নিভৃতে তেজস্বিনী পর্ব-২৫

0
417

#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_২৫
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“তুরাগের খবর পেলি?”

মাওয়ার কথায় ফোনের অপরপাশ থেকে ইভান অসহায় কণ্ঠে বলে,

“আমি চেষ্টা করছি মাওয়া। কিন্তু কোনোভাবেই ওর কোনো খবর পাচ্ছি না।”

“দেখ এভাবে ওর খবর পাওয়া যাবে না। আমি তুরাগের একটা বন্ধুকে চিনি। ওর থেকে কোনোভাবে তুরাগের নাম্বার নিতে পারলে লোকেশন ট্র্যাক করে সহজেই ওকে ধরতে পারব আমরা।”

“নাম কী ওর বন্ধুর?”

“শিহাব, আমার কাছে ওর ফেসবুক আইডি আছে। তুই যেভাবেই হোক ওর সাথে দেখা করে তুরাগের খবর নে।”

“যদি শিহাবের কাছে তুরাগের কোনো খবর না থাকে?”

“আরে ভাই নয় দিন আগেই ওরা একসাথে ছবি তুলেছে। আমি শিহাবের আইডিতে দেখেছি সেই পোস্ট।”

“আচ্ছা আমাকে ওর আইডি লিংক দে। বাকিটা আমি দেখছি।”

কল কেটে দিয়ে মাওয়া ইভানকে শিহাবের আইডি লিংক পাঠিয়ে দেয়।

এদিকে সিরাতের অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। অনেকটা সময় যাবত ওয়াশরুমে না যাওয়ার ফলে পেটে ব্যথা শুরু হয়ে গিয়েছে তার।

“বাইরে কেউ আছ? একটু ভেতরে এসো।”

দুই/তিনবার ডাকার পর তুরাগ ভেতরে ঢুকে বেশ ককর্শ গলায় জিজ্ঞেস করে,

“কী হয়েছে?”

“আমি ওয়াশরুমে যাব। আমার অনেক সমস্যা হচ্ছে। এখন ওয়াশরুমে যেতেই হবে।”

“ওয়াশরুমে যাওয়ার নাম করে পালিয়ে যেতে চাও হ্যা?”

“তোমরা কি আমাকে পালিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় রেখেছ? পুরো শরীর ব্যথায় অবশ হয়ে যাচ্ছে আমার।”

তুরাগ ভালোভাবে খেয়াল করে দেখে, সত্যিই সিরাতের অবস্থা ভালো না। সে ঠিকমতো চোখ মেলে তাকাতেও পারছে না।

“তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে নিয়ে চলো আমাকে। আমি আর পারছি না এভাবে বসে থাকতে।”

“বাঁধন খুলে দিচ্ছি। কিন্তু ভুল করেও পালানোর কিংবা চালাকি করার চেষ্টা করবে না। তাহলে কিন্তু তোমার কপালে দুঃখ আছে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। কিছু করব না আমি।”

তুরাগ ধীরে ধীরে সিরাতের হাত, পায়ের বাঁধন খুলে দেয়। এতক্ষণে যেন সিরাত একটু শান্তি পায়। নিজে থেকে উঠতে গিয়ে সে বুঝতে পারে পায়ের ব্যথায় ঠিকমতো দাঁড়ানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। তুরাগ সেটা বুঝতে পেরে এক হাতে সিরাতের হাত আর অন্য হাতে সিরাতের কোমড় চেপে ধরে। অতঃপর আলতোভাবে পা ফেলে সে প্রথমবারের মতো বন্দী ঘর থেকে বের হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো সম্পূর্ণ জায়গায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। ওয়াশরুমের পাশে দাঁড়িয়ে সিরাতের গা গুলিয়ে ওঠে। প্রচন্ড শরীর খারাপ নিয়ে যখন সিরাত ঠিকমতো দাঁড়াতেও অক্ষম ঠিক সেই মুহূর্তে সে অনুভব করে তার শরীরে কেউ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে স্পর্শ করছে। চমকে ওঠে সে। পাশ ফিরে লক্ষ্য করে তুরাগের নোংরা দৃষ্টিভঙ্গি। রাগে তার হাতের মুঠ শক্ত হয়ে আসে। কিন্তু এই মুহূর্তে ল*ড়াই করে নিজেকে রক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই চুপচাপ ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় সিরাত।

চারপাশে তাকিয়ে ছোট্ট একটা জানালা দেখতে পেয়ে তার মনে আশা জাগে, হয়তো এবার এই বন্দী জীবন থেকে বের হওয়ার কোনো রাস্তা খুঁজে পাবে সে। কিন্তু নিয়তি হয়তো এটা চায় না। তাই তো মেয়েটার সকল আশায় পানি ঢেলে তাকে বুঝিয়ে দেয়,

“এই ল*ড়াই বড্ড কঠিন। নিজেকে বাঁচাতে হলে আবারও তোকে তেজস্বিনী হতে হবে। নিজেকে দুর্বল ভেবে বসে থাকলে তুই হেরে যাবি সিরাত। হেরে যাবি বাস্তবতার মঞ্চে। সাথে হেরে যাবে সেই সকল মেয়ে যারা তোকে দেখে সাহসী হতে চেয়েছে। হতে চেয়েছে তেজস্বিনী!”

এসব ভেবে দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ে সিরাত। কান্নাগুলো আজ ধরা দিতে চাইছে না তার চোখে। আর কত কাঁদবে সে? কাঁদতে কাঁদতে যে তার চোখের নোনাপানি শুকিয়ে গিয়েছে।

ওয়াশরুমের বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে খানিকটা পানি খেয়ে নেয় সে। আয়নার সামনে নিজেকে দেখে মায়া হয়। মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে কী থেকে কী হয়ে গেল সে!

“আমাকে ভেঙে পড়লে চলবে না। কিছু একটা তো আমাকে করতেই হবে। হাতে সময় বেশি নেই। এই ছোট্ট জানালা দিয়েই আমাকে যা করার করতে হবে।”

আনমনে কথাটা ভেবে জানালার কাছে চলে যায় সিরাত। কিন্তু শত চেষ্টা করেও জানালার নাগাল পায় না। চারপাশে তাকিয়ে কিছু খুঁজেও পায় না যার সাহায্যে সে উপরে উঠতে পারবে।

“আর কতক্ষণ লাগবে? শোনো, পালানোর চেষ্টা করো না। কারণ সেটা কখনোই হবে না। বরং এটা করলে নিজের ক্ষতি নিজেই করবে তুমি। তাড়াতাড়ি বের হও।”

তুরাগের কণ্ঠস্বর শুনে সিরাত মুখে হাত দিয়ে ভাবে কী করা যায়!
কিছু একটা ভেবে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে ভীষণ জোরে একটা চিৎকার দিয়ে ওঠে সিরাত। আশেপাশে আরো অনেকগুলো বিল্ডিং থাকায় বিব্রত হয় তুরাগ। জোরে জোরে দরজা ধাক্কিয়ে বলে,

“খবরদার আমার সাথে চালাকি করার চেষ্টা করবে না। নয়তো এর ফল ভালো হবে না সিরাত।”

অবস্থা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে ভেবে ধীরে ধীরে ওয়াশরুমের দরজা খুলে বের হয় সে। তুরাগ কিছু বলার আগেই মা*থা ঘুরিয়ে পড়ে যায় মেঝের উপর।

“আরেহ্ কী হলো? এই মেয়ে একদম নাটক করবে না। ওঠো বলছি।”

মাহতাব বাইরে থেকে খাবার কিনে এনে সিরাতের এই অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করে,

“কী হয়েছে ওর? এভাবে পড়ে আছে কেন?”

“আরে ভাই ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যাচ্ছিল। তাই নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।”

অজানা ভয় বাসা বাঁধে মাহতাবের মনে। ভয়ে ভয়ে বলে,

“বেঁচে আছে তো? সিরাত এভাবে ম*রে গেলে আমরা দু’জন খুব বাজেভাবে ফেঁসে যাব ভাই!”

তুরাগ সিরাতের পালস্ চেক করে বলে,

“বেঁচে আছে। আগে ঘরে নিয়ে যাই। তারপর দেখছি বাকিটা।”

“আমি নিয়ে যাচ্ছি।”

কথাটা বলে মাহতাব সিরাতকে কোলে তুলে নেয়। ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানার উপর শুইয়ে দিয়ে বলে,

“ওর যা অবস্থা তাতে করে পালাতে পারবে না। আপাতত এখানেই শুয়ে থাকুক। জ্ঞান ফিরলে হাত, পা বাঁধা যাবে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে জীবন ঝুঁকি হতে পারে। তখন আমাদের বিপদ বাড়বে।”

“আচ্ছা দরজা, জানালা সবকিছু বন্ধ করে আমরা বাইরে চলে যাই চল।”

দু’জন মিলে ঘরের জানালাগুলো লক করে দিয়ে দরজা বাইরে থেকে আটকে বের হয়ে যায়৷ একদিকে সিরাত বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। অন্যদিকে তারা দু’জন খাবার খেতে ব্যস্ত।

দু’জন বেরিয়ে গেলে সিরাত চোখ মেলে তাকায়। চারপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে সে এখন কোথায় আছে।

“অজ্ঞান হওয়ার নাটক করে হাত, পায়ের বাঁধন খুলতে পেরেছি এটাই অনেক। এখন আমাকে কিছু ভাবতে হবে। ইশ্! কোনোভাবে যদি বন্ধুদের মধ্যে কারোর সাথে যোগাযোগ করতে পারতাম!”

সিরাতের মনের ইচ্ছা পূরণ করতেই যেন সকলের ফোনে একটা ম্যাসেজ আসে।

“তুরাগের ঠিকানা পাওয়া গিয়েছে। সবাই দ্রুত বড়ো রাস্তার মোড়ে আয়।”

ম্যাসেজটা পাঠিয়ে ইভান শিহাবকে ছেড়ে দেয়। থানা থেকে বের হওয়ার আগে কঠোর ভাষায় বলে,

“যদি তুরাগকে কিছু জানাস, তাহলে কালকের সকালটা আর দেখতে পাবি না। কথাটা ভালো করে মনে রাখ। নিজের ভালো চাইলে মুখ একদম বন্ধ রাখবি। বুঝেছিস?”

শিহাব ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয়,

“আমি কাউকে কিচ্ছু বলব না। কিচ্ছু বলব না।”

“এইতো ভালো ছেলের মতো কথা। এখন বের হয়ে যা থানা থেকে।”

শিহাব চলে গেলে দ্রুত পা চালিয়ে ইভান বড়ো রাস্তার মোড়ে চলে যায়। সেখানে গিয়ে সবাইকে অস্থির চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,

“তোরা চিন্তা করিস না। আমরা আজকেই সিরাতকে উদ্ধার করব। তুরাগের ঠিকানা শিহাবের কাছ থেকে পেয়ে গিয়েছি আমি। নাম্বারও আছে আমার কাছে।”

“তুরাগ এখন কোথায় আছে?”

“শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা বাড়ি আছে। খুব সম্ভবত ওটা একটা পরিত্যক্ত বাড়ি। ওখানেই আছে তুরাগ।”

“আমাদের এক্ষুণি বের হতে হবে। চল তোরা।”

অভির কথায় সহমত জানিয়ে সবাই বেরিয়ে পড়ে। ঘন্টা দুয়েকের পথটা যেন আজ সবার কাছে অনেক বেশি লাগছে।

“মেয়েটা ঠিক আছে তো? আমার না খুব ভয় হচ্ছে।”

“ভয় পাস না উর্মি। আমাদের বন্ধুর কিচ্ছু হবে না। ওর কিছু হতে পারে না। সিরাতের কোনো ক্ষতি হলে যে আমরা সবাই হেরে যাব।”

ইভান নিজে ড্রাইভ করেও শান্তি পাচ্ছে না। এত জোরে গাড়ি চালিয়েও পথ যেন কিছুতেই শেষ হতে চায় না।

অন্যদিকে সিরাত পুরো ঘর ঘুরেও কিছু পায় না। জানালা খোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তার এখন মনে হচ্ছে সে অনেক বড়ো একটা গোলকধাঁধার মাঝে আটকে পড়েছে।

দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে দ্রুত বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে সিরাত। তুরাগ একটু একটু করে সিরাতের কাছে এসে ওর চোখ কাঁপতে দেখে হেসে বলে,

“অভিনয়ে তুমি অনেক কাঁচা সিরাত। অজ্ঞান হওয়ার ভান করে আমাদের থেকে বেঁচে যাবে ভেবেছ? যদি এটাই ভেবে থাকো তাহলে ভুল ভেবেছ।”

মাহতাব অবাক হয়ে বলে,

“এসব কী বলছিস তুই?”

“আমি ঠিকই বলছি। ও অজ্ঞান হয়নি। সবটাই নাটক।”

সিরাত সবকিছু শুনেও নিরবে শুয়ে থাকে। মাহতাব ওর কাছে এসে দুই বাহু শক্ত করে ধরে বলে,

“যতই চেষ্টা করো, তুমি বাঁচতে পারবে না।”

“ওকে মুখে বলে কিছু হবে না। এইবার কাজে করে দেখাতে হবে।”

তুরাগ হাতে একটা লোহার রড নিয়ে সিরাতের কাছে এসে ওর ডান হাত বরাবর খুব জোরে আঘাত করে। প্রচন্ড ব্যথায় চিৎকার করে ওঠে সিরাত। একের পর এক আঘাতে মনে হয় তার হাতের সমস্ত হাড় ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে। হাত থেকে শুরু করে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রডের আঘাতে ক্ষ*তবিক্ষ*ত হয়ে যায় সিরাত।

“একদিন এভাবেই আমিও চিৎকার করেছিলাম। তোমার জন্য সব হারিয়েছি আমি। তোমার শান্তিতে বেঁচে থাকা আমি দেখতে পারব না। যেদিন সব হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম তোমাকে আমি এক কঠিন মৃ*ত্যু উপহার দিব। আর আজ সেই কাঙ্ক্ষিত দিন।”

তুরাগের এমন অস্বাভাবিক রূপ দেখে মাহতাব বলে,

“ভাই মেয়েটা ম*রে যাবে৷ এবার থাম প্লিজ।”

“কেন? থামব কেন? ওকে তো আমরা মা*রতেই চাই। এই তুই কি ভয় পাচ্ছিস? একদম ভয় পাস না। আমার এই ঠিকানা ওর বন্ধুরা কখনোই জানবে না। পুলিশও জানতে পারবে না। সবাই জানার আগেই ওকে মে*রে মাটির নিচে পুঁতে দিব। কেউ কখনোই ওর হদিস পাবে না।”

তুরাগের কথা শুনে মাহতাবের গলা শুকিয়ে আসে। শেষমেশ নিজের স্ত্রীকে খু*ন করবে সে!

“এসব জানাজানি হলে আমরা শেষ হয়ে যাব। আমাদের জ্যন্ত মে*রে ফেলবে সবাই। এখন সিরাতের ফ্যান, ফলোয়ার্স অনেক বেড়ে গিয়েছে৷ হাজার হাজার মানুষ ওকে ফলো করে। আমাদের পেলে সবাই জ্যন্ত মাটিতে পুঁতে দেবে।”

“আরে এত ভয়ের কিছু নেই। আজই ওর জীবনের শেষ দিন।”

কথাটা বলে নিজের পকেট থেকে একটা ছু*রি বের করে সিরাতের গলার কাছে ধরে তুরাগ। এটা দেখে মাহতাব ভয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। তুরাগ যেই মুহূর্তে সিরাতের গলার মাঝে ছু*রি দিয়ে আঘাত করতে যাবে ওই মুহূর্তে গু*লির আওয়াজে চমকে ওঠে দু’জন। পাশ ফিরে সামনে তাকিয়ে র*ক্ত লাল চোখে ইভানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তুরাগের হাত থেকে আপনাআপনি ছুরি পড়ে যায়। তাড়াতাড়ি করে ছুরিটা তুলে নিয়ে ইভানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“প্রেমিকার জন্য এত চিন্তা যে কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকে এখানে চলেই এলি। এক বাচ্চার মায়ের প্রতি এত দরদ? যাক এসে ভালো করেছিস৷ এখন তোর সামনেই তোর প্রেমিকাকে মা*রব আমি।”

মাওয়া দৌড়ে দরজার সামনে এসে সিরাতের র*ক্তাক্ত শরীর দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে তুরাগ সিরাতের গলায় পুনরায় ছু*রি ধরলে ইভান কিছু করার আগেই ওর হাত থেকে গান নিয়ে কোনোকিছু না ভেবে চোখ বন্ধ করে তুরাগের পিঠ বরাবর গু*লি ছুঁড়ে দেয় মাওয়া। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে ওঠে সবাই।

মাহতাব ভয় পেয়ে দূরে সরে যেতে চাইলে তার দুই পায়ে পরপর দুইটা গু*লি করে গান ফেলে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সিরাতের দিকে এগিয়ে যায় মাওয়া। তুরাগ ব্যথায় মাটিতে বসে পড়ে। মাওয়া সিরাতের কাছে গিয়ে তাকে ডাকতে শুরু করে। অসহ্য ব্যথায় চোখ দু’টো বন্ধ করার আগে তুরাগ নিজের শেষ চালটা দিয়েই দেয়।

“এক বন্ধুকে মা*রতে না পারি, আরেকটাকে তো পারব।”

কথাটা বলে মুহূর্তের মধ্যেই মাওয়ার পেটে ছু*রি ঢুকিয়ে দেয় তুরাগ। কোনো আওয়াজ না করে নির্বাক দৃষ্টিতে মাওয়া কেবল চেয়ে থাকে তুরাগের দিকে। আলতোভাবে পেটে হাত দিলে সে বুঝতে পারে তার হাত র*ক্তে মাখামাখি হয়ে গিয়েছে। মাওয়ার চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সিরাতের হাতের উপর হাত রেখে সে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।

একটা ঘরের মাঝে চারজন মানুষ নিষ্প্রাণ হয়ে শুয়ে আছে। ইভান সবকিছু দেখে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। হাটু গেঁড়ে মাটিতে বসে পড়ে। বাকিরা এসে এমন দৃশ্য দেখে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে রয়। অথৈ শব্দ করে কান্না করে ওদের দিকে এগিয়ে যায়। মাওয়ার পাশে বসে তাকে ডাকতে থাকে। উর্মি এসে বসে পড়ে সিরাতের পাশে। চুলের মাঝে বিলি কেটে বলে,

“রাত তুই না সেদিন আমাকে সাহস দিলি? তাহলে আজ তুই নিজে কেন এভাবে নিষ্প্রাণ হয়ে শুয়ে আছিস? তোর র*ক্তাক্ত শরীর দেখে তোর মেয়ে কী বলবে? তুই তো এভাবে চলে যেতে পারিস না। তোকে বাঁচতে হবে। সবাইকে বাঁচার কথা বলে তুই ম*রতে পারিস না। এই মেয়ে চোখ খোল। চোখ খোল বলছি। রাত!”

হাজার ডাকেও হয়তো সিরাত আর সাড়া দেবে না। উঠে বলবে না,

“এই দেখ আমি একদম ঠিক আছি। তোদের বন্ধুর কখনো কিছু হতেই পারে না। আমি তো অনেক সাহসী। হার না মানা এক তেজস্বিনী আমি।”

অথৈ মাওয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। অভি আবেগশূন্য চোখে দু’জনের দিকে তাকিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। মাওয়ার পাশে বসে বলে,

“সেদিন যখন আমরা দেখা করলাম, তখন তুই আমাকে কথা দিয়েছিলি আমাকে নিয়ে ভাববি। আমি যে তোর মুখ থেকে একটা বার ভালোবাসি কথাটা শোনার জন্য বহুকাল ধরে অপেক্ষা করছি। তুই আমাকে এভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে যেতে পারিস না। তোর এখনো অনেক কাজ বাকি। আমাকে ভালোবাসা বাকি। আমার ভালোবাসা গ্রহণ করা বাকি। আমার বউ হওয়া বাকি। আমি তোকে ছাড়া বাঁচতে পারব না। একটা বার চোখ খোল। দেখ, কেউ একজন তোর জন্য বুক পেতে রেখেছে। আমার বুকে মা*থা রাখবি না তুই? আমাকে ভালোবাসবি না? এই মেয়ে, তাকা আমার দিকে। বল না, ভালোবাসিস আমায়!”

না, মাওয়া সাড়া দেয় না। অভির চোখ যায় সিরাতের দিকে। সিরাতের ডান হাত থেকে অঝোরে র*ক্ত ঝরছে। সেই হাত স্পর্শ করে সে বলে,

“তুই না আমার বেস্ট ফ্রেন্ড? কতগুলো দিন তোর সাথে অভিমান করে কথা বলিনি আমি। এই দেখ, আমি নিজে থেকে তোর সাথে কথা বলছি। আমি তোকে কথা দিচ্ছি, আর কখনো তোর উপর অভিমান করে কথা বন্ধ করব না। এই বাবু, তাকা না আমার দিকে। তুই না সবসময় বলিস, আমি তোর ভাই। ভাইয়ের কষ্টে কষ্ট হচ্ছে না তোর? আমার যে বুক ফেটে যাচ্ছে রাত। আমার সবচেয়ে প্রিয় দু’জন মানুষ আমারই চোখের সামনে নিষ্প্রাণ হয়ে শুয়ে আছে। তোরা চলে গেলে আমি কীভাবে বাঁচব? এই পৃথিবীতে বন্ধুরা ছাড়া আমার তো আর কেউ নেই। আমাকে এতটা কষ্ট দিস না প্লিজ। এত কষ্ট নিয়ে আমি বাঁচতে পারব না রে। এই আমাকে একবার ভাই বলে ডাক না রাত। তোর মুখ থেকে আমি অনেক দিন হলো ভাই ডাক শুনি না। বোন আমার, একটা বার আমাকে ডাকবি প্লিজ!”

“তোরা শান্ত হ, ওদের এক্ষুণি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। অভি তুই মাওয়াকে নিয়ে আয়। আর ইভান তুই,”

নাবিল বাকি কথা বলার আগেই ইভান সিরাতের কাছে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নেয়। ছেলেটার চোখে কোনো পানি নেই। কেমন নির্জীব হয়ে আছে সে। সিরাতের মুখপানে তাকিয়ে বলে,

“দ্বিতীয় বারের মতো তোকে কোলে তুলে নিলাম। রাগ করবি না তো? শোন মেয়ে, তোর শত রাগ সহ্য করতে রাজি আছি আমি। শুধু তোকে হারাতে রাজি নই। তুই আমার উপর অভিমান করলি। সেটা তো মেনে নিয়েছি আমি। আমার ভালোবাসাকে গ্রহণ না করে তুই অন্য একজনের বউ হলি। সেটাও হাসিমুখে মেনে নিয়েছি। আমি কখনো তোকে জোর করিনি আমার হওয়ার জন্য। তোর সিদ্ধান্তকে সাদরে গ্রহণ করেছি। নিষিদ্ধ তোর প্রতি কখনো অধিকার খাটাতে চাইনি। আমি কেবল চেয়েছি তোর ভালো থাকা দেখতে। এই আমি শুধু তোর হাসিমুখ দেখতে চাই। তোর ভালো থাকা দেখেই তো এতদিন বেঁচে আছি আমি। আমার মনের কথাগুলো না জেনে তো তুই চলে যেতে পারিস না। আমি জানি, তুই ফিরবি। তোকে ফিরতেই হবে।”

তেজস্বিনী কি আর কখনো ফিরবে? বন্ধুর জন্য জীবন বাজি রাখা মাওয়া কি ফিরবে তার ভালোবাসার মানুষটার কাছে? হয়তো ফিরবে। কিংবা হার না মানা নারী হয়ে সমাজের বুকে এক অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে তারা দু’জন রয়ে যাবে নীলাভ আকাশের বুকে!

চলবে??

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে