নিভৃত রজনী
| ১৩ | (১৩০০+ শব্দ)
আকরামের খুব জেদি প্রকৃতির ছেলে। সবসময় যেটা চায় সেটা আদায় করেই ছাড়ে। বিশেষ করে মেয়েঘটিত ব্যাপারে ও ঝানু। মেয়েদের নিজের কন্ট্রোলে আনার জন্য সবসময় নিখুঁত প্লান করে আকরাম এবং প্রত্যেকবারই সেই প্লানে সাকসেসফুলও হয়। কিন্তু এই প্রথমবার ওর কোনো প্লানই কাজে আসছে না।
আজকে শিওর ছিল, এখানে এসে সারাদিন থাকলে কোনো না কোনোভাবে ঠিক চাঁদনীর সাথে কথা বলতে পারবে। কিন্তু মেয়েটার কিনা আজই অসুস্থ হতে হলো।
আকরাম খাওয়ার পরে বিকেল পর্যন্ত আড্ডা দিল নওয়াজের সাথে। তারপর একটা ফোনকল আসায় ছাদের দিকে গেল কথা বলার জন্য। ছাদের দরজায় এসে দাঁড়ানোর সাথে সাথে ওর মনে হলো, আজ এবাসায় আসাটা বৃথা যায়নি। চাঁদনী একা বসে আছে ছাদের কর্নারের দিকের একটা দোলনায়। কলটা কেটে দিয়ে মোবাইল সাইলেন্ট করে দিল আকরাম। তারপর ঠিক প্রথমদিনের মতো নিঃশব্দে গিয়ে চাঁদনীর পেছনে দাঁড়াল।
“কেমন আছ চাঁদনী?”
চাঁদনী হঠাৎ প্রশ্ন শুনে চমকে উঠে পিছনে ফিরে তাকাল। আকরামকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর চেহারাটা রক্তশূণ্য হয়ে গেল। আজকেও একেবারে পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে আকরাম। চাঁদনী ইতিউতি তাকিয়ে ওখান থেকে সরে আসার রাস্তা খুঁজল, কিন্তু দোলনার দুই পাশের রাস্তাই বন্ধ। একপাশে সাড়ি করে রাখা ফুলের টব, অন্যদিকে আকরাম।
চাঁদনীর অস্থিরতা দেখে হাসল আকরাম। বড় বড় চোখদুটোর চঞ্চল দৃষ্টি এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু শুধু ওর দিকেই তাকাচ্ছে না। আকরাম আবার প্রশ্ন করল, “শুনলাম তুমি নাকি অসুস্থ। এখন কী অবস্থা শরীরের?”
“ভালো।” ছোট করে জবাব দিল চাঁদনী। ওর দৃষ্টি এখনও ছাদের দরজার দিকে। মনে মনে প্রার্থনা করে যাচ্ছিল, আজও সেদিনের মতো কেউ আসুক ছাদে। কিন্তু আজ আর ভাগ্য সহায় হলো না ওর। চাঁদনী ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল ছাদে।
“তুমি কাঁপছ কেন চাঁদনী? এখনও কি শরীর খারাপ লাগছে? ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি কি তোমাকে ধরব? আমার মনে হচ্ছে এখন তুমি পড়ে যাবে।”
“না!” এবার বেশ জোড়ালো শোনালো চাঁদনীর কন্ঠস্বর।
ব্যতিব্যস্ত হলো আকরামও, “ওকে, ওকে। কুল ডাউন। এত হাইপার হয়ে যেও না প্লিজ। আমি তোমার কনসেন্ট ছাড়া তোমাকে টাচ করব না। আমি তো জাস্ট হেল্প করার জন্যই আস্ক করেছিলাম। তুমি বরং একটু বসো। আমরা নাহয় বসে বসেই কথা বলি।”
“আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমি বাসার ভেতরে যাব।”
“শরীর কি খুব বেশি খারাপ লাগছে? কিছুক্ষন অন্তত থাকো প্লিজ, তোমার সাথে কিছু কথা আছে।”
“আমার সাথে? কী কথা?”
“কথাগুলো তুমি ঠিক কীভাবে নেবে জানি না। সেই প্রথমদিন তোমাকে দেখার পর থেকে কথাগুলো বলার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি আমি। কিন্তু কিছুতেই বলতে পারি নি। আমি মানুষ হিসেবে সবসময়ই স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড। সোজাসাপটা কথা বলতে পছন্দ করি। আজও তাই বলছি। চাঁদনী, আই থিংক আই অ্যাম ইন লভ উইথ ইয়্যু।”
এতটুকু বলে আকরাম থামল চাঁদনীর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। অসুস্থতার ছাপ ফুটে উঠেছে মেয়েটার চেহারাতেও। বিশেষ করে চোখ এবং ঠোঁট ফুলে আছে কিছুটা। কান্না করেছিল বোধহয় মেয়েটি। ও নিজেও সম্ভবত জানে না, ওকে এখন ঠিক কতটা সুন্দর লাগছে। আকরামের ইচ্ছে হলো এখনই একটা হ্যাঁচকা টানে মেয়েটাকে নিজের কাছে টেনে এনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু আপাতত নিজের ইচ্ছের লাগাম টানল ও। এমনিতেই মেয়েটা ভয় পেয়ে আছে। এসব করলে আরো বেশি নার্ভাস হয়ে যাবে। যা করার ধীরেসুস্থেই করতে হবে।
আকরাম বলল, “তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ? প্লিজ, এরকম নার্ভাস হয়ো না। ট্রাই টু বি ইজি উইথ মি। আমি শুধুই একটা প্রপোজাল রেখেছি তোমার সামনে। এখনই তোমাকে কোনো উত্তর দিতে হবে না। তুমি ভেবে জানাও আমাকে। তবে কিছু কথা তোমাকে না বলে পারছি না। চারদিকের এতো এতো কৃত্রিম সৌন্দর্যের ভীরে তুমি একজনই প্রকৃত সৌন্দর্যের অধিকারী। ওই যে ফুলের টবে সদ্য ফুটে থাকা লাল গোলাপটি, যেটাতে কারও স্পর্শ লাগেনি এখন পর্যন্ত, ঠিক ওটার মতো। আমি আমার পুরো জীবনে এরকম একজনকেই খুঁজছিলাম। তোমার অ্যানসার যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব তোমার প্রতি।”
শেষের কথাগুলো বলে চাঁদনীর এক্সপ্রেশন দেখার জন্য ওর দিকে ভালো করে তাকাল আকরাম। কিন্তু কোনো পরিবর্তনই দেখতে পেল না ওর মধ্যে। অন্য কোনও মেয়ে হলে এতক্ষনে একটু হলেও কনভিন্স হয়ে যেত। নাহ, এই মেয়েকে বাগে আনতে পরিশ্রম করতে হবে অনেক।
২৩.
মাসের এই বিশেষ দিনগুলোতে চাঁদনীর ভুগতে হয় প্রচুর। বিশেষ করে পেটেব্যাথা হয় খুব। গতকালের চেয়ে অবশ্য আজ একটু বেটার লাগছে। মরিয়ম খাতুন অসুস্থতার কথা শোনার পর থেকে যথেষ্ট যত্ন নিয়েছেন ওর। গরম পানি করে দেওয়া, পেইনকিলার খাওয়ানো। গতকাল কোচিং বন্ধ ছিল বলেও কিছুটা রিল্যাক্স পাওয়া গেছে। কিন্তু আজ তো যেতেই হবে। পেটের সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যাথাটা উপেক্ষা করেই চাঁদনী ঘুম থেকে উঠে পড়ল।
বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে সময় দেখল। তারপর ফ্রেশ হয়ে এসে বই নিয়ে বসল কিছুক্ষনের জন্য। পড়তে পড়তেই গতকাল বিকেলের কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। আকরাম নামের লোকটার সাথে চাঁদনীর দ্বিতীয়বার দেখা হলো কাল। এত জলদি একটা মানুষকে যদিও জাজ করা ঠিক না, কিন্তু চাঁদনী কিছুতেই লোকটাকে পজিটিভলি নিতে পারছে না।
মেয়েদের স্বভাবতই কিছু বিশেষ ক্ষমতা থাকে। বিশেষ করে কোন ছেলে কী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে সেটা কিছুক্ষন অবজার্ভ করলেই অনেকটা বুঝতে পারে একটা মেয়ে। সেই অনুমানের ভিত্তিতেই চাঁদনীর ঠিক ভালো লাগেনি আকরামের তাকানোর ভঙ্গি। যদিও রুমের বাইরে বের হলে চাঁদনী যথেষ্ট মার্জিত হয়েই থাকে। তবুও গতকাল আকরামের সামনে প্রচন্ড রকমের অস্বস্তি হচ্ছিল ওর। লোকটার দৃষ্টি স্থির নয় একদমই, পুরো শরীর, বিশেষ করে স্পর্শকাতর স্থানটিতে বারবার তাকাচ্ছিল লোকটা। সে কথা মনে হলেও কেমন একটা ঘিনঘিনে অনুভূতি হয় ওর।
নওয়াজের বন্ধু সে। অথচ নওয়াজ একদমই এমন নয়। নওয়াজ কথা বললে সবসময় আই কন্টাক্টে বলে, এবং সেই তাকানোর ভঙ্গিতে কখনোই কলুষতা দেখেনি চাঁদনী। বরং, যতবারই নওয়াজের চোখে চোখ পড়েছে ততবারই অন্যকিছু মনে হয়েছে চাঁদনীর। নওয়াজ নিজের মুখে সরাসরিই জানিয়েছে যে চাঁদনীকে সে নিজের জীবনসঙ্গিনী হিসেবে চায় না, কিন্তু তার চাহনি বলে অন্যকিছু। নওয়াজের মুখের কথার সাথে তার আই এক্সপ্রেশন মেলাতে গেলেও বিভ্রান্তিতে পড়ে যায় চাঁদনী।
আকরামের বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বসে কখন যে সেটা নওয়াজে এসে থেমেছে, সেটা চাঁদনী নিজেও জানে না। মোবাইলের নোটিফিকেশন টোন শুনে চমকে উঠল হঠাৎ ও। পরক্ষনে নিজেকে আবার শাসাল ও। না, ওই লোকটাকে নিয়ে আর কিছুতেই ভাবা যাবে না। যেখানে সে স্পষ্ট করে তার অসম্মতির কথা জানিয়েছে, সেখানে তাকে নিয়ে অহেতুক ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। সেদিন গাড়িতে বলা কথাগুলো মনে হতেই চাঁদনীর মুখটা আবার থমথমে হয়ে এলো।
চাঁদনী আপাতত চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল। কোচিং-এ যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে প্রায়। নিচে নেমে নাস্তা করে রেডি হয়ে নিল চাঁদনী। তারপর পার্কিং-এ এসে গাড়ির সামনে দাঁড়াতেই পা দুটো থেমে গেল ওর। ড্রাইভিং সিটে নওয়াজ বসে আছে। চাঁদনীকে দেখে ও বলল,
“উঠে এস। আজ তোমাকে কোচিং-এ ড্রপ করতে আমিই যাব।”
“কেন?” চাঁদনীর ছোট প্রশ্ন।
“ওদিকটায় একটু কাজ আছে আমার আজ। তাই ভাবলাম তোমাকেও নিয়ে যাই।”
চাঁদনী গাড়িতে উঠে বসল।
নওয়াজ স্টার্ট দিয়ে প্রশ্ন করল, “এখন তোমার শরীরের কী অবস্থা? বেটার? মাথাব্যাথা কমেছে?”
চাঁদনী ইতস্তত করল। এক শব্দে জবাব দিল, “হ্যাঁ।”
“তোমাদের এক্সামের তো আর বেশি দেরি নেই। তা তোমার প্রগ্রেস কতদূর?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।”
টুকটাক কথা বলতে থাকল নওয়াজ। চাঁদনী ও সেগুলোর জবাব দিতে থাকল। চাঁদনীর একবার মনে হলো, কাল বিকেলে ছাদে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা নওয়াজকে বলা উচিৎ। কিন্তু ঠিক কীভাবে যে বলবে সেটাই ও বুঝতে পারছিল না। তাই বলতে চেয়েও বলা হলো না কথাগুলো।
কোচিং-এর সামনে চাঁদনীকে নামিয়ে দিয়ে নওয়াজ আবার বাসার দিকে ব্যাক করল। চাঁদনীর সাথে কিছুক্ষন কথা বলার জন্য আজ একটা মিথ্যে বলতে হয়েছে ওকে। আসলে আজ ওর কোনো কাজই ছিল না এদিকে। গতকাল মায়ের কাছে চাঁদনীর অসুস্থতার কথা শোনার পর থেকেই ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সেই সুযোগটা হয়ে উঠছিল না। তাই আজ একটু মিথ্যের আশ্রয় নিতে হলো। মেয়েটার অসুস্থতার কথা শুনে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল মনের মধ্যে সেটা এখন কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়েছে। একটা মানসিক শান্তিও অনুভূত হচ্ছে।
আজকাল চাঁদনী সারাক্ষনই মগজে গেথে থাকে একেবারে। এতদিন মনে হতো, চাঁদনীর প্রতি শুধুই অপজিট অ্যাট্রাকশন কাজ করে ওর। এর বেশি কিছু না। ও যেরকম কাউকে নিজের লাইফ পার্টনার হিসেবে চায় চাঁদনী ঠিক সেরকম নয়৷ কিন্তু ইদানিং সব কেমন ওলটপালট লাগে। নিজের বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলোকে নিজের কাছেই লাগামছাড়া মনে হয়। সংশয়ের কাঁটাটি দুলতে থাকে মনের মধ্যে। মনের অজান্তে চাঁদনী কি তাহলে বিশেষ কেউ হয়ে উঠছে ওর জন্য? নওয়াজ আর ভাবতে চাইল না। নিজের কনসেনট্রেশান অন্যদিকে নেওয়ার চেষ্টা করল।
কিন্তু চাইলেই কি আর সব এড়িয়ে যাওয়া যায়? নওয়াজের জন্যও চাঁদনীর প্রতি অনুভূতিগুলো এড়িয়ে যাওয়া কঠিন থেকে কঠিনতম হয়ে যাচ্ছিল। গুনে গুনে ঠিক আটদিন বাদে সুন্দর এক গোধূলি বেলায় নওয়াজ ফিল করল, চাঁদনীর প্রতি ওর অবসেশন বেড়েই যাচ্ছে। সেদিন ছোট্ট একটা ঘটনার জের ধরে একটু জেলাসিও বোধহয় ছুঁয়ে গেল ওকে।
ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল চাঁদনীর চাচাত ভাই তুরাগকে নিয়ে। চাঁদনী ঢাকায় আসার চারমাস পর প্রথমবার ওর সাথে দেখা করতে এলো ওর ছোট চাচার ছোটছেলে তুরাগ। হুট করে একদিন বিকালে তামজীদকে নিয়ে হাজির হলো সে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
নিভৃত রজনী
| ১৪ | (১২৯০+ শব্দ)
ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল চাঁদনীর চাচাত ভাই তুরাগকে নিয়ে। চাঁদনী ঢাকায় আসার চারমাস পর প্রথমবার ওর সাথে দেখা করতে এলো ওর ছোট চাচার ছোটছেলে তুরাগ। হুট করে একদিন বিকালে তামজীদকে নিয়ে হাজির হলো সে।
চাঁদনী সেদিন ছাদেই ছিল। গাড়ি থেকে তামজীদের সাথে তুরাগকে নামতে দেখে এক দৌড়ে নিচে নামল ও।
নওয়াজ লিভিংরুমে বসে ছিল ল্যাপটপ নিয়ে। চাঁদনীকে ওভাবে দৌড়ে দরজার দিকে যেতে দেখে সচকিত হলো ও। দরজা খোলার পর তামজীদকে ঢুকতে দেখে নওয়াজ বুঝতে পারল চাঁদনীর এভাবে উল্কার বেগে ছুটে যাওয়ার কারণ। হালকা হেসে নওয়াজ অতিথিদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করল। চাঁদনীর জন্য ওর ভাইয়েরা যে ঠিক কতটা ইম্পর্টেন্ট সেটা এতদিনে খুব ভালো করেই বুঝে গেছে ও।
পুরো পৃথিবীর সামনে চাঁদনী শান্তশিষ্ট, মেপে কথা বলা একটি মেয়ে হলেও নিজের কাছের মানুষগুলোর সামনে চঞ্চলা হরিণীর মতো দুরন্ত। এই প্রমাণ নওয়াজ আগেও কয়েকবার পেয়েছে। আজ আবারও চোখের সামনে দেখলে প্রাণোচ্ছল চাঁদনীকে। তামজীদ আর তুরাগ লিভিং রুমে এসে বসতে না বসতেই চাঁদনী তুরাগের সামনে অভিযোগের ডালি খুলে বসল।
“এতগুলো দিন পর তোমার মনে পড়ল আমার কথা? কীভাবে পারলে তুমি? আমি ঠিকই ভেবেছি এতদিন, তুমি আসলে আমাকে একটুও ভালোবাস না। যেহেতু আমার প্রতি তোমার কোনো টানই নেই, তাই আজ থেকে তোমার সাথে আমার কথা বলা বন্ধ।”
তুরাগ হেসে বলল, “পাগলী একটা। জানিসই তো পড়ার খুব প্রেসার যাচ্ছে। বাড়িতেই তো ফিরলাম গতকাল বিকেলে। আর আজ সকালেই রওয়ানা দিলাম ঢাকা। সেজন্যই তো তোর সাথে এতদিন দেখা করতে পারিনি। আর তোকে ফোন দিলেও তো রিসিভ করিস না।”
“কেন করব, আমাকে একটু দেখতে আসার যার সময় হয় না, তার সাথে কোনো কথা নেই আমার।”
“এখনও রেগে আছিস? আচ্ছা মাফ চাইছি আবারও। এরপর থেকে যতই ব্যস্ততা থাকুক, ঠিক তোকে দেখতে আসব।”
“ইনশাআল্লাহ বলো।”
তুরাগ হেসে শুধরে নিল, “দেখতে আসব ইনশাআল্লাহ।”
তুরাগ সেদিন রাতে নওয়াজদের বাসাতেই থেকে গেল। চাঁদনীর মতো সিরিয়াস স্টুডেন্টও সেদিন পড়াশোনা শিকেয় তুলে গল্পে মেতে রইল ওদের সাথে। পরেরদিন সকালের নাস্তা করে বিদায় নিল ওরা। চাঁদনী মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে থাকল।
নওয়াজও দাঁড়িয়ে ছিল চাঁদনীর ঠিক পিছনেই। চাঁদনীকে বলে কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পরে আবারও পিছনে ফিরে তাকাল তুরাগ। ঠিক সেই মুহূর্তেই নওয়াজ ব্যাপারটা বুঝতে পারল। চাঁদনীর দিকে তুরাগের তাকিয়ে থাকার সেই কয়েক সেকেন্ডেই সবটা স্বচ্ছ কাচের মতো হয়ে গেল ওর কাছে। ওই তাকানোর ভঙ্গি আর যাই হোক, ভাইসুলভ কোনোভাবেই হতে পারে না।
তুরাগ চলে যাওয়ার পর এই প্রথমবার নওয়াজ অনুভব করল, চাঁদনীর দিকে অন্য কোনো ছেলের অনুভূতি ওর ভালো লাগছে না। ইনসিকিউরড ফিল করল কিছুটা। কিন্তু তারপরেও নিজের ইগো থেকে বের হতে পারল না ও। একপ্রকার জোর করেও নিজেকে বোঝাল, চাঁদনী ওর সাথে যায় না। ওর দরকার এমন কাউকে যে হবে স্মার্ট এবং আধুনিক মানসিকতার।
২৪.
দেখতে দেখতে চাঁদনীর এক্সাম একেবারেই কাছাকাছি এসে গেল। কোচিং ও নেই এখন আর। বাসাতেই এখন তাই দিনরাত প্রিপারেশন নিচ্ছে এক্সামের জন্য। যেভাবে হোক, অ্যাডমিশন টেস্টে টিকে যেতেই হবে। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওকে। এমনকি আজকাল চোখ বন্ধ করলেও গলায় স্টেথোস্কোপ আর গায়ে অ্যাপ্রন জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিজেকেই দেখতে পায় চাঁদনী।
কিন্তু এখন এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে একটা উটকো ঝামেলাও এসে জুটেছে। সেটা হলো আকরাম। ছেলেটা কীভাবে যে চাঁদনীর মোবাইল নাম্বার পেল সেটাই ওর বুঝে আসছে না। প্রত্যেকদিন চাঁদনীকে কল করে বিরক্ত করছে ছেলেটা। একটা নাম্বার ব্লাকলিস্টেড করলে আরেকটা দিয়ে কল করে। বাধ্য হয়ে চাঁদনী তাই আননোন কল রিসিভ করাই বন্ধ করে দিয়েছে৷ তবুও থেমে নেই আকরাম। ক্রমাগত টেক্সট করে যাচ্ছে। চাঁদনী অনেক ভেবেও কোনো কুলকিনারা পায়নি, আকরামকে আসলে নাম্বারটা দিল কে! নওয়াজ নয় তো? মনের মধ্যে প্রশ্নটা এলেও ও ঠিক মেনে নিতে পারল না যে নওয়াজ এই কাজটা করতে পারে।
আচ্ছা, পুরো ব্যাপারটা নওয়াজের সাথে আলাপ করলে কেমন হয়? এতদিনে যতটুকু চাঁদনী দেখেছে, তাতে নওয়াজকে দায়িত্বশীল ছেলে বলেই মনে হয়েছে। ওকে জানালে নিশ্চই কোনো স্টেপ নেবে। চাঁদনী অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিল, নওয়াজকে ও জানাবে বিষয়টা৷ তাহলে যদি অন্তত ওই গায়ে পড়া ছ্যাচড়া লোকটা থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
চাঁদনী বই বন্ধ করে নওয়াজের রুমের দিকে গেল। আজ বাসাতেই আছে নওয়াজ। আজই তাহলে কথা বলে নেওয়া যাক। যদিও এভাবে একটা ছেলের ঘরে একা কথা বলতে যাওয়টা চাঁদনীর নিজের কাছেই একটু অড লাগছে। কিন্তু উপায় নেই। চাঁদনী চায় মরিয়ম খাতুনকে কিছু জানতে না দিয়েও সমস্যাটার সমাধান করতে। চাঁদনী নওয়াজের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজাটা ইঞ্চি তিনেক ফাঁকা হয়ে আছে তবুও ভদ্রতাবশত দরজায় নক করতে গেল চাঁদনী। কিন্তু দরজায় টোকা দিতে গিয়ে ঘরের মধ্যে কথোপকথন শুনে ওর হাত থেমে গেল।
না, আড়ি পেতে অন্যদের ব্যক্তিগত কথা শোনার বদ অভ্যাস চাঁদনীর কখনোই ছিল না। কিন্তু নওয়াজের গলায় নিজের নামটা শোনার পরে কোনো এক চৌম্বকীয় আকর্ষণে চাঁদনী চেয়েও নিজের পাদুটো ফ্লোর থেকে সরাতে পারল না। নওয়াজের উচ্চারণ করা প্রত্যেকটা শব্দই স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে। এসময়টায় এই রুমের দিকে কারও আসার সম্ভাবনা নেই। সেজন্য নওয়াজ বোধহয় কথাগুলো একটু জোড়েই বলছে।
“দেখো আম্মু, আমি তোমার যেকোনো ডিসিশানের প্রতিই রেস্পেক্টফুল। তুমি চাঁদনীকে পছন্দ করেছ, ঠিক আছে। কিন্তু আমার দিকটাও তো তুমি একবার ভাববে। চাঁদনীর সাথে আমার মেন্টালিটির আকাশ পাতাল তফাত। এটা তো দুই একদিনের ব্যাপার না। ইটস দ্যা ম্যাটার অভ অ্যাওয়ার টোটাল লাইফ। এভাবে আমার লাইফটা স্পয়েল করে দিও না প্লিজ।”
“নওয়াজ! এসব তুই কী বলছিস? আমি তোর লাইফ স্পয়েল করছি?”
“ওহ! আম্মু। নাও ইয়্যু আর গেটিং মি রং। আই ডাজেন্ট মিন দ্যাট।”
“হয়েছে। আমি আর তোর থেকে কোনোরকম ব্যাখ্যা চাই না। আমার কথার মূল্য তোর কাছে ঠিক কতটুকু সেটা আমার খুব ভালো করেই বোঝা হয়ে গেছে।”
“আম্মু, তুমি মাথা ঠান্ডা করো। এখানে এসে বসো তো। লেট মি এক্সপ্লেইন ইউ।”
“কী এক্সপ্লেইন করবি তুই? চাঁদনীকে তোর কোন দিক থেকে খারাপ মনে হচ্ছে?”
“চাঁদনীকে আমার কোনো দিক থেকেই খারাপ মনে হচ্ছে না আম্মু। চাঁদনী চমৎকার একটা মেয়ে। কিন্তু ওর সাথে আমার ম্যাচ করে না আম্মু। তুমি ওর লাইফস্টাইল দেখো আর আমারটা দেখো, তাহলেই সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে তোমার কাছে।..”
অনর্গল মাকে বুঝিয়ে যাচ্ছে নওয়াজ। ওর কথাগুলোর মর্মার্থ যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, চাঁদনীকে বিয়ে করলে নওয়াজের জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। নওয়াজের কথাগুলো শুনতে শুনতে চাঁদনীর চোখ থেকে অবাধ্য অশ্রুবিন্দুগুলো না চাইতেই টপটপ করে পড়ছিল। ঠিক ঐ মুহুর্তে ওখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে তুচ্ছ ফেলনা একটা বস্তু মনে হচ্ছিল। যাকে কিনা মরিয়ম খাতুন তার ছেলের কাছে গছিয়ে দিতে চাইছেন এবং ছেলে সেটা নিতে অসম্মতি জানাচ্ছে।
ওখানে দাঁড়িয়েই সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটা নিল চাঁদনী। যদিও নওয়াজ চাঁদনীকে বিয়ে করতে চায় না। তবু যদি কখনও মায়ের চাপে রাজিও হয়, চাঁদনী বেঁচে থাকতে সেই সিদ্ধান্তে রাজি হবে না কখনও। এমনকি পৃথিবীতে বিয়ে করার জন্য সর্বশেষ ছেলেটিও যদি নওয়াজ হয়, তবুও না।
আকরামের ব্যাপারটা নওয়াজের সাথে আলাপ করার সিদ্ধান্ত নিলেও আপাতত সেটাও করল না চাঁদনী। আর তো মাত্র কিছুদিন। এরপরেই এক্সাম হয়ে যাবে। তারপর এই বাসা ছেড়ে চলে যাবে ও। আল্লাহ চাইলে যদি এখানে চান্সও হয়, তাহলেও এই বাসায় আর থাকবে না। প্রয়োজনে হোস্টেলে উঠবে।
দেখতে দেখতে এক্সামের দিনটিও চলে এলো। সব গোছগাছ করে রেডি হয়ে চাঁদনী দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে নিল। তামজীদ বাসায় এলো ওকে নিয়ে যেতে। এক্সাম দিয়ে উৎফুল্ল মনেই বের হলো চাঁদনী। রুমে ফেরার পর সবাই একে একে জিজ্ঞাসা করল এক্সামের কথা। এমনকি নম্রতাও রুমে এসে জিজ্ঞাসা করে গেল, কেমন হয়েছে এক্সাম।
বিকেলে কল এলো তালুকদার মঞ্জিল থেকে। বাবা, ছোট আব্বু, ভাইজান, ভাবী সবার সাথে কথা হলো। শেষে দেওয়া হলো রেবেকা বেগমের কাছে। তিনি বললেন, “এবার তো পরীক্ষা শেষ। কাল তাহলে সাদমানকে পাঠাই। বাড়ি চলে আয়।”
“না, মা। কয়েকদিনের মধ্যেই রেজাল্ট দেবে। রেজাল্টটা নিয়ে একবারেই যাব। আমার কোচিং-এর ফ্রেন্ডরাও রেজাল্ট না পাওয়া অব্দি ঢাকা ছেড়ে যাবে না। তাছাড়া যতদিন পর্যন্ত ফলাফল না জানতে পারছি, ততদিন কিছুতেই শান্তি পাব না। তারচেয়ে বরং এখানেই থাকি আরও কয়েকটা দিন।”
“এত চিন্তার কিছু নেই। যা হবে ইনশাআল্লাহ ভালোই হবে। তাছাড়া তোর বাবা তো বলেছে, দরকার হলে তোকে প্রাইভেট কলেজে পড়াবে। তোর এত আগ্রহ, আল্লাহ তোর মনের আশা ঠিক পূরণ করবে।”
“দোয়া কোরো আমার জন্য।”
“পাগল মেয়ে। তোর জন্য আমরা সবসময় দোয়া করি।”
অনেকদিন পর বাড়িতে সবার সাথে কথা বলে চাঁদনীর খুব ভালো লাগল। আর কয়েকটা দিন মাত্র। তারপরে আবার সেই নিজের পরিচিত জায়গায় যাবে ও। এই জেলখানা থেকে মুক্তি মিলবে ওর।
২৫.
নওয়াজের ইচ্ছে ছিল গ্রাজুয়েশনের পর নিজে কিছু করার চেষ্টা করবে আগে। কিন্তু জামশেদ সাহেবের ইচ্ছায় তার বিজনেসেই মনোযোগ দিতে হচ্ছে এখন। অন্যান্য দিনের মতো আজ সন্ধ্যায়ও কিছু পেপারস নিয়ে বসেছিল ও। জামশেদ সাহেব কিছুদিনের জন্য দেশের বাইরে গিয়েছেন, তাই প্রেসারটা এখন আরও বেশি।
নওয়াজ পুরোপুরিই কাজে ডুবে গিয়েছিল, তক্ষুনি ঘরে ঢুকল মিশকাত, আবির আর আকরাম। নওয়াজ অবাক হলো খুব।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
নিভৃত রজনী [প্রাপ্তবয়স্ক সতর্কতা]
| ১৫ | (১৮০০+ শব্দ)
নওয়াজ পুরোপুরিই কাজে ডুবে গিয়েছিল, তক্ষুনি ঘরে ঢুকল মিশকাত, আবির আর আকরাম। নওয়াজ অবাক হলো খুব।
“তোরা হঠাৎ? আসবি যে আগে তো জানালি না!”
মিশকাত হেসে বলল, “সারপ্রাইজ দিলাম। তুমি তো ইদানিং বিজনেসম্যান হয়ে গেছ। পাওয়াই যায় না তোমাকে। তাই আজ আমরাই চলে আসলাম। আজ সারারাত আড্ডা হবে।”
“মাথা খারাপ। তোদের আড্ডা মানে আমি ভালো করেই জানি। ড্রিংক করে মাতলামি করবি সারারাত। হাই ভলিউমে গানও বাজাবি। এসব এখানে চলবে না। তাছাড়া আম্মুও আজ বাসায় নেই।”
মিশকাত বলল, “তুই এভাবে বলতে পারলি? আচ্ছা গানের ভলিউম হাই করব না, প্রমিস। আন্টি নাই তাতে তো আরও ভালো হয়েছে। মুরুব্বি মানুষ বাসায় থাকলে আরও অস্বস্তি হতো। আর যা করার আমরা তো রুমের মধ্যেই করব। তুই রাজি হয়ে যা প্লিজ।”
“ওকে।” নওয়াজ উত্তর দিল।
ওরা সবাই হই হই করে উঠল। শুধু আকরাম মৃদু হেসে সোফার এককোনে বসল। অবশেষে ওর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। মিশকাত আর আবিরকে মূলত ওই নিয়ে এসেছে নওয়াজকে রাজি করানোর জন্য। অনেকদিন ধরে চেষ্টা করেও চাঁদনীর সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। আজ তাই নিজেই প্লানটা করেছে ও। মিশকাত আর আবির অজান্তেই ওর ফাঁদে পা দিয়েছে। আকরাম বসে বসে ছক কষতে থাকল, কিভাবে চাঁদনীর সাথে দেখা করবে।
বাড়িতে মা নেই, তাই নওয়াজ রাতের খাবার খেতে ওদের নিয়ে নিচে গেল না আর। টুলুর মাকে বলে খাবার ঘরেই দিয়ে যেতে বলল।
চাঁদনী আর নম্রতা খাবার টেবিলে টুলুর মায়ের কাছেই জানতে পারল নওয়াজের বন্ধুদের আসার কথা। খাওয়া শেষে নম্রতা চাঁদনীকে বলল,
“আম্মু তো আজ বাসায় নেই। এখন রুমে গিয়ে ঢুকলে সকালের আগে আর দরজা খুলবে না। মনে থাকবে?”
নম্রতার বলার কারন বুঝতে পারল চাঁদনী। মাথা নেড়ে ও বলল, “আচ্ছা, আপু।”
নম্রতা কী একটা ভাবল কিছুক্ষন। তারপর বলল, “তারচেয়ে বরং আজ রাতে আমি তোমার সাথেই থাকব। আমার পড়তে হবে কিছুক্ষন। তারপর তোমার রুমে যাব আমি। এতে কি তোমার কোনো প্রব্লেম আছে?”
“না না। কী বলছেন আপনি। কোনো সমস্যা নেই।”
চাঁদনী নিশ্চিন্ত হলো কিছুটা।
মরিয়ম খাতুন আজ বাসায় নেই। সন্ধ্যায় হাসপাতালে গিয়েছিলেন প্রতিবেশী একজন মহিলাকে দেখতে। হাসপাতালে যাওয়ার পর জানতে পারলেন, রোগীটির অবস্থা খুব একটা সুবিধার না। রাতটুকুও হয়তো সার্ভাইব করবে না। সেজন্য আজ রাতটা হাসপাতালেই থেকে যাবেন। চাঁদনী রাতের খাবার খেয়ে রুমে গিয়ে আগে দরজা লক করল। তারপর একটা উপন্যাসের বই নিয়ে পড়তে শুরু করল। আর অপেক্ষা করতে লাগল নম্রতার আসার।
নওয়াজদের আড্ডাটা জমে উঠল রাত বারোটার পরে। অবশ্য নওয়াজের জন্য সেভাবে এনজয় করা যাচ্ছে না কিছুই। কারণ নওয়াজ বারবার করে বলে দিয়েছে, আওয়াজ যাতে কিছুতেই রুমের বাইরে না যায়।
দেড়টার দিকে আকরাম বলল, রুমের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। আমি একটু ছাদে যাচ্ছি। ওর মনের দুরভিসন্ধি কেউ আঁচও করতে পারল না। রুমের বাইরে বের হয়ে দরজা টেনে আটকে দিয়ে আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করল না আকরাম। অপর প্রান্তের রুমের দিকে গেল সোজা। কাঙ্ক্ষিত দরজায় নক করতে গিয়ে ওর মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল। ড্রিংক এর মাত্রাটা একটু বেশিই হয়ে গেছে মনেহয়। আকরাম নিজেকে ধাতস্থ করে দরজায় নক করল। ভিতর থেকে প্রশ্ন এল, “কে?”
আকরাম জবাব না দিয়ে আবার নক করল। বেশ কয়েকবার নক করার পর খুলল দরজাটা। ওপাশে দাঁড়ানো মানুষটির দিকে তাকিয়ে আকরাম হেসে জিজ্ঞাসা করল, “কেমন আছ চাঁদনী?”
চাঁদনী পরপর কয়েকবার দরজায় করাঘাত শুনে ভেবেছিল নম্রতাই এসেছে বোধহয়। কিন্তু দরজা খোলার পরে বুঝল চূড়ান্ত বোকামিটা ও করে ফেলেছে। আকরামের প্রশ্নের জবাব না দিয়েই আবার দরজাটা আটকে দিতে গেল ও। কিন্তু আকরাম সেটা করার সুযোগ দিল না একদমই। গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে দরজা ঠেলে হুড়মুড় করে রুমের মধ্যে ঢুকে পড়ল। তারপর এক সেকেন্ডও সময় ব্যয় না করে চাঁদনীর দুহাত দুপাশ থেকে পিছনে নিয়ে শক্ত করে আটকে ধরল। নিজের এক পা দিয়ে পিছনে লাথি দিয়ে আটকে দিল দরজাটাও।
চাঁদনী কয়েক সেকেন্ডের জন্য রিয়্যাক্ট করতেও ভুলে গেল। ওর বিশ্বাসই হতে চাইল না সত্যিই এই ঘটনাটা ওর সাথে ঘটছে এখন।
চাঁদনী নিজের হাতদুটো ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে বলল, “আপনি এসব কী করছেন? প্লিজ ছেড়ে দিন আমাকে।”
চাঁদনীর কথা শুনে ওকে ছাড়ার বদলে আরেকটু শক্ত করে ধরল আকরাম। আলগা করে দেওয়া মাথার কাপরটা পড়ে গেছে কাঁধে। এত কাছাকাছি চাঁদনীকে পেয়ে নিজেকে সামলে রাখাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে ওর জন্য। অবশ্য সামাল দেওয়ার চেষ্টাও ও করছিল না ও। আকরাম চাঁদনীকে ঠেলে দেওয়ালের সাথে নিয়ে মিশিয়ে দিল। নিজের এক হাত ছাড়িয়ে তরিৎ বেগে চাঁদনীর গলার দিকের ওড়না ধরে টান দিয়ে নিজের হাতে নিয়ে এলো। তারপর সেটা ছুঁড়ে মারল রুমের এককোনে। অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদের আশঙ্কায় চাঁদনীর বুকটা ধ্বক করে উঠল। এবার বুঝি আর নিস্তার পাওয়া যাবে না।
নিজের চরম ক্ষতি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনুমান করে চাঁদনী এবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আকরাম ওর থুতনি ধরে হাসতে হাসতেই বলল,
“কাঁদছ কেন চাঁদনী? ভয় পাচ্ছ? এত নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই। আমি তো শুধু কথা বলতে এসেছি তোমার সাথে। না মানে, কথা বলতে আসলেও এখন আমার অন্যকিছু করতে ইচ্ছে করছে। ড্রিংক করে কিছুটা মাতাল ছিলাম এতক্ষন, কিন্তু তোমাকে দেখার পর আমি পুরোপুরি মাতাল হয়ে গেছি। সো চাঁদনী, এখন আর কেঁদ না প্লিজ। এস, আমরা আমাদের এই সময়টুকুকে ইঞ্জয় করি।”
চাঁদনী কান্না ভুলে বিস্ফোরিত চোখে তাকাল আকরামের দিকে। আজকের রাতের পর আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কি কোনো পথ খোলা থাকবে ওর জন্য?
২৬.
নওয়াজের বিরক্ত লাগা স্বত্বেও কিছু করতে পারছে না ও। মিশকাত আর আবির দুজনেই ড্রিংক করে এখন পুরোপুরি কন্ট্রোললেস হয়ে আছে। এর আগেও রাত জেগে এরকম বহু আড্ডা ওরা দিয়েছে। তবে সেটা ফাহিমের ফাঁকা ফ্লাটে অথবা অন্য কোথাও। কিন্তু নওয়াজের বাসায় এই প্রথমবার এলো। নওয়াজই মূলত ওদের আনতে চাইত না ওদের বাসায়। স্পষ্টই সে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিল, ওরা এমনিতে আড্ডা দিতে যেকোনো সময় এই বাসায় আসতে পারে। কিন্তু মদ খেয় মাতলামো করতে কখনও নয়।
আজ যদিও ওরা একপ্রকার জোর করেই এসেছে। মিশকাত বলেছে, শুধু আজকের দিনই। এরপর আর কখনও এটা রিপিট হবে না। তাই বাধ্য হয়েই অনুমতি দিতে হয়েছে ওকে।
অন্যান্য দিনগুলোতে নওয়াজ নিজেও একটু আধটু লিমিটের মধ্যে থেকেই ড্রিংক করে। কিন্তু আজ নেশা হয়ে যাওয়ার ভয়ে আর সেসব কিছু করল না ও। মা, বাবা কেউই বাসায় নেই। চাঁদনী আর নম্রতা দুজনে একা আছে। যদি ওরা কেউ কন্ট্রোললেস হয়ে ওদের…। না, বন্ধুদের উপর ভরসা আছে নওয়াজের। ওরা বাইরে যাই করুক, নওয়াজের বাসাতে নিশ্চই উলটোপালটা কিছু করবে না। তবুও একটা খচখচানি থেকেই যায় মনের মধ্যে।
নওয়াজ মিশকাতকে বলল, “এবার তোদের থামা উচিৎ।”
মিশকাত সাথে সাথেই জবাব দিল,
“চুপ কর শালা। থামব মানে? এখন তো কেবল শুরু। দ্যা নাইট ইজ স্টিল ইয়াং। তুই কথা কম বলে নিচে যা। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি নিয়ে আয়।”
“আমি এখন যেতে পারব না।”
আবির এবার বলল, “যা না ভাই, প্লিজ। এখনও ঠিকভাবে কিছু ফিল করতে পারছি না।”
নওয়াজ রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। সিঁড়িতে দুই পা নেমে হঠাৎ থেমে গেল ও। কানে একটা সুক্ষ্ণ চিৎকারের শব্দ এসে লাগল। গলাটা চাঁদনীর নাকি! নিজের অজান্তেই নওয়াজ এগিয়ে গেল চাঁদনীর রুমের দিকে। এখন আর কোনো আওয়াজ আসছে না। দরজায় টোকা দিতে গিয়েও দিল না নওয়াজ। এটা মনের ভুলও হতে পারে। উল্টোদিকে ঘুড়ে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল ও। এবার স্পষ্ট পুরুষালী গলার স্বর কানে এলো ওর।
নওয়াজের বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগল যে এটা আকরামের গলা। সাথে সাথে পুরো ব্যাপারটাই ওর কাছে ক্লিয়ার হয়ে গেল। দরজা ভেজানো ছিল। নওয়াজ ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে যা দেখল তাতে ওর আপাদমস্তক রাগে দপদপ করে উঠল। এরকম রূপে চাঁদনীকে দেখতে হবে সেটা কখনও কল্পনাও করতে পারেনি নওয়াজ।
দেওয়ালের এককোনায় গুটিশুটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চাঁদনী। ভয়ে হাত পা কাঁপছে থরথর করে। ওরনাটা দলা করে বুকের কাছে এনে চেপে ধরা। এই প্রথম চাঁদনীর চুল দেখল নওয়াজ। কোমর অব্দি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। তারসাথে আর যে দৃশ্যটি দেখল নওয়াজ সেটা দেকে ওর মস্তিষ্কে আগুন জ্বলে উঠল। চাঁদনীর ফুলহাতা কামিজের একটা পাশের হাতা পুরোপুরি ছেড়া। কাঁধ থেকে শুরু করে পুরো হাত উন্মুক্ত। জাফরান রঙের অন্তর্বাসের স্ট্রাপ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। ধবধবে সাদা বাহুতে টকটকে লাল হয়ে আছে সদ্য তৈরি হওয়া কামড়ের দাগটি।
দরজা খোলার শব্দে চাঁদনী আর আকরাম দুজনেই সেদিকে তাকাল। নওয়াজ এগিয়ে গিয়ে একটানে বিছানার চাদর তুলে ফেলল৷ তারপর সেটাই জড়িয়ে দিল চাঁদনীর গায়ে। চাঁদনী ওখানেই বসে পড়ল গায়ে চাদরটি পেঁচিয়ে। তখনও ও কাঁপছিল ও মৃগী রোগীর মতো।
অর্ধমাতাল আকরাম অনেকটা কৈফিয়ত দেওয়ার মতো বোঝানোর চেষ্টা করল নওয়াজকে, “আগেই রেগে যাস না। অ্যালাউ মি ট্যু এক্সপ্লেইন ইয়্যু দ্যা ম্যাটার। হয়েছে কি আসলে…।”
বাক্যটা শেষ করতে পারল না ও। তার আগেই নওয়াজ হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে সর্বশক্তি দিয়ে আকরামের নাক বরাবর ঘুসিটা দিল। গলগল করে রক্ত বের হলো নাক দিয়ে। ঠিক কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দ্বিতীয় ঘুসিটা দিল তলপেটেরও অনেক নিচে। এবার আকরাম তলপেট চেপে ধরে ফ্লোরেই শুয়ে পড়ল। নওয়াজ টিশার্টের কলার ধরে উঠিয়ে দার করাল আকরামকে। পরের ঘুসিটা দিল গালে, আজ যেন ওর গায়ে অসুরের শক্তি ভর করেছে। আকরামের মাথাটা উল্টোদিকের দেয়ালে সজোরে ঠুকে গেল। আবার ধপ করে ও পড়ে গেল ফ্লোরে। নওয়াজ ওখানে দাঁড়িয়েই পকেট থেকে ফোন বের করে নম্রতার নাম্বারে কল দিয়ে চাঁদনীর রুমে আসতে বলল।
নম্রতা পড়তে পড়তে টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। ঘুমঘুম চোখেই ও এসে দাঁড়াল চাঁদনীর রুমের সামনে। বিধ্বস্ত আকরামকে ফ্লোরে শুয়ে থাকতে এবং চাঁদনীকে এমন আলুথালু হয়ে বসে থাকতে দেখে ওর ঘুম পুরোপুরি উবে গেল। নওয়াজ কিছু না বললেও ও নিজ দায়িত্বেই পুরো বিষয়টা বুঝে নিল।
নওয়াজ বলল, “ওর সাথে একটু থাক তুই।”
পরক্ষনেই আবার আকরামের দিকে ফিরল ও। তলপেটে ক্রমাগত লাথি দিতে দিতে চেঁচিয়ে উঠল, “স্কাউন্ড্রেল। এতবড় সাহস হয় কী করে তোর!”
নওয়াজের গলার স্বর আবির এবং মিশকাতের কান অব্দিও পৌঁছে গেল। ওরা একছুটে চলে এলো চাঁদনীর রুমের সামনে। পরিস্থিতি দেখে, ঘরের মধ্যে কী হয়েছে সেটা বুঝতে মিশকাত আর আবিরেরও খুব একটা সময় লাগল না।
নম্রতার পাশে দাঁড়ানো অপরিচিতা বিধ্বস্ত মেয়েটিকে এই প্রথমবার দেখল ওরা। কিন্তু কারোরই বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এটাই চাঁদনী। নওয়াজের অ্যাবসেন্সে আকরামের মুখে বর্ননা শুনে অপূর্ব সুন্দর একটি মুখ কল্পনা করে নিয়েছিল ওরা। কিন্ত আজকে চাঁদনীকে দেখে মনে হলো, আকরাম যা বলেছে তার চেয়েও হাজারগুন সুন্দর মেয়েটি।
নওয়াজ আকরামকে মেরেই চলেছে। মিশকাত আর আবির এক পলক তাকিয়েই চাঁদনীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। তারপর গিয়ে নওয়াজকে জাপটে ধরে থামানোর চেষ্টা করল।
আবির বলল, “এবার থাম নওয়াজ। আর মারলে মরে যাবে। দেখছিস তো রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছে মনেহয়। ও মাই গড, মাথা ফেটে গেছে মনে হচ্ছে।”
নওয়াজ থামল কিছুক্ষনের জন্য। বলল, “ওকে নিয়ে এখনই আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হ। বাস্টার্ডটার এতবড় সাহস হয় কী করে?”
মিশকাত বলল, “আচ্ছা, ওকে নিয়ে বাইরে যাই আগে। মেয়েটা এমনিতেই ভয় পেয়ে আছে। এখানে আর কোনো সিনক্রিয়েট করিস না।”
“একেবারে বাডির বাইরে নিয়ে যা ওকে। নইলে আজ আমি ওকে মার্ডার করে ফেলব।” নওয়াজ চেঁচিয়ে বলল।
আবির আর মিশকাত জানে, এটা নিছকই কোনো হুমকি নয়। নওয়াজ রেগে গেলে নিজের উপর কোনো কন্ট্রোলই থাকে না ওর। সত্যিই হয়তো মেরেই ফেলবে আজ আকরামকে।
আকরামকে কোনোরকমে দুপাশ থেকে দুজনে ধরে দাঁড় করালো। মিশকাত বলল, “ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। মাথা থেকে এভাবে ব্লিডিং হতে থাকলে সিরিয়াস কিছু হয়ে যেতে পারে।”
ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর নওয়াজ বলল, “নম্রতা, তুই ওর সাথেই থাক। একটু নরমাল করার চেষ্ট কর।”
নওয়াজ থেমে গেল এতটুকু বলেই। যদিও চাঁদনীকে দেখে বোঝা যাচ্ছে যে বড় কোনো ক্ষতি হওয়ার আগেই নওয়াজ এসে পড়েছিল। তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রশ্নটা করল ও, “চাঁদনী। বলছিলাম যে তুমি কিছু মনে করো না, ওই স্কাউন্ড্রেলটা কি..।
প্রশ্নটা কীভাবে করবে সেটা বুঝে উঠতে পারছিল না ও। কিন্তু চাঁদনী বুঝে গেল। যান্ত্রিক স্বরে ও উত্তর দিল, “আমার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি।”
“ওকে।”
ছোট্ট জবাব দিয়ে নওয়াজ বের হয়ে এলো ঘর থেকে। রুমে এসে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকল ও। আকরামের প্রতি প্রচন্ড রাগ হতো নওয়াজের ওর এই স্বভাবটার জন্য৷ কিন্তু আজ রাগের সাথে কোথাও একটা ব্যাথাও অনুভব হচ্ছে। চাঁদনীর জন্যই বোধহয় সেটা। ওই সময়টাতে মেয়েটার উপর থেকে ঠিক কী গেছে সেটা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছে ও।
পুরোটা সময় শুধু চাঁদনীকে নিয়েই ভেবে গেল ও। ভাবতে ভাবতে একসময় নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল, চাঁদনী কী বিশেষ কেউ হয়ে উঠছে ওর জন্য?
(চলবে ইনশাআল্লাহ)