নিভৃতে তেজস্বিনী পর্ব-২৬+২৭

0
459

#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_২৬
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

কাঁদতে কাঁদতে ছোট্ট নাবিহাকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালের ভেতরে ঢোকেন মিসেস ইতি ইসলাম। এসেই প্রথমে ইভানকে জিজ্ঞেস করেন,

“আমার মেয়ে কেমন আছে ইভান? সত্যি করে বলো আমার মেয়েটা ঠিক আছে তো?”

ইভান নাবিহাকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,

“শান্তি হন আন্টি। সিরাতের কিচ্ছু হবে না। ও ঠিক হয়ে যাবে।”

“আর মাওয়া? মাওয়া ঠিক আছে তো? মেয়েটা সিরাতের জন্য নিজের জীবন বাজি রাখল। ওর কিছু হলে আমরা কখনো নিজেদের মাফ করতে পারব না। ওর বাবা-মাকে খবর দিয়েছ তোমরা?”

“মাওয়ার ট্রিটমেন্ট চলছে। ওর বাবা-মাকে খবর দেওয়া হয়েছে।”

ইতি ইসলাম একটা চেয়ারের উপর বসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সিরাতের বাবা মেয়ে আর তার বান্ধবীর এমন অবস্থার খবর শুনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মালিহা আর তুবা মামার কাছে রয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মাওয়ার বাবা-মা চলে আসে। ইতি ইসলামের পাশে বসে মাওয়ার মা মিসেস রেনু মন্ডল বলেন,

“আপা আমাদের মেয়েরা ঠিক হয়ে যাবে তো?”

ইতি ইসলাম কিছু বলতে পারেন না। নির্বাক দৃষ্টিতে কেবল তাকিয়ে রয় অসহায়ের মতো।

মাওয়ার বাবা অভির কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে,

“সব সময় বাহাদুরি দেখাতে যাও হ্যা? আজ তোমাদের জন্য আমার মেয়ের এই অবস্থা। পুলিশ ছিল না? সিরাতকে তো পুলিশ উদ্ধার করতে পারত। তোমরা কেন এসব করতে গেলে? তোমরা গিয়েছ ভালো কথা। আমার মেয়েকে নিয়ে গিয়েছ কেন? ওর যদি কিছু হয় তাহলে আমি তোমাদের কাউকে ছেড়ে দিব না বলে দিলাম।”

পাশ থেকে তারিন বলে,

“আংকেল আপনি একটু শান্ত হন প্লিজ। এখন রাগারাগির সময় নয়। আমরা সবাই বিধ্বস্ত অবস্থায় আছি। আমি বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমরা সবাই ওদের দু’জনকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। সিরাতের পরিবারের দিকে একবার তাকান। ওর ছোট্ট মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখুন, মা’কে ছাড়া মেয়েটার কী অবস্থা!”

নাবিহার নিষ্পাপ চাহুনি দেখে মাওয়ার বাবা মিস্টার আরাফাত শিকদার কিছুটা দমে গেলেও রাগ তার কমে না। চেয়ারে বসে মেয়ের চিন্তায় ভাজ পড়ে তার কপালে।

মিনিট বিশেক পর ডাক্তার বের হলে নাবিল দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“ডাক্তার সিরাত আর মাওয়া এখন ঠিক আছে তো?”

“মাওয়ার শরীর থেকে অনেক র*ক্ত ঝরেছে। তবে ওকে র*ক্ত দেওয়া হয়েছে। বিপদ কেটে গিয়েছে। আশা করছি আজকের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে।”

“আর সিরাত?”

“ওর অবস্থা অনেকটাই খারাপ। ডান হাতে অনেক বেশি ব্যথা পেয়েছে। তাছাড়া পুরো শরীরেই অসংখ্য আঘাতের দাগ রয়েছে। ওর সেড়ে উঠতে সময় লাগবে।”

কথাটা শুনে ইতি ইসলাম শব্দ করে কেঁদে ওঠে। তাকে সামলানোর জন্য রেনু মন্ডল বলেন,

“আপা কাঁদবেন না। আমাদের সিরাত ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের সবার দোয়া ওর সাথে আছে। আমার মেয়েটা যখন বেঁচে আছে তখন সিরাতেরও বাঁচতেই হবে। ওদের কিছু হতে পারে না। মায়ের বুক খালি করে ওরা কোত্থাও যেতে পারে না।”

“তাই যেন হয়। বিয়ের পর থেকে আমার চঞ্চল, প্রাণবন্ত, হাসিখুশি মেয়েটা কেমন শান্ত হয়ে গেল। আগে যদি জানতাম ওই অমানুষ ছেলেটা আমার মেয়েকে এত অত্যাচার করে তাহলে কবেই ওই ন*রক থেকে ওকে নিয়ে আসতাম আমরা।”

“যা হওয়ার তা তো হয়ে গিয়েছে। এখন আল্লাহর কাছে ওদের সুস্থতা কামনা করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারব না আমরা।”

এক দুর্বিষহ ভোর কাটিয়ে যখন সকালের সূর্যোদয় হয় তখনই যেন সকলের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য জ্ঞান ফিরে আসে মাওয়ার। প্রথমে মাওয়ার বাবা-মা দেখা করে করে আসে। তারপর সিরাতের মা মাওয়ার কাছে গিয়ে বলেন,

“আমার মেয়ের বন্ধুদের আমি সব সময় নিজের ছেলেমেয়েদের মতো করে দেখেছি। কিন্তু তুমি আজ যা করলে মা সেই ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না।”

পেটের ব্যথায় বারংবার আর্তনাদ করে ওঠা সত্ত্বেও মাওয়া বলে,

“এভাবে বলবেন না আন্টি। ছোট থেকে আমাদের সবার বিপদে সিরাত সবার আগে এগিয়ে এসেছে। সেই মেয়েটাকে নিজের চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে কীভাবে দেখি বলুন তো? সিরাত যে আমাদের বন্ধুমহলের প্রাণ। আচ্ছা ও ঠিক আছে তো?”

“এখনো মেয়েটার জ্ঞান ফেরেনি।”

“সে কি! বিপদ কাটেনি?”

দরজা ঠেলে অভি ভেতরে এসে বলে,

“বিপদ কেটে গিয়েছে। তবে অনেক আঘাত করা হয়েছে তো। তাই জ্ঞান ফিরতে সময় লাগছে। তুই চিন্তা করিস না।”

মাওয়া মন খারাপ করে বলে,

“ওর সাথে যারা এমন করেছে তাদের শাস্তি পেতে হবে। এই অভি, মাহতাব আর তুরাগকে হাসপাতালে আনা হয়েছে?”

“হুম ইভান নিজ দায়িত্বে ওদের হাসপাতালে ভর্তি করেছে।”

“বেঁচে আছে তো?”

“কই মাছের প্রাণ ওদের। বাঁচবে না আবার?”

অথৈ এর কথায় মাওয়া হালকা হেসে বলে,

“কোথায় আছে এখন ওরা? ওদের সাবধানে রাখবি যেন পালাতে না পারে।”

“নাবিল আর ফারহান ওদের সাথে আছে। সব ঘটনা শুনে ফারহান ভোরেই চলে এসেছে।”

“আচ্ছা অনেক কথা হয়েছে। এখন তুই বিশ্রাম নে। অসুস্থ শরীরে এত কথা বলা ঠিক না।”

“হ্যা মা তুমি এখন বিশ্রাম নাও। আমরা বাইরেই আছি। কিছু লাগলে ডাক দিয়ো।”

কথাটা বলে মিসেস ইতি ইসলাম বাকিদের নিয়ে চলে যায়। অভি বাইরে যেতে চাইলে মাওয়া পেছন থেকে ডেকে বলে,

“অভি একটু আমার কাছে আয়।”

অভি কাছে গেলে মাওয়া ওকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলে,

“কেঁদেছিস মনে হচ্ছে। আমাকে হারানোর ভয় পাচ্ছিলি বুঝি?”

অভিমানের সুরে অভি উত্তর দেয়,

“আমি কাঁদলে তোর কী? তুই তো আর আমাকে ভালোবাসিস না।”

প্রতিত্তোরে মাওয়া কিছু না বললে অভি এক পলক তাকিয়ে বের হয়ে যেতে চায়। মাওয়া বেশ মজা পায় তার এমন চেহারা দেখে। কিছুক্ষণ থেমে বলে,

“বাউণ্ডুলে ছেলেটাকে মাওয়া ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে। তার ঘরণী হওয়ার জন্য মাওয়া প্রস্তুত!”

মাওয়ার এমন কথা শুনে অভির পা থেমে যায়। অবাক চোখে মাওয়ার দিকে তাকালে সে খেয়াল করে মেয়েটার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি বিরাজমান। এই হাসিটা যে সত্যিকারের হাসি তা বুঝতে একটুও দেরি হয় না অভির। সে কিছু না বলে মুচকি হেসে বের হয়ে যায়।

“যাহ্! চলে গেল ছেলেটা। আমি যে আমার মনের কথা বললাম তার উত্তর না দিয়েই চলে গেল। ফাজিল ছেলে একটা হুহ।”

মাওয়ার জ্ঞান ফেরার আনন্দে সবার চোখমুখ উজ্জ্বল হলেও সিরাতের চিন্তায় উজ্জ্বল মুখগুলো কালো আঁধারে ছেয়ে যায়। মেয়েটার এখনো কেন জ্ঞান ফিরছে না এই ভেবে অস্থির হয়ে যাচ্ছে সবাই।

হাসপাতালের করিডরে ইভানকে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেদিকে এগিয়ে যায় তামান্না।

“কষ্ট হচ্ছে খুব তাই না? তোর কী একবারও মনে হয় না এসব কিছুর জন্য কোথাও না কোথাও তুই দ্বায়ী?”

তামান্নার কথায় ইভান অসহায় কণ্ঠে বলে,

“আমি দ্বায়ী?”

“হ্যা, তুই দ্বায়ী৷ রাত কেন এত তাড়াতাড়ি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেটা তো আমাদের কারোর অজানা নয়। তুই একাই যে রাতকে ভালোবেসেছিস তা তো নয়। রাতও তো তোকে ভালোবেসেছিল। তোর সাথে ঘর বাঁধতে চেয়েছিল। যেদিন তুই ওকে ভালোবাসার কথা বললি সেদিন রাত বলেছিল ওকে বিয়ে করতে। রাত বিয়ের আগে প্রেম, ভালোবাসায় বিশ্বাসী ছিল না। তুই ওকে কথা দিয়েছিলি যথাযথ সম্মান দিয়ে নিজের জীবনসঙ্গী বানাবি। কিন্তু তা তো হয়নি। বরং তোর বাবা আর তোর দাদুবাড়ির সবাই ওকে অপমান করেছিল। তুই নিশ্চয়ই সেইসব ভুলে যাসনি? সেদিন যদি তুই প্রতিবাদ করে রাতের হাত শক্ত করে ধরতিস তাহলে আজ এসব হয়তো হতো না। ওর জীবনটাও এভাবে নষ্ট হয়ে যেত না।”

“আমি নিরুপায় ছিলাম তামান্না। চাইলেও ওই মুহূর্তে ওর হাত ধরা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি যদি সবার বিরুদ্ধে গিয়ে ওকে বিয়ে করতাম তাহলে বাবা আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করে দিত।”

“সেটাই। বাবার ছেলে হয়েই থাক তুই। রাতকে কাছে পাওয়ার চিন্তা আর কখনো করিস না ইভান। ও যেমন মেয়ে তাতে আমি এটুকু জোর দিয়ে বলতেই পারি যে ও কখনোই আর ফিরে আসবে না তোর কাছে। ওর আত্মসম্মানবোধ আমাদের সবার চেয়ে অনেক বেশি৷ যে ছেলেটা ওর সম্মান রক্ষা করতে পারে না সে আর ওকে কী ভালো রাখবে!”

তামান্নার শেষ কথাটা শুনে যেন ইভানের বুকের ভেতর অসহনীয় ব্যথা শুরু হয়। সে কিছু না বলে চুপচাপ চলে যায়। তার চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে তামান্না দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে,

“কেবল ভালোবাসলেই হয় না। ভালোবাসার মানুষটার সম্মান রক্ষা করা, তাকে আগলে রাখা, তার বিশ্বাস অক্ষুণ্ণ রাখা, ভরসার জায়গা হয়ে ওঠা, এই সবকিছু অর্জন করতে হয়। নতুবা নিজের থেকে বেশি ভালোবেসেও প্রিয় মানুষটাকে আটকে রাখা যায় না। সে পাখি হয়ে উড়ে যায় অন্য খাঁচায় বন্দী হতে। তখন সত্যিকারের ভালোবেসেও আর কোনো লাভ হয় না। দু’জন মানুষ একে-অপরকে ভালোবেসেও চিরজীবনের জন্য আলাদা হয়ে যায়। হয়তো কেউই সুখী হয় না। কেবল সুখে থাকার চেষ্টা করে। কিংবা সুখে আছি কথাটার উপর ভিত্তি করে দিনের পর দিন ভালো থাকার অভিনয় করে যায়। তাই দিন ফুরাবার আগেই ভালোবাসার মানুষটাকে যথাযথ সম্মান দিয়ে নিজের করে নিতে হয়। নয়তো সারাজীবন শুধু আফসোস করতে হয়। না পাওয়ার যন্ত্রণায় ছটফট করতে হয়।”

চলবে??

#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_২৭
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“মাহতাব আর তুরাগ কোথায়?”

জ্ঞান ফেরার পর সিরাত সর্বপ্রথম এই প্রশ্ন করায় অভি উত্তর দেয়,

“তোদের দুই বান্ধবীর ওদেরকে নিয়ে এত চিন্তা কীসের? নিজেরা মৃ*ত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলি। অথচ ভাবছিস ওই অসভ্যগুলোর কথা!”

“দুই বান্ধবী মানে? আর কার কী হয়েছে?”

ইভান অভিকে ইশারায় চুপ করতে বলে নিজে উত্তর দেয়,

“তুই এখনো অনেকটা অসুস্থ। আগে সুস্থ হ। তারপর সব শুনিস।”

“না, এখনই বল আমাকে। আর কে অসুস্থ?”

পাশ হতে অথৈ জবাবে বলে,

“মাওয়া অসুস্থ। তুরাগ যখন তোকে মা*রতে পারল না তখন মাওয়াকে আঘাত করেছে। ওর পেটে ছু*রি ঢুকিয়ে দিয়েছিল।”

অথৈ এর কথা শুনে সিরাত উত্তেজিত হয়ে গেলে ইভান শান্ত স্বরে বলে ওঠে,

“শান্ত হ রাত। মাওয়া এখন ঠিক আছে। তাছাড়া মাওয়া তুরাগ আর মাহতাবকে গু*লি করেছে। ওরা ওদের শাস্তি অবশ্যই পাবে।”

সিরাত চিন্তিত হয়ে যায় ইভানের কথা শুনে। মুখ গম্ভীর করে বলে,

“ওরা দু’জন বেঁচে আছে তো?”

“হ্যা, বেঁচে আছে। আমাদের হেফাজতে আছে। তুই চিন্তা করিস না।”

বন্ধুদের কথার মাঝে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করেন ইতি ইসলাম। তার কোলে নাবিহা ঘুমিয়ে আছে। মেয়েটার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। সুন্দর চেহারাটা যেন কয়েক দিনের মাঝেই মলিন হয়ে গিয়েছে। মা আর মেয়ের এমন বিষণ্ণ চেহারা দেখে সিরাতের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে।

“মা!”

মেয়ের মুখে এতদিন পর ‘মা’ ডাক শুনে আত্মা শান্ত হয় মিসেস ইতি ইসলামের। ঘুমন্ত নাতনিকে উর্মির কোলে দিয়ে মেয়ের পাশে বসে পরম যত্নে তার সম্পূর্ণ মুখে হাত বুলিয়ে হু হু করে কেঁদে ওঠেন ইতি ইসলাম।

মায়ের হাতের উপর হাত রেখে সিরাত বলে,

“কেঁদো না মা। দেখো আমি একদম ঠিক আছি। সুস্থ আছি।”

“আমার মেয়েটার হাতে এত মোটা ব্যান্ডেজ, কপালে র*ক্ত জমে আছে, ঠোঁট কেটে র*ক্ত জমে আছে। এসব দেখেও আমি কীভাবে শান্ত থাকি? আমার বুকটা যে ফেটে যাচ্ছে আম্মু।”

“আমি ঠিক হয়ে যাব। হার মেনে নেওয়ার মেয়ে তো আমি না। তোমার দোয়া আমার সাথে আছে৷ মায়ের দোয়া সাথে থাকলে কি কেউ খারাপ থাকতে পারে মা?”

মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে সিরাত আবদার করে,

“আমার মা*থায় একটু হাত বুলিয়ে দাও না মা। কতদিন হলো তোমার কোলে শুয়ে তোমার আদর খাই না। মায়ের কোলে শুয়ে যে শান্তি পাওয়া যায় তা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না।”

সিরাতের কথা শেষ হওয়ার আগেই তার মা*থায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দেয় মা। এর মাঝে নাবিহার ঘুম ভেঙে যায়। মা’কে শুয়ে থাকতে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সে।

“মাম্মা মাম্মা!”

মেয়ের মুখ থেকে এতদিন পর কাঙ্ক্ষিত সেই ডাক শুনে চোখের কোণে পানি জমে যায় সিরাতের। ডান হাতে ব্যথা থাকায় বাম হাত দিয়ে মেয়েকে নিজের কাছে ডাকে সে। উর্মি নাবিহাকে সিরাতের পাশে বসিয়ে দিলে মেয়েকে বুকে আগলে নিয়ে নিরবে অশ্রু ঝরায় সিরাত। মেয়ের সম্পূর্ণ মুখে অসংখ্য চুমু এঁকে দেয়। ছোট্ট ছোট্ট হাত দু’টো ধরে হাতের পিঠেও চুমু এঁকে দেয়।

“মা আমার, তুমি ঠিক আছ? নানুমনির কাছে লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে ছিলে তো?”

“নাবিহা আমার থেকে বেশি তারিনের কাছে ছিল। ওর কাছেই এই কয়েকদিন থেকেছে। মেয়েটা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। নাবিহাকে তো ওই দেখে রেখেছে।”

মায়ের মুখে এমন কথা শুনে সিরাত তারিনের দিকে তাকায়। সে চুপচাপ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে।

“এই মেয়ে তুই এভাবে কাঁদছিস কেন হ্যা? আমার মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মতো দেখে রাখলি। তার জন্য তো আমি তোর কাছে চির ঋণী হয়ে গেলাম।”

“একটা মা*ইর দিব তোকে। তোর মেয়ে মানে আমাদের সবার মেয়ে। ওর দেখভাল করা আমার দায়িত্ব। তার জন্য আবার কীসের ঋণ রে? খুব পর ভাবিস আমাকে তাই না?”

“তুই আমার কাছে আয়।”

তারিন সিরাতের কাছে এগিয়ে গেলে সিরাত ওর হাত ধরে বলে,

“আমি হয়তো স্বামী সুখ পাইনি। কিন্তু চরম পর্যায়ের ভাগ্যবতী না হলে তোদের মতো বন্ধু পাওয়া যায় না রে। একজন আমার জন্য জীবন বাজি রাখল। আরেকজন আমার মেয়েকে এত যত্নে রাখল। বাকিরা সবাই প্রাণপণ চেষ্টা করে আমাকে উদ্ধার করল। তোরা না থাকলে হয়তো আমি আজ বেঁচে ফিরতে পারতাম না। তেজস্বিনীদেরও হেরে যেতে হয়। কিন্তু তোরা আমাকে জিতিয়ে দিয়েছিস। জীবনে প্রকৃত বন্ধু থাকা কতটা প্রয়োজন সেটা তোরা খুব ভালোভাবে প্রমাণ করেছিস। আমার মা, আমার পরিবার, আমার মেয়ে, আমার বন্ধু, সবাইকে খুব ভাগ্য করে পেয়েছি আমি। এক জীবনে তো সব পাওয়া যায় না। আমি ভালো স্বামী পাইনি তো কী হয়েছে? বাকি সব তো পেয়েছি। এই আমার পরম সৌভাগ্য!”

“তোর কথা শেষ হয়েছে? তাহলে এবার বিশ্রাম নে।”

ইভানের কথায় সিরাত বায়না ধরে বসে।

“আমি এক্ষুণি মাওয়ার কাছে যাব। আমাকে নিয়ে চল।”

“এই অবস্থায় তোর কোথাও যাওয়া যাবে না।”

“আমি এতকিছু জানি না। হয় আমাকে ওর কাছে নিয়ে চল, নয়তো ওকে আমার কাছে নিয়ে আয়।”

“আজব তো!”

“তোরা কিছু করবি? নাকি আমি এই শরীর নিয়ে উঠব?”

নাবিল হন্তদন্ত হয়ে এসে বলে,

“তোরা কী যমজ বোন?”

সিরাত ভ্রূদ্বয় সংকুচিত করে বলে,

“কী হয়েছে?”

“এখানে তুই জেদ ধরেছিস। ওখানে মাওয়া পারলে এখনই তোর কাছে ছুটে চলে আসে।”

“আত্মার সম্পর্ক এটা বুঝলি?”

“খুব বুঝেছি ম্যাডাম। তাই তো এত এত ঝামেলা করে মাওয়াকে তোর কেবিনে নিয়ে এলাম। এখন থাক দুই বান্ধবী একসাথে।”

ফারহানকে দেখে সিরাত খুশি হয়ে বলে,

“তুই কখন এলি?”

“আমি আজ ভোরে এসেছি। নকশির থেকে সবকিছু শুনে আমি আর থাকতে পারিনি। আরো আগেই আসতাম। কিন্তু এই হারামির দল আমাকে প্রথমে কিছুই বলেনি।”

“তোকে আর আমরা আলাদা করে চাপ দিতে চাইনি দোস্ত।”

“হ্যা ভাই তোরা তো আমার খুব বড়ো উপকার করে ফেলেছিস এটা করে।”

ফারহান আর নাবিলকে থামিয়ে দিয়ে সিরাত বলে,

“তোরা একটু থাম। আমি এখন মাওয়ার সাথে একা থাকব। বাকিরা বের হয়ে যা।”

নকশি সরু চোখে তাকিয়ে বলে,

“একজনকে পেয়ে বাকিদের ভুলে যাবি তুই? এটা তোর থেকে আশা করিনি হুহ।”

“ওরে আমার অভিমানিনী পরে অভিমান করিস। এখন বের হ সবাই।”

মা আর মেয়েকে একটু আদর করে দিয়ে বাকিদের সাথে পাঠিয়ে দেয় সিরাত। কেবিনে কেবল থেকে যায় সে আর মাওয়া। মাওয়াকে একদম সিরাতের পাশাপাশি রাখা হয়েছে। সিরাত এক হাত এগিয়ে দিয়ে বলে,

“এখন কেমন আছিস তুই?”

মাওয়া ডান হাত দিয়ে সিরাতের হাত ধরে বলে,

“তোকে সুস্থ হতে দেখে আমি কি খারাপ থাকতে পারি?”

“এত বড়ো ঝুঁকি না নিলেও পারতি।”

“চুপ কর তো তুই। বেশি কথা বলবি না একদম।”

“আচ্ছা আমার একটা অনুরোধ রাখবি?”

“অভির কথা বলবি তাই তো?”

“হুম। দেখ অনেক তো হলো ভুল বোঝাবুঝি। এবার তোরও জীবন নিয়ে ভাবতে হবে। আর অভির থেকে বেশি ভালো তোকে অন্য কেউ বাসতে পারবে না।”

“আমি আজ ওকে বিয়ের জন্য হ্যা বলেছি।”

“এহ্?”

সিরাতকে অবাক হতে দেখে মাওয়া হেসে বলে,

“বাকিরা এখনো কিছুই জানে না। আগে সুস্থ হই। তারপর বলব।”

“কীভাবে হলো এসব?”

“আসলে তুই যেদিন নিখোঁজ হলি সেদিন আমি ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ফোন বন্ধ করে দু’জন নদীর পাড়ে বসে ছিলাম কতক্ষণ। সত্যি বলতে আমিও অভিকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু আমি সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বাবা ওকে পছন্দ করে না। তাকে মানানোর জন্য সময়ের প্রয়োজন ছিল আমার। সেদিন বাবার সাথে ঝগড়া করেই বের হয়েছিলাম। জানিস? অভি আমাকে প্রপোজ করেছে ওইদিন। ওর মনের কথাগুলো শোনার পর ওকে আর দূরে সরিয়ে রাখতে ইচ্ছা করছিল না আমার। আমি তোকে সবকিছু জানানোর জন্যই ফোন অন করেছিলাম। তখনই নাবিল কল করে বলে তুই নিখোঁজ। এরপর তো তোকে খুঁজতে খুঁজতে অস্থির হয়ে গেলাম আমরা। ওকে আর মনের কথা বলতে পারিনি। অবশেষে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ওকে মনের কথা বললাম।”

“তা কী বলেছিস শুনি?”

“ভালোবাসি!”

কথাটা বলার সময় মাওয়াকে ব্লাশ করতে দেখে সিরাত মুচকি হেসে বলে,

“যাক, সবার ভালোবাসা একে একে পূর্ণতা পাচ্ছে তাহলে!”

মাওয়া সিরাতের কথা শুনে বলে,

“সবার ভালোবাসা তো পূর্ণতা পায়নি রাত।”

“মানে?”

“ইভান আর তোর ভালোবাসা যে অপূর্ণ রয়ে গেল।”

“আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে যা হয়নি সেটা এখন হবে ভেবে থাকলে ভুল করবি তোরা। আর কিছুদিন পর নাবিহা চার বছরে পা দেবে। আমার বিয়ের বয়সও প্রায় ছয় বছরের কাছাকাছি। যারা আমাকে ছয় বছর আগে মেনে নেয়নি তারা এখন আমাকে মেনে নেবে বলে মনে হয় তোদের? আর যেখানে আমার আত্মসম্মানে আঘাত লাগে সেখানে তো আমি কখনোই যাব না। ইভান ভালো বন্ধু হতে পারে। ভালো সন্তান হতে পারে। হয়তো ভালো বাবাও হতে পারবে। কিন্তু ভালো স্বামী কিংবা ভালো প্রেমিক কখনোই হতে পারবে না!”

“জীবনকে কি দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া যায় না?”

“অবশ্যই যায়। কিন্তু তেজস্বিনীরা কখনো আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে পারে না। আমি আর কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারব না। ইভানকে ভালোবেসে আমি কষ্ট ছাড়া কিছু পাইনি। একটা কথা কি জানিস তো? বন্ধুত্ব বন্ধুত্ব অবধিই সুন্দর। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তো তাই।”

“একা কী বাঁচা যায়?”

মাওয়ার এমন প্রশ্নে সিরাত খুব সুন্দর করে বলে,

“ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে বর্তমান নষ্ট করা বোকামি। এখন বর্তমান নষ্ট হলে ভবিষ্যতে গিয়ে আমাদের অতীতও আমাদের কষ্ট দেবে। আমরা কতদিন বাঁচব তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই অনিশ্চিত জীবনে জীবনসঙ্গী ছাড়া বাঁচা যাবে না এটা কোথাও লেখা নেই। আমার মেয়েকে নিয়ে আমি বাঁচার চেষ্টা তো অন্তত করি। একজন জীবন থেকে যেতে না যেতেই অন্যজনকে নিয়ে ভাবার তো প্রয়োজন নেই। মাঝে মাঝে একা বেঁচে থাকার স্বাদও নিতে হয়। তেজস্বিনী শব্দটার মানে তো তোর অজানা নয়। আমি সমাজের সেই সকল মেয়েদের জন্য কিছু করতে চাই যারা স্বাধীনভাবে বাঁচতে চেয়েও বাঁচতে পারছে না। এবার আমিও একটু একা বাঁচতে চাই। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা না হয় তখন ভাবা যাবে। বৃদ্ধ বয়সের কথা চিন্তা করে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত আমি নিতে চাই না। এমনও তো হতে পারে, হয়তো বৃদ্ধ হওয়ার আগেই আমি চলে যাব এই দুনিয়া ছেড়ে। তাহলে সেই বৃদ্ধ বয়সের কথা ছাব্বিশ বছর বয়সে এসে আমি কেন ভাবতে যাব? এই ভাবাটাও আমার কাছে অপচয়!”

চলবে??

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে