নিভৃত রজনী পর্ব-১৯+২০+২১

0
167

নিভৃত রজনী
| ১৯ | (১৬৫০+ শব্দ)

জামশেদ সাহেব কিছু বলার ভাষা হারিয়ে শুধু ফ্যালফ্যাল করে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

নওয়াজ একটু সময় দিল বাবাকে প্রথম কথাটুকু গলাধঃকরণ এর জন্য। জামশেদ সাহেবও খুব দ্রুতই সামলে নিলেন নিজেকে।
“ভালো কথা বিয়ে করবে। আমরা ঢাকায় ফিরে নাহয় এই বিষয়ে আলাপ করব৷ এখন একটা ইনভাইটেশনে যাচ্ছি। এখন এসব বলার কি খুব দরকার আছে?”

“দরকার আছে আব্বু। এখনই সঠিক সময় তোমাকে কথাগুলো বলার। তুমি প্লিজ একটু মন দিয়ে আমার কথাগুলো শুনো।”

নওয়াজ সংক্ষেপে চাঁদনীর প্রতি ওর দুর্বলতাটুকু বলে গেল। যদিও বাবার কাছে ব্যাপারগুলো শেয়ার করতে কিছুটা আনইজি লাগছিল। কিন্তু না বলেও পারছিল না ও। মরিয়ম খাতুনও যে চাঁদনীকে পুত্রবধূ করতে চান, সেটুকু উল্লেখ করতেও ভুলল না। কারণ ও জানে মায়ের কথা বললে বাবা ব্যাপারটাকে একটু বেশিই গুরুত্বের সাথে দেখবেন।

জামশেদ সাহেব সব শুনলেন গম্ভীরমুখে। তারপর বললেন,
“সব ঠিক আছে। কিন্তু এখনই বিয়ের ডিসিশানটা নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছি না আমি। আচ্ছা, এখন এসব কথা থাক। দাওয়াতটা অ্যাটেন্ড করে ঢাকা ফিরে আসি আগে। তারপর তোমার মায়ের সাথে বসে পুরো ব্যাপারটা ডিসকাস করা যাবে।”

নওয়াজ ইচ্ছে করেই আকরাম সম্পর্কিত সেদিন রাতের ব্যাপারটুকু আমজাদ সাহেবকে বলেনি। তাই তিনি ছেলের মনের অবস্থা পুরোপুরি আঁচ করতে পারছিলেন না। নওয়াজ নিজেও বলতে পারছিল না যে চাঁদনীকে হারিয়ে ফেলার একটা ভয় অট্টালিকা গড়ে তুলছে ওর মনের মধ্যে।

যদিও ব্যাপারটা বাবার সাথে আলাপ না করে মায়ের সাথে করতে পারলে ভালো হতো৷ কিন্তু সেই রাস্তাও নওয়াজ নিজ হাতে বন্ধ করে দিয়েছে।

শেষদিন যখন চাঁদনীকে বিয়ে করা নিয়ে মায়ের সাথে তর্ক হয়েছিল সেদিন মরিয়ম খাতুন স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছিলেন, নওয়াজের বিয়ে সম্পর্কিত কোনো ব্যাপারে তিনি আর কখনও থাকবেন না। নিজের মায়ের রাগ আর জেদ সম্পর্কে নওয়াজ খুব ভালো করেই অবগত আছে। খুব সহজে রাগে না মা, কিন্তু একবার রেগে গিয়ে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে হাতে পায়ে ধরেও তাকে টলানো যায় না।

নওয়াজ জানে মাকে এখন হাজারবার অনুরোধ করলেও তিনি নওয়াজকে কোনোপ্রকার সাহায্য করবে না। এই মুহূর্তে তাই এরচেয়ে ভালো কোনো উপায় ওর মাথায় আসছে না। মন বলছে, যত দ্রুত সম্ভব চাঁদনীকে নিজের করে নিতে হবে, নইলে যেকোনো সময় হাতছাড়া হয়ে যাবে সে।

নওয়াজ তাই খুব বেশি ব্যাখ্যার মধ্যে গেল না। ও অনুমান করেছিল, বাবা হয়তো এমন কিছুই বলবে। তাই পরের চালটা চালল ও,
“আমি তোমার কথা রেখেছি আব্বু৷ নিজে কিছু করার খুব ইচ্ছে ছিল আমার৷ তবুও শুধু তোমার কথায় তোমার ব্যাবসা বুঝে নিচ্ছি। তাই তোমারও উচিৎ আমার কথা রাখা।”

কথাগুলো বলার সময় নওয়াজ নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে নার্ভাস লাগছিল খুব৷ ও অপেক্ষা করছিল জামশেদ সাহেবের পরবর্তী কথা শোনার জন্য। কিন্তু তিনি আর খুব একটা তর্কে গেলেন না। বললেন, “আমার ভেবে দেখতে হবে আরেকটু।”
নওয়াজ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।

তালুকদার মঞ্জিলে যখন ওরা পৌঁছাল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
সবার সাথে সৌজন্যসাক্ষাতের পর জামশেদ সাহেব রুমে গিয়ে ফ্রেশ হলেন। মরিয়ম খাতুন বললেন, “তুমি এখন কিছুক্ষন রেস্ট নাও। আমি গিয়ে দেখি তোমাদের নাস্তার কী বন্দোবস্ত হলো।”
“নাস্তা পরে হবে। আগে এখানে বসো, তোমার সাথে আমার কথা আছে।”
“বুঝলাম, শুনব কথা। তার আগে অন্তত খাও কিছু। এত লম্বা জার্নি করে এসেছ।”

মরিয়ম খাতুনের আপত্তি স্বত্বেও তাকে হাত ধরে টেনে এনে বসালেন জামশেদ সাহেব। নওয়াজের সাথে রেস্টুরেন্টে হওয়া কথোপকথন পুরোটাই খুলে বললেন স্ত্রীকে। মরিয়ম খাতুন অবাক হয়ে শুনলেন সব কথা। তারপর আনন্দের আতিশায্যে স্বামীর একহাত ধরে উৎফুল্ল কন্ঠে বললনে, “তাহলে চলো, আজই এনায়েত ভাইয়ের সাথে আলাপ করে বিয়ের কথাটা পাকা করে ফেলি। পারলে বিয়েটাও আজ পড়িয়ে রাখব।”

জামশেদ সাহেব স্ত্রীর কথায় দ্বিগুন আশ্চর্য হলেন।
“তুমিও কি তোমার ছেলের মতো পাগল হয়ে গেলে। বলল আর বিয়ে হয়ে গেল। এত সহজ সব?”

মরিয়ম খাতুন এবার ঠান্ডা মাথায় বোঝাতে লাগলেন স্বামীকে,
“আমি প্রথম থেকেই চাইতাম চাঁদনীকে আমার পুত্রবধূ করতে। কিন্তু তোমার ছেলে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। অনেক চেষ্টা করে তাই হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। এখানে আসার পর জানতে পারলাম, চাঁদনীর পরিবার থেকে যতদ্রুত সম্ভব ওর বিয়ে দিতে চাইছে। বিশেষ করে চাঁদনী ডাক্তারিতে চান্স পাওয়ার পর তাদের তোড়জোড় আরও বেড়ে গেছে। চাঁদনী এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে। তাই ওকে নিয়ে কেউ রিস্ক নিতে চাইছে না। ঢাকা শহরে একা একটা মেয়ে ডাক্তারি পড়তে গিয়ে যদি কোনো সম্পর্কে জরিয়ে যায়, এই ভয় পাচ্ছে সবাই। তাই এনায়েত ভাই চান যত দ্রুত সম্ভব ওর বিয়ে দিতে। সম্ভবত এখন একটা খুব ভালো প্রপোজালও আছে ওনাদের হাতে। যেকোনো সময় সেটা ফিক্সড হয়ে যেতে পারে। এতদিন আমি কিছুই বলিনি, কারন আমি জানতাম নওয়াজ চাঁদনীকে বিয়ে করতে চায় না। কিন্তু এখন নিজেই যেহেতু তোমার কাছে বলেছে যে ও চাঁদনীকে পছন্দ করে, তাহলে আর আমি দেরি করতে চাই না।”
একটানা কথা বলে থামলেন মরিয়ম খাতুন।

জামশেদ সাহেবের আর কোনো কথা বলার জো রইল না। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, “ঠিক আছে, তোমরা মা ছেলে দুজনেই যেহেতু চাইছ, আমি আর কি বলব, যা খুশি করো।”

“যা খুশি করো মানে? আমি একা করব নাকি? তুমিও যাবে আমার সাথে।”

“ওকে, যাব। আগে কিছুক্ষন রেস্ট নেই।”
“রেস্ট পরে, তুমি এখনই যাবে।”

জামশেদ সাহেব উঠে বসতে বসতে বললেন, “সত্যিই, এখানে আসার পর তোমার বয়স মনে হয় পঁচিশ বছর কমে গেছে।”

৩২.
রাতের খাবারের পর চাঁদনীর ডাক পড়ল বাবার রুমে। রুমের সামনে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়লো চাঁদনী, “বাবা, আসব?”
“আয়।”
চাঁদনীকে ডেকে এনে নিজের পাশে বসালেন এনায়েত তালুকদার। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেন তিনি। সেদিনের সেই ছোট্ট চাঁদনী আজ কত বড় হয়ে গেছে। আজকে তিনি চাঁদনীকে ডেকেছেন বিশেষ একটি কারনে।

চাঁদনী জিজ্ঞাসা করল, “হঠাৎ আলাদা করে ডেকে পাঠালে যে? ব্যাপারটা কী?”
“একটা বিষয়ে তোর মতামত জানতে ডেকেছি। তোর মায়ের শারিরীক অবস্থা তো জানিস। বেশিরভাগ সময় অসুস্থই থাকে। সে চায় তোর বিয়েটা দেখতে। শুধু সে নয়, আমি তোর ছোট আব্বু, এমনকি তোর ভাইদেরও একই মত। সেজন্যই তোকে আজ এখানে ডাকা। আমি সবার সাথে আলোচনা করে একটা ছেলেকে পছন্দ করেছি। চাইলে তুই নিজেও ছেলের সাথে আলদা করে কথা বলতে পারিস। তোর মা নিজেই তোর সাথে কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু মতামতটা আমি তোর মুখ থেকেই শুনতে চাইছিলাম। দরকার হলে সময় নে, তারপর আমাকে ভেবে জানা, মা।”

বিয়ে সম্পর্কিত আলাপ একটু আধটু চাঁদনীর কানেও আসছে কয়েকদিন ধরে। নায়লা ভাবী কয়েকদিন আগে বলেছিল চাঁদনীকে। আজ এখানে আসার আগে চাঁদনী কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল, ওকে ঠিক কিসের জন্য ডাকা হচ্ছে। বাবা মায়ের টেনশন বুঝতে পারছে চাঁদনী। বিয়ে করতে খুব একটা আপত্তিও নেই ওর। কিন্তু অন্য কাউকে বিয়ে করতে হবে মনে পড়লেই সেই বিশেষ একজনের কথা মনে পড়ে যায়। পরক্ষনেই শাসায় নিজেকে। না ওই লোকটার কথা আর একদম ভাবা যাবে না।

ভুলতে চেয়েও তাকে ভোলা দায় হয়ে যাচ্ছে চাঁদনীর জন্য। হঠাৎ ওর মাথায় এলো, আচ্ছা বিয়েটা করে ফেললে কেমন হয়? এখন তাকে ভুলে যাওয়া যতটা কঠিন মনে হচ্ছে, হতে পারে বিয়ের পর তাকে খুব সহজেই ভুলে যাওয়া যাবে। হয়তো নতুন একজনের সাথে বাঁধা পড়ে গেলে পুরোনোকে ভুলে যাওয়া সহজ হবে। সবসময় ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া চাঁদনী জীবনে প্রথমবার নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটি নিয়ে নিল কয়েক মিনিটের মধ্যেই।

“ভাবার দরকার নেই বাবা। তোমরা যা ভালো মনে করবে আমার জন্য সেটাই করো। আমি জানি, তুমি, ছোট আব্বু আর ভাইয়ারা আমার জন্য খারাপ সিদ্ধান্ত নেবে না।”

এনায়েত তালুকদার অনেকটাই নিশ্চিত ছিলেন যে মেয়ে তার মুখের উপরে অমত করবে না। সেজন্য আগেই তিনি কথা দিয়ে ফেলেছেন মরিয়ম খাতুনকে।

এনায়েত তালুকদারের এখনও মনে পড়ে সেই দিনটির কথা। যেদিন গুটিগুটি পায়ে তালুকদার মঞ্জিলে প্রথমবার তার বাবার সাথে মরিয়ম নামের ছোট্ট মেয়েটি এসেছিল। দুপাশে বিনুনি ঝুলিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি তখন সবে শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা রেখেছে। বাবা সেদিন বলেছিলেন, “এনায়েত, তোমাদের দুই ভাইয়ের কোনো বোন নেই বলে তোমরা খুব আফসোস করতে না? নাও, আজ তোমাদের জন্য বোন নিয়ে এসেছি।”

ব্যাস, সেদিন থেকেই শুরু। মরিয়ম খাতুনকে ওরা দুই ভাই ভালোবাসত নিজের মায়ের পেটের বোনের মতো। মরিয়ম খাতুন যখন ‘ভাইজান’ বলে ডাক দিত, তখন মনেই হতো না যে তার সাথে তালুকদার মঞ্জিলের কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। এভাবেই চলছিল দিনগুলো।

বছরের পর বছর পেরিয়ে গেল। তারপর একদিন মরিয়ম খাতুনের বিয়ে হয়ে গেল। প্রথম প্রথম বিয়ের পরে মাঝেমাঝে আসতেন মরিয়ম খাতুন, চিঠিও লিখতেন। কিন্তু আস্তে আস্তে দুটোই বন্ধ হয়ে গেল। দুরত্ব বাড়ল, পক্ষান্তরে কমল যোগাযোগ।

তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনের মতো উন্নত হলে হয়তো যোগাযোগটা ওভাবে বন্ধ হয়ে যেত না। দেখাসাক্ষাৎ অথবা কথাবার্তা না হলেও এনায়েত কিংবা বেলায়েত তালুকদার কখনোই ভোলেননি তাদের বোনটির কথা। আজ বহুবছর পর চাঁদনীর জন্যই বলতে গেলে আবার যোগাযোগ হলো তার সাথে। সেই বোন আজ এনায়েত তালুকদার সহ বাড়ির সবাইকে একত্রিত করে প্রস্তাব রেখেছে চাঁদনীকে তার পুত্রবধূ করে নেওয়ার জন্য৷

অন্য জায়গায় চাঁদনীর বিয়ে প্রায় ঠিক হয়েই ছিল। কিন্তু মরিয়ম খাতুনের মুখের উপর বারণ করার সাধ্য এনায়েত তালুকদারের ছিল না। তাই প্রায় ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়েটা ভেঙে দিয়ে মরিয়ম খাতুনের ছেলের সাথেই বিয়েটা ঠিক করল সবাই মিলে। এই কয়েকদিনে মরিয়ম খাতুন সম্পর্কে সবারই একটা ধারণা হয়ে গেছে। তাই কারোর দ্বিমত পোষণ করার মতো কোনো অবকাশই রইল না।

অন্যকেউ হলে এত সহজে কখনও রাজি হতেন না এনায়েত তালুকদার। অন্তত কয়েক দফায় পাত্রপক্ষ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তবেই জানাতেন মতামত। মরিয়ম খাতুনকে তিনি বিশ্বাস করেন বলেই খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি।

কিন্তু সমস্যা হলো, মরিয়ম খাতুন আজই বিয়েটা পড়িয়ে রাখতে চাইছেন। এনায়েত তালুকদার চাইছিলেন তামজীদের বিয়ের পর ধুমধাম করে চাঁদনীর বিয়ে দিতে। কিন্তু মরিয়মের যুক্তি শোনার পর মনে হলো, এখনই বিয়ে দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত হবে। সত্যিই তো, আর কিছুদিন পর চাঁদনী পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে৷ তাছাড়া ডাক্তারীতে যে পড়ার চাপ তাতে বিয়েশাদির ঝামেলা করলে ওর পড়ার ক্ষতি হতে পারে। তারচেয়ে এখন যখন আত্মীয়স্বজন সবাই আছে, তাহলে এখনই বিয়েটা পড়িয়ে রাখা যাক। পরে একসময় সুযোগ বুঝে অনুষ্ঠান করলেই হলো। আর বিয়েটা হয়ে গেলে চাঁদনীকেও নিশ্চিন্ত মনে আবার ঢাকা পাঠানো যাবে। এনায়েত তালুকদার চাঁদনীর মতামত নিয়ে গঞ্জের বাজারে লোক পাঠালেন কাজী নিয়ে আসার জন্য।

তালুকদার মঞ্জিল আজ আত্মীয়স্বজনে ভরপুর। রাত পোহালেই তামজীদের বিয়ের জন্য বরযাত্রী যাবে। রাতে সবাই তখন আগামীকালের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত। চাঁদনী সবেমাত্র রাতের খাবার খেয়ে রুমে এসেছে। ঠিক তখনই তার পিছুপিছু এসে ঢুকল নায়লা আর নম্রতা। তাদের মুখের হাসিটা কী আজ অন্যরকম লাগছে!

নায়লার হাতে লাল বেনারসি। পুরো ব্যাপারটা তখনও বোধগম্য হচ্ছিল না চাঁদনীর। তারপর হুট করেই ওর মস্তিষ্ক কাজ করতে শুরু করল। তারমানে আজই বিয়ে? কীভাবে সম্ভব! কিছুক্ষন আগে মতামত নিয়ে এত দ্রুত বিয়ের আয়োজন।

হতভম্ব চাঁদনীকে নায়লা নিজেই শাড়িটা পড়িয়ে দিল। নম্রতা সাজিয়ে দিল অল্পস্বল্প। চাঁদনীর বুকের মধ্যে তখন দামামা বাজছে। একতরফা একটা ভালোলাগাকে তাহলে আজই হত্যা করতে হবে গলা টিপে। এরপর আর ওই মানুষটাকে নিয়ে ভাবা যাবে না কখনও। আজ রাতেই শরীরে আর মনে অন্য কারও সীলমোহর লেগে যাবে। উদাস দৃষ্টি আর ভগ্ন হৃদয় নিয়ে চাঁদনী অপেক্ষা করতে লাগল সেই বিশেষ মুহূর্তের। অনেক চেষ্টা করেও আর শেষপর্যন্ত সামলাতে পারল না নিজেকে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল চাঁদনী।

বিয়েটা হলো খুব সাদামাটা ভাবে। কাজীর মুখে প্রথমবার হবু বরের নামটা শুনল চাঁদনী। সাথে সাথেই বুকটা ধ্বক করে উঠল ওর। চোখ তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে পলক ফেলতে ভুলে গেল ও।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
| ২০ | (১৭০০+ শব্দ)

বিয়েটা হলো খুব সাদামাটা ভাবে। কাজীর মুখে প্রথমবার হবু বরের নামটা শুনল চাঁদনী। সাথে সাথেই বুকটা ধ্বক করে উঠল ওর। চোখ তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে পলক ফেলতে ভুলে গেল ও।

নিশ্চিত হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। নইলে এরকম অসম্ভব একটা বিষয় কেন চোখের সামনে দেখবে ও! তাকে নিয়ে বেশি ভাবছে বলেই বোধহয় চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। চোখ নাহয় ভুল দেখছে, কিন্তু তাই বলে কি কানও ভুল শুনছে! নাহ, আর ভাবা যাচ্ছে না কিছু। সব কেমন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। একপলক তার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে ফেলল চাঁদনী।

আকদ হয়ে যাওয়ার পর মরিয়ম খাতুন এসে আলতো করে জরিয়ে ধরলেন চাঁদনীকে। কপালে ছোট্ট করে চুমু দিয়ে বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ, অবশেষে আমার মনের ইচ্ছে পূরণ হলো। আমি সবসময় চাইতাম এই মিষ্টি মেয়েটাকে আমার পুত্রবধূ করতে। শেষপর্যন্ত আমাকে নিরাশ হতে হয়নি।”

তখনও সবকিছু চাঁদনীর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল। নিজের মনের অনুভূতিগুলো সংশয়ে দোদুল্যমান আজ। মনের মধ্যে একান্ত গোপনে যাকে জায়গা দিয়েছিল, সেই মানুষটাকেই আজ নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে, কিন্তু তবুও খুশি হতে পারছে না চাঁদনী। বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন মনের মধ্যে আটঘাট বেঁধে বসে আছে। বিয়েটা কেন করল নওয়াজ? যে কখনও চাঁদনীর দিকে ভালো করে ফিরেও তাকায়নি, চাঁদনীর দুর্বলতার কথা জেনে যে নিজে থেকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, চাঁদনীকে বিয়ে করতে যার এত অনীহা ছিল, সে হুট করেই কেন বিয়েটা করল?

বাড়িভর্তি লোকজন সবাই এসে দেখে যাচ্ছে চাঁদনীকে। কেউ কেউ ঠাট্টাও করছে। ওর কানে এসব ঢুকলেও মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না। নিজের ভাবনাতেই বুদ হয়ে আছে চাঁদনী। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে একটা মাটির পুতুল বসে আছে নিশ্চুপ হয়ে।

রাত বেড়ে যাচ্ছে। কাল সকালে আবার বর‍যাত্রী যাবে তামজীদের সাথে। তাড়াহুড়ো করে তাই চাঁদনীকে ওর রুমে দেওয়া হলো। এই অল্প সময়ের মধ্যেই চাঁদনীর রুমের চেহারা পাল্টে গেছে। হালকা ফুল দিয়ে পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে পুরো রুম। বিছানার পাশেই একটা লাগেজ। লাগেজটা কার সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না ওর। এরকম ভারী শাড়ি সচরাচর পড়া হয় না বলে বিরক্ত লাগছে খুব। কিন্তু তবুও চেঞ্জ করল না চাঁদনী। মনের ভিতরে জমা প্রশ্নগুলো এখন ক্রোধে পরিনত হচ্ছে।

শাড়ি পড়েই খাটের এককোনে থম মেরে বসে থাকল চাঁদনী। নওয়াজ রুমে ঢুকল নিঃশব্দে। এসে চাঁদনীর পাশে কিছুটা দুরত্ব রেখে বসল। তারপর ঘন গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল, “কেমন আছ চাঁদনী?”

খুব সাধারন প্রশ্ন, তবুও চাঁদনী কেঁপে উঠল। আজ নওয়াজের কন্ঠস্বরটা কি অন্যরকম লাগছে? কেমন একটা মাতাল করা। জবাদ দিতে গিয়েও কী একটা মনে হতে আর জবাবটা দিল না ও। পালটা প্রশ্ন করল সরাসরি নওয়াজের মুখের দিকে তাকিয়ে, “বিয়েটা কেন করলেন?”

হঠাৎ প্রশ্নটা করায় নওয়াজ চমকাল ভীষণভাবে। চাঁদনীর এমন কঠিন দৃঢ় কন্ঠস্বর এর আগে কখনও শোনেনি ও। নওয়াজ বলল, “তুমি কি খুব বেশি রেগে আছ? আমরা ঠান্ডা মাথায় বসে কথা বলতে পারি।”

আবারও নওয়াজের কথা এড়িয়ে নিজের মতো করেই বলে গেল ও, “মায়ের কথা রাখতে এতো বড় আত্মত্যাগ না করলেও হতো।”
নওয়াজ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “মানে?”
“বিয়েটা তো মায়ের খুশির জন্যই করেছেন, তাই না?”
“তোমাকে কে বলল এসব?”
“আপনি নিজেই তো বলেছেন। আপনার মা চায়, আমাকে ছেলের বউ করে নিতে কিন্তু আপনি চান না। চাইবেনই বা কেন? আমাকে বিয়ে করা মানে তো একপ্রকার পেইন, আমাকে বিয়ে করলে সাফার করতে হবে আপনাকে। আমি তো একটা বোঝা, যেটা আপনি না চাওয়া স্বত্বেও আপনার মা আপনার মাথায় চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। তাই না?”

নওয়াজের স্মৃতিপটে ভেসে উঠল সেই দিনটার কথা। যেদিন চাঁদনী কোচিং থেকে বাড়ি ফেরার পথে চলন্ত গাড়িতে ঠিক এই কথাগুলোই ও বলেছিল চাঁদনীকে। সেদিন মনে হয়েছিল ও যা করছে ঠিকই করছে। কিন্তু আজ ও বুঝতে পারছে সেদিন ওভাবে চাঁদনীকে কথাগুলো বলা মস্তবড় ভুল ছিল। পারলে সেদিনের সেই কথাগুলো এক্ষুনি উইথড্র করে নিত নওয়াজ।

নওয়াজ নিজের পক্ষে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করল, “তোমার বুঝতে কোথাও একটা ভুল হচ্ছে চাঁদনী।”

“আমার কোনো ভুল হচ্ছে না। আপনি অস্বীকার করতে পারবেন, আমাকে বিয়ে করা নিয়ে আপনার মায়ের সাথে আপনার তর্ক হয়নি? আপনি নিজে আপনার মাকে বলেছেন, আমাকে বিয়ে করলে আপনার লাইফ স্পয়েল হয়ে যাবে। আমি আপনার সাথে ঠিক ম্যাচ করি না। কী? বলেননি এসব?”
অবাক স্বরে প্রশ্ন করল নওয়াজ, “তুমি এসব কীভাবে জানলে?”

হাসল চাঁদনী, “সেদিন আপনার রুমে যেতে চেয়েছিলাম আপনার ঐ চরিত্রহীন বন্ধুটির কথা জানাতে। সে আমাকে বিরক্ত করছিল প্রচন্ড রকমের। সেদিন না চাইতেও আপনার এবং আপনার মায়ের কথোপকথন কানে এসেছিল আমার।”

নওয়াজ বুঝল চাঁদনীকে পেয়েও পুরোপুরি পাওয়া হয়নি ওর। নওয়াজের করা প্রত্যাখ্যান ওর মনে এখনো গেঁথে আছে ভয়ানকভাবে। ঠিক কীভাবে নিজের কথাগুলো শুরু করবে সেটাই বুঝতে পারছিল না নওয়াজ। চাঁদনী এখনও ভাবছে নওয়াজ মায়ের কথাতে বিয়েটা করেছে। চাঁদনীর এমনটা ভাবাই স্বাভাবিক।

বিছানায় এলিয়ে রাখা চাঁদনীর একটা হাত আলতো করে ধরে কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলল নওয়াজ। চাঁদনী তৎক্ষনাৎ ঝটকা মেরে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে জ্বলজ্বলে চোখে তাকাল নওয়াজের দিকে। সেই অগ্নিঝরা চোখের দিকে তাকিয়ে নওয়াজের সব ওলটপালট হয়ে গেল। প্রথমদিনের এক পলক দেখাতেই যেই চোখের ভাষা ও পড়ে নিয়েছিল, আজ সেই একই চোখের চাহনীকে এত দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে কেন কে জানে। এই চোখে কি আগের মতো মুগ্ধতা আর কোনোদিন দেখতে পাবে নওয়াজ?

চাঁদনীর গলা চড়ল কিছুটা, “একদম ছোঁবেন না আমাকে। আগে আমার প্রশ্নগুলোর স্পষ্ট উত্তর দিন। কেন এভাবে আমার জীবনটা নষ্ট করলেন?”

“আমি তোমার জীবন নষ্ট করেছি? এসব কী বলছ তুমি?”

“ঠিকই বলছি৷ সেচ্ছায় তো বিয়েটা করেননি। মাকে খুশি করতে করেছেন। তারমানে নিশ্চই স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক আমাদের মাঝে হবে না। তাহলে তো আমার জীবনটা নষ্টই হলো, তাই নয় কি?”

“তুমি একটু মাথা ঠান্ডা করে আমার কথা শোনো চাঁদনী।”

“আমি এখন কোনো কথা শোনার মতো অবস্থাতে নেই। এরকম অনুভূতিহীন একটা সম্পর্ক দিনের পর দিন বয়ে নিয়ে চলা আমার পক্ষে সম্ভব না।”
“তারমানে! তুমি কী বলতে চাও?”

“এই বিয়ে বিয়ে খেলা যথেষ্ট হয়েছে। এসব থেকে মুক্তি চাই আমার। যত দ্রুত সম্ভব আপনার মায়ের সাথে কথা বলবেন, তারপর ডিভোর্স….।”

“চাদনী!” এবার স্থান কাল পাত্র ভুলে চেঁচিয়ে উঠল নওয়াজ।
“তোমার মাথা ঠিক আছে? এখনও একঘন্টা পার হয়নি আমাদের বিয়ে হয়েছে। তুমি এরমধ্যেই এসব কী বলছ? নিজের মনগড়া কিছু ভিত্তিহীন ভাবনার উপর নির্ভর করে হুট করে একটা কথা বলে দিলেই হলো? এত সস্তা মনে হয় তোমার কাছে সব? আমি একবারও বলেছি যে মায়ের কথায় আমি তোমাকে বিয়ে করেছি? হ্যা, আগের কিছু পরিস্থিতির ভিত্তিতে তোমার মনে এরকম একটা ভাবনা আসা স্বাভাবিক। কিন্তু তার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য একবার আমার সাথে কথা বলো। সেটা না করে তুমি কী বলছ এসব আবোলতাবোল।”

একটু থেমে নওয়াজ আবার গলার স্বর নরম করল কিছুটা, “তোমাকে কীভাবে বোঝাব জানি না। আমি মায়ের কথায় বিয়েটা করিনি। আম্মু তো আমাকে বুঝিয়ে হাল ছেড়েই দিয়েছিল। আমি নিজেই আবার আব্বু এবং আম্মুর মাধ্যমে তোমার পরিবারের কাছে প্রস্তাবটা রেখেছিলাম।”

“তা হঠাৎ আপনার এমন পরিবর্তনের কারন জানতে পারি?”

চাঁদনী প্রশ্ন করার সাথে সাথেই দ্বিধাহীনভাবে উত্তর দিল নওয়াজ, “কারণ আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।”

কয়েকটা শব্দের ছোট্ট একটা লাইন। লাইনটা শুনে চাঁদনী পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল নওয়াজের দিকে। নওয়াজ আগে থেকেই তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। শুধু মুখের কথায় কখনও বিশ্বাস করত না চাঁদনী এই কথাটা৷ কিন্তু চোখ, চাঁদনীর দিকে স্থির হয়ে থাকা ওই অন্তর্ভেদী চোখদুটো বলে দিচ্ছে, এইমাত্র উচ্চারিত শব্দগুচ্ছ শুধুই কথার কথা নয়। হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ সেগুলো।

ওই চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘোর লেগে যাচ্ছিল চাঁদনীর। অজান্তে কখন মাথা থেকে শাড়ির আঁচলটা খসে পড়েছে সেটা ও নিজে না দেখলেও নওয়াজ খেয়াল করেছে। একগাছি ছোট চুল কানের পাশে বেয়ে গালের উপর পড়ে আছে অবিন্যস্ত হয়ে। অজান্তেই নওয়াজের হাত আবার চাঁদনীর গাল ছুঁয়ে গেল অবাধ্য চুলগুলোকে সরিয়ে দিতে।

চাঁদনীর হুঁশ ফিরল। ঝাড়া দিয়ে ক্ষিপ্র হাতে নওয়াজের হাত সরিয়ে দিল ও আবারও।

নওয়াজের ভালোবাসার ছোট্ট স্বীকারোক্তিতে মনের মধ্যে জমে থাকা অভিমানগুলো বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। কিন্তু তবুও কোথাও একটা কুন্ঠাবোধ রয়েই যাচ্ছে। এতদিন পরে হুট করে বোধোদয় হলো তবে তার।

চেয়েও নিজের রাগ ধরে রাখতে পারছিল না চাঁদনী। কিন্ত চোখেমুখে তার বিন্দুমাত্র রেশটুকু আসতে দিল না ও। এত সহজে ধরা দেবে না ও কিছুতেই। এতদিন প্রত্যাখান করে এসে এখন সে চাইলে তার এক কথাতেই সব ভুলে যাবে চাঁদনী? কক্ষনো না। চাঁদনী সস্তা কোনো খেলনা নয় যে নওয়াজের ইচ্ছেমতোই চলতে হবে ওকে। দেখা যাক, কতদিন ধৈর্য ধরতে পারে সে। মনের ভাবনাটুকু মনেই লুকিয়ে রেখে চাঁদনী কঠোর স্বরে প্রশ্ন করল আবার, “আশ্চর্য! আপনাদের বাড়ি থেকে এসেছি মাত্র কয়েকটা দিন গেল। এর মাঝে কী এমন হলো যে আপনি আমাকে ভালোবেসে ফেললেন?”

“কয়েকটা দিন না চাঁদনী। আমি অনেক আগে থেকেই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমি এমনই গাধা, নিজের অনুভূতিগুলো নিজেই বুঝতে পারিনি কখনও।”
পুরো চেহারায় করুণ এক অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলে কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে বলল নওয়াজ।

নওয়াজ মুখে ‘না’ বললেও তার চোখের ভাষা অন্যকিছু বলত সবসময়। এতদিন চাঁদনীর মনে হয়েছিল, নওয়াজের প্রতি উইকনেস কাজ করে বলেই হয়তো ওরকম মনে হচ্ছে ওর। কিন্তু নওয়াজের কথা শুনে নিশ্চিত হলো ও, কিছু একটা ওদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল সেই প্রথম দিন থেকেই।

চাঁদনী তবুও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারল না। বিছানা ছেড়ে উঠে আলমারির দিকে এগিয়ে গেল ও,

“সারাদিন অনেক পরিশ্রম হয়েছে। আমি ক্লান্ত খুব। এসব বাজে কথা শোনার সময় এখন আমার নেই।”

আহত শোনালো এবার নওয়াজের কন্ঠস্বর, “এসব তোমার বাজে কথা বলে মনে হচ্ছে? এতটা নিষ্ঠুর হয়ো না প্লিজ। তুমি তো এমন ছিলে না চাঁদনী।”

চাঁদনী কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করল না। ওয়াসরুম থেকে চেঞ্জ করে এসে বিছানার এককোনে শুয়ে পড়ল।

অগত্যা নওয়াজও চুপ করে শুয়ে পড়ল বিছানার অপরপাশে চাঁদনীর থেকে কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে। চাঁদনীকে নিজের কাছে টেনে নেওয়ার জন্য ওর হাতদুটো নিশপিশ করছিল, কিন্তু সাহস করে এগিয়ে যেতে পারছিল না নওয়াজ। চাঁদনীর এই রাগ কীভাবে ভাঙাবে সেট ভাবতে ভাবতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়ল ও।

৩৩.
তালুকদার মঞ্জিলে আসার পর এই কয়েকদিনে নম্রতার একটা অভ্যাস বদলেছে। সেটা হলও, খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা।

এ বাড়ির সবাই সকাল সকালই ঘুম থেকে উঠে যায়। এমনকি সাখাওয়াত এবং নায়লার পাঁচ বছরের ছোট্ট ছেলে নাভিদ, সেও সেই ফজরের ওয়াক্তে উঠে বসে থাকে বাবার সাথে মসজিদে যাওয়ার জন্য।

বাড়ির সবাই যেখানে খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, সেখানে অনেক বেলা অব্দি ঘুমিয়ে থাকাটা নিজের কাছেই কেমন একটা বেমানান লাগে নম্রতার। সেজন্য নম্রতাও আজকাল ঘুম থেকে উঠে পড়ে জলদি জলদিই। আজও খুব ভোরেই উঠল ও।

বাড়িতে আজ একটু বেশিই হৈচৈ হচ্ছে। নম্রতা নিচে নেমে দাঁড়িয়ে পড়ল। তানিম বসে আছে সোফাতে। তার পাশেই বসে আছে নাভিদ। নাভিদকে সকালের নাস্তা খাইয়ে দিচ্ছে তানিম। নম্রতা মাথা নিচু করে খাবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ও জানে, কঠিন হৃদয়ের পুরুষটি ওর দিকে ফিরেও তাকাবে না। তবুও তার সামনে গেলে চলার গতি কেন জানি শ্লথ হয়ে আসে, বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করে।

খাবার ঘরে ঢুকতেই নম্রতার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। নওয়াজ করুন মুখে বসে আছে একটা চেয়ারে। আর তার সামনে দশ থেকে বারো রকমের খাবার সাজিয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে আছে রেবেকা বেগম।

নওয়াজ খাবার খায় খুবই পরিমিত। সাধারণত বাসায় অনেকগুলো আইটেম রান্না হলেও নওয়াজ দুই একটা দিয়েই তার খাওয়া কমপ্লিট করে। এখানে এতো এতো খাবাররে চাপে পড়ে নওয়াজের বর্তমান অবস্থা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারছে নম্রতা। বাড়ির একমাত্র মেয়ে-জামাই বলে আপ্যায়নের ডোজটা একটু বেশিই হচ্ছে।

নম্রতা মুখ টিপে হেসে একদিকের চেয়ারে বসে পড়ল। নওয়াজ হতাশ চোখে তাকাল ওর দিকে। তাকানোর ভঙ্গিটাই ওর মনের কথা বলে দিচ্ছিল যেন, “এইবারের মতো বাঁচিয়ে নে বোন।”

নওয়াজকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে নম্রতা নিজের মতো নাস্তা খাওয়া শুরু করল।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
| ২১ | (১৪৫০+ শব্দ)

নওয়াজকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে নম্রতা নিজের মতো নাস্তা খাওয়া শুরু করল।

নাস্তা খাওয়া শেষ করে নাজেহাল নওয়াজকে ওখানে রেখে নম্রতা পা বাড়াল চাঁদনীর রুমের দিকে। একদিনের ব্যবধানে চাঁদনীর সাথে সম্পর্কের সমীকরণ বদলে গেছে।

নম্রতা দরজায় নক করে ঘরে ঢুকে প্রথমেই বলল, “তুমি তো আমার বড় ভাইয়ের বউ হয়ে গিয়েছ। এখনও কি আগের মতো নাম ধরেই ডাকব নাকি ভাবি ডাকব?”

চাঁদনী হাসল।
“তুমি আমাকে নাম ধরেই ডেক।”
“তুমি বললেই তো হচ্ছে না। ভাইয়ার কাছেও জিজ্ঞাসা করে দেখি। আফটার-অল তার বউ। তার মতামতেরও তো একটা ব্যাপার আছে।”
নম্রতার কথার প্রত্যুত্তরে চাঁদনী হাসল আবারও।

ততক্ষনে নওয়াজও রুমে এসেছে। নম্রতা ওকে দেখে অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “আরে ভাইয়া, এত জলদি তোমার ব্রেকফাস্ট করা হয়ে গেল?”

নওয়াজ চোখ পাকিয়ে তাকাল ওর দিকে।
নম্রতা হেসে বলল, “ভালো সময়েই এসেছ। তোমার বউয়ের সাথে সম্মোধন নিয়ে কথা হচ্ছিল। তাকে নাম ধরে ডাকব নাকি ভাবি ডাকব?”

“অফকোর্স ভাবি ডাকবি। বড় ভাইয়ের ওয়াইফকে কেউ নাম ধরে ডাকে?”

“ওকে, তবে তাই হোক।” হেসে বলল নম্রতা।

তারপর চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাবি, আমি এখন যাই তাহলে। তোমরা নিজেদের মতো সময় কাটাও।”

নম্রতা চলে গেল। তার পিছু পিছু রুমের বাইরে রওয়ানা দিল চাঁদনীও। নওয়াজ প্রশ্ন করল, “চলে যাচ্ছ?”
“কেন, কোনো দরকার আছে?”

“দরকার ছাড়া কি কিছুক্ষন সময় আমরা একসাথে থাকতে পারি না?”

“না।”

প্রশ্নটা নওয়াজ খুব আগ্রহ নিয়েই করেছিল। কিন্তু একটিমাত্র শব্দের উত্তর শুনে ওর মুখটা চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো হয়ে গেল।

সেই মুখটা দেখে চাঁদনীর মায়া হলো। কিন্তু তবুও ধরা দিল না ও।

দেখতে দেখতে কয়েকটা দিন কেটে গেল। বৌভাতের প্রোগ্রামের পরে আত্মীয়স্বজন যারা ছিল, সবাই একে একে বিদায় নিতে লাগল৷ নম্রতাদেরও ফিরে যাওয়ার সময় চলে এলো।

এই কয়দিনে নওয়াজ এবং চাঁদনীর মধ্যকার দুরত্ব কমেনি এতটুকুও। যদিও নওয়াজ শেষপর্যন্ত চেষ্টা করেই যাচ্ছিল নিজের মতো। কিন্তু চাঁদনীর দিক থেকে চেষ্টা ছিল না বিন্দুমাত্রও।

যাওয়ার দিন মরিয়ম খাতুন আলাদা করে চাঁদনীকে ডাকলেন নিজের রুমে।

“ডেকেছেন আন্টি?”
“এখনও আন্টি বলেই ডাকবে?”
“স্যরি, মা।”
“হয়েছে, আর স্যরি বলতে হবে না। চেয়েছিলাম তো তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে, কিন্তু শুনলাম যেতে চাইছ না নাকি।”
“আসলে মা, কিছুদিন পরেই অ্যাডমিশন। একবার ঢাকা গেলে তো অনেকদিন আবার বাড়িতে আসা হবে না৷ তাই চাইছিলাম, আরও কিছুদিন থেকে যেতে।” কৈফিয়ত দেয়ার স্বরে বলল চাঁদনী।

“পাগলী একটা, এভাবে কেন বলছ। তোমার বাড়িতে তুমি যতদিন খুশি থাকবে। সাবধানে থেক। আর যত দ্রুত সম্ভব আমার কাছে চলে যেও।”

“আরেকটা কথা মা।”
“কী কথা?”

“আমার পড়াশোনাটা আমি হোস্টেলে থেকে চালিয়ে যেতে চাই।”

“সেকি? কেন? আমাদের বাড়িতে থেকে পড়তে অসুবিধা কোথায়? ওখানে কি তোমার কোনো সমস্যা আছে?”
“কোনো সমস্যা নেই মা।”

“তাহলে কেন যাবে না? আমি চাই তুমি আমার কাছেই থাক।”

“আপনি চাইলে অবশ্যই সেটা হবে। কিন্তু মা, আপনি তো জানেনই ডাক্তারি পড়াটা আমার ছোটবেলার স্বপ্ন। আমি জানি, বাড়িতে থাকলে আপনি আমার যথেষ্ট খেয়াল রাখবেন। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, হোস্টেলের স্ট্রিক্ট পরিবেশে আমি পড়াশোনায় আমার কনসেন্ট্রেশন যতটা ধরে রাখতে পারব, বাড়িতে থাকলে আমি ততটা পারব না। আপনি চাইলে আমি বাড়িতে থেকেই পড়ব। কিন্তু তাতে আমার কনসেনট্রেশান ডিসট্রাক্টেড হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমবিবিএস করার পুরোটা সময় আমি শুধু পড়াতেই ফোকাস করতে চাই। যেটা বাড়িতে থেকে আমার জন্য কঠিন হয়ে যাবে।”

“আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি মা। আচ্ছা, তুমি যেভাবে চাও, সেভাবেই হবে।” চাঁদনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন মরিয়ম খাতুন।

চাঁদনী মৃদু হেসে বলল, “অনেক ধন্যবাদ মা।”

৩৪.
টেবিলের সামনে রাখা বইটা শব্দ করে বন্ধ করে দিয়ে বিরক্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেলল নম্রতা। গত দেড়ঘন্টা যাবত বই সামনে নিয়ে বসে থাকলেও পড়া হয়নি একটা অক্ষরও। হবেই বা কী করে! বিক্ষিপ্ত মন মেজাজ নিয়ে চাইলেও পড়ায় মনোযোগ ধরে রাখা যায় না।

তালুকদার মঞ্জিল থেকে ওরা ফিরেছে আর চারদিন হতে চলল। কিন্তু ফিরে আসার দিনের সেই তীব্র অপমানবোধ এখনও মস্তিষ্কে সদর্পে ঘুনপোকার মতো আক্রমণ করে চলেছে, কুটকুট করে।

নম্রতা তালুকদার মঞ্জিলে থাকাকালীন খুব করে একটা সুযোগ খুঁজছিল তানিমের সাথে কথা বলার। সেই সুযোগটা পেল ফিরে আসার দিন। সকালের নাস্তা করার পরে দক্ষিনের বারান্দায় গিয়ে যখন ও দাঁড়াল, তানিম তখন বাইরে কারও সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত ছিল।

নম্রতা মনের কথাগুলো গুছিয়ে গুটিগুটি পায়ে দ্বিধা নিয়ে দাঁড়াল তানিমের পিছনে। সেই প্রথমদিন তানিমের সাথে করা অহেতুক দুর্ব্যবহার ওকে পীড়া দিচ্ছিল খুব। নিজের সেই চুড়ান্ত বাজে ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইতেই গিয়েছিল ওখানে।

কয়েক মিনিট দাঁড়ানোর পরেও যখন তানিম ওর দিকে ফিরে তাকাল না, তখন ইচ্ছে করেই কয়েকটা শুকনো কাশি দিল দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য। তবুও তানিমের কোনো হেলদোল নেই। ফোনের ওপাশে কারও সাথে কথা বলেই গেল। নম্রতা চুপ করে অপেক্ষা করল ফোনালাপ শেষ হওয়ার। কিন্তু কথা বলা শেষ করে তানিম নম্রতাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে চলে যেতে শুরু করল। বাধ্য হয়েই নম্রতা ডাক দিল ওকে।
“শুনছেন?”
“আমাকে বলছেন?” খুব স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন করল তানিম।
“হ্যা, আপনার সাথে একটু কথা ছিল।”
“আমি আসলে ব্যস্ত কিছুটা।”
“ওকে, নো প্রব্লেম। তাহলে পরে কথা হবে।” যথেষ্ট বিনয়ের সাথে বলল নম্রতা।
“পরেও কথা হবে না।” কাটাকাটা জবাব তানিমের।
“মানে?” পরের কথাটা যেন বুঝতে পারল না নম্রতা।

“মানে নরমালি আমরা যদি কারও সাথে কথা বলতে আগ্রহী না হই, এবং সেটা তাকে সরাসরি না বলতে পারি, তখন আমরা ব্যস্ততার অযুহাত দেই। আপনি যেহেতু শহরে থাকা স্মার্ট মেয়ে এতটুকু তো আপনার বোঝার কথা। কিন্তু আপনি যখন বুঝতে পারছেন না, তাই আমিই বলছি। আমি আপনার সাথে কথা বলতে প্রচন্ড বিরক্তবোধ করছি। বলা যায়, আমি একেবারেই আগ্রহী নই আপনার সাথে কথা বলতে।”

কথাগুলো তানিম বলেছিল একেবারেই স্বাভবিক কন্ঠে। রাগের ছিটেফোঁটা বহিঃপ্রকাশ ছিল না ওর কন্ঠে। নম্রতার এতদিন মনে হতো, পুরুষরা রাগলে তাদের গলা চড়ে যায় সবার আগে। কিন্তু এরকম শান্ত নরম স্বরেও যে কোনো পুরুষ রাগ দেখাতে পারে, সেটা ও জানত না। তানিমের ঠান্ডা মেজাজে বলা কথার তীর লক্ষ্যভেদ করল ঠিক নম্রতার হৃদয় বরাবর। শুধু কয়েকটা বাক্যে কী ভীষণভাবেই না সে অপমান করল নম্রতাকে।

নম্রতা ওখানে দাঁড়িয়েই কেঁদে ফেলল। তবুও তানিমের মন গলল না। কান্নারত নম্রতাকে ওখানে রেখেই চলে গেল তানিম। চূড়ান্ত পর্যায়ের অপমানিত হয়ে সারাটা সকাল কেঁদেই কাটাল নম্রতা।

সেই অপমানবোধের দগদগে ঘা গত চারদিনে এতটুকুও শুকায়নি। বরং প্রত্যেকদিন অসংখ্যবার সেই মুহুর্তটুকুর কথা মনে করে ঘা-টা আরও তাজা হয়েছে।

কিন্তু এতকিছুর পরেও তাকে ভুলতে পারছে না ও কিছুতেই। বরং অ্যাট্রাকশনটা আগের চেয়ে আরও স্ট্রং হয়েছে। এমনকি নম্রতারা যখন ফিরে আসছিল, কতবার যে ও পিছনে ফিরে তাকিয়েছে তাকে একপলক দেখার জন্য।

মোবাইলে আসা নোটিফিকেশনের শব্দে চমকে উঠে ভাবনার জগৎ থেকে বের হলো ও। চেয়ার ছেড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল কিছুক্ষনের জন্য। বিকেলের এই সময়টাতে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালে মন কিছুটা হলেও ফুরফুরে হয়।

নম্রতার দৃষ্টি কিছুক্ষন এদিক ওদিক ঘুরে গেটের কাছে এসে থেমে গেল। গেট দিয়ে যেই গাড়িটা ঢুকছে, এটাকে নম্রতা চেনে। আর চেনে বলেই ওর পালপিটিশিন বেড়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। নম্রতার মনে হলো ওর দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে। নইলে হঠাৎ এই অসময়ে তাকে কেন দেখবে! পরক্ষনেই বুঝতে পারল, ও যা দেখছে সবই বাস্তব।

গাড়ি থেকে প্রথমেই নামল তানিম। তারপর একে একে চাঁদনী আর রেবেকা বেগম নামল। নম্রতা দৌঁড়ে নামল দোতলা থেকে। দরজার কাছাকাছি এসে পৌঁছতেই বাজল কলিংবেল। নম্রতা দরজা খুলে সালাম দিল রেবেকা বেগমকে। তারপর হেসে চাঁদনীকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করল, “কেমন আছো ভাবি?”

হুট করে ভাবি ডাকটায় অপ্রস্তুত হলো চাঁদনী। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে জবাব দিল, “আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। তুমি?”
“ভালো।”
জবাব দিয়ে গেস্টদের লিভিংয়ে বসাল নম্রতা। তারপর মায়ের রুমের দিকে গেল তাকে ডাকতে।

মরিয়ম খাতুন সব শুনে বললেন, “ওহ, ওরা এসে গেছে।”
“তুমি জানতে ওরা আসবে?”
“হ্যা। জানব না কেন! চাঁদনীর ভর্তি কাল, তাই তানিম ওকে নিয়ে এসেছে। আর রেবেকা আপাকে আমি খুব করে বলেছিলাম বেড়াতে আসতে। তাই তিনিও এসেছেন।”
“ওহ।” ছোট্ট করে জবাব দিল নম্রতা।

৩৫.
নওয়াজের আজকাল ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়৷ জামশেদ সাহেব খুব শীঘ্রই ব্যবসার পুরো ভার নওয়াজের হাতে তুলে দিতে চাইছেন। সেসব বুঝে নিতে নওয়াজের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। সকালে অফিসে ঢোকার পর শুধু লাঞ্চ টাইমে কিছুটা সময় পায়৷ তারপর কখন যে আবার রাত হয়ে যায়, নওয়াজ নিজেও জানেনা।

আজ অবশ্য আরও বেশি দেরি হয়েছে। অফিস শেষ করে আবিরের সাথে ডিনার করেছে বাইরে। ওদের পাঁচজনের ফ্রেন্ড সার্কেলটা এখন দুইভাগে বিভক্ত। আকরামের সাথে ইচ্ছে করেই আর যোগাযোগ করে না নওয়াজ। যেহেতু মিশকাত আর ফাহিমের সাথে আকরামের বন্ধুত্ব বেশ স্ট্রং, তাই ওদের সাথেও অটোমেটিক যোগাযোগ কমে এসেছে। এদিকে আবির সেদিন আকরামের করা জঘন্য কাজটার পরে ওর সাথে বন্ধুত্ব শেষ করে দিয়েছিল নিজে থেকেই। এখন তাই আবিরের সাথেই শুধু মাঝেমধ্যে আড্ডা দেওয়া হয়।

নওয়াজ যখন বাসায় ফিরল তখন রাত প্রায় এগারোটা। রুমের মধ্যে ঢুকে দেখল ডিম লাইট জ্বেলে রাখা হয়েছে। নওয়াজ অবাক হল। ওর রুমে ডিম লাইট জ্বালল কে?

রুমের লাইটের সুইচ অন করে বিছানার দিকে তাকাতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠল ও। চাঁদনী শুয়ে আছে বিছানায়। নওয়াজ অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে এগিয়ে গিয়ে বিছানার এককোনে বসল। তার প্রায় সাথে সাথেই চাঁদনী উঠে বসল।

রোবোটিক গলায় প্রশ্নটা করল নওয়াজ,
“চাঁদনী, তুমি এখানে?”

চাঁদনী হাই তুলে বলল,”এখানে আসায় কি আপনার খুব অসুবিধা হয়ে গেল? তাহলে বলুন, আমি অন্য রুমে চলে যাচ্ছি।”

কথা শেষ করে চাঁদনী খাট থেকে নেমে যেতে উদ্যত হলো। নওয়াজ হাত ধরে থামিয়ে দিল ওকে,
“চলে যেতে কখন বললাম আমি!”

চাঁদনী নওয়াজের ধরা হাতটার দিকে তাকাল। নওয়াজ সাথে সাথেই ছেড়ে দিল হাতটা। তারপর কাঁচুমাচু হয়ে বসে থাকল। কয়েকমিনিট অপেক্ষা করে অধৈর্য হয়ে গেল চাঁদনী।
“আজ সারারাত কি এভাবেই বসে থাকবেন?”
চাঁদনীর প্রশ্নে নওয়াজকে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখাল।
“তাহলে কী করব?”
“আপনি যা খুশি করুন। কিন্তু সবার আগে লাইটটা বন্ধ করুন প্লিজ। সারাদিন জার্নি করে আমি খুব ক্লান্ত। একটু ঘুমাব এখন।”
“ওহ, আমি এক্ষুনি লাইট অফ করে দিচ্ছি।”

নওয়াজ লাইটের সুইচ অফ করে দিল আগে, তারপর ডিম লাইটের মৃদু আলোতেই ওয়ারড্রব খুলে একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে গেল ফ্রেশ হতে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে