(প্রাপ্তবয়স্ক সতর্কতা)
নিভৃত রজনী
| ২২ | (১৪৫০+ শব্দ)
নওয়াজ লাইটের সুইচ অফ করে দিল আগে, তারপর ডিম লাইটের মৃদু আলোতেই ওয়ারড্রব খুলে একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে গেল ফ্রেশ হতে।
বেশ লম্বা সময় নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বিছানার দিকে গেল নওয়াজ। উঁকিঝুঁকি মেরে প্রথমে বোঝার চেষ্টা করল চাঁদনী ঘুমিয়েছে নাকি। নওয়াজ ইদানিং চাঁদনীকে ভয় পাচ্ছে অল্প অল্প। বিশেষ করে সেই বিয়ের রাতে চাঁদনী যখন জেরা করল বিয়ে করার কারন জানতে চেয়ে, ঠিক তখন থেকেই।
নওয়াজ ভেবেছিল বিয়ের কথা জেনে চাঁদনী সারপ্রাইজড হয়ে যাবে। খুশিও হবে। কিন্তু বিয়ের পরে চাঁদনীর ওভাবে রিয়্যাক্ট করাটা নওয়াজের জন্যে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল।
অবশ্য চাঁদনীর ওই আচরণটার পিছনে লজিক আছে। নওয়াজ নিজেই তো সেধে ওকে প্রত্যাখ্যান করেছিল একদিন৷ তারপর হুট করে আবার বিয়ে করতে চাইলে মনের মধ্যে প্রশ্ন আসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
নওয়াজ স্বগতোক্তি করল, বি ব্রেভ নওয়াজ। এত হেজিটেড করার কিছু নেই। এটা চাঁদনী। সেই নরম মেয়েটা যে তোকে দেখলে সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিত একসময়। তুই আশেপাশে থাকলেও যার শরীরে মৃদু কাঁপুনি শুরু হয়ে যেত। যার চোরা চোখ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকত তোর দিকে। সবচেয়ে বড় কথা, মেয়েটা এখন তোর বউ। তার উপরে অধিকার আছে তোর।
নওয়াজ কয়েকটা শুকনো কাশি দিয়ে প্রশ্ন করল, “ঘুমিয়েছ চাঁদনী?”
“না।” সাথে সাথেই জবাব দিল চাঁদনী।
“আজ একটু কম ঘুমালে কি খুব অসুবিধা হবে?”
“তা তো হবেই।”
চাঁদনীর যান্ত্রিক জবাবে দমল না নওয়াজ।
“অসুবিধা হলে হোক। চলো আজ রাতটা আমরা গল্প করে কাটাই।”
“এবার কিন্তু আপনি আমাকে বিরক্ত করছেন।”
চাঁদনীর কথা শুনে নিঃশব্দে হাসল নওয়াজ। ওর পুরোনো সাহসটা ফিরে এসেছে আবার। এখন আর চাঁদনীকে ভয় লাগছে না।
সম্পূর্ণ সিরিয়াস স্বরেই রসিকতাটা করল নওয়াজ, “সেকি, তুমিই তো কিছুক্ষন আগে বললে লাইট অফ করে আমার যা খুশি করতে। এখন বিরক্ত কেন হচ্ছ?”
ইঙ্গিতপূর্ণ কথাটা বুঝতে অসুবিধা হলো না চাঁদনীর। এতক্ষন উলটো দিকে মুখ করে শুয়ে নওয়াজের সাথে কথা বলছিল ও। এবার এপাশ ফিরে নওয়াজের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকাল ও।
“আমি মোটেও ওরকম কিছু মিন করে বলিনি।”
“কীরকম কিছু?” চাঁদনীকে নাস্তানাবুদ করতে প্রশ্ন করল নওয়াজ। ওর ঠোঁটের কোনো আলতো হাসি লেগে আছে।
চাঁদনী কিছুক্ষন আমতা আমতা করে প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্য বলল, “এসিটা একটু কমিয়ে দিন। শীত লাগছে।”
নওয়াজও আজ নাছোড়বান্দা। যেভাবে হোক চাঁদনীকে আজ আত্মসমর্পণ করিয়েই ছাড়বে।
“এসির পাওয়ার না কমিয়ে শীত নিবারণের আরও অনেক উপায় আছে। অনুমতি দিলে আমি এক্ষুনি তোমার শীত কমানোর ব্যবস্থা করি?”
চাঁদনী থেমে গেল এবার। নওয়াজের কথাগুলো একেবারে অন্যরকম লাগছে এই রাতের নির্জনতায়। এতক্ষনের হালকা শীত-শীত অনুভূতির সাথে শিরা উপশিরায় একটা শিরশিরে অনুভূতিও টের পেল চাঁদনী।
নওয়াজ ওর চুপ থাকাকে সম্মতির লক্ষন ধরে নিল বোধহয়। আধো আলোতেই চাঁদনীকে পাতলা কম্ফোর্টারে ঢেকে দিল ও। তারপর নিজেও কম্ফোর্টারের ভিতরে ঢুকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল চাঁদনীকে। কন্ঠস্বর একেবারে স্বাভাবিক।
“এখনও শীত লাগছে?”
চাঁদনীর টের পেল ওর হাত পা অসার হয়ে আসছে। মস্তিষ্ক বলছে নওয়াজকে এত সহজে নিজের কাছে ঘেসতে দেওয়া যাবে না একদম। কিন্তু শরীরটা নওয়াজের উষ্ণ আলিঙ্গণ উপভোগ করছিল খুব করে। একই সাথে মন বলছিল, এভাবেই সে নিজের সাথে ওকে জড়িয়ে ধরে রাখুক অনন্তকাল।
চাঁদনীর প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য কিছুক্ষন অপেক্ষা করল নওয়াজ। তারপরে স্পর্শগুলোকে আরেকটু গভীর করল।
নওয়াজকে বাঁধা দেওয়ার মতো সামান্য শক্তিটুকুও চাঁদনীর শরীরে রইল না। বরং সেই আলতো, গভীর এবং উষ্ণ স্পর্শগুলো পাওয়ার জন্য ও নিজেও উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। একসময় নিস্তেজ হয়ে শরীরের ভার নওয়াজের উপরেই ছেড়ে দিল ও। কাঁপা গলায় শুধু এতটুকুও বলতে পারল ও, “ডিম লাইটটাও অফ করে দেন প্লিজ।”
নওয়াজ ঘন স্বরে ফিসফিস করে চাঁদনীর কানে কানে বলল, “মোটেও না। বরং প্রথমবার বলে কিছুটা স্যাকরিফাইস করলাম। এরপর প্রত্যেকবার আদর করার সময় রুমের সবগুলো লাইট জ্বেলে রাখব আমি।”
ক্লান্ত চাঁদনীর পুরো রাতে আর ঘুমানো হলো না একফোঁটাও। সুখময় অত্যাচারে নতুন এক নওয়াজকে আবিষ্কার করতে করতেই কেটে গেল সারারাত।
নওয়াজ এবং চাঁদনী দুজনেরই চোখ লেগে এসেছিল শেষরাতের দিকে। সকালে নওয়াজের ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে। ঘুম থেকে উঠে আশেপাশে কোথাও চাঁদনীকে পেল না ও। ব্যালকনিতে গিয়েও খোঁজ করল। সেখানে রেলিঙের সাথে কাল রাতে চাঁদনীর পড়নে থাকা আধভেজা স্যালোয়ার কামিজ মেলে দেওয়া।
নওয়াজ গোসল সেরে নিচে নামল নাস্তা করতে। খেতে খেতে মাকে প্রশ্ন করল,
“চাঁদনী গতকাল কার সাথে এসেছে মা?”
মরিয়ম খাতুন বললেন, “তানিম আর রেবেকা ভাবি এসেছেন চাঁদনীর সাথে।”
“কাল তো বললে না যে ওরা আসবে।”
“তুই সকালে অফিসে চলে যাওয়ার পর জানতে পারলাম যে আসবে। তারপর সারাদিন তো জানানোর সুযোগটুকুও পেলাম না। রাতেও ফিরলি দেরি করে। জানাবটা কখন!”
“বুঝেছি। এখন বাসায় তো দেখছি না চাঁদনীকে। কোথায় গেছে আবার?”
“কেন? তুই জানিস না? চাঁদনীর আজ ভর্তির ডেট। তাছাড়া চাঁদনীর হলে ওঠার বিষয়টাও ঠিকঠাক করতে হবে। সেজন্যই বেরিয়েছে ওরা।”
নওয়াজ খাওয়া থামিয়ে দিল মাঝপথেই। চাঁদনীর আজ ভর্তি অথচ কাল কিছুই বলল না। আর কি বলল মা! চাঁদনী হলে উঠবে!
“মা, চাঁদনী হলে থাকবে? মানেটা কী?”
“চাঁদনী হলে থেকেই পড়তে চাইছে। আর ওর চাওয়াটাকে আমি গুরুত্ব দিতে চাই। চাঁদনীর থাকা নিয়ে আর কোনো কথা হবে না”
“কিন্তু তাই বলে…।”
“শোন নওয়াজ, দিনের পর দিন তুই মেয়েটাকে অবহেলা করে গিয়েছিস। তারপরেও ওর সাথে বিয়েটা যে হয়েছে সেটাই অনেক। চাঁদনী বলেছে পড়াশোনার সুবিধার্থে ও হলে উঠতে চায়৷ কিন্তু আমি জানি আসল কারণটা কী। বিয়ের আগেই এমন তিক্ততা তুই তৈরি করেছিস ওর সাথে যে মেয়েটা বাড়িতে থাকতে অব্দি চাইছে না। এখন ওকে ওর মতো থাকতে দে।”
মায়ের কথা শুনে নওয়াজ অর্ধেক নাস্তা করেই উঠে গেল। চাঁদনীর আজ ভর্তি, অথচ একবারও ওর সাথে সেটা বলল না! এমনকি হলে উঠতে চাওয়ার ব্যাপারটাও বলার প্রয়োজনবোধ করল না! নওয়াজের খুব একটা ভালো লাগল না বিষয়টা। চাঁদনী ওর স্ত্রী, তার ছোটখাট বিষয়গুলোও জানার অধিকার আছে ওর। সেই অধিকার থেকে চাঁদনী কেন ওকে বঞ্চিত করবে?
কিছুক্ষন ভাবার পর নওয়াজের মনে হলো, চাঁদনীকে একতরফা ভাবে দোষ দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। ও নিজেও তো হলুদিয়া থেকে ফেরার পর একবারও চাঁদনীর সাথে যোগাযোগ করেনি। অবশ্য নওয়াজ যে ইচ্ছে করে এই কাজটা করেছে তেমনটাও নয়৷ চাঁদনীর ফোনে অসংখ্যবার ডায়াল করতে গিয়েও শেষপর্যন্ত করতে পারেনি ও। ওদের মধ্যে তেমনভাবে সখ্যতাটাই গড়ে ওঠেনি আসলে।
নওয়াজ তালুকদার মঞ্জিলে যেই দুদিন ছিল, চাঁদনী কথা বলা তো দূরের কথা একবার তাকিয়েও দেখেনি ওর দিকে। বরং যতবারই নওয়াজ কথা বলতে গেছে, ততবারই এমন ভাবে জবাব দিয়েছে যেন সে মহাবিরক্ত ওর উপরে। নওয়াজও তাই আর ঘাটায়নি ওকে। ভেবেছে কিছুদিন গেলে তারপর চাঁদনীর সাথে মিটমাট করে নেওয়ার আরেকটা চেষ্টা করবে।
এরমধ্যেই গতকাল হঠাৎ চাঁদনীকে নিজের রুমে দেখে যথেষ্টই ভড়কে গিয়েছিল ও। তারপর হঠাৎ করেই এতটা কাছে আসা ছিল মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো। কাল রাতে শারিরীক দুরত্ব ঘুচিয়ে কাছে আসাটা হয়েছে বটে কিন্তু তবুও কোথাও একটা আক্ষেপ। চাঁদনী কি আদৌ সহজ হতে পেরেছে ওর সাথে। নাহ, আর এভাবে হেলাফেলা করা যাবে না ব্যাপারটাকে। চাঁদনীর সাথে সহজ স্বাভাবিক একটা সম্পর্ক তৈরির জন্য এখন থেকেই চেষ্টা করতে হবে।
৩৬.
তানিম গ্রাজুয়েশন করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। খুব ভালো সিজিপিএ থাকার কারনে অনেকগুলো হ্যান্ডসাম স্যালারি জব অফারও পেয়েছিল। কিন্তু সেগুলো সব রিজেক্ট করে ও ফিরে গিয়েছিল গ্রামে। কারণ শহর কখনোই ওর পছন্দের তালিকায় ছিল না।
তানিমের শহরকে অপছন্দ করার পেছনে যেকটা মেজর রিজন ছিল তারমধ্যে অন্যতম হলো ধূলো-বালিময় শহরের তীব্র যানজট। ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়িতে জ্যামে বসে থাকাটা ওয়েস্ট অভ টাইম ছাড়া আর কিছুই মনে হতো না ওর।
খুব প্রয়োজন না হলে ও শহরমুখো হতো না ও। কিন্তু এখন চাঁদনীর জন্য মাঝেমধ্যেই আসতে হয় ঢাকায়। আজ ও তীব্র গরমে প্রায় দেড় ঘন্টা জ্যামে বসে থেকে তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে অবশেষে চাঁদনীর হলের সামনে পৌঁছাল ও।
গাড়ি পার্ক করে কল করল চাঁদনীর ফোনে। গুনে গুনে তিনবার রিং হওয়ার পর রিসিভ করল চাঁদনী। তানিম ওর কাছে এসেছে শুনে বলল,
“উফ, তানিম ভাই। তুমি আসার আগে অন্তত একবার জানাবে তো। আমার শ্বাশুড়ি তো সকালে গিয়ে আমাকে তার কাছে নিয়ে এসেছেন। আজ বোধহয় আর ফেরা হবে না। তুমি এক কাজ করো, এখানেই চলে এসো।”
“চাঁদনী, এখন তাহলে আমি ফিরে যাই। পরে আবার এসে তোর সাথে দেখা করে যাব।”
“মানে কী! এতদূর এসে তুমি আমার সাথে দেখা না করেই চলে যাবে?”
“তুই হলে ফিরে আমাকে ফোন দিস। আমি সেদিনই এসে তোর সাথে দেখা করে যাব।”
“আমি বুঝতে পারছি না, এই বাড়িতে আসতে তোমার এত কিসের সমস্যা! আমার শ্বাশুড়ি মা এত পছন্দ করেন তোমাকে, তার সাথে অন্তত দেখা করে যাওয়া উচিৎ তোমার।”
“কিন্তু চাঁদনী…।”
“আবার কিন্তু? এবাড়িতে কেন তুমি আসতে চাও না, সেটা আগে আমাকে ক্লিয়ার করো। ওকে, ফাইন৷ যখন তুমি আসতেই চাও না। আসতে হবে না তোমাকে।”
তানিমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চাঁদনী খট করে লাইন কেটে দিল।
কথায় আছে, মানুষ যেটা এড়িয়ে যেতে চায়, বেশিরভাগ সময় ভাগ্যক্রমে তাকে সেটারই মুখোমুখি হতে হয়। চাঁদনীর সাথে কথা বলার পর তানিমের মেজাজ আরও চড়ে গেল। সত্যিই ভুল হয়ে গেল। আগে চাঁদনীকে কল করে নেওয়া উচিৎ ছিল। চাঁদনীর শ্বশুড়বাড়ি যেহেতু ঢাকাতে, মাঝেমাঝে চাঁদনী সেখানেও যাবে এটাই স্বাভাবিক। এখন তো আর এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। মরিয়ম খাতুনদের ওখানে যেতেই হবে। নইলে আবার চাঁদনী রেগে যাবে।
ওখানে যাওয়া মানেই আবার ওই মেয়েটার মুখোমুখি হতে হবে। তানিম চায় না ওই মেয়েটার সামনে যেতে। যদিও তানিম জানে, মেয়েটা হয়তো তার প্রথমদিনের সেই ব্যাবহারের জন্য অনুতপ্ত। তালুকদার মঞ্জিলে যেকদিন ছিল মেয়েটা, প্রত্যেকবারই তানিম সামনে থাকলে কী ভীষণ একটা কুন্ঠাবোধে গুটিয়ে নিত নিজেকে। তখনই তানিম বুঝেছিল, যে প্রথম সাক্ষাতের সেই ব্যাবহারের জন্য লজ্জিত সে। তারপর তালুকদার মঞ্জিল থেকে ফেরার দিন যখন তানিমের সাথে কথা বলতে চাইছিল, তখনও তানিম আন্দাজ করে নিয়েছিল কারনটা। সেদিন ইচ্ছে করেই মেয়েটাকে পালটা অপমান করেছিল ও। তারপর মেয়েটা যখন ওর কথা শুনে কেঁদে ফেলল, তখন অবশ্য মনে হয়েছিল যে কথাগুলো ওভাবে বলা ঠিক হয়নি। একটা সুক্ষ্ণ অপরাধবোধও বাসা বেঁধেছিল মনে। কিন্তু তানিম সেটাকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি।
আসলে জীবনে প্রথমবার কোনো মেয়ের থেকে অপমানিত হওয়া ওর পৌরুষে আঘাত করেছিল ভীষনভাবে। বিশেষ করে সামান্য একটা ধাক্কার জন্য ওর চরিত্রের উপর আঙুল তোলাটা মেনে নিতে পারেনি তানিম একদমই।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
নিভৃত রজনী
| ২৩ | (১৪৫০+ শব্দ)
আসলে জীবনে প্রথমবার কোনো মেয়ের থেকে অপমানিত হওয়া ওর পৌরুষে আঘাত করেছিল ভীষনভাবে। বিশেষ করে সামান্য একটা ধাক্কার জন্য ওর চরিত্রের উপর আঙুল তোলাটা মেনে নিতে পারেনি তানিম একদমই।
মরিয়ম খাতুনদের বাড়ি পৌঁছে তানিম দেখল সেখানে এলাহি কারবার চলছে। আত্মীয়স্বজনে গিজগিজ করছে বাড়ি। মরিয়ম খাতুন ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছেন। তানিমকে দেখে তিনি খুশি হলেন খুব। কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে বললেন, “নওয়াজের বিয়েটাতো একেবারেই হঠাৎ করে হয়েছে, তখন কাউকেই তেমনভাবে বলা হয়নি। কাছের আত্মীয়স্বজনেরা খুব করে চাইছিল নওয়াজের বউ দেখতে। সেজন্যই আজ সবাইকে ইনভাইট করেছিলাম। খুবই ব্যস্ততা যাচ্ছে বুঝলে।”
মরিয়ম খাতুনের কথার প্রত্যুত্তরে তানিম শুধু স্মিত হাসল।
কিছুক্ষন থেমেই মরিয়ম খাতুন ডেকে উঠলেন আবার, “নম্রতা, এদিকে আয় তো।”
নম্রতা প্রায় সাথেসাথেই ছুটে এলো। এসেই চমকাল খুব। একপ্রকার বিভ্রান্ত হয়ে প্রশ্ন করল, “ডেকেছিলে আম্মু?”
“হ্যা, তানিমকে নিয়ে ডাইনিংয়ে যা। ছেলেটা এতদূর জার্নি করে এসেছে। দুপুরের খাওয়া নিশ্চই হয়নি এখনও।”
তানিম বলে উঠল, “আন্টি, আজ থাক। আমি চাঁদনীর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। দেখা করেই রওয়ানা হব আবার।”
“একদম চুপ। আজ আর তোমার ফেরা হবে না। আমি এদিকটায় একটু ব্যস্ত, তুমি নম্রতার সাথে যাও। প্রায় বিকেল হতে চলল, খাবার খেয়ে তারপর চাঁদনীর সাথে দেখা করবে।”
অগত্যা নম্রতার সাথেই যেতে হলো তানিমকে। তবে এই প্রথমবার একটা ব্যাপার উলটো ঘটল। ডাইনিং রুমে গিয়ে খাবার সার্ভ করে দেওয়ার পুরোটা সময়ে নম্রতা একবারও তাকাল না তানিমের দিকে। কিন্তু তানিম বেশ কয়েকবারই আনমনে তাকিয়ে ফেলল সুশ্রী ওই মুখটির দিকে। প্রত্যেকবারই তাকানোর পরেই আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিল ও। একসময় নিজের কাজে নিজেই বিরক্ত হয়ে খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল ও।
তানিম খাওয়া শুরু করার সাথে সাথেই নম্রতা রান্নাঘরে গেল। কিছুক্ষনের মধ্যে ফিরে এলো একটা পিরিচে কয়েকটা কাঁচামরিচ নিয়ে। তানিমের প্লেটের পাশেই সেটাকে রাখল।
তানিম থামল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। খাবার খাওয়ার সময় আস্ত কাঁচমরিচ লাগবেই তানিমের। ভাতের প্রত্যেক লোকমার সাথে একটু একটু করে কাঁচামরিচ কামড়ে খাওয়া অভ্যাস ওর। কিন্তু এই মেয়েটা সেটা কীভাবে জানল! তালুকদার মঞ্জিলে থাকাকালীন খেয়াল করেছে? হয়তোবা।
খাওয়ার মাঝপথে তানিমের প্লেটে আরেকটু মুরগির মাংস তুলে দিল নম্রতা। তানিম চমকাল। ওর খাওয়ার দিকে খুব ভালো করেই খেয়াল করছে মেয়েটা। খাবার টেবিলে যতগুলো আইটেম ছিল, তারমধ্যে সবচেয়ে তৃপ্তি করে মুরগির মাংসটাই খেয়েছে ও। সেজন্যই বোধহয় আবারও ওর প্লেটে মাংস তুলে দিয়েছে।
তানিমের খাওয়ার প্রায় শেষের দিকে আরেকচামচ ভাত দিতে গেল নম্রতা। তানিম বাম হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ভাতের চামচ আটকে দিল।
ডাইনিং রুমে পিনড্রপ সাইলেন্স। একটাও শব্দ উচ্চারণ না করে কাটল পুরোটা সময়। তানিম খাওয়া শেষ করে উঠে গেল। এবার স্বেচ্ছায় পূর্ণদৃষ্টিতে তানিমের দিকে তাকাল নম্রতা। গ্রে কালারের শার্ট আর রংচটা জিন্সে পিছন থেকেও যথেষ্ট হ্যান্ডসাম লাগছে তাকে। সামনাসামনি তাকানোর সাহস নেই বলে পিছন দিকে থেকেই তাকিয়ে থাকল নম্রতা। আনমনেই ভেতর থেকে বেড়িয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ কি সামনের মানুষটার কানেও পৌঁছাল? নইলে চলতে চলতেও ওই পা দুটো কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে কেন গেল?
৩৭.
নওয়াজের আজকাল আর কিছুই ভালো লাগে না। জলজ্যান্ত সুন্দরী একটা বউ থাকা স্বত্বেও সিঙ্গেলদের মতো দিন কাটাতে হচ্ছে। চাঁদনীর সাথে বিয়ের প্রায় তিনমাস হতে চলল। আস্তে আস্তে সময় যত যাচ্ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে নওয়াজের হতাশাও বাড়ছে।
সেই যে বিয়ের তিন-চারদিন পর এক রাতে হঠাৎ চাঁদনীকে আবিষ্কার করেছিল ওর রুমে। তারপর স্বপ্নের মতো কাটল রাতটা।
ভেবেছিল সেই রাতের পর চাঁদনীর সাথে সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে৷ কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পরেরদিন থেকে চাঁদনী ঠিক আগের মতোই হয়ে গেল। নওয়াজ কথা বললেও ওর দিকে বিরক্ত চোখে তাকাত। তারপর প্রায় তিনটি মাস চলে গেল, কিন্তু চাঁদনী অধরাই রয়ে গেল ওর কাছে।
চাঁদনীর সাথে ফিজিক্যাল অ্যাটাচমেন্টটা তৈরি না হলে হয়তো নিজেকে দমিয়ে রাখা যেত। কিন্তু সেদিন রাতের প্রত্যেকটা সেকেন্ডের কথা এখনও মনে আছে ওর। আর যতবার সেই কথা নওয়াজ মনে করে, ততবারই চাঁদনীকে পাওয়ার তৃষ্ণাটা বেড়ে যায় সমানুপাতিক হারে।
এমন না যে চাঁদনী বাসায় আসে না। দুই-এক সপ্তাহ পরপরই শ্বশুড়বাড়িতে আসে চাঁদনী। দুই-তিনদিন থেকে যায়।
সবচেয়ে বড় কথা বিয়ের আগে চাঁদনী ঠিক যতটা চুপচাপ ছিল, এখন ঠিক ততটাই সরব। মরিয়ম খাতুন এবং নম্রতার সাথে তার সখ্যতা একেবারে চোখে পড়ার মতো। এমনকি অন্তর্মুখী স্বভাবের জামশেদ সাহেবকেও মাঝে-মাঝে চাঁদনীর সাথে হেসে কথা বলতে দেখা যায়।
একমাত্র নওয়াজের বেলাতেই চাঁদনীর যত উদাসীনতা। সারাদিনে একবার তাকিয়ে দেখবে না নওয়াজের দিকে। এতো গেল সারাদিনের কেচ্ছা, রাতেও আরেক কাহিনী ফেঁদে বসে থাকে। ঘুমানোর সময় সে নওয়াজের রুমেই আসে। কিন্তু বিছানার মাঝখানে থাকে একটা নাদুসনুদুস স্বাস্থ্যবান কোলবালিশ। সেটা বিছানার মাঝে রাখার সময় চাঁদনী নওয়াজের দিকে এমনভাবে তাকায়, যেই তাকানোর ভঙ্গিটাই বলে দেয়, রাতে নওয়াজ কোলবালিশ ক্রস করতে চাইলে ভয়াবহ কিছু ঘটে যাবে। চাঁদনীর ওই দৃষ্টি দেখে নওয়াজ আর সাহস করে কোলবালিশ ডিঙিয়ে যেতে পারে না। সারারাত ওর কাটে নিদ্রাহীন। কোলবালিশটাকে মনে হয় চীনের দূর্ভেদ্য মহাপ্রাচীর।
নওয়াজের এই ছটফটানির বিপরীতে চাঁদনী খুব আরাম করে ঘুমায়। ঘুমন্ত সেই মুখ, বালিশের ঘষায় এলোমেলো হয়ে থাকা চুল, ফোলা ঠোঁট নওয়াজকে অশান্ত করে তোলে। মেয়েটা ওর বৈধ স্ত্রী, মেয়েটার শরীরের প্রত্যেকটা ভাঁজ সম্পর্কে ও অবগত। অথচ তবুও তাকে ছুঁতে না পেরে অন্তর্দহনে শেষ হয়ে যেতে হচ্ছে নওয়াজকে।
শারিরীক চাহিদা তবুও দমিয়ে রাখা যায়। কিন্তু চাঁদনীর সবচেয়ে কাছের মানুষটি হয়েও তার মনের নাগাল না পাওয়াটাকে নিজের সবচেয়ে বড় অক্ষমতা বলে মনে হয়।
শুধু বিয়ে নামের একটা ট্যাগ লেগে আছে দুজনের মধ্যে। অথচ দুজনে দুই পৃথিবীর বাসিন্দা। চাঁদনী নিজের মতো করে যেই পৃথিবীটা তৈরি করেছে সেখানে নওয়াজের প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু নওয়াজের তৃষ্ণার্ত মন সেকথা মানতে চায় না একদমই। সে প্রত্যেকদিন, প্রত্যেক ক্ষনে দেখতে চায় নিজের সহধর্মিণীকে। দেড় দুই সপ্তাহ পরপর একটা রাত তাকে দেখে আশ মেটে না নওয়াজের।
কাছে থেকে না হোক দূর থেকে অন্তত একনজর দেখার জন্য চাঁদনীর হলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে নওয়াজ। চাঁদনী হিজাব, নিকাব পড়া থাকে। শুধু চোখদুটো ছাড়া তার আর কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না। নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে নিজেকে আড়াল করে থাকে বলে দূর থেকে চাঁদনীর চোখদুটোও স্পষ্ট দেখা যায় না। তবুও নওয়াজ আসে। প্রত্যেকদিন একবার মিনিটখানেকের জন্য চাঁদনীকে দেখলে নিজেকে ও সান্ত্বনা দিতে পারে, চাঁদনী ওর কাছাকাছিই আছে।
আজও চাঁদনীকে একটু দেখার আশায় কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল নওয়াজ। কাঁধের উপরে হঠাৎ কারও আলতো টোকায় চমকে পিছনে ফিরে তাকিয়ে ওখানেই ফ্রিজড হয়ে গেল। চাঁদনী নেকাব খুলে ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল
“কী ব্যাপার? এখানে কী দরকার?
এরকম ক্ষেত্রে ধরা পড়ে গেলে আর পাঁচজনে যা বলে নওয়াজও তাই বলল,
“আসলে এই রাস্তা দিয়েই একটা কাজে যাচ্ছিলাম।”
“কাজে যাচ্ছিলেন, ভালো কথা। কিন্তু এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছেন?”
“না, মানে। গাড়িটার হঠাৎ যে কী হয়েছে! স্টার্টই হচ্ছে না।”
“তাহলে গাড়িটা এবার বদলে ফেলুন।”
“বদলাতে হবে কেন? সার্ভিসিংয়ে নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
“একদিন গাড়ি নষ্ট হলে সেটা সার্ভিসিংয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু রোজ রোজ নষ্ট হলে সেটা বদলে ফেলাই ভাল।”
“মানে?”
“মানে গত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে এই রোডে এসে আপনার গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। তাই বলছিলাম, গাড়িটা বদলে ফেলুন।”
নওয়াজ বুঝল, ধরা পড়ে যাচ্ছে ও। তাই এবার প্রসঙ্গ বদলাল।
“তুমি এদিকে কী করছ চাঁদনী?”
“শ্বশুড়বাড়িতে যাচ্ছি।”
“আমাদের বাসায় যাচ্ছ? গাড়িতে উঠে বসো তাহলে। আমিই নিয়ে যাই।”
“কিন্তু আপনার গাড়ি তো স্টার্ট নিচ্ছে না।” কথাটা বলে হেসে ফেলল চাঁদনী।
নওয়াজ কান চুলকে মিনমিন করে বলল, “আরেকবার চেষ্টা করে দেখি। এবার মনেহয় স্টার্ট নেবে।”
চাঁদনী পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল এবার নওয়াজের দিকে। সামনে ফর্মাল গেটাপে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন পুরুষটি ওর স্বামী, এটা ভাবলেও সুখময় একটা অনুভূতি হয় চাঁদনীর। পড়ন্ত দুপুরের ক্লান্তিটাও কী চমৎকারভাবে মানিয়ে গেছে তার চেহারার সাথে। কিছুটা বিষাদও কি খেলা করে যাচ্ছে দুটি চোখের তারায়?
চাঁদনী গাড়িতে উঠে বসল। হঠাৎ করেই ওর খুব মায়া হলো৷ নাহ, মানুষটার সাথে এতটা কঠোর হওয়া বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। বাইরে যতই কাঠিন্যের খোলসে নিজেকে আবৃত করে রাখুক, ভেতরের প্রায় পুরোটা জুড়েই তো তার বসবাস। শরীর এবং মনের সবটুকুই যাকে উজাড় করে দেওয়া হয়ে গেছে, তার সাথে অযথা এতটা দুরত্ব তৈরি করার আদৌ কি কোনো প্রয়োজন আছে।
চাঁদনী জানে, নওয়াজ ওকে ভালোবাসে। চাঁদনী নিজেও চায় দেয়ালটা ভেঙে গুড়িয়ে দিতে। কিন্তু সেই প্রথমদিককার নওয়াজকে মনে পড়ে যায় মাঝে মাঝেই। যার কাছে চাঁদনীকে বিয়ে করাটা যন্ত্রনা বলে মনে হতো।
চাঁদনী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিজের মধ্যে তৈরি হওয়া এই অন্তর্দন্দের অবসান কবে হবে কে জানে।
৩৮.
অনেকদিন পর দুপুরের খাওয়ার পরে বেশ আয়েশ করে লম্বা একটা ভাতঘুম দিল নম্রতা। অবশেষে ওর ইয়ার ফাইনাল শেষ হলো। দীর্ঘ বিবিএ লাইফের সমাপ্তি হলো শেষ পর্যন্ত। আপাতত একটা লম্বা সময়ের জন্য পড়াশোনার মতো বোরিং একটা বিষয় থেকে রেহাই পেয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই ছিল ও।
ঘুম থেকে উঠল সন্ধ্যারও পরে। নাস্তা করে সোশ্যাল সাইটে বন্ধুদের সাথে তুমুল আড্ডায় মাতল। সামনের লম্বা ছুটির সময়টা কীভাবে কাটাবে তার একটা প্লানও করে ফেলল নম্রতা। আসলে এই সময়টুকু ও সবকিছু ভুলে গিয়ে একেবারে নিজের মতো করে পার করতে চায়।
এমনকি তানিম নামের যে নাকউঁচু স্বভাবের লোকটা মনের মধ্যে গেড়ে বসে আছে, তাকেও আপাতত আর মনে করতে চায় না ও।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। সেজন্যই বোধহয় ঠিক তিনদিনের মাথায় নম্রতাদের বাসায় এসে হাজির হলো এনায়েত তালুকদার,বেলায়েত তালুকদার এবং তানিম। আবারও একটা বিয়ের দাওয়াত দিতে আসা তাদের।
সাদমান দিনরাত এক করে প্রিপারেশন নিয়েছিল একটা সরকারী চাকরির। অবশেষে সাদমানের একটা প্রথম শ্রেণির চাকরি হয়েছে কিছুদিন আগেই। চাকরি হতেই তাই বিয়ের তোড়জোর শুরু হয়ে গেছে।
আগেরবারের মতোই যথারিতী চাঁদনী, নম্রতা আর মরিয়ম খাতুনকে নিয়ে হলুদিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন দুই ভাই। নম্রতার মনের মধ্যে ভাষাহীন আনন্দ হচ্ছিল। চোখদুটো বারবার চলে যাচ্ছিল ড্রাইভিং সিটের দিকে। তানিমের পিছনে কোনাকোনি জানালার পাশের সিটে বসেছিল নম্রতা। আড়চোখে তাকালেই তাই তানিমের মুখের একটা পাশ দেখা যাচ্ছিল।
নম্রতা খুব সতর্ক দৃষ্টি রেখে পুরোটা পথ দেখে গেল তাকে যেন কিছুতেই তানিম বুঝতে না পারে। কিন্তু বোকা মেয়েটা বুঝতেও পারল না যে তানিম তালুকদারের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া এতটা সহজ নয়৷
সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতেও নম্রতার প্রত্যেকটা মুভমেন্ট নোটিস করছিল তানিম খুব ভালোভাবেই।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
নিভৃত রজনী
| ২৪ | (১৪৩০+ শব্দ)
সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতেও নম্রতার প্রত্যেকটা মুভমেন্ট নোটিস করছিল তানিম খুব ভালোভাবেই।
প্রায় সারারাত জার্নি করে ওরা তালুকদার মঞ্জিলে পৌঁছাল খুব সকালবেলা। প্রথমবার এবাড়িতে এসে স্বভাবতই কিছুটা সংকোচবোধ করেছিল নম্রতা। কিন্তু এই বাড়ির সবার আন্তরিক ব্যবহারে এত সুন্দর একটা সখ্যতা তৈরি হয়েছিল যে এবার আর একদমই প্রথমবারের মতো লাগছিল না।
সারাদিন আনন্দেই কাটল নম্রতার। কিন্তু তখনও ও জানত না যে দিনের শেষে ওর এই সব আনন্দ রূপ নেবে বিষাদে। ব্যাপারটা ও জানতে পারল রাতে। চাঁদনী, রেবেকা বেগম আর মরিয়ম খাতুন বসে গল্প করছিলেন তখন। নম্রতা ওর একটা ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিল রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় বসে। কথা বলা শেষ করে রুমে ঢুকতে গিয়েও মায়ের কথা শুনে থেমে যেতে হলো ওকে।
“কী বলেন! তানিমের জন্যেও প্রস্তাব এসেছে? কোথা থেকে?”
“হ্যাঁ। প্রস্তাব এসেছে আরও মাস দুয়েক আগে। মেয়ের বাবা পাশের গ্রামের চেয়্যারম্যান। একমাত্র মেয়ে তাই নিজের কাছাকাছিই রাখতে চাইছেন। তিনি শুনেছেন তানিম ব্যাবসা বানিজ্য সব গুছিয়ে গ্রামেই থাকবে। তাছাড়া তিনি তানিমকে আগে থেকেই চেনেন। সবমিলিয়ে তিনিই তাই আগ বাড়িয়ে প্রস্তাব রেখেছিলেন।
মেয়েটাকে আমরা চিনি। পছন্দ করার মতো মেয়ে। যদিও এই বিষয়ে মেয়ের বাবাকে কোনোপ্রকার সিদ্ধান্ত জানাইনি। যেহেতু সাদমান তানিমের বড়, তাই আগে ওর বিয়েটাই করাতে চাইছিলাম আমরা। এখন তো সাদমানের বিয়েটা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। তাই চাঁদনীর বাবা আর চাচা চাইছেন তানিমের বিয়ের কথাটাও পাকা করে রাখতে।”
“ভালোই হলো ভাবী। সাদমানের বিয়ের পর তানিমের বিয়ের দাওয়াতটাও তাহলে খুব তারাতারিই পারব।”
“হ্যা, আল্লাহ যদি চান তানিমের বিয়েটাও খুব জলদিই করাতে চাই। ছেলেমেয়েগুলোর সংসার গুছিয় দিতে পারলে আমরা বুড়ো-বুড়িরা একটু নিশ্চিন্ত হতে পারি।”
তারা কথা বলতে থাকলেন। কিন্তু নম্রতার পৃথিবীটা দুলে উঠল মুহুর্তে। চোখ তখন পানিতে টইটম্বুর। একসময় চোখ উপচে তারা গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে৷ ঠিক সেই সময় কান্নারত নম্রতার চাঁদনীর সাথে চোখাচোখি হলো ওর। চাঁদনী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। নম্রতা রুমের মধ্যে থাকা মানুষগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য একছুটে রুম থেকে বের হয়ে গেল। এই রাতের বেলা নিস্তব্ধ, নিরিবিলি ছাদটাই ওর জন্য উপযুক্ত জায়গা, তাই ছাদের দিকেই এগিয়ে গেল নম্রতা।
নম্রতা রুম থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই চাঁদনীও ওর পিছু নিয়েছিল। নম্রতা বারান্দার দরজায় এসে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই সেদিকে চোখ গিয়েছিল ওর। তানিমের বিয়ের আলোচনা শুনে নম্রতার মুখমন্ডল বিবর্ণ হয়ে যাওয়া, কেঁদে ফেলা সবটাই গভীর মনোযোগের সাথে খেয়াল করেছে ও। গাড়িতে ফেরার পথেও তানিমের দিকে নম্রতার আড়চোঝে তাকানোটা খেয়াল করেছিল ও কয়েকবার। তাই দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে খুব একটা অসুবিধা হলো না চাঁদনীর।
নম্রতাকে ফলো করে চাঁদনী যখন ছাদে গিয়ে পৌঁছাল তখন নম্রতা ছাদের এককোনে বসে হাঁটুতে মাথা গুজে কাঁদছিল। চাঁদনী ওর কাধে গিয়ে হাত রাখার সাথে সাথেই চমকে উঠে চাঁদনীর দিকে তাকাল নম্রতা। চাঁদনী কোনোরকম ভনিতা ছাড়াই প্রশ্ন করল, “তানিম ভাইকে পছন্দ করো তুমি?”
নম্রতা জবাব না দিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। কী জবাব দেবে সে!
“নম্রতা আপু, চুপ করে থেকো না৷ যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দাও।”
নম্রতা তবুও চুপ। চাঁদনী কিছুটা সময় দিল এবার নম্রতাকে। তারপর আবার বলা শুরু করল, “পরে কিন্তু আফসোস করেও লাভ হবে না। তানিম ভাইয়ের প্রতি তোমার মনে যদি কোনো উইকনেস তৈরি হয়ে থাকে,তাহলে সেটা আমাকে বলো। হয়তো আমি তোমাকে হেল্প করতে পারব।”
অনেকক্ষন পর চাঁদনীর কথার এবার জবাব দিল নম্রতা, “কোনো লাভ হবে না ভাবি৷ তোমার ভাই আমাকে পছন্দ করে না একদমই। বরং ঘেন্না করে ভীষণ।”
“কিন্তু আমি যতদূর জানি, শুধু শুধু কাউকে ঘৃণা করার মতো মানুষ নয় আমার তানিম ভাই।”
“শুধু শুধু তো নয়। এই তিক্ততার সূত্রপাত আমিই করেছিলাম।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রথম দিনের ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাটুকু বলে গেল নম্রতা। চাঁদনী শুনল চুপ করে। নম্রতা কথা শেষ করে থামার পর চাঁদনী বলল,
“আমার পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তানিম ভাইয়ের আত্মসম্মানবোধ সবচেয়ে বেশি। এমনকি আব্বু আর ছোট আব্বুও হিসেব করে কথা বলেন তার সাথে। যে কিনা জীবনে কোনো মেয়ের দিকে ভালো করে চোখ তুলেও দেখেনি, তার চরিত্র নিয়ে তুমি প্রশ্ন তুললে, সেটাই হয়তো তানিম ভাই মেনে নিতে পারেনি।”
“সেটাই তো সবচেয়ে বড় ভুল আমার জীবনের। সেদিন না জেনেই বাজে ব্যবহারটা করেছিলাম। জানো ভাবি, আমার অপমানের জবাবে সেদিন তোমার ভাই নতুন একটা স্মার্টফোনের সাথে সেই যে চিঠিটা দিয়েছিল সেটা পড়ে প্রচন্ড রাগ হয়েছিল আমার। আমি শুধু একটা মোক্ষম সুযোগ খুঁজছিলাম পালটা অপমান করার জন্য। যাতে রাগটা কমে না যায়, সেজন্য মাঝেমাঝে চিঠিটা নামিয়ে পড়তাম। এরকম করতে করতে কখন জানি সব ওলট-পালট হয়ে গেল। একসময় খেয়াল করলাম আমার আর আগের মতো রাগ লাগছে না। বরং তার কথা ভাবতে ভালো লাগছে। তারপর একসময় বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা শুধু ভালোলাগার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তাকে আমি..।”
নম্রতা থেমে গেল। ওর অসম্পূর্ণ বাক্যটি শেষ করল চাঁদনী,
“ভালোবেসে ফেলেছ, তাই তো? আচ্ছা, তুমি কি ভাইয়ার কাছে একবারও তোমার করা কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে স্যরি বলেছ?”
“সেই সুযোগটা তোমার ভাই দিলে তো। গিয়েছিলাম তো মাফ চাইতে। কিন্তু তোমার ভাই বলেছে, আমার সাথে কথা বলতে সে বিরক্তবোধ করে। সম্ভবত আমার চেহারাটাও সে দেখতে চাও না। যাই হোক, বাদ দাও। এসব কথা বলে আর কোনো লাভ নেই।”
“লাভ আছে কী নেই সেটা পরে দেখা যাবে। আমি নিশ্চয়তা দিতে পারছি না, তবে আমার মতো করে চেষ্টা করব আমি। কিন্তু আল্লাহ চাইলে তানিম ভাইয়ের সাথে যদি তোমার বিয়েটা হয়৷ তাহলে কিন্তু অনেককিছুই চেঞ্জ হয়ে যাবে। বিশেষ করে তোমার ছেলে বন্ধুদের সাথে কন্টাক্ট অফ করে দিতে হবে। তানিম ভাই যেরকম মেয়েকে নিজের স্ত্রী হিসেবে চায়, তুমি তার একেবারে বিপরীত। বিয়ের পরে নিজেকে চেঞ্জ করতে পারবে তো?”
চাঁদনী হঠাৎ বিয়ের কথা বলায় কিছুটা লজ্জা পেল নম্রতা। আবারও চুপ করে রইল ও।
চাঁদনী এবার বিরক্ত হলো কিছুটা,
“আমি একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলাপ করছি। তুমি এভাবে চুপ করে থাকলে তো হবে না।”
“প্রয়োজনে চেঞ্জ করব নিজেকে।”
কিছুক্ষন থেমে চাঁদনী আবার বলল, “তোমার কাছে আরও একটা অনুরোধ। যদি কেউ বিয়ে সম্পর্কে তোমার মতামত জানতে চায়, তাহলে এমন চুপ করে থেক না। সরাসরি ‘হ্যা’ না বললেও এটা বোলো যে পরিবারের সবাই যা সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই তোমার সিদ্ধান্ত হবে।”
নম্রতা ভরসা পেল না তেমন চাঁদনীর কথায়। যে লোকটা নম্রতার সাথে কথা অব্দি বলতে চায় না, সে ওকে বিয়ে করতে রাজি হবে? আদৌ সম্ভব এটা।
৩৯.
চাঁদনী শুধু একটা সুযোগ খুঁজছিল কথাগুলো বলার জন্য। সেই সুযোগটা ও পেল পরেরদিন বিকালে। আর ঠিক আটদিন পরে সাদমানের বিয়ে। চাঁদনীর বাবা, চাচা আর ভাইয়েরা মিলে দাওয়াতের লিস্টটা চেক করছিল। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কাউকে দাওয়াত দেওয়া বাদ পড়ে গেল নাকি। চাঁদনী তখন রুমে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল,
“তোমাদের সাথে কিছু কথা ছিল। আগে তোমাদের কাজগুলো শেষ করো, তারপর কথা বলব।”
তানিম বলল, “কাজ শেষ করতে হবে না৷ তুই কি বলতে চাইছিস বল।”
“আমি খুব সিরিয়াস একটা কথা বলতে চাইছি। সময় লাগবে আমার। তাই বলছিলাম…।”
“সমস্যা নেই৷ আমরা পরে করে নেব কাজ।” চাঁদনীকে থামিয়ে দিয়ে বললেন এনায়েত তালুকদার।
“এভাবে কথা বলা যাবে না বাবা। দাঁড়াও আমি আগে মা, চাচী আর আমার শ্বাশুড়িকে ডেকে নিয়ে আসি৷ সবার সামনেই আমি কথাটা বলতে চাই।”
চাঁদনী রুম থেকে বের হয়ে গেল। অন্যরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। চাঁদনীর কথায় সবাই মোটামুটি কনফিউজড হয়ে গেছে। চাঁদনী সবাইকে নিয়ে ফিরল কিছুক্ষনের মধ্যেই।
সোফার এককোনে বসে সিরিয়াস স্বরেই সে বলা শুরু করল, “কথাটা আসলে আমার ননদ নম্রতা আপু বিষয়ক। পরিচয়ের শুরু থেকেই আমার সাথে তার খুব ভালো সখ্যতা ছিল৷ এবং তখন থেকেই তাকে নিয়ে আমার মনে একটা সুপ্ত ইচ্ছেও ছিল। সাদমান ভাইয়ের বিয়েটা হুট করে ঠিক হয়ে যাওয়ায় আমি আমার ইচ্ছের কথা জানাতে পারিনি। কিন্তু এবার আর আমি দেরি করতে চাই না। আমি চাই, তানিম ভাইয়ের সাথে নম্রতা আপুর বিয়ে হোক।”
রুমের মধ্যে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল চাঁদনীর মুখের দিকে। নীরবতা ভেঙে সবার আগে কথা বললেন মরিয়ম খাতুন
“তুমি এসব কী বলছ চাঁদনী? এভাবে হুট করে কি বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। তাছাড়া তানিমের বিয়ে তো ঠিক হয়েই আছে।”
“বিয়ের কথা চলছে মা, এখনও মেয়েপক্ষকে সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। সেরকম হলে তাদের না বলে দেওয়া হবে। কিন্তু আপনি এমনভাবে বলছেন কেন? নম্রতা আপুর জন্য তানিম ভাইকে কি আপনার যোগ্য বলে মনে হচ্ছে না?”
“না না। কি বলছ তুমি এসব! তানিমের মতো ছেলেকে পছন্দ না করার কোনো কারন নেই। বরং সেরকম কিছু হলে আমি খুশিই হবো। কিন্তু এরকম হুট করে তো কিছু হয় না। সবার মতামত নেওয়ারও তো প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে তানিম এবং নম্রতার।”
চাঁদনী এবার তানিমের দিকে তাকিয়ে বলল, “নম্রতা আপুর মতামত পরে নেব। আগে অন্য সবার মত আছে কিনা জেনে নেই। এটা আমার আবদার বলতে পার তোমাদের কাছে। আশা করি আমার ইচ্ছেটা গুরুত্ব পাবে তোমাদের কাছে।”
বেলায়েত তালুকদার সবার আগে তার মত জানালেন, “আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং নতুন একটা সম্পর্ক তৈরি হলে নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তাটা আরও মজবুত হবে। ভাইজান, সাখাওয়াত তোমরা কী বলো?”
এনায়েত তালুকদার জবাব দিলেন, “মরিয়মের মেয়ে এই বাড়ির বউ হয়ে আসবে এতে আপত্তির কী আছে। চেয়ারম্যান সাহেবকে নাহয় না বলে দিলাম। কিন্তু তানিমের মত আছে কিনা সেটাও তো জানা দরকার। তানিম, তোর কিছু বলার থাকলে বলতে পারিস।”
রুমের সবগুলো চোখ এবার স্থির হলো তানিমের দিকে। তানিম গম্ভীর মুখে এতক্ষনের আলাপ শুনছিল। চাচার প্রশ্ন শুনে জবাব দিতে খুব একটা সময় নিল না ও।
“চাঁদনী যেটা চেয়েছে সেটাই হোক।”
চাঁদনী হাসল বিজয়ের হাসি।
এনায়েত তালুকদার বললেন, “মরিয়ম, এবার তাহলে নম্রতা মাকে ডেকে তার মতটা নিয়ে নেই। তারপর তুমি নম্রতার বাবা আর ভাইয়ের সাথে আলাপ করে ফেল পুরো ব্যাপারটা। তারপর একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যাবে।”
মরিয়ম খাতুন সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। চাঁদনী প্রায় সাথে সাথেই ছুটল নম্রতাকে ডাকতে।
নম্রতা এসে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়াল এককোনে। হঠাৎ করেই কেন জানি ওর ভয় লাগছিল খুব।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)