নিভৃত রজনী
| ২ | (১৩৬০+ শব্দ)
তানিমের শিরা উপশিরা তখন দপদপ করছিল রাগে। ও আরেকবার পিছনে ফিরে তাকাল। তারপর গেটের বাইরে বেরিয়ে এলো।
অনেকক্ষন বাইরে কাটিয়ে তানিম যখন বাসায় ফিরল তখন সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। দুপুরে খাবার টেবিলে আবার দেখা হলো মেয়েটির সাথে। এবার বিস্তারিত জানা গেল তার সম্পর্কে।
মরিয়ম খাতুনের মেয়ে। নাম নম্রতা।
মরিয়ম খাতুন ওদের তিন ভাইবোনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন নম্রতাকে। এবার শান্ত মেজাজেই সালাম দিল নম্রতা। সাখাওয়াত সালামের জবাব দিল। চাঁদনীও সৌজন্য রক্ষার্থে দুএকটা কথা বলল। কিন্তু তানিম একবারের জন্য চোখ তুলেও তাকাল না।
দুপুরে খাওয়ার পরে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে গ্রামে ফেরার প্রস্তুতি নিল ওরা। যাওয়ার আগে তানিম এককোনে ডেকে নিল চাঁদনীকে। সাখাওয়াত যাতে শুনতে না পায় সেরকম নিচু গলায় বলল, “মরিয়ম আন্টির মেয়েটা কোন রুমে থাকে সেটা দুই মিনিটের মধ্যে খোঁজ নিয়ে জানা আমাকে।”
তানিমের কথা শুনে চাঁদনী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ভাইয়ের মুখের দিকে। অপরিচিত একটা মেয়ের রুমের হদিস চাইছে তার তানিম ভাই, এটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিল না। তানিম বলল, “এভাবে না তাকিয়ে জলদি যা বলছি কর। আমার হাতে বেশি সময় নেই। তোকে পরে সব বিস্তারিত বলব।”
চাঁদনী বলল, “খোঁজ নিতে হবে না। দোতলায় ডানদিকের প্রথম রুমটাতেই থাকে আপুটা। ওই রুম থেকেই কয়েকবার বের হতে দেখেছি ওনাকে।”
তানিম বিছানার পাশে রাখা ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে সোজা দোতলার দিকে চলে গেল। কাঙ্ক্ষিত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মধ্যমা এবং তর্জনী আঙুলের উলটো পিঠ দিয়ে আলতো করে টোকা দিল দরজায়। তারপর ব্যাগটা দরজার ঠিক সামনে রেখেই নিচে নেমে এলো। মরিয়ম খাতুনের থেকে বিদায় নিয়ে সাখাওয়াতকে নিয়ে বেরিয়ে এলো ওবাড়ি থেকে।
৩.
সার্কেলের কিছু ফ্রেন্ডদের সাথে কথা কাটাকাটির জন্য গতকাল রাত থেকেই নম্রতার মেজাজের পারদ চড়ে ছিল। আজ সকালে সেটা আরও একধাপ বেড়ে গেল। মর্নিং ওয়াক থেকে ফেরার পথেই ধাক্কা লাগল লোকটার সাথে। মুখে মিষ্টি কথা বললেও আসলে বদের হাড্ডি একটা। ও নাহয় মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ছিল বলে সামনের কিছু লক্ষ করেনি, কিন্তু সে তো দেখেশুনেই আসছিল। ইচ্ছে করেই আসলে ধাক্কাটা দিয়েছে বদ লোকটা। ধাক্কা দিয়ে আবার কী সুন্দর করে ক্ষমা চাওয়ার নাটকও করল।
অনেক চেষ্টার পর মেজাজটা একটু ঠান্ডা করে দুপুরে ডাইনিং রুমে গিয়েছিল লাঞ্চ করতে। বদমাইশ লোকটা সেখানেও হাজির। পরে মায়ের কাছে থেকে পরিচয় জানা গেল।
লোকটা বিকেলে নাকি চলে যাবে, এটা শোনার পরেই রুমে এসে দরজা লক করে দিয়েছে নম্রতা। ক্যারেকটারলেসটা না যাওয়া অব্দি আর দরজাই খুলবে না ও। কিন্তু রুমের মধ্যে একা সময় কাটছে না ওর। অন্যসময় হলে এতক্ষনে বন্ধুদের সাথে ভার্চুয়াল আড্ডায় মেতে ওঠা যেত, কিন্তু ফোনটাও সেই সকাল থেকে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। না, আজকেই একটা নতুন ফোন নিতে হবে।
নম্রতা রেডি হয়ে নিল। আগে রিতিমাদের বাসায় যেতে হবে, ওখান থেকেই সোজা শপিংমলে যাওয়া যাবে। রেডি হয়ে বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে ক্রেডিট কার্ডটা বের করতে যাবে, ঠিক তখনই দরজায় মৃদু শব্দ হলো। নম্রতা থমকে গেল কিছুক্ষনের জন্য। এভাবে কে নক করছে দরজায়। এত আস্তে তো এবাড়ির কেউ কখনও নক করে না। তবে কি আজকের গেস্টদের কেউ? তারাই বা কেন নক করবে?
নম্রতা গিয়ে দরজা খুলল। আশ্চর্য! কেউ নেই দরজার ওপাশে। শুধু ব্রাউন পেপারের ছোট্ট একটা শপিং ব্যাগ পড়ে আছে দরজার সামনে। দ্বিধান্বিত নম্রতা প্যাকেট নিয়ে রুমের মধ্যে এলো আবার। ব্যাগ খুলে ভিতরের বক্সটা বের করেই চমকে উঠল। একটা নতুন মোবাইলের বক্স। বক্সের ভেতর থেকে মোবাইলটা বের করল নম্রতা। আজ সকালে যেই মোবাইলটা নষ্ট হয়েছে হুবহু সেই মোবাইলটাই। এমনকি কালারটাও এক। নম্রতার বুঝতে অসুবিধা হলো না, কাজটা কে করেছে। মোবাইলের বক্সটা ব্যাগের মধ্যে রাখতে গিয়ে আরও একটা জিনিস নজরে এলো ওর। ভাঁজ করা একটা কাগজ। খুলে দেখল সেটা একটা চিঠি আসলে।
পড়তে শুরু করল ও,
“আশা করি চিনতে পেরেছেন। ক্ষতিপূরণ দিয়ে গেলাম। যদিও আপনিও সমান দোষী ছিলেন, তারপরেও ক্ষতিপূরণ পুরোটাই আমি দিলাম। আপনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ফোনটার দাম জানি কিনা আমি। আপনাকে আজ বলি, এরকম দামি একশোটা ফোন কেনার সামর্থ্য তানিম তালুকদারের আছে আলহামদুলিল্লাহ।
আর একটা কথা, চিঠিটা সম্মোধনহীন শুরু করেছি। কারন আমার মনে হয়েছে আপনার নামটা আপনার স্বভাবের সাথে ঠিক যায় না। ঘরে আসা অতিথিদের সাথে প্রথম দেখাতেই যে দুর্ব্যবহার করে তার নাম নম্রতা না রেখে রাখা উচিৎ ‘অসভ্যতা।’
অথবা প্রথম দেখাতে আমার সম্পর্কে কিছু না জেনেই এই যে আপনি বললেন, আমি মেয়ে দেখলেই স্পর্শ করতে চাই, আপনার এই নোংরা চিন্তাভাবনার জন্য নম্রতা না ডেকে আপনাকে ‘নর্দমা’ বলেও ডাকা যায়।
যাই হোক, নামের পোস্টমর্টেমে আর না যাই। ভালো থাকুন।
আল্লাহ হাফেজ।”
চিঠি পড়া শেষ করে নম্রতা ফণা তোলা বিষধর সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে উঠল। চিঠিটা দুমড়ে মুচড়ে রুমের এককোনে ছুঁড়ে মেরে দৌড়ে নিচে নামল। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে নামল সেটায় আর সফল হতে পারল না।
মরিয়ম খাতুন জানালেন সাখাওয়াত এবং তানিম কিছুক্ষন আগেই বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেছে বাসা থেকে৷ নম্রতা সাথে সাথেই আবার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। নিজের রুমে গিয়ে মোবাইলটাকে হাতে নিল ফ্লোরে আছাড় মারার জন্য। হাত উঁঁচু করেও কী একটা মনে করে থেমে গেল আবার। তারপর খুব যত্ন করে মোবাইলটাকে আবার প্যাকেট করল, চিঠিটাও তুলে এনে আবার সুন্দর করে ভাজ করল। তারপর সব আগের মতোই ব্যাগে ভরে আলমারির একটা তাকে সযত্নে তুলে রাখল।
বোনকে যেহেতু এখানে রেখে গেছে, আজ হোক বা কাল আবার দেখা হবেই। আজকের এই অপমানের জবাব সেদিন কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দেবে অসভ্য লোকটাকে। ইন ফিউচার দেখা হলে লোকটাকে ঠিক কীভাবে উচিত শিক্ষা দেবে তার একটা নীল নকশা তৈরির জন্য এখনই ভাবতে বসে গেল নম্রতা। অথচ নিজেকে বুদ্ধিমতী বলে দাবি করা বোকা মেয়েটা বুঝতেও পারল না, একদিন এই তীব্র ঘৃণা জমতে জমতে রূপ নেবে সমুদ্রসমান ভালোবাসায়। যেই স্পর্শের জন্য আজ তাকে অযৌক্তিক অপমান করল, সেই স্পর্শ পাওয়ার জন্য দিনরাত তড়পাতে হবে ওকে। দিনের পর দিন একঘরে থাকার পরেও সেই অসভ্য লোকটা ওর দিকে ফিরেও তাকাবে না।
৪.
নতুন জায়গায় প্রথম রাত চাঁদনীর খুব একটা খারাপ কাটল না। তবে সকালটা তেমন পছন্দ হলো না ওর। সাধারনত ওর সকাল শুরু হয় পাখির ডাক শুনে। ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে রুমের সাথে লাগোয়া খোলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে বিশাল ফুলের বাগান। মোট চার শতাংশ জায়গার উপর তৈরি করা এই ফুলের বাগানটি শুধুই চাঁদনীর। ভাইয়েরা বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা রকম ফুলের চারা এনে দেয়। চাঁদনী সেগুলো নিজ হাতে রোপণ করে, পরিচর্যা করে সেগুলোর। চাঁদনীর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য।
কিন্তু এখন এসবই অতীত। নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে সবকিছু ফেলে চাঁদনীকে চলে আসতে হয়েছে। ফজরের নামাজ পড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে প্রচন্ড হতাশ হলো ও। রাস্তার ওপারে উঁচু উঁচু দালান ছাড়া আর কিছুই নেই। শুধু একটা বাড়ির গেটের দুইপাশে দুইটা বাগানবিলাস দেখা যাচ্ছে। এদিকটায় অবশ্য লোকজনের কোলাহল নেই তেমন। একেবারে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন চারদিক। মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ি যাওয়া আসা করছে রাস্তা দিয়ে।
চাঁদনী রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে আবার ব্যালকনির দিকে তাকাল। এতবড় ব্যালকনি অথচ একেবারেই খালি। একটা গাছের টব অব্দি নেই। পুরো বাড়িতে এখনও সুনসান নীরবতা? প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে চাঁদনী বিছানায় এসে বসল। সময় যেন কাটতেই চাইছে না। আচ্ছা, একবার মরিয়ম আন্টির কাছে গিয়ে দেখবে। না থাক, যদি বিরক্ত হয়। এরা বোধহয় আরও দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। তারচেয়ে বরং ছাদে যাওয়া যাক। মরিয়ম আন্টি তো বলেছিলেন, বোরিং লাগলে চাঁদনী ছাদে গিয়েও সময় কাটাতে পারে। বিছানার পাশ থেকে ওড়নাটা নিয়ে সুন্দরভাবে মাথায় ও গায়ে পেঁচিয়ে নিল ও। তারপর রওয়ানা হলো ছাদের দিকে। ছাদে রোদ এসে পড়তে শুরু করেছে কেবল, গরম ও লাগছে বেশ। একটু ছায়ার জন্য আশেপাশে তাকাল ও।
পাশেই একটা ছাউনি। সেখানে চেয়ার টেবিল সবই আছে। সেখানের একটা চেয়ারে বসে ছিলেন মরিয়ম খাতুন। চাঁদনীকে তিনিই দেখলেন প্রথম। দেখে ডাক দিলেন, “আরে চাঁদনী, এদিকে এসো।”
চাঁদনী এগিয়ে গেল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “এত সকালে ঘুম থেকে উঠেছ কেন?”
“এত সকাল তো নয়, মে মাসের সকাল সাতটা মানে অনেক বেলা। আমারতো আরও সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস।”
“যাক, একজন অন্তত পাওয়া গেল আমার মতো। এবাড়িতে সকাল দশটার আগে কেউ ঘুম থেকে ওঠে না। শুধু ভার্সিটি বা অফিসের তাড়া থাকলে সেদিনই ভোরে ঘুম থেকে ওঠে এরা।”
চাঁদনী বলল, “আমাদের বাড়িতে সবাই খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। সকাল সাতটার মধ্যে সবাই নাস্তার টেবিলে এসে যায়। বাবা সবসময় বলে, ফজরের নামাজ আদায় না করে দিন শুরু করলে সেই দিন কখনও ভালো কাটতে পারে না।”
“ঠিকই বলেন তোমার বাবা। এবাড়িতে শুধু আমি আর টুলুর মা ফজরের ওয়াক্তে ঘুম থেকে উঠি। আমি নামাজ পড়ে কোরআন তেলাওয়াত করে কিছুক্ষন ছাদে এসে হাঁটাহাঁটি করি। তারপর নিচে গিয়ে দৈনন্দিন কাজগুলো শুরু করি।
ভালো কথা, তোমার অ্যাডমিশন কোচিং-এ ভর্তির কী হলো?”
“আগামীকাল তামজীদ ভাই আসবে। সে নিয়ে যাবে ভর্তি করাতে।”
“কাল থেকে তাহলে নতুন জার্নি শুরু।”
“হ্যাঁ।”
“ও, এখন তাহলে নিচে যাই। অনেক ভোরে উঠেছ, ক্ষিধে পেয়েছে নিশ্চই এখন। নাস্তা করে নেবে চলো।”
সারাদিন চাঁদনীর সময় কাটল মরিয়ম খাতুনের সাথে টুকটাক গল্প করে আর তানিম ভাইয়ের কিনে দেওয়া স্মার্টফোনটি ঘাটাঘাটি করে।
এত দিন চাঁদনীর কোনো স্মার্টফোন ছিল না। আসলে খুব একটা দরকারও ছিল না সেটার৷ কিন্তু এখন ঢাকায় থাকা হবে বলে গতকাল তানিম নিজেই ফোনটা কিনে দিয়ে গেছে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
নিভৃত রজনী
| ৩ | (১২৬০+ শব্দ) [প্রাপ্তবয়স্ক সতর্কতা]
এত দিন চাঁদনীর কোনো স্মার্টফোন ছিল না। আসলে খুব একটা দরকারও ছিল না সেটার৷ কিন্তু এখন ঢাকায় থাকা হবে বলে গতকাল তানিম নিজেই ফোনটা কিনে দিয়ে গেছে।
এবাড়িতে সারাদিনই কেমন একটা দমবন্ধ করা পরিবেশ থাকে। চাঁদনীদের বাড়ির মতো কোলাহল নেই। কথাও মেপে বলে সবাই।
সকালে দেখা হলো মরিয়ম আন্টির হাজবেন্ড জামশেদ আঙ্কেলের সাথে। চাঁদনী সালাম দিল। সে শুধু সালামের জবাবটুকু দিল রোবটের মতো। তারপর নাস্তা করে বের হয়ে গেল বাসা থেকে। নম্রতা অবশ্য টুকটাক কিছু কথা বলেছিল। তবে চাঁদনী খুব একটা কম্ফোর্ট ফিল করেনি তাতে৷ কেমন জানি একটা তাচ্ছিল্য ছিল কন্ঠে। যেন দায়সারা কথা বলছে সে। দুই একটা প্রশ্ন করে সেও উঠে রুমে চলে গেল। শহরের মানুষগুলো বোধহয় এরকমই হয়। অথচ চাঁদনীদের বাড়িতে কোনো অতিথি গেলে তাকে মাথায় তুলে রাখা হয়। অতিথিটির কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা সেই খেয়াল রাখে বাড়ির সবাই মিলে।
মরিয়ম আন্টি অবশ্য সকাল থেকে যথেষ্ট খেয়াল রেখেছেন। বিকালে ওর সাথে বসে গল্পও করেছেন অনেকক্ষন। হলুদিয়া এবং তার গ্রামের গল্প। চাঁদনীদের বাড়ির গল্প। নিজের পরিবারের গল্প। একে একে সবই বললেন চাঁদনীকে। কথোপকথনের একপর্যায়ে চাঁদনী জিজ্ঞাসা করল, “নম্রতা আপু শুধু একাই? তার আর কোনো ভাইবোন নেই?”
মরিয়ম খাতুন হেসে বললেন, “আছে তো। ওরা দুই ভাইবোন। প্রথমেই আমার ছেলে নওয়াজ, তারপরে নম্রতা। নওয়াজ এখন ঢাকার বাইরে আছে, বন্ধুদের সাথে ট্যুরে গিয়েছে। কাল অথবা পরশুর মধ্যে চলে আসবে।”
চাঁদনী ছোট্ট করে বলল, “ও।”
৫.
বিলাসবহুল একটি রিসোর্ট। রিসোর্ট এর সামনের দিকে আছে সুইমিংপুল। সেই সুইমিংপুলের সামনেই বসে আছে চারটি ছেলে। সবার সাথেই ব্যাগপত্র। ওরা সবাই ঢাকা থেকে এখানে এসেছিল ছয়দিন আগে। আজ ওদের ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। রিসোর্ট থেকে চেক আউট করাও হয়ে গেছে। কিন্তু ওরা এখনও রওয়ানা দিতেই পারেনি। না যেতে পারার অবশ্য বিশেষ একটি কারণও রয়েছে।
ওরা মোট পাঁচজন এসেছিল এখানে। গতকাল রাতেই একজন বলল, সে রাতে রিসোর্টে থাকবে না। কোথাও একটা যাবে৷ তবে সকালে ফেরার সময় সবার সাথে এসে জয়েন করবে। সেই একজন এখনও এসে পোঁছায়নি। এমনকি তাকে ফোনেও ট্রেস করা যাচ্ছে না এখন। বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেছে ওরা। একইসাথে বন্ধুটির জন্য কিছুটা চিন্তিতও।
আবির বলল, “শালাকে কাল বারবার করে বললাম, সাথে অন্তত একজনকে নিয়ে যা। কথাই শুনল না। এখন কোথায় গিয়ে যে মরেছে কে জানে।”
নওয়াজ বলল, “কোনো কারণে দেরি হতেই পারে, কিন্তু সেটা কন্টাক্ট করে জানাবে তো আমাদের। অযথা টেনশন নিতে হয় না তাহলে আর।”
ফাহিম এতক্ষন অস্থির ভঙ্গিতে ফোন হাতে নিয়ে পায়চারি করছিল। এবার সে হাঁটা থামিয়ে বলল, “সেই কখন থেকে ট্রাই করে যাচ্ছি, এখনও নট রিচেবল।”
মিশকাতের মুখের ভাষায় কখনোই লাগাম ছিল না। সে বলে উঠল, “দেখ গিয়ে, সারারাত মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করে এখন মটকা মেরে ঘুমাচ্ছে। কাল রাতেই সন্দেহ হইছিল আমার, শুয়ো**টা নতুন কোনো মাল পাইছে। এই হ্যাবিট ওর জীবনেও যাবে না। শালা আস্ত একটা মা**বাজ।”
আবির বলল, “রাইট। আমিও এটাই ভাবছিলাম। দুনিয়া উলটে গেলেও আকরাম নারীসঙ্গ ছাড়তে পারবে না।”
ফাহিম বলল, “থাম তোরা, এইবার সব জানা যাবে। ওইযে স্যার আসছেন গাড়ি নিয়ে।”
ওর কথায় সবাই প্রবেশদ্বারের দিকে তাকাল। সত্যিই আকরাম আসছে। আকরাম আসার দুমিনিটের মধ্যেই ওরা রওয়ানা হয়ে গেল ঢাকার উদ্দেশ্যে। সবার প্যাকিং করাই ছিল। আকরামের দেরি দেখে ওর ব্যাগও গুছিয়ে নিয়েছিল বন্ধুরা মিলে। তাই আর তেমন কোনো সমস্যা হলো না। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে অনেকটা। গাড়িতে যেতে যেতেই নাহয় আকরামের দেরি হওয়ার কারন জানা যাবে।
এখন ড্রাইভিং করছে নওয়াজ। তার পাশেই বসে আছে ফাহিম। পিছনের সিটে বসেছে যথাক্রমে আবির, মিশকাত আর আকরাম।
মিশকাত আকরামের শরীরের কাছে নাক নিয়ে শুঁকে বলল, “লেডিস পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছি বডি থেকে। সত্যি করে বল, কাল রাতে কোথায় ছিলি।”
আকরাম জবাব না দিয়ে হাসল।
মিশকাত বলল, “হাসিস না বা*। যা জিজ্ঞাসা করছি জবাব দে। কাল রাতে কোথায় ছিলি? ফিরতে এর দেরি হলো কেন?”
আকরাম হাই তুলে বলল, “কাল রাতে লাখির সাথে ছিলাম।”
ফাহিম আর মিশকাত প্রায় একসাথেই চেঁচিয়ে উঠল, “কী!”
মিশকাত বলল, “লাখি, মানে ওই রাখাইন মেয়েটা? গত কয়েকদিন ধরে যাকে লাইন মারছিস?”
“হ্যাঁ।”
“ধুর, হু হা করিস না। ডিটেইলে বল।”
“কয়েকদিন ধরেই ভুজুংভাজুং দিয়ে পটিয়েছিলাম। কাল ভাবলাম, আজ তো চলেই যাব, দেখি যাওয়ার আগে কিছু করা যায় নাকি। সেজন্যই কাল ইমোশোনাল ড্রামা করলাম একটু। বললাম, ঢাকায় গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব বাবা মাকে নিয়ে আবার আসব ওর কাছে। অনেক চেষ্টার পর রাজি হয়ে গেল৷
এখান থেকে কিছুদূর এগিয়ে সস্তার একটা হোটেল আছে। ওখানেই ওকে নিয়ে উঠলাম রাতে। অনেক দেরি করে ঘুমিয়েছি বলে সকালে উঠতেও দেরি হয়েছে। উঠে দেখি মোবাইলেও চার্জ নেই। সাথে সাথেই রওয়ানা দিলাম।”
“আসল কথায় আয়, তারমানে কাল রাতে ওই মেয়েটার সাথে ছিলি? ফাইনাল টাস্ক হয়ে গেছে তার মানে?”
আকরাম বিজয়ের হাসি হাসল।
নওয়াজ এতক্ষন চুপচাপ ওদের কথা শুনে যাচ্ছিল। এবার ও বলল,
“তারমানে মেয়েটার কনসেন্ট ছাড়াই তুই ওর সাথে ইন্টিমেট হয়েছিস।”
“আশ্চর্য! আমি কি জোর করেছি নাকি? ওর কনসেন্ট নিয়েই হয়েছে সব।”
“কিন্তু সেটা মিথ্যের মাধ্যমে। এরজন্য পরে যদি মেয়েটাকে ভুগতে হয়, তার দায়ভার কে নেবে?”
“ভুগতে হবে না। প্রোটেকশন নিয়েই করেছি সব। তারপরেও যদি কোনো সমস্যা হয়, তার দায়ভার ওর। ভুলও সব ওর। মাত্র ছয়দিনের পরিচয়ে যদি একটা অপরিচিত ছেলের সাথে ও বিছানা পর্যন্ত চলে যেতে পারে, তাতে আমার কী করার আছে?”
ফাহিম দেখল, নওয়াজের ঘাড়ের পাশের রগ ফুলে উঠতে শুরু করেছে। প্রত্যেকবার রেগে যাওয়ার আগে এমনটা হয়৷ আর একবার রেগে গেলে তুলকালাম বাঁধিয়ে দেবে নওয়াজ। আসন্ন বিপদের সম্ভাবনা অনুধাবন করে ফাহিম কথা ঘোরাতে বলল, “আচ্ছা বুঝলাম, তুই খুব ব্যস্ত ছিলি কাল। সকালে সেটা একবার অন্তত ফোন করে জানানো উচিৎ ছিল। আমরা এদিকে টেনশনে শেষ।”
“বললাম তো, ফোনে চার্জ ছিল না।”
“তোর ফোনে নাহয় চার্জ ছিল না, অন্য কারও ফোন থেকে অন্তত জানানো উচিৎ ছিল। হোটেল থেকেই নাহয় একটা কল করতি।”
“নাম্বার কোথায় পেতাম? সব তো ফোনে সেভ করা, আর ফোন তো বন্ধ।”
ফাহিম বিস্ময়ের চূড়ান্তে পৌঁছে গেল।
“মানে? গত চার পাঁচ বছরে তুই আমাদের একজনের একটা কন্টাক্ট নাম্বারও মুখস্ত করতে পারিসনি?”
“স্ট্রেঞ্জ! দরকার হয় না তাই মুখস্ত করিনি। এতে এত রিয়্যাক্ট করার কী আছে?”
আকরামের নির্লিপ্ত উত্তরে ফাহিম থেমে গেল। বাকীরাও চুপ হয়ে গেছে। গাড়ি চলছে। মিউজিক প্লেয়ারে বেজে যাচ্ছে লিঙ্কিন পার্কের গান, ব্যাটল সিম্ফনি।
৬.
রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে একটা উপন্যাস নিয়ে বসে গেল চাঁদনী। অ্যাডমিশনের পড়া এখনও সেভাবে শুরু হয়নি। আজ তামজীদের সাথে গিয়ে ভর্তি হয়ে এসেছে ও। ক্লাস শুরু হবে আরও তিন দিন পরে। সেজন্যই এখনও কিছুটা চাপমুক্ত আছে চাঁদনী। পড়তে পড়তে একসময় পুরোপুরিই বইয়ের পাতায় ডুবে গেল ও।
দরজা কিছুটা খোলাই ছিল, তবুও মরিয়ম খাতুন এসে নক করলেন দরজায়। মনোযোগ বইয়ের পাতায় ছিল বলেই হঠাৎ শব্দে চমকে উঠল চাঁদনী। দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, “আরে আন্টি, আপনি?”
“হ্যাঁ। খাওয়ার টেবিলে জিজ্ঞাসা করতে মনে ছিল না, তাই এখন এলাম। রাতে একা ঘুমাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাতো? তাহলে আমাকে বলতে পার।”
“না আন্টি, একদমই অসুবিধা হচ্ছে না। আপনি বসুন না।”
“না, এখন আর বসব না তাহলে। আসলে ইনসমনিয়ার জন্য স্লিপিং পিল নেই মাঝেমধ্যে। আজও নিয়েছি। এখন গিয়ে তাই ঘুমিয়ে পড়তে হবে৷ আসছি তাহলে। তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো।”
মরিয়ম খাতুন চলে গেলেন। চাঁদনী আবার ডুবে গেল বইয়ের পাতায়, তারপর দ্বিতীয়বারের মত চমকাল আবার। না, আর কেউ ওর রুমের দরজায় নক করেনি। তবে বাসার মেইন দরজার বাইরে কলিংবেল দিচ্ছে কেউ।
ঘড়ির দিকে তাকাল চাঁদনী। রাত এগারোটা ছত্রিশ। কে না কে এসেছে। আগ বাড়িয়ে দরজা খুলতে যাওয়া নিশ্চই ঠিক হবে না। চাঁদনী নিজের কাজে মনোযোগ দিল, তবে সেই মনোযোগ ধরে রাখতে পারল না। কারন অনবরত কলিং বেল বেজেই চলেছে। কী ব্যাপার? কেউ খুলছে না কেন দরজাটা? মরিয়ম আন্টি নাহয় স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমিয়েছে কিন্তু বাকীরা কী করছে? আন্টির মেয়েটাও কি ঘুমাচ্ছে? এবাড়িতে একজন ত্রিশ বত্রিশ বছর বয়সী কাজের মহিলাও আছে, তার তো অন্তত উঠে গিয়ে দরজাটা খোলা উচিৎ।
একটানা অনেকক্ষন কলিং বেল বেজে যাওয়ার পর একপ্রকার বাধ্য হয়েই চাঁদনীকে নামতে হলো। দরজার সামনে গিয়েও আবার থেমে গেল চাঁদনী। আচ্ছা, বোকার মতো এত রাতে ও দরজাই বা খুলতে যাচ্ছে কেন? চোর ডাকাতও তো হতে পারে। চাঁদনী আবার ওর নিজের রুমের দিকে পা পাড়াল। দরজার ওপাশের আগন্তুক তখন আরও বেশি অস্থির। আগের চেয়েও দ্রুত গতিতে বাজিয়ে চলেছে বেল।
চাঁদনী শেষমেষ সিদ্ধান্ত নিল দরজা খুলবে। শরীরে এবং মাথায় ভালো করে ওড়না পেঁচিয়ে দরজাটা খুলল ও। সাথে সাথেই এক পশলা দমকা হাওয়া ছুঁয়ে গেল ওর সর্বাঙ্গ। দরজা খুলে ওপাশের মানুষটাকে দেখে ওখানেই থমকে গেল চাঁদনী।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)