নিভৃত রজনী
| ১১ | (১৪০০+ শব্দ)
নম্রতা কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় বসে রইল খাটের এককোনে। কান পেতে ওপাশের কন্ঠস্বর শোনার চেষ্টাও বোধহয় করছিল একটু-আধটু।
মরিয়ম খাতুন ফোন রাখতেই প্রশ্ন করল ও, “কার সাথে কথা বলছিলে আম্মু?”
“তানিমের সাথে। চিনেছিস তো? চাঁদনীর সাথে সেই প্রথম দিন যে এসেছিল।”
“চিনেছি।” নম্রতা ছোট্ট করে উত্তর দিল।
“ছেলেটা সেই একবার এলো শুধু বাসায়, তারপর আর কোনো খবর নেই। আজ হঠাৎ করে কথা হলো তো, তাই আসতে বললাম।”
“ও। তা কী বলল সে? আসবে?”
“বলল তো আসবে। দেখা যাক। কিন্তু তুই হঠাৎ এই সময়ে আমার রুমে?”
নম্রতার ঘোর কাটল মায়ের প্রশ্নে, “না মানে, মাথা ব্যাথা হচ্ছিল খুব। তোমার কাছে কি পেইন কিলার হবে?”
“আমার কাছে তো নেই, তবে নওয়াজের কাছে থাকতে পারে।”
নম্রতা কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল, “খুব পেইন হচ্ছে আম্মু, ভাইয়ার কাছে একটু গিয়ে দেখবে, মেডিসিনটা পাও কিনা।”
“সারাক্ষন ফোন নিয়ে পড়ে থাকলে ব্যাথা তো হবেই। তুই এখানে বসে থাক। আমি নওয়াজের কাছে গিয়ে দেখছি।”
নম্রতা ভ্রু কুঁচকে তাকাল মায়ের দিকে। মাথাব্যাথার সাথে ফোনের কী সম্পর্ক সেটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করলেও চেপে গেল আপাতত। এখন ওর মাথায় অন্য একটা বিষয় ঘুরছে।
মরিয়ম খাতুন রুম থেকে বের হয়ে যেতেই নম্রতা চট করে মায়ের মোবাইলটা নিল। তানিমের সাথে কথা বলছিল মা। তার মানে কন্টাক্ট লিস্টের লাস্ট নাম্বারটাই ওই লোকটার। নম্রতা কললিস্ট চেক করল তড়িঘড়ি করে। কিন্তু শেষপর্যন্ত হতাশ হতে হলো ওকে। লাস্ট নাম্বারটা সেভ করা চাঁদনীর নামে। তারমানে কি চাঁদনীর মোবাইল থেকেই কথা বলছিল লোকটা৷ ইশ! নাম্বারটা পাওয়া গেল না। নম্রতা মুখ গোমড়া করে ফোনটা আবার রেখে দিল যথাস্থানে। ততক্ষনে মরিয়ম খাতুন ওষুধ নিয়ে চলে এসেছেন।
নম্রতা ট্যাবলেটের পাতাটা নিয়ে নিজের রুমে চলে এলো। গ্লাসে পানি ঢেলে ওষুধের পাতা থেকে ওষুধ খুলতে গিয়ে খেয়াল করল, এখন একদমই আর মাথাব্যাথা নেই।
ওষুধ না খেয়েই বিছানায় এসে বসল ও। তানিমের ফোন নাম্বারটা না পাওয়ায় এখনও মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। আর কি কোনো উপায় আছে ওই বদ লোকটার কন্টাক্ট নাম্বার পাওয়ার? নম্রতা ভাবতে বসে গেল। ভাবতে ভাবতে একসময় হঠাৎ করেই খেয়াল এলো ওর। আশ্চর্য! ওই লোকটার কন্টাক্ট নাম্বার পাওয়ার জন্য এত চেষ্টা কেন করছে ও? কী হবে ওই অসভ্য লোকটার নাম্বার দিয়ে?
নম্রতার মেজাজের পারদ আস্তে আস্তে বেড়েই যাচ্ছিল। সব দোষ মিথিলার। সেদিন ও তানিমের ব্যাপারে কথাগুলো বলার পর থেকেই একেবারে মাথার মধ্যে গেঁড়ে বসেছে লোকটা। না, এরকম হতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। মনের মধ্যে কোনোরকম পজেটিভ জায়গা রাখা যাবে না লোকটার জন্য। শায়েস্তা করতে হবে লোকটাকে। লোকটা বাজেভাবে অপমান করেছে নম্রতাকে। তাকে সেই অপমানের আরও দশগুন ফিরিয়ে দিতে হবে। নম্রতা প্রতিজ্ঞা করল মনে মনে। তবে সেই প্রতিজ্ঞাটা কতটা দৃঢ় হলো কে জানে?
চাঁদনী ফিরে এলো দুই দিনের মধ্যেই। যদিও রেবেকা বেগম বারবার করে বলেছিলেন আরও একটা দিন থেকে যেতে। কিন্তু কোচিং-এর ক্লাসগুলো মিস যাবে বলে চাঁদনী জোর করেই চলে এসেছে। চাঁদনীকে এবার নিয়ে এসেছে সাদমান।
নম্রতা সকালে নাস্তার টেবিলেই মায়ের কাছে শুনেছিল যে চাঁদনী আজ ফিরছে। চাঁদনী ফিরছে মানে তার সাথে তানিমের আসারও সম্ভাবনা আছে। নম্রতা সবরকম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল তানিমের মুখোমুখি হওয়ার। সেই অপমানজনক চিঠিটার কী উত্তর দেবে সেটাও রিহার্সাল করেছে কয়েকশবার। যদিও আত্মবিশ্বাস কিছুটা কমই মনে হয়েছিল নিজের কাছে। তবুও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ছিল ও। কিন্তু নম্রতার সব প্লান ভেস্তে গেল, যখন দেখল চাঁদনীর সাথে তানিমের বদলে সাদমান এসেছে। অহেতুক নিজের রুমে গিয়ে জিনিসপত্রের উপরে রাগ ঝারল কিছুক্ষন। তারপর একসময় থেমে গেল।
২০.
চাঁদনী ফেরার পর থেকেই নওয়াজ সুযোগ খুঁজছিল ওর সাথে কথা বলার। কিন্তু সেই সুযোগটা হয়েও হচ্ছিল না। কিংবা চাঁদনী নিজেই সেই সুযোগটা দিতে চাইছিল না বোধহয়। শেষে নিরিবিলিতে কথা বলার জন্য নওয়াজ আগের পন্থাই বেছে নিল। কোচিং ক্লাস থেকে চাঁদনীকে আনার জন্য ড্রাইভারের বদলে ও নিজেই গেল।
চাঁদনী সবেমাত্র বের হয়ে গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, তখনই সামনে এসে থামল গাড়িটা। নওয়াজকে দেখে আজও কিছুটা চমকাল ও, তবে আজ আর কোনো প্রশ্ন করল না। এগিয়ে গিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়াল। নওয়াজ সরাসরিই কথা বলল, “তোমার সাথে কিছু কথা আছে। অপজিটেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে, তোমার যদি খুব বেশি তাড়া না থাকে তাহলে ওখানে গিয়ে আমরা কিছুক্ষন বসতে পারি।”
চাঁদনী উত্তর দিল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই, “গাড়িতে যেতে যেতেও তো আমরা কথা বলতে পারি। আমার সাথে আপনার কী এমন কথা থাকতে পারে যার জন্য আলাদা করে বসতে হবে আমাদের!”
চাঁদনীর এরকম ঝটপট উত্তর আশা করেনি নওয়াজ। কিছুটা থমকাল ও। তারপর বলল, “ওকে। তোমার সমস্যা থাকলে দরকার নেই আলাদা করে কথা বলার। গাড়িতে উঠে বসো।”
নওয়াজের মুখ থমথমে। চাঁদনী সেদিকে একপলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। আবার নতুন করে কী বলতে চায় লোকটা। সেদিনের মতোই কি আবার কথার আঘাতে জর্জরিত করতে চাইছে ওকে। চাঁদনী ছোট্ট করে শ্বাস ছেড়ে বলল, “আচ্ছা, চলুন। আগে শুনে নেই আপনি কী বলতে চাইছেন।”
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছোট্ট রেস্টুরেন্টটিতে ঢুকতেই চাঁদনীর গায়ে এক পশলা শীতল হাওয়া এসে লাগল। নওয়াজ বেছে বেছে একেবারে কর্ণারের দিকের একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। চাঁদনীও অনুসরণ করল ওকে। নওয়াজ টেবিলের কাছে গিয়ে বলল, “তুমি এদিকে মুখ করে বসো, ওদিকটায় লোকজন আছে ভালোই। তোমার আনইজি লাগতে পারে।”
চাঁদনী নওয়াজের কথামতই বসল। নওয়াজ মেন্যু কার্ড এগিয়ে দিয়ে বলল, “লাঞ্চ টাইম তো হয়ে এলো অলমোস্ট। কী খাবে বলো।”
“আমি এখন কিছুই খাব না। আপনি প্লিজ আপনার প্রয়োজনীয় কথাগুলো বলুন।”
“বলব তো। কিন্তু একেবারে না খেয়ে তো বসা যাবে না এখানে। হালকা কিছু হলেও নাও।”
“আমি আসলে এরকম পাবলিক প্লেসে খেতে অভ্যস্ত নই। ”
“আমি বুঝতে পারছি। সেজন্যই তো এদিকটায় বসলাম। এখন আর তাকালেও কেউ তোমার খাওয়া দেখতে পারবে না। তাই এখন মনেহয় আর হেজিটেড করার কোনো কারণ নেই।”
চাঁদনী বুঝল, এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কিছু না কিছু খেতেই হবে। অগত্যা বাধ্য হয়েই বলল “ঠিকাছে, আপনি আপনার পছন্দমতো অর্ডার করুন। তবে ভারী কিছু খাব না আমি এখন।”
“ওকে।” ছোট্ট করে জবাব দিয়ে নওয়াজ ওয়েটারকে ডাক দিয়ে অর্ডার দিল।
চাঁদনীর মনের মধ্যে উথালপাথাল চলছে। সেদিনের বলা প্রত্যেকটা শব্দ মনে গেথে আছে এখনও। চাঁদনী মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, আজ আর সেদিনের মতো চুপ করে থাকবে না। নওয়াজই কথা বলা শুরু করল।
“আমি আসলে সেদিনের জন্য তোমার কাছে অ্যাপোলজি চাইতেই এখানে ডেকেছি।”
চাঁদনী অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “আশ্চর্য! হঠাৎ আপনি আমার কাছে ক্ষমা কেন চাইবেন?”
“সেদিন ওভাবে কথা বলা আমার একদমই ঠিক হয়নি। তোমাকে নিজের অজান্তেই হার্ট করে ফেলেছি সম্ভবত। আমি আসলে কথাগুলো সেদিন ওভাবে বলতে চাইনি।”
“ঠিকাছে, আপনার যেভাবে বলতে ইচ্ছে হয়েছে সেভাবেই আপনি বলেছেন। সেজন্য তো আমি আপনাকে কিছু বলিনি। তাই আমাকে এভাবে কৈফিয়ত দিতে হবে না।”
“তবুও। সেদিন তোমাকে ওভাবে বলাটা আমার উচিৎ হয়নি। ভালোলাগাটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেটা নিয়ে প্রশ্ন করে শুধু শুধু তোমাকে বিব্রত করলাম।”
“আমি বুঝতে পারছি না, আপনি বারবার ভালোলাগার ব্যাপারটাকে কেন হাইলাইট করছেন? আমি কি আপনাকে একবারও বলেছি যে আমার আপনাকে ভালোলাগে?”
হঠাৎ চাঁদনীর এমন রিয়্যাক্ট করায় নওয়াজ আবারও থমকাল কিছুটা।
“না, বলনি। কিন্তু সেই প্রথমদিন…।”
নওয়াজের মুখের কথা কেড়ে নিল চাঁদনী।
“সেই প্রথমদিন কী? আমি আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষন, তাই আপনি ধরে নিলেন যে আমি আপনাকে খুব পছন্দ করে ফেলেছি? দেখুন, প্রথম দেখায় হঠাৎ করেই একটা সুন্দর মুখের প্রতি অ্যাট্রাক্টেড হওয়া খুব কমন একটা বিষয়। এরকম আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বহুবার হয়। যেমন ধরুন, একটা সিনেমা কিংবা নাটক দেখতে গিয়ে হঠাৎ করে নায়ককে ভালো লেগে যেতেই পারে। তারমানে তো এটা নয় যে সেই নায়ককে আমি বিয়ে করতে চাই। অথচ আপনি সেদিন ব্যাপারটাকে বিয়ে অব্দি টেনে নিয়ে গিয়েছেন। এই নরমাল ইস্যুটাকে নিয়ে এরটা সিরিয়াস হওয়ার কোনো কারণই দেখছি না আমি। আপনার প্রতি প্রথম দেখায় আমার মনে যেটা তৈরি হয়েছিল সেটা জাস্ট একটা ইনফ্যাচুয়েশন ছিল, যেটা সময়ের সাথে সাথে কেটে গেছে অনেক আগেই। এখনও কেন আপনি এই বিষয়টা নিয়ে পড়ে আছেন সেটাই বুঝতে পারছি না।”
নওয়াজ চুপচাপ শুনছিল চাঁদনীর কথা। চাঁদনী থেমে যাওয়ার পরে ও বলা শুরু করল, “তুমি আমাকে ভুল বুঝছ। আমি মোটেও নেগেটিভভাবে কথাগুলো তোমাকে বলতে চাইনি। আমি চাইছিলাম তুমি যাতে পুরো ব্যাপারটা ইজিলি নাও। আমার সাথে কথা বলতে গেলে তুমি সবসময় নিজেকে কেমন একটা গুটিয়ে রাখো, তাই আমি চেয়েছিলাম ফ্রী ভাবে…”
আবারও মাঝপথে নওয়াজকে থামিয়ে দিল চাঁদনী।
“আপনি আবারও ভুল করছেন। আপনার সাথে ফ্রী ভাবে কথা না বলতে পারার সাথে আপনাকে পছন্দ বা অপছন্দ করার কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু আমার ভাইয়েরা ছাড়া বাইরের আর কোনো ছেলের সাথেই কথা বলতে আমি কম্ফোর্টেবল ফিল করি না। আমি ছোট থেকে এভাবেই বড় হয়েছি। এমনকি স্কুল কলেজেও খুব একটা প্রয়োজন ব্যাতীত আমি কোনো ছেলের সাথে কথা পর্যন্ত বলিনি কখনও। আপনাকে আজ একটা ব্যাপার ক্লিয়ার করে দেই। আমার দিক থেকে আপনার প্রতি কোনোরকম অনুভূতিই নেই। তাই প্লিজ এই টপিকটা আজ এখানেই শেষ করলে ভালো হয়।”
“ওকে। সব তো তাহলে ক্লিয়ার করলেই তুমি। তবু আমার কোনো কথায় যদি তুমি হার্ট হয়ে থাক, তাহলে আমি সত্যিই স্যরি।”
চাঁদনী নওয়াজের কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল, “এবার আমাদের বাড়ি যাওয়া উচিৎ। দুপুর হয়ে এসেছে প্রায়। যোহরের ওয়াক্ত শুরু হয়ে গেছে। আপনি যে খাবারটা অর্ডার করেছেন, সেটা বরং ওদের বলে পার্সেল নিয়ে নিন।”
গাড়িতে উঠে আর তেমন কোনো কথাই হলো না ওদের মধ্যে।
আজকে চাঁদনীর সহজ স্বীকারোক্তিতে স্পষ্টই বোঝা গেল যে নওয়াজের প্রতি ওর স্পেশাল কোনো ফিলিংস নেই। এতে নওয়াজের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু কেন জানি চিনচিনে একটা মনখারাপের রেশ রয়ে গেল ওর মধ্যে। বারবার নিজেকে নিজে প্রশ্ন করেও এর যথাযথ কারণ খুঁজে পেল না নওয়াজ।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
নিভৃত রজনী
|১২| (১৫০০+ শব্দ)
আজকে চাঁদনীর সহজ স্বীকারোক্তিতে স্পষ্টই বোঝা গেল যে নওয়াজের প্রতি ওর স্পেশাল কোনো ফিলিংস নেই। এতে নওয়াজের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু কেন জানি চিনচিনে একটা মনখারাপের রেশ রয়ে গেল ওর মধ্যে। বারবার নিজেকে নিজে প্রশ্ন করেও এর যথাযথ কারণ খুঁজে পেল না নওয়াজ।
২১.
রাতের ঘুমটা চমৎকার হয়েছে নম্রতার। মধ্যরাত থেকেই অবিরাম বৃষ্টি হওয়ায় গাঢ় একটা ঘুম হয়েছে। আজ ভার্সিটি যাওয়ারও তাড়া নেই। তাই বেশ বেলা করেই ঘুম থেকে উঠল ও। এখনও বৃষ্টি হচ্ছে।
নম্রতা ফ্রেশ হয়ে একমগ কফি নিয়ে ব্যালকনিতে বসল বৃষ্টি দেখার জন্য। কফিমগে কয়েকটা চুমুক দেওয়ার পরেই চোখ গেল রাস্তার দিকে। সাদা রঙের গাড়িটি এসে থামল ওদের বাসার ঠিক গেটের সামনে। গাড়ি থেকে যে অবয়বটি নামল তাকে দেখেই চমকে গেল নম্রতা। প্রথমবার সেই যে দেখা হলো, তারপর কতগুলো দিন গেল? প্রায় তিনমাস তো হবেই। হ্যাঁ, প্রায় তিনমাস পরে দ্বিতীয়বার দেখল এই লোকটাকে।
নম্রতা পাশের টি টেবিলের উপর কফিমগটা রেখে চট করে উঠে দাড়াল। পাঞ্চক্লিপ দিয়ে চুল আটকে দৌড়ে এলো রুমের মধ্যে। বিছানা থেকে ওড়নাটা কোনোরকমে গায়ে টেনে নিয়ে দৌড় লাগাল নিচতলার দিকে। পুরোনো অপমানগুলো আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ওর। নিচে নেমে জলদি গিয়ে মেইন দরজাটা খুলল ও। এতগুলো দিন যেই সময়টার জন্য ও অপেক্ষা করে ছিল ফাইনালি সেই সময়টা এসেই গেল।
বন্ধ দরজা খুলে দেওয়ার সাথে সাথেই মুখোমুখি হলো দুজন। নম্রতা কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে যাওয়া চেকশার্টে উপর দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠা ওই পেটানো শরীর আর গভীর কালো দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে সহসাই থেমে যেতে হলো ওকে। এতগুলো দিন যাবত যেই কথাগুলো বলার জন্য জমিয়ে রেখেছিল তার একটা বাক্যও মনে পড়ল না ওর হঠাৎ করে। অনেকক্ষন যাবত আমতা আমতা করে একটা স্পষ্ট শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারল না নম্রতা। মস্তিষ্কটাও একেবারে ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সবকিছু কেমন একটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে যেন। সব ভুলে গিয়ে ফ্যালফ্যাল করে ওই কঠিন মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকল নম্রতা।
সারারাত ড্রাইভ করে তানিমের প্রচন্ড রকমের ক্লান্ত লাগছিল। তারউপর আবার গেট থেকে বাড়ির মেইন দরজা পর্যন্ত আসতে আসতে পুরোপুরিই ভিজে গেছে বৃষ্টিতে। তাড়াহুড়ো করেই তাই কলিং বেল চাপতে যাচ্ছিল ও। কিন্তু তার আগেই হুট করে খুলে গেল দরজাটা। দরজার ওপাশে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে একদমই আশা করেনি তানিম।
সারাপথ মনে মনে ও প্রার্থনা করেছে যেন ওই বদমেজাজী মেয়েটার মুখোমুখি ওকে না হতে হয়। অথচ সবার আগে কিনা ওই মেয়েটার সাথেই ওর দেখা হয়ে গেল। তানিম একপলক নম্রতার দিকে তাকিয়েই আবার নিচের দিকে তাকাল। অদ্ভুত তো, মেয়েটা সরছে না কেন। আর এরকমভাবে তাকিয়েই বা আছে কেন? নিশ্চয় আবার কোনো ঝগড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তানিম নিচের দিকে তাকিয়েই নম্রতার পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু অনেকক্ষন কেটে যাওয়ার পরেও কোনো রেসপন্স না পেয়ে প্রশ্ন করল, “কিছু বলবেন?”
নম্রতা কোনো জবাব না দিয়ে মোহগ্রস্ত হয়ে তাকিয়েই থাকল। তানিম আগের চেয়েও কিছুটা উচ্চস্বরে প্রশ্ন করল, “এক্সকিউজ মি, কিছু কি বলবেন আপনি?”
নম্রতা ঘোরের মধ্যেই অস্ফুট শব্দ করল, “হ্যাঁ?”
তানিম ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে তৃতীয়বারের মতো একই প্রশ্ন করল, “কিছু বলবেন আপনি?”
নম্রতার হুশে এলো এবার,”হ্যাঁ, বলব।”
“বলুন তাহলে।”
“হ্যাঁ মানে না, কিছু বলব না।”
তানিম কিছুটা বিরক্তবোধ করল এবার।
“কিছু না বললে পথটা ছাডুন। আমি ভেতরে যাব।”
নম্রতা চট করেই সরে গেল। তানিম ওকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে এসে ঢুকল।
মরিয়ম খাতুন লিভিং রুমে ঢুকে তানিমকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন।
“অবশেষে তুমি এলে। কেমন আছো বাবা। তোমার বাসার সবাই কেমন আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছে। আপনি কেমন আছেন আন্টি?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। তুমি তো দেখি একদম ভিজে গিয়েছ। গেস্ট রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও জলদি, ঠান্ডা লেগে যাবে নইলে। আমি তোমার জন্য শুকনো জামাকাপরের ব্যবস্থা করছি।”
“আপনি ব্যস্ত হবেন না প্লিজ। আমার সাথেই শুকনো কাপর আছে। আপনার জন্য বাড়ি থেকে সামান্য কিছু জিনিস পাঠিয়েছে। সেগুলো একটু গাড়ি থেকে আনার ব্যবস্থা করলে ভালো হতো।”
“আমি এক্ষুনি লোক পাঠাচ্ছি। কিন্তু এসবের কী দরকার ছিল আবার। প্রত্যেকবারই তোমরা কিছু না কিছু নিয়ে আসো।”
“তেমন কিছুই না আন্টি। বাড়ি থেকে সামান্য কিছু জিনিস পাঠিয়েছে আপনার জন্য। আর আমার বাগানের কিছু ফ্রেশ আম। আপনারা খেলে আমার ভালো লাগবে।”
“আচ্ছা, আমরা সবাই খাব। তুমি এখন গিয়ে চেঞ্জ করে নাও আগে৷ এভাবে ভেজা থাকলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। চাঁদনীও কোচিং থেকে চলে আসবে একটু পরেই। তোমাকে দেখলে খুব খুশি হবে।”
মরিয়ম খাতুনের কথার প্রত্যুত্তরে তানিম হালকা হাসল।
নম্রতা এতক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তানিমের সাথে মায়ের কথোপকথন শুনছিল। আর চোরাচোখে বারবার ওকে দেখছিল। তানিমের হাসিটা যেন একেবারে ওর হৃদয়ের গভীরে গিয়ে স্পর্শ করল। নম্রতা আর দোতলায় নিজের রুমে গেল না। এই সেই বাহানায় নিচেই থেকে গেল। তানিম ফ্রেশ হয়ে বের হতে হতেই চাঁদনী বাসায় ফিরে এলো। আজও নওয়াজ ওকে আনতে গিয়েছিল। বাসায় ঢুকে তানিমকে লিভিং রুমের সোফায় বসে থাকতে দেখে কিছুক্ষন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল৷ তারপর “ভাইয়া!” বলে জোরে চিৎকার করে উঠল।
চাঁদনীর চিৎকার শুনে নম্রতা আর নওয়াজ অবক হয়ে তাকাল চাঁদনীর দিকে। সবসময় নিচুস্বরে কথা বলা মেয়েটা যে এত জোরে চিৎকার করতে পারে সেটা ওরা কল্পনাও করতে পারেনি। চাঁদনী অবশ্য কারও তোয়াক্কাও করল না। এগিয়ে গিয়ে তানিমের পাশে বসে বলল, “ভাইয়া, তুমি! কখন এলে? আসবে সেটা আমাকে আগে কেন বললে না?”
“সারপ্রাইজ দিলাম। আগেই বলে দিলে তো তোর এই হাসিমুখটা দেখতে পারতাম না।”
চাঁদনীকে এতটুকু বলে তানিম নিজেই আগে সালাম দিল নওয়াজকে। নওয়াজ সালামের জবাব দিয়ে টুকটাক সৌজন্যমূলক কথাবার্তা বলতে বলতে সোফার এককোনে এসে বসল।
চাঁদনী উচ্ছ্বসিত হয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে তানিমকে। তানিমও সেসবের জবাব দিয়ে যাচ্ছে একের পর এক।
নওয়াজ চাঁদনীর এই নতুন রূপের সাথে একেবারেই অপরিচিত ছিল। ও শুধুই অবাক হয়ে দেখে যাচ্ছিল চাঁদনীকে।
তালুকদার বাড়ির সবগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে তানিমই সবচেয়ে তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন। চারপাশের খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলোও খুব সহজে ওর চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না। চাঁদনীর প্রতি নওয়াজের বিশেষ দৃষ্টিও ঠিক ওর চোখে পড়ে গেল। সেই দৃষ্টিতে মুগ্ধটা স্পষ্ট। নওয়াজ নিজে ওর অনুভূতি সম্পর্কে বেখবর থাকলেও তানিমের চোখে সবটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। আরও একটা ব্যাপার ও এড়িয়ে যেতে পারল না। এই বাসার ম্যানারলেস মেয়েটা আজ একটু পরপরই ওর দিকে তাকাচ্ছে। যেটা ওর অস্বস্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে আরও।
মরিয়ম খাতুন কিছুক্ষন পরেই এলেন নাস্তা নিয়ে। নম্রতা লিভিংয়ের সাথের লাগোয়া ব্যালকনিতে বসে ছিল। তানিমকে নাস্তা দিয়ে একটা পাকা আম আর নাইফ নিয়ে নম্রতার দিকে এগিয়ে দিল। নম্রতা বলল, “আম এনেছ কেন?”
“খাওয়ার জন্য এনেছি। বেশ মিষ্টি, খেয়ে নে একটা।”
“আমি খাব না।”
“সেকি। তুই তো পাকা আমের পোকা। আম দেখলেই হামলে পড়িস। এখন খাবি না কেন?”
“ইচ্ছে নেই তাই খাব না। এই আম আর কখনও আমার সামনে আনবে না।” শেষের কথাটুকু একটু চেঁচিয়েই বলল ও।
মরিয়ম খাতুন বিরক্ত স্বরে বললেন, “খাবি না বুঝলাম, কিন্তু সেটা এত চেঁচিয়ে বলার কি আছে?”
ব্যলকনির পুরো কথোপকথনই তানিমের কানে এসেছে স্পষ্টভাবে। ওর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আবার। মেয়েটির তার সবচেয়ে পছন্দের ফলটি না খাওয়ার কারণ আর কেউ না বুঝলেও তানিম খুব ভালোভাবেই বুঝেছে।
২২.
গাড়ি থামিয়ে লুকিং গ্লাসে শেষবারের মতো তাকিয়ে চুলটা হাতের আঙুল দিয়ে ঠিক করে নিল আকরাম। পাশের সিটে রাখা পারফিউমটা আরেকবার স্প্রে করে নিল গায়ে। তারপর নামল গাড়ি থেকে।
আজ অনেকটা সময় হাতে নিয়েই ও এসেছে নওয়াজদের বাসায়। সেদিন চাঁদনী নামের মেয়েটাকে দেখার পর থেকেই ওর রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। সেই প্রথমদিনের পর থেকে অনেকবারই চেষ্টা করেছে চাঁদনীর সাথে একটু কথা বলার। কিন্তু সেই চান্সটাই পায়নি একবারও।
মেয়েটা বাসা থেকে কোচিং ছাড়া আর তেমন কোথাও যায় না। সেই কোচিং-এ যাওয়া আসার সময়েও ওকে ফ্রী পাওয়া যায় না। নওয়াজদের বাড়ির ড্রাইভার কিংবা নওয়াজ সাথেই থাকে। আকরাম বেশ কয়েকদিন চাঁদনীর কোচিং-এর বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেছে ওর সাথে একটু কথা বলার জন্য। একদিন একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়েও গিয়েছিল প্রায় কাছাকাছি। এরমধ্যেই হুট করে একটা ছেলে আসলো চাঁদনীর কাছে। কিছুটা আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের কথোপকথন শুনে বুঝেছে যে ওটা চাঁদনীর ভাই ছিল।
আকরামের দৃঢ় বিশ্বাস, ও ঠিক চাঁদনীকে নিজের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়াতে পারবে। কিন্তু তারজন্য মেয়েটার সাথে আগে কথা বলতে হবে। জোর জবরদস্তি আকরামের কখনোই পছন্দ ছিল না। চাঁদনীর ব্যাপারটা তাই খুব সফটলি হ্যান্ডেল করতে হবে৷ সেজন্যই আজ এই বাড়িতে আসা।
আকরাম বাসার সামনে এসে কলিংবেল চাপল। দরজা খুলে দিল টুলুর মা। আজকে আকরাম সমস্ত প্লান করেই এসেছে। তাই আজ আর এসেই নওয়াজের খোঁজ করল না ও। তার বদলে লিভিংয়ের সাথে ব্যালকনিতে বসা মরিয়ম খাতুনের দিকে এগিয়ে গেল।
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। নওয়াজের কাছে এসেছ তো? যাও, ও উপরেই আছে।”
“না, আজ নওয়াজের কাছে আসিনি। আজ আপনার কাছে এসেছি।”
“আমার কাছে?” কিছুটা অবাক হলেন মরিয়ম খাতুন।
“হ্যাঁ। আজ আপনার হাতের রান্না খেতে এসেছি। আব্বু আর আম্মু কয়েকদিন আগে দেশের বাইরে গেছে। বাসার কাজের লোকের রান্না আর খেতে পারছি না। তাই চলে এলাম। আপনার হাতের মজার মজার রান্না খেতে। দুপুরে এখানেই খাব আজ।”
“খুব ভালো করেছ। শুধু দুপুরে কেন? রাতেও থেকে যেও আজ।”
“তাহলে তো আরও ভালো। থ্যাংকস আন্টি।”
মরিয়ম খাতুন হেসে বললেন, “এখন তাহলে উপরে যাও। নওয়াজ ওর রুমেই আছে।”
“ওকে আন্টি।” কথা শেষ করে আকরাম চলে গেল।
দীর্ঘ সময় নওয়াজের সাথে আড্ডা দিয়ে নিচে নামল দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। খাওয়ার চেয়ে অবশ্য চাঁদনীকে দেখা এবং একটু কথা বলার আগ্রহটাই বেশি ছিল। কিন্তু নিচে নেমে খাবার রুমের কোথাও চাঁদনীকে পেল না ও। তাহলে কি মেয়েটা এদের সাথে একত্রে বসে খায় না? আকরামের রাগ লাগল খুব। এত চেষ্টা করেও কি শেষপর্যন্ত দেখা হবে না চাঁদনীর সাথে? খাবার খেতে খেতে অন্যমনস্ক হয়ে গেল ও। হঠাৎ সংবিৎ ফিরল নওয়াজের মুখে বিশেষ একটি নাম শুনে।
“চাঁদনী কোথায় মা? আজ খেতে এলো না কেন?”
মরিয়ম খাতুন উত্তর দিলেন, “চাঁদনীর শরীরটা একটু খারাপ করেছে আজ। নিচে নামতে পারবে না। একটু আগে ওর খাবার উপরে পাঠিয়ে দিয়েছি তাই।”
আকরামের খুব জেদি প্রকৃতির ছেলে। সবসময় যেটা চায় সেটা আদায় করেই ছাড়ে। বিশেষ করে মেয়েঘটিত ব্যাপারে ও ঝানু। মেয়েদের নিজের কন্ট্রোলে আনার জন্য সবসময় নিখুঁত প্লান করে আকরাম এবং প্রত্যেকবারই সেই প্লানে সাকসেসফুলও হয়। কিন্তু এই প্রথমবার ওর কোনো প্লানই কাজে আসছে না।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)