নিভৃত রজনী
| ৮ | (১২৩০+ শব্দ)
ক্লাসরুমের ভিতরে বসে বাইরের আবহাওয়া একদমই বোঝা যায়নি এতক্ষন। আজ সকালে যখন বাসা থেকে বের হয়েছিল, তখন জুলাই মাসের চমৎকার রৌদ্রজ্জ্বল একটি সকাল ছিল।
অথচ এখন বিরামহীন বৃষ্টি। পাশের মেয়েটির সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতেই নিচে নামছিল চাঁদনী। নিচে নেমে গেটের দিকে তাকাতেই ভীষণভাবে চমকাল ও। নওয়াজ দাঁড়িয়ে আছে ওর দিকে তাকিয়ে। চাঁদনীর পা দুটো থেমে গেল অজান্তেই। নওয়াজ এগিয়ে এলো এবার।
“যাক, বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হলো না।”
চাঁদনীর পা দুটোও আবার শ্লথগতিতে চলতে শুরু করেছে।
“আপনি হঠাৎ? আজ ড্রাইভার চাচা আসেনি?”
“কেন? আমি আসায় কি খুব অসুবিধা হয়ে গেল?”
“আমি তো সেটা বলিনি। ”
গাড়িতে পর্যন্ত হাঁটতে গিয়ে দুজনেই আরও খানিকটা ভিজে গেল। চাঁদনীর ইচ্ছে ছিল পিছনে বসার। কিন্তু নওয়াজ আগেই এগিয়ে গিয়ে সামনের দরজাটা খুলে চাঁদনীকে উঠতে ইশারা করল। অগত্যা ড্রাইভিং সিটের পাশেই গিয়ে বসতে হলো ওকে। নওয়াজ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, “ড্রাইভার চাচাই গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলেন। কিছুদূর এগিয়েই এক্সিডেন্ট করেছেন। তাই আমাকেই আসতে হলো।”
“সেকি! এখন কী অবস্থা তার?”
“একটা পায়ে খুব বাজেভাবে ফ্রাকচার হয়েছে। আর তেমন কিছু না।”
“ও।”
“সেই সকালে বের হয়েছো বাসা থেকে। ক্ষিদে পেয়েছে নিশ্চই। খাবে কিছু?”
“তেমন ক্ষিদে পায়নি।”
“ওকে।”
কিছুক্ষন চুপচাপ দুজনে। তারপরেই নওয়াজ প্রশ্নটা করল আচমকা, “তুমি আমাকে পছন্দ করো?”
চাঁদনী যেন প্রথমে বুঝতেই পারল না প্রশ্নটা। ও সরাসরি তাকাল নওয়াজের দিকে। অভ্যস্ত হাতে স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাচ্ছে নওয়াজ, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সামনের রাস্তার দিকে। নীরবতা ভেঙে নওয়াজই আবার কথা বলল, “প্রশ্নের উত্তর দিতে কি ভয় পাচ্ছ?”
নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁপা স্বরে জবাব দিল চাঁদনী, “না, ভয় পাব কেন? হঠাৎ আপনি এরকম অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নই বা কেন করছেন?”
“আমার মনে হলো তাই।”
“এটা আপনার একটা ভুল ধারনা।”
“তুমি খুব ভালো করেই জানো, এটা ভুল ধারনা নয়। প্রথমদিনই তোমার চোখদুটো আমাকে বলে দিয়েছিল সব। তারপর যতবারই তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছে প্রত্যেকবারই তুমি এড়িয়ে যেতে চেয়েছ আমাকে। যতক্ষন পর্যন্ত আমি তোমার চোখের আড়ালে থাকি ততক্ষন পর্যন্ত তুমি একেবারেই স্বাভাবিক, অথচ আমি সামনে গেলেই তোমার অস্থিরতা বেড়ে যায়। এসবই আরও বেশি করে প্রমাণ করে দেয় যে আমার ধারনা মোটেও ভুল নয়।”
এরকম স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়ার পরে আর কিছু বলার অবকাশই রইল না চাঁদনীর। ও শুধু নিচের দিকে তাকিয়ে থাকল। অনুভূতিগুলো লুকানোর এত চেষ্টা করার পরেও শেষপর্যন্ত ধরা পড়ে যেতেই হলো।
কিছুক্ষন থেমে থাকার পরেও চাঁদনীর থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে নওয়াজই আবার বলতে শুরু করল, “তুমি কি খুব আনইজি ফিল করছো? বি ইজি। অপজিট অ্যাট্রাকশন, এটা খুব কমন একটা ব্যাপার আজকাল।”
চাঁদনীর নিচু মাথা আরও নিচু হয়ে গেল সংকোচে। হয়তো নওয়াজ কিংবা ওর মতো শহুরে ছেলেমেয়েদের জন্য এসব খুবই কমন কিন্তু চাঁদনীর জন্য এভাবে নিজের লুকোনো অনুভূতি প্রকাশ হয়ে যাওয়া ভীষণ রকমের লজ্জার। নওয়াজ বলে গেল, “একি, তোমার তো দেখি কথাই বন্ধ হয়ে গেছে। আমি কিন্তু আজ প্রশ্নটা করেছিলাম একটা ব্যাপার ক্লিয়ার করার জন্য।”
“কী ব্যাপার?” নওয়াজের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল চাঁদনী।
“এই যে আমাকে দেখলেই তোমার আড়ষ্ট হয়ে থাকা। আমার মনেহয়, তোমার এগুলো থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করা উচিৎ এবার।”
“আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।”
“ওকে। মন দিয়ে আমার কথাগুলো শুনতে থাকো। আশা করি বুঝতে পারবে। আমার মনে হয় আমাকে দেখলেই এভাবে নিজেকে গুটিয়ে না নিয়ে আমার সাথে নরমালি বিহেভ করা উচিৎ তোমার। নইলে দিন দিন তোমার এই ইমোশনগুলো বাড়তেই থাকবে। কিন্তু একবার যদি আমার সাথে সহজ হয়ে যেতে পারো, তাহলে দেখবে সময়ের সাথে সাথে তোমার ইনফ্যাচুয়েশনও কেটে যাবে।”
নওয়াজের কথাগুলো বলার ধরন খুব একটা ভালো লাগল না চাঁদনীর। চাঁদনী ফের প্রশ্ন করল, “আমার বিষয়গুলো নাহয় আমিই বুঝে নেব। আপনি হঠাৎ এসব নিয়ে কেন ভাবছেন?”
“ভাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে৷ আমার প্রতি তোমার অ্যাট্রাকশন আরও বেড়ে গেলে সেটা তোমার এবং আমার দুজনের জন্যই প্রব্লেম ক্রিয়েট করতে পারে। অন্য কেউ যদি ব্যাপারটা ধরে ফেলে, তাহলে তো আরও অকওয়ার্ড লাগবে। যেটা কখনও হওয়া পসিবল না সেরকম একটা ব্যাপার নিয়ে হেজিটেশনে ভুগতে হবে আমাকে অযথাই। এসব নিয়ে ভাবার আরেকটা মেজর কারণ হচ্ছে আমার মা। গত পরশুই সে তোমাকে নিয়ে তার নিজের একান্তই একটি ইচ্ছের কথা জানিয়েছেন আমাকে। তিনি চান, আমার সাথে তোমার বিয়ে দিতে। তিনি যদি কোনোভাবে জানতে পারেন আমার প্রতি তোমার দুর্বলতা রয়েছে তাহলে সিওর জোর করেই তোমাকে আমার মাথায় চাপিয়ে দেবে। ইউ নো, মায়ের ইমোশোনাল ব্লাকমেইলে পড়ে অনেকবার আমাকে সাফার করতে হয়েছে। নতুন করে কোনো পেইন আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। অ্যান্ড রিয়েলি আই মিন ইট। আই কান্ট টেইক ইট এনিমোর। এজন্যই তোমাকে আগে, অ্যালার্ট করে দিলাম।”
চাঁদনী মন দিয়েই শুনেছে কথাগুলো। প্রব্লেম ক্রিয়েট হওয়া, হেজিটেশনে ভোগা, অকওয়ার্ড ফিল, মাথায় চাপিয়ে দেওয়া, ইমোশনাল ব্লাকমেইল, সাফার করা, এসব বিক্ষিপ্ত কিছু শব্দ ওর কানে বাজতে লাগল অনবরত। নওয়াজের সব কথার মর্মার্থ উদ্ধারের পর চাঁদনীর মনে হলো, কেউ যেন খুব জোরে ওর গালে চপেটাঘাত করেছে। জানালার দিকে মাথা ঘুড়িয়ে দুফোটা অশ্রু বিসর্জন দিল ও।
না, নওয়াজ ওকে নিজের উপযুক্ত মনে করছে না বলে একদমই আক্ষেপ নেই ওর। কিন্তু এই যে হেয় করে কথা বলা, এগুলোই ওর আত্মসম্মানে আঘাত করল ভীষণভাবে। চাঁদনীকে বিয়ে করা মানে ওর মাথায় বোঝা চাপিয়ে দেওয়া? চাঁদনীকে বিয়ে করলে ওকে সাফার করতে হবে? এসব কথা বলে যে চাঁদনীকে তুচ্ছ প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে সেটা কি জানে ছেলেটা!
আচ্ছা, এরা দুই ভাইবোনই কি একইরকম? অন্যকে আঘাত করে ছোট করে, কিংবা তুচ্ছ প্রমাণ করে এরা আসলে কী পায়? সেদিন নম্রতার রুমে জঘন্য অপমানের পরেও ঠিক এমনই লেগেছিল ওর। নিজের রুমে ফিরে হাউমাউ করে কেঁদেছিল সেদিন চাঁদনী। আচ্ছা, ওরা কি জানে যে ওদের বলা কথাগুলো চাঁদনীর হৃদয়কে ঠিক কতটা ক্ষতবিক্ষত করেছে। রাগ আর অপমানবোধে চাঁদনী আর একটা কথাও বলল না।
অথচ, নাকউঁচু, আত্ম-অহংকারী ছেলেটা বুঝতেও পারল না,পাশে বসা মেয়েটিকে ভদ্র ভাষায় চুড়ান্ত পর্যায়ের অপমান করছে ও।
১৫.
নওয়াজের ফাইনাল এক্সাম আর কয়েকদিন পরেই। এক্সামের আগে তাই শেষবারের মতো গ্রুপ স্টাডিতে বসেছে ওরা। দুপুরের পরপরই বসেছিল ওরা। বিকালের দিকে আকরাম হঠাৎ বলে উঠল, “অনেক হয়েছে। এখন আর লোড নিতে পারছি না। তোরা কন্টিনিউ কর। আমি বাইরে থেকে একটু মাইন্ড রিফ্রেশ করে আসছি।”
নওয়াজ, আবির, ফাহিম আর মিশকাত চারজনই তাকাল ওর দিকে। কারণ আকরামের এই মাইন্ড রিফ্রেশের ব্যাপারটা ওদের সবারই জানা। বাইরে গিয়ে কোনো না কোনো মেয়ের সাথে ভিডিও কলে কিছুক্ষন নোংরা কথাবার্তা বলবে, তারপর আবার এসে পড়তে বসবে।
ফাহিম আর মিশকাত এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না, তবে আবির চটে যায় খুব। আর নওয়াজ মুখে কিছু না বললেও মনে মনে প্রচন্ডরকম বিরক্ত হয়। শুধু ফ্লার্ট কিংবা প্রেম হলেও ঠিক ছিল। কিন্তু আকরামের টার্গেট হলো মেয়েদের বিছানা অব্দি নেওয়া, তারপর ইন্টারেস্ট কমে গেলে ছেড়ে দেওয়া।
আকরাম ওদের কারও মেজাজের তোয়াক্কা না করেই রুম থেকে বের হয়ে এলো। ছাদের দিকটা নিরিবিলি থাকে বলে সেদিকেই এগিয়ে গেল ও। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নারী অবয়বের পিছনের দিক দেখে আবার নেমে যেতে শুরু করল ও। কয়েক সিঁড়ি নেমেও ফের দাঁড়িয়ে পড়ল।
ছাদের মেয়েটাকে ও নম্রতা ভেবেছিল এতক্ষন। কিন্তু হঠাৎ করেই ওর মনে হলো এটা নম্রতা নয়। শারিরীক আকৃতি নম্রতার থেকেও কিছুটা ভারী। এমনকি ড্রেসাপও অন্যরকম। আকরাম আবারও ছাদে উঠল। নিঃশব্দে মেয়েটির আরও কাছে এগিয়ে গেল। কয়েক হাতের দুরত্বেই দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। মনোযোগ আকর্ষনের জন্য এবার ইচ্ছে করেই কাশি দিল আকরাম।
চাঁদনী প্রচন্ডভাবে চমকে উঠে পিছনে তাকাল। অপরিচিত একজনকে দেখে ঘাবড়েও গেল খুব। ছেলেটার পলকহীন তাকিয়ে থাকায় ঘাবড়ে যাওয়ার সাথে সাথে অস্বস্তিও লাগতে শুরু করল।
কে এই ছেলেটা? নওয়াজের বয়সী বলেই মনে হচ্ছে। তাহলে কি নওয়াজের বন্ধু? সে যেই হোক। ছেলেটার তাকানোর ধরন একেবারেই অন্যরকম। শুধু চেহারাতেই স্থির থাকছে না সেই দৃষ্টি। মাথা থেকে পা অব্দি, এমনকি সারা শরীরে বারবার ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে। সেই চাহনী খুব একটা শ্লীল মনে হলো না চাঁদনীর৷ আবার ছেলেটা এমনভাবে কর্ণারের দিকটায় এসে আটকে দাঁড়িয়েছে যে চাঁদনীর পাশ কাটিয়ে যাওয়ারও সুযোগ নেই। চাঁদনীর মন বলছে, এখান থেকে এখনই সরতে না পারলে একটা বিপদ ঘটার সম্ভাবনা আছে। নিরুপায় বোধ করল ও।
চাঁদনী প্রার্থনা করল মনে মনে, কেউ অন্তত আসুক। হঠাৎ করে ছাদের দরজায় কথা শোনা গেল, “একি চাঁদনী, তুমি এখানে কী করছ? আর আকরাম ভাই, আপনার তো ভাইয়ার রুমে থাকার কথা এখন। এখানে হঠাৎ?”
চাঁদনী হাফ ছেড়ে বাঁচল নম্রতা চলে আসায়। নম্রতার কথায় নিশ্চিত হলো, এটা নওয়াজেরই বন্ধু।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)