নিভৃত রজনী পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
155

নিভৃত রজনী
| ১৬ | (১৪০০+ শব্দ)

পুরোটা সময় শুধু চাঁদনীকে নিয়েই ভেবে গেল ও। ভাবতে ভাবতে একসময় নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল, চাঁদনী কী বিশেষ কেউ হয়ে উঠছে ওর জন্য?

নওয়াজ চাঁদনীর রুমের দরজায় টোকা দিল ঘন্টাখানেক পর। ভিতর থেকে জবাব দিল নম্রতা,
“কে ভাইয়া? ভেতরে এসো। দরজা খোলাই আছে।”
নওয়াজ ধীরপায়ে রুমের ভেতরে ঢুকল। চাঁদনী উলটোদিক মুখ করে গায়ে কাঁথা দিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। আর তার পাশেই বসে আছে নম্রতা।
নওয়াজ প্রশ্ন করল, “ঘুমাচ্ছে?”
“না, জেগেই আছে এখনও।”

অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থেকেও বলার মতো আর কিছু খুঁজে পেল না নওয়াজ। অগত্যা বলল, “তুই আজ রাতটুকু ওর সাথেই থাকিস। কিছু দরকার হলে আমাকে ডাক দিস।”
নম্রতা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। নওয়াজ রুম থেকে বের হতেও গিয়েও আবার থেমে গেল চাঁদনীর গলার স্বর শুনে।
“আমি একটা অনুরোধ করতে চাই। আজকের এই ইনসিডেন্টটা সম্পর্কে মরিয়ম আন্টি যেন কিছু না জানতে পারেন। তিনি এখানে আসার সময় আমার বাবাকে কথা দিয়েছিলেন, আমার যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। আজ যদি শোনেন যে তার বাসাতেই আমার সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হতে যাচ্ছিল। তাহলে আমার পরিবার এমনকি আমার সামনেও লজ্জায় পড়ে যাবেন। তাই আমি চাই যে কিছুক্ষন আগে যা হয়েছে সেটা এই রুমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক।”

নওয়াজ আর নম্রতা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ওর দুজনেই ভাবছিল, হয়তো চাঁদনী সব বলে দেবে মরিয়ম খাতুনকে। এখন চাঁদনীকেই বারন করতে দেখে দুজনে নিশ্চিন্ত হলো কিছুটা। কিন্তু চাঁদনীর পরের কথাটাতেই নওয়াজ অবাকের চূড়ান্তে পৌঁছে গেল,
“আর নম্রতা আপু, তোমার ভাইকে প্লিজ এই রুমে থেকে বের হয়ে যেতে বলো। ওনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।”

নম্রতা আর নওয়াজ দুজনেই চুপ হয়ে গেল কিছুক্ষনের জন্য। নওয়াজের মনে তখন তোলপাড় চলছে। চাঁদনী এভাবে কেন বলল? তাহলে কি আজকের এই ইনসিডেন্টের জন্য ওকেই দায়ী করছে চাঁদনী?

হ্যা, ভুল একটু ছিল ওর। আজকের রাতটা ওদের থাকতে দেওয়া একেবারেই উচিৎ হয়নি। কিন্তু ওই বা কীভাবে বুঝবে যে আকরাম এমন একটা পদক্ষেপ নেবে। আকরামের নারীলিপ্সা থাকলেও কখনও কাউকে জোর করেনি ও। বরং বরাবরই বলত, জোর জবরদস্তি ওর ভালো লাগে না। ওর কথায় ইমপ্রেসড হয়ে যে মেয়ে এগিয়ে আসত তার সাথে ওর একটা সম্পর্ক তৈরি হত কিছুদিনের জন্য। নইলে একেবারে বিদায়। আকরামের কথা মনে আসতেই নওয়াজের মেজাজটা আবার চড়ে গেল।

আপাতত নিজের কনসেনট্রেশান আবার চাঁদনীর দিকেই দিল ও। কিছটা কৈফিয়তের মতো শোনাল ওর কথাগুলো, “চাঁদনী, তুমি আমাকে ভুল বুঝছ। আমি…”
“বোঝাবুঝির কিছু নেই আর। যে ছেলে বাবা মায়ের অনুপস্থিতিতে তার বন্ধুদের নিয়ে বাসায় মদের আসর বসায়, তাকে আর নতুন করে বোঝার কী আছে। আমি নাহয় বাইরের মেয়ে, কিন্তু ঘরে নিজের একটা বোন থাকতে এরকম জঘন্য কাজ যে করতে পারে, তার সাথে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধে।”
“চাঁদনী প্লিজ, আমার কথাটা একবার..”
“দয়া করুন আমার উপর। এখন যান এখান থেকে। আমি একটু ঘুমাব।”

নওয়াজের হৃদয়টা এফোড় ওফোড় হয়ে যাচ্ছিল চাঁদনীর বলা প্রত্যেকটা কথায়। ধীরপায়ে টলতে টলতে একপ্রকার ঘোরের মধ্যে নিজের রুমে এসে খাটের এককোনে ধপ করে বসে পড়ল ও। দুহাতে খামচে ধরল নিজের চুল। চাঁদনীর কথাগুলোতে নিজের ভিতরে হওয়া অদৃশ্য রক্তক্ষরণ টের পাচ্ছিল নওয়াজ। ইচ্ছে করছিল এখনই গিয়ে চাঁদনীর ভুলগুলো ভাঙিয়ে দিয়ে আসতে। নিজেকে পাগল পাগল লাগছিল। চাঁদনী শেষের কথাগুলো বলার সময় একেবারে নওয়াজের চোখের দিকে তাকিয়েছিল। সেই প্রথম দিন ওই চোখদুটোতে যতটা মুগ্ধতা দেখেছিল নিজের জন্য, আজ তার দ্বিগুন ঘৃণা উপচে পড়ছে সেই একই চোখে। মাতাল করা ওই চোখদুটো আজ ওকে সমুদ্রসমান ঘৃণা নিয়ে দেখছিল। সেসব ভাবলেও নওয়াজের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।

অনেকক্ষন স্থবিরের মতো বসে থাকল নওয়াজ। চাঁদনীর ওই এলোমেলো রূপটি চোখের সামনে ভেসে উঠছিল বারবারই। অস্থিরভাবে বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে একসময় অজানা অনুভূতিগুলো খোলা বইয়ের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল ওর কাছে। নওয়াজ এই প্রথমবার বুঝতে পারল ও চাঁদনীকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেছে। চাঁদনী নামের মেয়েটি ওর হৃদয়ের সবটুকু জায়গা দখল করে ফেলেছে সুনিপুণভাবে।

২৭.
সকালে চাঁদনীর ঘুম ভাঙল উষ্ণ করতলের নরম স্পর্শে। মায়েরা ঠিক যেভাবে সন্তানের মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেয়, অনেকটা তেমনই লাগল স্পর্শটা ওর কাছে। চোখ খুলতে খুলতে চাঁদনী অস্ফুটস্বরে ডেকে উঠল “মা!”
ঘুমের ঘোরে স্পর্শটা ঠিক মায়ের মতো লাগলেও চোখ খুলে অন্য কাউকে দেখতে পেল। তিনিও অবশ্য মায়ের চেয়ে কোনো অংশে কম নন চাঁদনীর জন্য। চাঁদনী কয়েক সেকেন্ড মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল।

মরিয়ম খাতুন স্নেহময় কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, “এখন কেমন লাগছে শরীর?”
চাঁদনী চমকে গেল হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে। আমতা আমতা করে বলল, “আমি তো ঠিকই আছি।”

“তাহলে নম্রতা যে বলল, গতকাল রাত থেকেই নাকি মাথাব্যাথা করছে তোমার। সকালে নাস্তা করতেও তো নিচে গেলে না। এত বেলা করেও তো কখনও ঘুম থেকে ওঠ না তুমি। সত্যি করে বলো তো, খুব বেশি খারাপ লাগছে শরীর?”
চাঁদনী বলল, “আরে না। সামান্য মাথাব্যাথা। আরও কিছুক্ষন ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবে।”
“আচ্ছা, আবার ঘুমিয়ে থেক। কিন্তু তার আগে নাস্তাটা করে নাও অন্তত।”
“আন্টি, খেতে ইচ্ছে করছে না কিছু।”
“চুপ, একদম কোনো বাহানা চলবে না। আমি নাস্তা নিয়ে এসেছি। উঠে বসে খেয়ে নাও এক্ষুনি।”

মরিয়ম খাতুন নিজেই পরোটা ছিঁড়ে ডালে ডুবিয়ে চাঁদনীর মুখের সামনে তুলে ধরলেন। মেয়েটাকে আজ একেবারেই বিধ্বস্ত লাগছে। চাঁদনী চুপচাপ খেয়ে নিল খাবারটুকু।

মরিয়ম খাতুন নাস্তা খাওয়ানো শেষ করে চলে গেলেন। চাঁদনী আবার শুয়ে পড়ল বিছানায়। কিন্তু একফোঁটা ঘুমও আর ওর চোখে এলো না। গতকাল রাতের ভয়াবহতা কথা ভাবলে এখনও শিউরে উঠছে শরীর। গতকাল ঠিক সময়ে যদি নওয়াজ না আসত, তাহলে আজ হয়তো এই সুন্দর সকালটাও দেখা হতো না। নাহ, আবার ওই লোকটাই এসে যাচ্ছে ভাবনায়। ওর জন্যই তো কাল দুর্ঘটনাটা ঘটতে যাচ্ছিল। নিজের উপরে বিরক্তি এসে গেল চাঁদনীর। বারংবার চেষ্টা করেও তার প্রতি অনুভূতিগুলোকে দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না কিছুতেই। বেইমান মন কেন জানি নিয়ন্ত্রণে থাকতে চাইছে না একদমই। কাল রাতের কথাই ধরা যাক না। যার জন্য এত বড় একটা বিপর্যয় ঘটে যাচ্ছিল প্রায়, তাকে বাঁচিয়ে দিতেই চাঁদনী বলেছিল যাতে ব্যাপারটা মরিয়ম খাতুনকে না জানানো হয়।

মরিয়ম খাতুনের সাথে নওয়াজের সম্পর্কটা ইদানিং এমনিতেই খুব একটা ভালো যাচ্ছে না, সেটা কয়েকদিন ধরেই আঁচ করতে পারছিল চাঁদনী। সম্ভবত চাঁদনীকে নিয়েই সমস্যাটার সূত্রপাত হয়েছে। এরমধ্যে আবার যদি মরিয়ম খাতুন জানতে পারতেন যে নওয়াজের বন্ধুর দ্বারা চাঁদনীর এতবড় একটা ক্ষতি হতে যাচ্ছিল, তাহলে তার অনুশোচনা হতো ঠিকই। পাশাপাশি ছেলের সাথে তিক্ততা আরও বেড়ে যেত। নওয়াজ নিজের মায়ের চোখে ছোট হয়ে যেত অনেকটা। সেজন্যই মূলত চাঁদনী ব্যাপারটা তাকে জানাতে বারণ করেছিল।

ভাবনাগুলো ডালপালা ছড়াচ্ছিল মনের মধ্যে। আচমকা ফোনের ভাইব্রেশনে সংবিৎ ফিরল ওর। মোবাইল স্ক্রিনে জ্বলে নিভে ভেসে উঠছে নামটি, ‘ভাইজান’।

চাঁদনী ফোন রিসিভ করে যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় সালাম দিল। কিন্তু এত চেষ্টা করেও শেষরক্ষা হলো না। সালামের জবাব দিয়ে প্রথমেই প্রশ্ন করল সাখাওয়াত, “তোর কন্ঠটা এমন শুকনো লাগছে কেন? শরীর খারাপ করেছে?”

“আরে না, বিছানায় শুয়ে আছি বলে এমন মনে হচ্ছে কন্ঠ।”
“এতো বেলা করে তো তুই বিছানায় থাকিস না কখনও।”
চাঁদনী কয়েক সেকেন্ডে মনে মনে সাজিয়ে নিল কথাগুলো। তারপর বলল, “আসলে করার মতো কোনো কাজ নেই। পড়াশোনাও তো নেই এখন। তাই শুয়ে ছিলাম।”
“ও। শুনলাম রেজাল্ট না জেনে নাকি বাড়ি আসতে চাইছিস না?”
“হ্যাঁ। সেটাই করব ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন খুব বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে। তোমাদের কথা মনে পড়ছে খুব।”
“এই চাঁদনী, তুই কি কাঁদছিস?”
চাঁদনী উপচে পড়া চোখের জল মুছে বলল, “কী যে বলো। কাঁদব কেন!”
“আমার চাঁদনী কাঁদলে আমি ঠিক বুঝতে পারি। বাড়ির জন্য খুব বেশি মন খারাপ লাগছে, তাই না?”
“হ্যাঁ,ভাইজান। খুব মন কেমন করছে বাড়ির জন্য। তুমি জলদি এসে আমাকে নিয়ে যাও।”
“কালই তোকে বাড়ি আনার ব্যবস্থা করছি। বাড়িতে তোর জন্য বিশাল একটা সারপ্রাইজ আছে।”
হঠাৎ আগ্রহী হয়ে উঠল চাঁদনীর কন্ঠ, “কী সারপ্রাইজ?”
“সেটা কালই জানতে পারবি।”

পরেরদিন সকালেই সারপ্রাইজটা পেয়ে গেল চাঁদনী। এনায়েত আর বেলায়েত তালুকদার দুজনেই মরিয়ম খাতুনদের বাসায় এসে হাজির হলো খুব সকালে। মূলত জামশেদ সাহেবের সাথে কথা বলার উদ্দেশ্যেই এত সকালে আসা। তাদের মুখেই জানা গেল সব।

তামজীদের বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। এগার দিন পরে বিয়ে। সেজন্য চাঁদনীকে নিতে এসেছেন তারা। শুধু চাঁদনী নয়, তারা চান জামশেদ সাহেবও যেন সপরিবারে তাদের বাড়িতে গিয়ে থাকেন বিয়ে অব্দি।জামশেদ সাহেব বিনয়ের সাথেই জানালেন, অফিস ফেলে এতদিন আগে গিয়ে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

এনায়েত তালুকদার তবুও দমবার পাত্র নয়। জামশেদ সাহেব নিজে আগে যেতে না পারলেও মরিয়ম খাতুন এবং নম্রতাতে যেন তাদের সাথেই যেতে দেন, তারজন্য সবিনয় অনুরোধ করলেন। জামশেদ সাহেব কিছুক্ষন ইতস্তত করে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন। তারপর সম্মতি দিলেন যাওয়ার জন্য। জামশেদ সাহেব তাদের দুই ভাইয়ের থেকে বিদায় নিয়ে অফিসের জন্য রওয়ানা দিলেন। এনায়েত তালুকদার শেষবারের মতো আবার স্মরণ করিয়ে দিলেন, জামশেদ সাহেব তাদের নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে বিয়েতে উপস্থিত থাকলে তারা খুব খুশি হবেন।

মরিয়ম খাতুন অতিথিদের নাস্তা দিয়ে নম্রতার রুমে গেলেন। মেয়েটা যেতে রাজি হবে কিনা কে জানে। মেয়ে যেতে না চাইলে তার একা যাওয়া হবে না কখনও। অথচ হলুদিয়া গ্রামে যাওয়ার কথা শুনে তার মনটা আবার সেই দুরন্ত কৈশোরে ফিরে গেছে। নম্রতাকে বিস্তারিত জানানোর পর কিছুক্ষন কী একটা ভেবে রাজি হয়ে গেল যাওয়ার জন্য। অতঃপর ঘন্টা দুয়েক পরে এনায়েত ও বেলায়েত তালুকদারের সাথে চাঁদনী, মরিয়ম খাতুন এবং নম্রতা রওয়ানা হয়ে গেল হলুদিয়া গ্রামের উদ্দেশ্যে।

২৮.
নওয়াজের ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে। গত দুদিন ধরে সবকিছু কেমন একটা ওলটাপালট হয়ে যাচ্ছে। সারারাত ধরে ঘুম না হওয়ার কারনে সকালে ঘুম থেকে উঠতে অনেকটাই দেরি হয়ে যায়।

ওর নিদ্রাহীনতার একমাত্র কারণ চাঁদনী নামের মেয়েটি। গত পরশু হয়ে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটার পর থেকে একবারের জন্যও চাঁদনীর দেখা পায়নি নওয়াজ।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
| ১৭ | (১৫৩০+ শব্দ)

ওর নিদ্রাহীনতার একমাত্র কারণ চাঁদনী নামের মেয়েটি। গত পরশু হয়ে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটার পর থেকে একবারের জন্যও চাঁদনীর দেখা পায়নি নওয়াজ।

গতকাল সারাদিন নিজের রুম থেকে একবারের জন্যেও বের হয়নি চাঁদনী। এমনকি তিনবেলার খাবারও নিজের রুমে খেয়েছে। নওয়াজ তীর্থের কাকের মতো সারাদিন তাকিয়ে ছিল ওই দরজার দিকে। ইশ! যদি একবার কিছুক্ষনের জন্য হলেও তার দেখা পাওয়া যেত! চাঁদনীর প্রতি অনুভূতিগুলো নিজের কাছে স্পষ্ট হওয়ার পর থেকে ওকে দেখার আকুলতা বেড়েই যাচ্ছে ক্রমাগত৷ অথচ সে এখন আলোকবর্ষ দূরে৷ সবচেয়ে বেশি যেই যেই ব্যাপারটা নওয়াজকে পীড়া দিচ্ছে সেটা হলো, চাঁদনী ওকে ভুল বুঝে আছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগও পাচ্ছে না নওয়াজ।

ঘুম ঘুম চোখে এসে সকালের খাবার খেতে বসল নওয়াজ। নওয়াজ বসার পর টুলুর মা নাস্তা এনে দিল।

নওয়াজ খেতে খেতে প্রশ্ন করল,
“মা কোথায়? নিচে দেখছি না যে আজ।”
“তারা তো কেউ বাড়িতে নেই।”
“বাড়িতে নেই মানে।”
সকালে চাঁদনীকে নিতে আসা থেকে শুরু করে সবটাই বলল টুলুর মা।
“ভাইজান, আপনি ঘুম থেকে ওঠার আগেই তারা চলে গেছে। আমাকেও ছুটি দিয়ে গেছে এই কয়দিনের জন্য।”
“আচ্ছা।”
নওয়াজের এবার প্রচন্ড হতাশ লাগল। চাঁদনী চলে গেছে একেবারে।

অর্ধেক নাস্তা করেই ও ছুটে গেল চাঁদনীর রুমে। বেশিরভাগ সময় যেই দরজাটা ভেজানো অথবা ভেতর থেকে লক করা থাকে আজ সেটা পুরোপুরি খোলা। কয়েক ঘন্টা আগেও এই রুমে চাঁদনী ছিল, কিন্তু এখন আর নেই। চলে গেছে চাঁদনী। আর ফিরে আসার সম্ভাবনাও হয়তো নেই। খাটটা ছিমছাম গোছানো এখনও। মনে হচ্ছে এইমাত্র চাঁদনী উঠে ব্যালকনিতে গেছে খাট থেকে। খাটের সাথে লাগোয়া টেবিলটা খালি একেবারে। এই টেবিলেই থরে থরে সাজানো ছিল চাঁদনীর বইখাতা। নওয়াজ পুরো রুমে একবার চোখ বুলিয়ে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেল। চাঁদনী এই রুমে আসার পর এই প্রথমবার নওয়াজ ব্যালকনিতে এলো। ব্যালকমিতে পা রেখেই চমকে গেল ও। পুরো ব্যালকনি ফুলের টবে ভর্তি। জানা অজানা নানা ফুল ফুটে আছে সেখানে। ওর বুঝতে অসুবিধা হলো না, এসব কে করেছে। নওয়াজ আলতো হাতে ছুঁয়ে গেল ফুলগুলো। চাঁদনীও নিশ্চই এভাবেই আদর করে দিত ফুলগুলোকে। নওয়াজ দেরিতে হলেও উপলব্ধি করতে পারল, ওর পুরো পৃথিবীটাই চাঁদনীময় হয়ে গেছে।

এ কেমন টানাপোড়েন! যখন চাঁদনী কাছে ছিল, তখন তাকে দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্য কতই না প্রচেষ্টা ছিল ওর। অথচ যখন চাঁদনী নাগালের বাইরে চলে গেল তখন তাকে পাওয়ার জন্য মন-প্রাণ সব আকুল হয়ে আছে। ভালোবাসার প্রগাঢ়তা আজ টের পাওয়া যাচ্ছে হাড়ে-হাড়ে।

ধ্যানমগ্ন নওয়াজ কল্পনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো মোবাইলের রিংটোনে। মিশকাত ফোন দিয়েছে। নওয়াজ রিসিভ করে জিজ্ঞাসা করল, “কল করেছিস কেন?”

নওয়াজের কথা বলার ধরন শুনেই মিশকাত বুঝতে পারল, এখনও রাগ পড়েনি ওর। ও কল দিয়েছিল নওয়াজকে কিছুক্ষন গালিগালাজ করতে। কিন্তু নওয়াজের মেজাজ অনুধাবন করে নরমালিই কথা বলা শুরু করল, “কিছু না। এমনি কল করলাম। আমি আর ফাহিম তো সেই পরশু থেকেই হাসপাতালে। আকরামের অবস্থার তো এখনও কোনো উন্নতি নেই।”
“তারমানে এখনও মরেনি।”
“নওয়াজ! তোর মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেল? মানলাম আকরাম একটা অন্যায় করেছে। কিন্তু তার জন্য তুই পানিশমেন্টও তো যথেষ্ট দিয়েছিস। তাছাড়া ও সেদিন ড্রাঙ্ক ছিল। তুই নিজেও তো ওকে ভালো করে চিনিস। ও যেমন স্বভাবেরই হোক না কেন, কখনও কোনো মেয়েকে এভাবে ফোর্স করেনি এর আগে।”
“আকরামকে ডিফেন্ড করার জন্য এই লেইম এক্সকিউজগুলো দেওয়া বন্ধ কর প্লিজ। সেই প্রথমদিনই আমি তোদের সামনে আকরামকে ওয়ার্ন করেছিলাম। বলেছিলাম, চাঁদনীর থেকে দূরে থাকতে। কিন্তু ও কানে তোলেনি আমার কথা। এমনকি চাঁদনীর সম্মতি না থাকা স্বত্বেও বারবার চাঁদনীকে বিরক্ত করে গেছে। পরশু রাতের ব্যাপারটাতেও তোরা আকরামের দোষ ধামাচাপা দিতে চাইছিস ও ড্রাঙ্ক ছিল বলে। কিন্তু তুই নিজেও খুব ভালো করে জানিস যে সেই রাতে আকরাম ততটাও ড্রিংক করেনি যাতে ও একেবারে ভারসাম্যহীন হয়ে যাবে। অর্থাৎ চাঁদনীর সাথে ও যেটা করেছে, সেটা ওর সজ্ঞানেই করেছে।”

“তুই আর আবির যে কী শুরু করেছিস৷ সেদিন রাতে আবির সেই যে হসপিটালে পৌঁছে দিয়ে গেল, আর কোনো খোঁজ নিল না। বুঝলাম যে ও ভুল করেছে। তারজন্য শাস্তিও পেয়েছে। এখন পুরোনো কথা মনে রেখে শত্রুতা বাড়ানোর আদৌ কি কোনো দরকার আছে। আফটার-অল এতদিনের বন্ধু আমরা।”

“শুধু বন্ধু বলেই এতদিন আমি চুপ ছিলাম। নইলে ওর ওই নোংরা কাজগুলোর জন্য অনেক আগেই ওকে শিক্ষা দিয়ে দিতাম। সত্যি কথা বলতে ওর সাথে বন্ধুত্ব রাখার কোনো ইচ্ছেও আর নেই আমার। অন্তত এবারের ওর ওই জঘন্য কাজগুলোর জন্য। আমি যদি ঘুনাক্ষরেও আগে বুঝতে পারতাম যে সেদিন রাতে ও প্লান করে আমাদের বাসায় এসেছে তাহলে…।
” প্লান করে মানে?”
নওয়াজকে মাঝপথে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল মিশকাত।
“সেদিন আকরাম নিজেই গিয়ে তোদের বলেছিল আমার বাসায় আড্ডা দেওয়ার জন্য আমাকে রাজি করাতে। ও সেদিন আগে থেকেও ভেবে রেখেছিল, যেকোনোভাবে চাঁদনীর রুমে যাবে।”
“তোকে এসব কে বলল!”
“অবাক হওয়ার কিছু নেই। আবির নিজেই আমাকে সব বলেছে কাল। শোন মিশকাত, তোদের সাথে আমার অলমোস্ট ফাইভ ইয়ারের ফ্রেন্ডশিপ। কিছুটা হলেও তোদের নেচার আমি জানি। আকরাম এর আগে কোনো মেয়ের সাথেই জোর করেনি। এর কারণ কি জানিস? কারণ এর আগে ও যেই মেয়েকেই টার্গেট করেছে সেই ওর ফাঁদে পা দিয়েছে। তাই জোর করার প্রয়োজন পরেনি। কিন্তু চাঁদনীই প্রথম যে ওকে বারবার রিজেক্ট করেছে। প্রথমে সামনাসামনি, তারপর ফোনে বহুবার চাঁদনীকে বিরক্ত করেছে ও। ওর অনেকগুলো কন্যাক্ট নাম্বার চাঁদনীর ফোনে ব্লাকলিস্টেড করা। এই যে বারবার প্রত্যাখ্যান, এটাই মেনে নিতে পারেনি আকরাম। সেজন্যই সেদিন ইচ্ছে করে চাঁদনীর চরিত্রে কলঙ্ক লাগাতে ওরকম একটা স্টেপ নিয়েছে।”

“নওয়াজ প্লিজ, এখন আর এসব কথা থাক। আকরাম আমাদের বন্ধু, এখনও হাসপাতালে অসুস্থ হয়ে পরে আছে। মাথায় স্টিচ লেগেছে অনেকগুলো। এখন পুরোনো কথাগুলো ভুলে যা।”
“তোকে আজ একটা কথা ক্লিয়ার ভাবে বলি। আকরাম আমার বন্ধু ছিল, কিন্তু এখন আর নেই। ভবিষ্যতেও আর কখনও হবে না। এটা যেমন আমার মনের কথা, আকরামেরও ঠিক তাই।”
“মানে?”
“ওই যে বললাম,তোদের নেচার আমি কিছুটা হলেও জানি। আমার ধারনা যদি ভুল না হয়, এইযে তুই আমাকে আজ কল দিয়েছিস, এটাও তোকে আকরাম শিখিয়ে দিয়েছে। আকরাম চায় আমার সাথে এখন একটা ভালো সম্পর্ক রাখতে তারপর একদিন সুযোগ বুঝে বদলা নেবে আমার উপর। কি? ঠিক বলেছি তো?”
“তুই ভুল বুঝছিস নওয়াজ।..”
মিশকাত ভড়কানো এবং দুর্বল গলায় সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করল।
নওয়াজ হেসে বলল, “ওকে সাবধান করে দিস মিশকাত, আর যেন কখনও আমার সামনে না আসে।”

২৯.
তালুকদার মঞ্জিলে চাঁদনীরা যখন পৌঁছাল, তখন প্রায় সন্ধ্যা। গাড়ি থেকে নেমে নম্রতা হাফ ছেড়ে বাঁচল। এরকম লং জার্নি ওর কাছে সবসময়ই বিরক্তিকর লাগে। চাঁদনী সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে, মরিয়ম খাতুনও খুশিমনে সৌজন্যমূলক আলাপচারিতা করছেন। নম্রতা সবাইকে সালাম দিয়ে সোফার এককোনে চুপ করে বসে পড়ল। ওর চোরা দৃষ্টি খুঁজে যাচ্ছিল বিশেষ একজনকে। কিন্তু তার ছায়ার হদিসও পাওয়া গেল না বসার ঘরের আশেপাশে। টুকটাক নাস্তার পরে ওদের বিশ্রামের জন্য রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নেওয়ার জন্য বিছানায় শোয়ার কিছুক্ষন পরেই নম্রতা টের পেল, চিনচিনে একটা ব্যাথা হচ্ছে মাথার মধ্যে। বেশিক্ষন জার্নি করলেই এই সমস্যাটা হয় ওর। সময়ের সাথে সাথে ব্যাথাটা আরও বাড়তে থাকল। তাই রাতের খাবার খেতেও আর নিচে নামা হলো না নম্রতার।

তানিমের সাথে ওর দেখা হলো পরেরদিন সকালে। ওদের এই সাক্ষাতের সাক্ষী হয়ে রইল আরেকটা দুর্ঘটনা ঠিক প্রথম দিনের মতোই। রাতে জলদি ঘুমিয়েছে বলে নম্রতার ঘুম ভাঙল সকাল সকালই। রুম থেকে বাইরে বের হয়ে নিচে যাওয়ার জন্য সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ এগিয়েছিল ও। হঠাৎ কি একটা মনে হতে উলটো ঘুড়ে তাড়াহুড়ো করে উঠতে গেল, ঠিক তখন বাঁধল বিপত্তিটা।

ঠিক প্রথম দিনের মতো আরেকটি ধাক্কা। না, এবার নম্রতার হাতে কোনো ফোন ছিল না। তবে তানিমের হাতে ল্যাপটপ ছিল। সেটা হাত ফসকে সিড়ি দিয়ে গড়িয়ে একেবারে নিচে পড়ল। নম্রতা অসহায় চোখে প্রথমে তানিমের দিকে তাকাল। তারপরে তাকাল ফ্লোরে পড়ে থাকা দ্বিখন্ডিত ল্যাপটপটির দিকে। একেবারে মাঝ বরাবর ভাগ হয়ে পড়ে আছে ল্যাপটপটি। নম্রতা মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে ফেলল। এখনই বুঝি শুরু হবে কথার গোলাবর্ষণ। অপমান করার এতবড় সুযোগ নিশ্চই লোকটা হাতছাড়া করবে না। নম্রতাও তো ঠিক একই কাজ করেছিল একদিন। নম্রতা সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টা করল। করুক অপমান। নম্রতাও এবার অপমানের যোগ্য জবাব দেবে ঠিক একইভাবে। নতুন একটা ল্যাপটপ কিনে এনে দেবে প্রয়োজনে লোকটাকে।

অনেকক্ষন হয়ে যাওয়ার পরেও কোনো শব্দ না পেয়ে নম্রতা চোখ খুলে তাকাল। তানিম ততক্ষনে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে ল্যাপটপটা তুলে নিয়েছে হাতে। নম্রতা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকল সেদিকে।

তানিম ল্যাপটপটা তুলে নিয়ে আর এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না। নম্রতার দিকে একবারও না তাকিয়ে হেঁটে সোজা অন্যদিকে চলে গেল। নম্রতার মনে হলো, তানিমের কিছু না বলাটাও একরকম অপমান করাই হলো। নম্রতা সেদিন আজবাজে কথা বলে যতটা অপমান করেছিল তানিমকে আজ তানিম কিছু না বলে তার চেয়েও বেশি অপমান করে গেল ওকে। নম্রতার দিকে একবারও না তাকিয়ে, ভালো-মন্দ কথা না বলে একপ্রকার অগ্রাহ্য করে গেল ওকে। নম্রতা টের পেল, ওই দাম্ভিক লোকটির এমন নিস্পৃহ আচরণে ওর দুচোখ ভর্তি জল জমছে। নম্রতা ওড়নার এককোনা দিয়ে চোখের পানি মুছল। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল নিচে। চাঁদনীর সাথেই প্রথম দেখা হলো ওর,
“ও তুমি এসে গেছ। আমি এক্ষুনি যাচ্ছিলাম তোমাকে ডাকতে। রাতেও তো না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লে। ক্ষিধে পেয়েছে নিশ্চই। চলো, নাস্তা করে নেবে।”

নম্রতা চাঁদনীকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেল। খাবার ঘরে ঢুকে আবারও ওর পা থেমে গেল তানিমকে দেখে। চাঁদনী তাড়া দিল, “কই আপু? বসো।”
নম্রতা বসে পড়ল চুপচাপ। নম্রতা বসতেই নায়লা ওর খাবার বেড়ে এগিয়ে দিল। নম্রতা চাঁদনীকে জিজ্ঞাসা করল, “আম্মু কোথায়?”
“আন্টি তো মা আর চাচীর সাথে বাড়ির পিছন দিকটায় ঘুরতে গেছে। তুমি খেয়ে নাও, তারপর আমরাও যাব। তোমাকে আমাদের এই সুন্দর গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখাব।”

চাঁদনীর কথার প্রত্যুত্তরে নম্রতা হাসল কেবল। হঠাৎ করেই ওর মনে পড়ল, চাঁদনীর ওদের বাসায় যাওয়ার প্রথম দিনগুলোর কথা। ঠিকভাবে কথা পর্যন্ত বলত না ও চাঁদনীর সাথে। গ্রাম থেকে এসেছে শুনে অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে।

অথচ চাঁদনীদের বাসার মানুষগুলো একেবারেই আলাদা। গতকাল এই বাড়িতে আসার পর থেকে বাড়ির সদস্যরা মাথায় তুলে রাখছে অতিথিদের। কিছুক্ষন পরপরই এসে খোঁজ নিচ্ছে কিছু লাগবে কিনা। এইযে নায়লা নাস্তা দিতে দিতে টুকটাক কথা বলছে। কথাগুলো এমনভাবে বলছে যেন নম্রতারা এই বাড়ির কত আপন। অথচ মায়ের কাছে যতটুকু শুনেছে তারে এই বাড়ির সাথে ওদের কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই।

তানিম এককোনের চেয়ারে বসে নাস্তা করছিল। যদিও সে একবারও চোখ তুলে নম্রতার দিকে তাকাচ্ছিল না, তবুও নম্রতার অস্বস্তি হচ্ছিল খুব। ওকে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতেই বোধহয় তানিম জলদি খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
| ১৮ | (১৪৫০+ শব্দ)

তানিম এককোনের চেয়ারে বসে নাস্তা করছিল। যদিও সে একবারও চোখ তুলে নম্রতার দিকে তাকাচ্ছিল না, তবুও নম্রতার অস্বস্তি হচ্ছিল খুব। ওকে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতেই বোধহয় তানিম জলদি খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল।

নায়লার দিকে তাকিয়ে তানিম বলল, “ভাবি, বাড়িতে কিছু লাগলে বোলো। আমি আজ বিকেলে শহরে যাচ্ছি।”
কথাগুলো নায়লার উদ্দেশ্যে বললেও তানিমকে পালটা প্রশ্ন করলেন খাবার ঘরের দরজায় দাঁড়ানো তানিমের মা দেলোয়ারা বেগম, “হঠাৎ শহরে কেন যাবি আবার?”
“ল্যাপটপটা ভেঙে গেছে। নতুন একটা নিতে হবে।” তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে মুছতে জবাব দিল তানিম।
“সেকি! ভাঙল কীভাবে?”
“সিঁড়ি থেকে নামার সময় হাত ফসকে নিচে পরে গেছে।”
“এতবড় একটা জিনিস এমনি এমনি হাত থেকে পড়ে গেল? কারও সাথে ধাক্কা লেগেছিল?”

দেলোয়ারা বেগমের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই মুখভর্তি খাবার নিয়ে বিষম খেল নম্রতা। নায়লা এবং দেলোয়ারা বেগম দুজনে মুহূর্তেই ব্যস্ত হয়ে গেল নম্রতাকে নিয়ে। নায়লা পানি এগিয়ে দিল ওর দিকে।
তানিম অবশ্য এসবকিছু দেখেও দেখল না। স্মার্টফোনে কী একটা দেখতে দেখতে রুম থেকে বের হয়ে গেল।

সকালের নাস্তার পর নম্রতাকে নিয়ে নিজের গ্রাম দেখাতে বের হলো চাঁদনী। অক্টোবরের শেষের দিক, তাই গ্রামাঞ্চলে শীতের আমেজ শুরু হয়ে গেছে অল্পবিস্তর। ওরা বাড়ি ফিরল মধ্যদুপুরে। সময়গুলো কেটে যাচ্ছে ভালোই।

বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরল তুরাগ। কিছু কিছু আত্মীয়স্বজনও আসা শুরু করেছে তামজীদের বিয়ে উপলক্ষ্যে। দেখতে দেখতে দুইদিন চলে গেল। বিয়ে উপলক্ষ্যে তালুকদার মঞ্জিলে ইতোমধ্যে আনন্দপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে, সেই আনন্দকে আরেকটু বাড়িয়ে দিল চাঁদনীর অ্যাডমিশন টেস্টের রেজাল্ট। বিকেলের দিকে জানা গেল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেয়েছে চাঁদনী। ভাইয়েরা মিলে চাঁদনীর এই অ্যাচিভমেন্টকে সেলিব্রেট করল সেদিন।

৩০.
মনস্তাত্ত্বিক কিছু বিষয় মাঝে মাঝে এমন জটিল হয়ে ওঠে যে স্বয়ং মানুষটিও বুঝতে পারে না, সে নিজে আসলে কী চায়। নম্রতার সাথেও আজকাল এমনটাই হচ্ছে। নিজের মধ্যে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা অন্য এক নিজেকে আবিষ্কার করছে আজকাল ও। এই নম্রতার সাথে আগের নম্রতার ব্যাবধান আকাশ পাতাল। নিজের মধ্যে জাগ্রত হওয়া এই নতুন সত্তা একেবারে অজানা কেউ৷

কবে থেকে এটা শুরু হয়েছে ও নিজেও জানে না। কিন্তু ভয়ংকর কোনো একটা অসুখে কাবু হয়ে আছে, শুধু এতটুকু উপলব্ধি করতে পারে ইদানিং। সে পাশ থেকে হেঁটে গেলেও মাদকতা ছড়িয়ে দিয়ে যায়। আর সেই নেশায় বুদ হয়ে থাকে নম্রতা। ঠিক কতটা আত্মসম্মানবোধে টইটম্বুর লোকটা, সেটা তার প্রতিটি দাম্ভিক পদক্ষেপই প্রমাণ করে দেয়৷

এমনিতে সব ঠিকঠাক। সবার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে লোকটা, বিয়ে বাড়িতে আসা অতিথিদের আপ্যায়ন করছে। কিন্তু শুধু নম্রতা যেখানে যাচ্ছে সেই জায়গাটিকে সুকৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে সবসময়। নম্রতা যে তার বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেটা ও নিজেও বুঝতে পারছে। কিন্তু নিজেকে মানাতে পারছে না তবুও। লোকটা বিরক্ত হচ্ছে জানা স্বত্ত্বেও তার সামনে যাওয়াটা যেন সহজাত প্রবৃত্তির মতো হয়ে গেছে নম্রতার জন্য।

তালুকদার মঞ্জিলে নম্রতারা চারদিন হয় এসেছে। এই চারদিনে নম্রতা অগণিতবার তানিমের সামনে গেলেও ওর সাথে তানিমের চোখাচোখি হয়েছে মাত্র কয়েকবার। এবং দুজনার দৃষ্টি মিলিত হওয়ার ন্যানোসেকেন্ডের মধ্যে তানিম চোখ সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু নম্রতা তাকিয়ে ওকে দেখেছে অনেকক্ষন। এমন না যে ও ইচ্ছে করেই তাকিয়ে থেকেছে। যতক্ষন তানিম সামনে থাকে, ততক্ষন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে ও। মনে হয় তানিম ছাড়া বাকি সবকিছু অদৃশ্য হয়ে গেছে। তারপর হঠাৎ করেই হুঁশ ফেরে ওর। নিজের কর্মকান্ডে নিজেই বিব্রত হয়।

একটা নতুন অনুভূতির উন্মোচন করার জন্য নম্রতার দিক থেকে ঠিক যতটা আগ্রহ, তানিমের দিক থেকে ঠিক ততটাই বিতৃষ্ণা আর অনীহা। এই যে তালুকদার মঞ্জিলে আসার পর থেকে নম্রতা ভদ্র মেয়েটি হয়ে আছে। তানিমের আশেপাশে কারণে অকারণে ঘুরঘুর করছে, চোরা দৃষ্টিতে বারবার ওকে দেখার চেষ্টা করছে। এসবের কিছুই চোখ এড়ায়নি তানিমের। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহও জন্মায়নি ওর নম্রতা নামের ওই মেয়েটির প্রতি। কিংবা বলা যায়, আগ্রহ জন্মানোর সুযোগ তানিম নিজেই দেয়নি। নম্রতার ছায়া আশেপাশে দেখলেও তানিমের সেই প্রথমদিনের করা অপমানের কথা মনে পড়ে যায়। খুব প্রয়োজন ছাড়া তানিম কখনও কোনো মেয়ের সাথে কথা বলা তো দূরের কথা ঠিকভাবে কখনও চোখ তুলে অব্দি তাকায়নি। অথচ ওই মেয়েটা কয়েক মিনিটের পরিচয়ে সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য তানিমকে চরিত্রহীন বলে ফেলেছিল। তানিমের আত্মসম্মানে প্রবলভাবে আঘাত করেছিল সেদিন নম্রতার বলা প্রত্যেকটি শব্দ।

তারপর চলে গেছে অনেকগুলো মাস। কিন্তু নম্রতার দেওয়া সেই আঘাতের ক্ষত এখনও একই রকম দগদগে যন্ত্রনাদায়ক হয়ে রয়ে গেছে তানিমের মনের মধ্যে।

দুজনের মধ্যে যে ভালোলাগা, মন্দলাগা, আগ্রহ আর অনীহার বিপরীতমুখী একটা লুকোচুরি খেলা চলছিল সেটা ওরা ছাড়াও তৃতীয় একজনের নজরে খুব ভালোভাবেই পড়ল। সেই একজনটি হলো চাঁদনী। চাঁদনীর মনে হলো নম্রতার চোখে নিজেকেই দেখতে পাচ্ছে ও। ঠিক এরকম মুগ্ধতা নিয়ে ও নিজেও তো দেখত একজনকে। এখনও চোখ বন্ধ করলে তাকে দেখতে পায় ও। চাঁদনী যতই তাকে মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে, ততই যেন মনের মধ্যে পাকাপোক্ত করে গেড়ে বসে সে। চাইলেও তাকে ভুলে যাওয়া যায় না। কিন্তু ভুলতে তো হবেই। যে ওকে চায় না, তাকে মনের মধ্যে পুষে রাখারও কোনো মানে হয় না৷ তাই প্রতিনিয়তই নওয়াজকে ভুলে যাওয়ার উপায় খুঁজে চলেছে ও।

তানিম এবং নম্রতার মতো চাঁদনী এবং নওয়াজের সম্পর্কটাও বিপরীতেই চলছিল। চাঁদনী যখন নওয়াজকে ভুলে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল, নওয়াজ তখন ভাবছিল, কীভাবে চাঁদনীকে পাকাপোক্তভাবে নিজের করে নেবে।

ক্ষনে ক্ষনে নওয়াজের অস্থিরতা বেড়েই চলছিল। সেই ইনসিডেন্টের পর থেকে চাঁদনী ওকে ভুল বুঝে আছে, এবং সেদিন থেকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য একবার চাঁদনীর সাথে কথা বলারও সুযোগ পায়নি ও। এই নিয়ে আত্মগ্লানিতে ভুগে চলছিল ও প্রত্যেকটা মুহূর্তে।

চাঁদনী অনেকগুলো মাস ওর কাছাকাছি একই ছাদের নিচে ছিল, তখন চাঁদনীকে খুব একটা কাছে থেকে দেখা হয়ে ওঠেনি কখনও। অথচ এখন যখন চাঁদনী যোজন যোজন দূরে চলে গেছে, তখন তাকে একটাবার দেখার জন্য মন চাতক পাখির মতো তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে। মনেহয় যেন কত যুগ পার হয়ে গেছে চাঁদনীকে না দেখে, তার ওই কন্ঠস্বর না শুনে।

নওয়াজ ওর স্বাভাবিক জীবনের ছন্দপতন অনুভব করছিল বেশ ভালোভাবেই। চাঁদনীর সেই কান্নাভেজা মুখ প্রত্যেকরাতেই অবিকল ভেসে ওঠে মানসপটে। ধারাল সেই কন্ঠস্বর কঠোরভাবে বলেছিল নওয়াজকে রুম থেকে বের হয়ে যেতে। চাঁদনীর রেগে উচ্চারণ করা সেই প্রত্যেকটা শব্দ এখনও ঝংকার তুলে যায় ওর কানে। সেই শেষ কথা চাঁদনীর সাথে। আর সেদিনই প্রথম হৃদয় জানান দিয়েছিল তার গোপনে থাকা প্রণয়ের আভাস। নিজেকে আজকাল ওর গাধা বলে মনে হয়। চাঁদনীর ফোন নাম্বারটা থাকলে অন্তত যোগাযোগ করা যেত৷ অথচ এতদিনে সেটাও রাখা হয়নি কখনও৷

সবকিছু নিয়েই এখন আফসোস হয় নওয়াজের। এগার ডিজিটের একটা মোবাইল নাম্বার কেন রাখল না। কিংবা সময় থাকতে নিজের মধ্যে অজান্তে পুষে রাখা গোপন কথাগুলো কেন টেনে হিঁচড়ে বের করতে পারল না, তারজন্যেও হা-হুতাশ করে খুব। কিন্তু এখন এসব নিয়ে ডিপ্রেশনে ভুগে আদৌ কি কোনো লাভ আছে। তারচেয়ে বরং এই ড্যামেজটুকু কন্ট্রোল করার জন্য কিছু একটা করা উচিৎ। ভাবতে ভাবতেই নওয়াজের মস্তিষ্কের ঘুটঘুটে অন্ধকারে হঠাৎ বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলে উঠল। এই প্লানটা নিশ্চিত কাজে দেবে। এবার আর কোনো ভুল নয়। সঠিক সুযোগ ও সময় পেলেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করে ফেলতে হবে।

৩১.
তালুকদার মঞ্জিলের অন্দরমহলে আজকাল সন্ধ্যাকালীন চায়ের আসরটা বেশ জমে ওঠে। মাঝখানে আর একদিন বাদ দিয়েই বিয়ে। তাই স্বভাবতই বাড়িতে ব্যস্ততা প্রচুর। বাড়ির মহিলারা কাজ করতে করতেই আড্ডাটা জমিয়ে তুলেছে বেশ। চাঁদনীর মা রেবেকা বেগম আর মরিয়ম খাতুন এককোনে বসে ঝি-বউদের হাসিঠাট্টা দেখতে দেখতে টুকটাক গল্প করে চলছিলেন।

হঠাৎ কল আসায় কথা বলার জন্য উঠে বারান্দার দিকে গেলেন মরিয়ম খাতুন। কল করেছেন জামশেদ সাহেব। মরিয়ম খাতুন ফোন রিসিভ করে সালাম দিলেন। জামশেদ সাহেব সালামের জবাব দিয়ে বললেন, “ভালোই সময় কাটছে তোমার তাহলে।”
“সময় ভালো যাচ্ছে সেটা তুমি কীভাবে বুঝলে?”
“দেখলাম, সবাই মিলে হাসিগল্প করছ, ছাদে বসে পা দুলিয়ে আচার খাচ্ছ, তাই বললাম আরকি।”
“মানে, এসব তুমি কীভাবে দেখলে?”
“নম্রতা ভিডিও করে পাঠাল। মেসেজে লিখেছে, গ্রামে গিয়ে তার মা নাকি একেবারে বাচ্চা হয়ে গেছে।”
“মেয়েটা এসব আবার কখন করল?”
“ভালোই করেছে। এত ভালো লাগছিল ভিডিওগুলো দেখতে। মনে হলো যেন বিয়ের সময়ের সেই চঞ্চলা মরিয়মকে দেখছি আমি।”
মরিয়ম খাতুন হেসে ফেললেন স্বামীর কথা শুনে। সারা পৃথিবীর কাছে মানুষটা গম্ভীর আর দাম্ভিক হলেও তার কাছে একেবারে খোলা বইয়ের মতো। মরিয়ম খাতুন প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কাল কখন রওয়ানা দেবে?”
“ভাবছি বিকেলের দিকে।”
“বিকেলে রওয়ানা দিলে তো প্রায় সারারাত জার্নি করতে হবে। তারচেয়ে কাল সকালেই রওয়ানা দাও। একরাত এখানে এসে থাকলে না হয়। এনায়েত ভাই খুব খুশি হবেন তাহলে।”
“তুমি যখন বলছ, তাই করব নাহয়।”
“নওয়াজ কী বলল৷ সে আসবে?”
“বলল তো যাবে।”
টুকটাক কথোপকথন সেরে ফোন রাখলেন মরিয়ম খাতুন।

মরিয়ম খাতুনের কথামতো পরেরদিন সকালেই নওয়াজকে নিয়ে রওয়ানা হলেন জামশেদ সাহেব। প্রায় অর্ধেক পথ ড্রাইভ করার পর হাইওয়ের পাশে থামল নওয়াজ। তখন দুপুর হয়ে এসেছে প্রায়।

লম্বা জার্নিতে একটু ঘুমঘুম এসে গিয়েছিল জামশেদ সাহেবের। হঠাৎ গাড়ি থেমে যাওয়ায় সকচিত হয়ে বসে নওয়াজের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি। নওয়াজ বলল,
“একটা রেস্টুরেন্ট চোখে পড়ল এদিকে। যেতে যেতে তো বিকেল হয়ে যাবে। তাই ভাবলাম লাঞ্চটা এখন থেকেই করে নেই। কি বলো তুমি?”
“বলছিস যখন চল তাহলে।”

রেস্টুরেন্টে ঢুকে নিরিবিলি একটা কোনে গিয়ে বাবাকে নিয়ে বসল নওয়াজ। খাবারের অর্ডার দিয়ে আরেকবার নিজের কথাগুলো মনে মনে গুছিয়ে নিল ও। তারপরে বলা শুরু করল, “আব্বু, তোমার সাথে আমার খুব ইম্পর্টেন্ট কিছু বলার আছে।”
“গো অ্যাহেড।” বলে টেবিল থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা তুলে নিলেন জামশেদ সাহেব।

নওয়াজ অপেক্ষা করল কিছুক্ষন। বাবার পানি খাওয়া অবস্থায় কথাগুলো বললে অঘটন ঘটে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। জামশেদ সাহেব তৃষ্ণা মিটিয়ে আবার ছেলের দিকে তাকালেন। নওয়াজ কথা বলা শুরু করল কোনো কোনোপ্রকার ভূমিকা ছাড়াই, “আব্বু, আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি, এবং তাকে বিয়ে করতে চাই।”

জামশেদ সাহেবের মনে হলো তিনি ভুল শুনছেন। গম্ভীর মেজাজের মানুষ বলে কখনও ছেলেমেয়েদের সাথে সামান্য সখ্যতাটুকু গড়ে ওঠেনি তার। নম্রতা এবং নওয়াজের যত আবদার আর চাহিদা সব মায়ের কাছেই ছিল। যেই ছেলে সামান্য হাতখরচটুকুও কখনও তার কাছে চায়নি সে আজ নিজের বিয়ে করার কথা বাবার কাছে বলছে এটা ঠিক তার হজম হলো না।

জামশেদ সাহেব কিছু বলার ভাষা হারিয়ে শুধু ফ্যালফ্যাল করে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে