকরামের সামনে তোমাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখলাম, সেদিন যে কী তোলপাড় আমার মধ্যে হয়ে যাচ্ছিল সেটা তোমাকে আমি বলে বোঝাতে পারব না। তোমার সেই কান্নাভেজা মুখ দেখেই আমি প্রথমবার রিয়েলাইজ করেছিলাম, আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি।”

কিছুক্ষনের জন্য থামল নওয়াজ। তারপর আবার বলল, “আগে যা হয়ছে সব ভুলে যাও চাঁদনী। চলো আমরা আবার নতুন করে শুরু করি৷ যতটুকু দুরত্ব আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে, সেটা স্বাভাবিক করার জন্য আমাদের দুজনেরই চেষ্টা করতে হবে।”

চাঁদনী বলল, “আমিও চাই, সেই চেষ্টাটাই করতে।”

“তাহলে আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রথম ধাপটা আমরা শুরু করে দিতে পারি কালই। কী বলো?”

“কী করতে হবে আমাকে?”

“কালই তোমার জিনিসপত্র সব নিয়ে আমাদের বাসায় শিফট হয়ে যাও।”

চাঁদনী থতমত খেয়ে গেল। মোক্ষম চালটাই চেলেছে নওয়াজ। পালটা যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করল চাঁদনী এবার।

“মায়ের সাথে তো আগেই আমার কথা হয়েছে এই ব্যাপারে। হলে থেকে আমি পড়াশোনায় যেমন কনসেনট্রেশান দিতে পারব, বাড়িতে থেকে সেটা…।”

“কেন? তোমার কী মনে হয়? তুমি বাড়িতে থাকলে আমি সারাক্ষন তোমাকে ডিস্টার্ব করব?”

চাঁদনী হতভম্ব হয়ে বলল, “আশ্চর্য! আমি সেটা কখন বললাম?”

“সবকিছু বলে দিতে হয় না চাঁদনী। কিছু ব্যাপার নিজে থেকেই বুঝে নেওয়া যায়। আমার বাবা ইন্ট্রোভার্ট টাইপের মানুষ তাই সবার সাথেই কথা কম বলে, নম্রতা এখন আর এখানে নেই। মা আছে, তবে সে তোমার পড়াশোনা নিয়ে যথেষ্টই সিরিয়াস। বাকী রইলাম শুধু আমি। অর্থাৎ তুমি আমার জন্যই এই বাড়িতে থেকে পড়তে চাইছ না। তোমার কী মনে হচ্ছে? এই বাড়িতে থাকলে সময়ে অসময়ে আমি তোমার পড়াশোনার ক্ষতি করে তোমার সাথে রোমান্স করতে চাইব?”

শেষের কথাটুকুতে চাঁদনী লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল। বুঝল, ও ধরা পড়ে গেছে নওয়াজের কাছে। যার থেকে দুরত্ব বজায় রাখতে এমন পালিয়ে বেড়ানো, অবশেষে সে হাতেনাতে পাকড়াও করে ফেলেছে ওকে। চাঁদনী মাথা নিচু করে ভাবতে লাগল, এই পরিস্থিতিটা ঠিক কীভাবে সামাল দেবে।

চাঁদনীর থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে নওয়াজ বলল, “সত্যিই এটাই তাহলে কারণ। ওকে ফাইন, আমিই যদি সমস্যা হই, তাহলে আমার রুমে ওঠার দরকার নেই। বিয়ের আগে প্রথমবার যেমন আলাদা রুমে উঠেছিলে, সেভাবেই আবার ওঠো। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আমি কখনও তোমার রুমে উঁকি পর্যন্ত দেব না। মাঝে মাঝে শুধু একটু সময় দিলেই হবে আমাকে। আর তাতেও যদি তোমার আপত্তি থাকে, তাহলে আমি প্রমিস করলাম, তুমি ডাক্তার না হওয়া পর্যন্ত আমি তোমাকে স্পর্শও করব না।”

শেষের কথাটুকু নওয়াজ একটু জোর দিয়েই বলল। চাঁদনী আঁতকে উঠল। ডাক্তার না হওয়া পর্যন্ত স্পর্শ করবে না মানে! সে তো এখনও বহু বছরের ব্যাপার। এই যে, ঠিক এই মুহূর্তটাতেই তো চাঁদনী ব্যাকুল হয়ে আছে নওয়াজের এলোমেলো ছোঁয়াগুলো পাওয়ার জন্যে। ডাক্তার হওয়া তো এখনও অনেকগুলো বছরের ব্যাপার। এতদিন নওয়াজ দূরে থাকলে তো ও মরেই যাবে। চাঁদনী এবার চাপা গলাতেই জোরে বলে উঠল, “না!”

“না মানে?” নওয়াজ প্রশ্ন করল।

আবারও অপ্রস্তুত হয়ে গেল চাঁদনী। নওয়াজের যেই কথায় আপত্তি জানিয়ে না বলেছিল, সেটা এড়িয়ে গেল। পুরোপুরি কোনঠাসা হয়ে সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হলো এবার।

“মানে আপনার ধারনা পুরোপুরি ভুল। আমি মোটেও আপনার জন্য হলে থাকছি না।”

“আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।”
“ওকে। আমি কালই এই বারিতে শিফট হব।”

চাঁদনীর উত্তর শুনে নওয়াজকে ততটাও খুশি বলে মনে হলো না। ও বোধহয় আরেকটু ক্লারিটি চাইছিল। সেজন্যই আবার বলে উঠল,
“ওকে। তাহলে আম্মুকে বলে তোমার রুমটা পরিস্কার করে রাখতে বলব কালই৷”

চাঁদনীর নিচু মাথা লজ্জায় আরও নুয়ে গেল
“তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি আপনার রুমেই উঠব।”

নওয়াজ এবার শব্দ করেই হাসল। এতক্ষনে অশান্ত মনটা শান্ত হয়েছে ওর। আপাতত চাঁদনী বাসায় আসতে রাজি হয়েছে এটাই অনেক। নওয়াজ আবার অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল,
“তো ম্যাডাম। আপনার কোলবালিশের ব্যারিকেড তো আমি নিচে ফেলে দিয়েছি। এবার কি আমরা একটু কাছাকাছি আসতে পারি?”

চাঁদনী চুপ করে বসে থাকল। নীরবতাকে সম্মতির লক্ষন ধরে নিয়েই এগিয়ে গেল নওয়াজ। চাঁদনী থামিয়ে দিল ওকে। নিচু স্বরে বলল, “লাইটটা অফ করে আসেন প্লীজ।”

নওয়াজ আরেকধাপ এগিয়ে গিয়ে বলল, “উফ! জানো যে বলে কোনো লাভ হবে না। তারপরেই প্রত্যেকবার কেন যে একই কথা বলো তুমি।”

চাঁদনী বোধহয় আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। চতুর নওয়াজ সেটা বলার সুযোগটুকু দিল না। তার আগেই চাপা শীৎকারে ভারী হয়ে উঠল রুমের পরিবেশ৷

৪৪.
তানিমের ইদানীং ব্যস্ততা যাচ্ছে খুব। বিয়ে ঠিক হওয়ার পরেই নতুন ব্যাবসাটা শুরু করার সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল ও। এমনিতে আমবাগান, মাছের ঘের, গঞ্জের বাজারের স্টলগুলো আর শেয়ারে কয়েকটা ছোটখাট বিজনেস থেকে প্রত্যেক মাসে ওর যা লাভ হয় সেটা বেশিরভাগ সময়েই লাখ ক্রস করে।

তবুও আজকাল তানিম চেষ্টা করছে নিজের ইনকাম আরও বাড়ানোর জন্য। বিশেষ করে নম্রতাকে বিয়ে করার পরে। বিলাসবহুল পরিবেশে ছোট থেকে বড় হয়েছে সে। শ্বশুড়বাড়িতেও নিশ্চই সেরকম একটা পরিবেশই চাইবে সে৷ সেজন্যই আজকাল প্রানান্তকর চেষ্টা তানিমের।

ইদানিং ব্যাবসার কাজে কিছুটা ঘনঘনই ঢাকা যেতে হচ্ছে তানিমকে। গতকাল সকালেও ঢাকা গিয়েছিল ও। ফিরল তার পরেরদিন বিকেলে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে