#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_২২
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
“মুঠোভরা সিঁদুরের ছোঁয়ায় যেদিন আমার সিঁথি রাঙিয়ে দিল উৎসব, সেদিন ভাবিনি বিয়ের কথাটা সবাই জানার আগেই আমি বিধবা হয়ে যাব৷ জানিস? আমরা দু’জন দু’জনকে ভীষণ ভালোবাসতাম। আমি আজও ওকে ভালোবাসি। সবার আড়ালে আমরা দু’জন সংসারও শুরু করেছিলাম। কিন্তু সুখের সংসার আমার ভাগ্যে বেশিদিন লেখা ছিল না। মাত্র সাত মাসের মা*থায় আমাকে সম্পূর্ণ একা করে দিয়ে সে চলে গেল। লাল বেনারসি গায়ে জড়ানোর আগেই আমাকে পরতে হলো সাদা শাড়ি!”
উর্মির কথায় বাকি সবাই স্তব্ধ হয়ে নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার দিকে। এগারো জন বন্ধুর মাঝে একমাত্র উর্মি সনাতন ধর্মী। কিন্তু এটা কখনো বাকিরা অনুভব করেনি। উর্মি মেয়েটা একটা সময় ভীষণ প্রাণোচ্ছল ছিল। সকলের সাথে সহজেই মিশে যেত। সেই মেয়েটা যে নিজের মধ্যে এক আকাশ সমান কষ্ট বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে এটা যেন বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে বাকিদের।
সিরাত উর্মির কাঁধে হাত রাখলে এক পলক তাকিয়ে সে পুনরায় বলতে শুরু করে,
“আমার আর উৎসবের সম্পর্কটা আমাদের পরিবার থেকে মেনে নেয়নি। উৎসব ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের ছোট ছেলে। আর আমি উচ্চবিত্ত পরিবারের একমাত্র মেয়ে। আমার বড়ো দুই দাদা উৎসবকে অনেক অপমান করেছিল ওদের পারিবারিক অবস্থা নিয়ে। চার বছর আগে আমাদের সম্পর্ক শুরু হয়৷ সম্পর্কের দুই মাসের মধ্যে সবাই আমাদের বিষয়ে সবকিছু জেনে যায়। আমার পরিবার থেকে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়, আমি আর উৎসবের সাথে যোগাযোগ করতে পারব না। আমি রায় বংশের মেয়ে। যার তার সাথে তো আর আমার বিয়ে হতে পারে না৷ কিন্তু ভালোবাসা কী এসব মানে? আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারতাম না। তাই ছয় মাসের মধ্যে আমরা দু’জন পালিয়ে বিয়ে করি। সবকিছু ঠিকই ছিল। আমাদের ছোট্ট সংসার সাজিয়েছিলাম আমরা। আমাদের সংসারে অভাব ছিল। তবে কষ্ট ছিল না। অভাবের সংসারে আমরা বেশ ভালোই ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ একদিন আমাকে কাঁদিয়ে আমার ভালোবাসার মানুষটা বহুদূরে চলে গেল। স্বার্থপর ছেলেটা একবারও আমার কথা ভাবলো না।”
সকলের চোখেই পানি জমেছে। তাদের এত কাছের বন্ধুটার জীবনে এতকিছু ঘটে গেল, অথচ তারা কেউ কিছু জানতেই পারল না!
তামান্না ধীর পায়ে উর্মির পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কীভাবে হলো এসব?”
জানালা দিয়ে বাইরের খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উর্মি জবাব দেয়,
“রাতের খাবার খাওয়া শেষে আমি সবকিছু গুছিয়ে ওর পাশে বসলাম। ওও আমাকে বলল, আমার বুকের উপর শুয়ে আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে প্লিজ? আমি ওর কথামতো বুকের উপর শুয়ে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর সে আমার কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলল, ভালোবাসি মহারাণী। আমি কিছু না বলে মুচকি হাসলাম। অতঃপর সে নিশ্চুপ হয়ে গেল। আমি ভাবলাম, হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘন্টা খানেক এভাবেই কেটে গেল। হঠাৎ খেয়াল করলাম ওর হৃৎস্পন্দনের গতি একদম কমে এসেছে, নেই বললেই চলে। মনের মধ্যে অজানা ভয় বাসা বাঁধল। আমি ধীরে ধীরে ওর বুকের উপর থেকে উঠে মুখের কাছে হাত নিয়ে কয়েক বার ডাকলাম৷ সে কোনো সাড়া দিল না। আতঙ্কে বুক কাঁপছিল আমার। অনেক্ক্ষণ যাবত ডাকার পরেও যখন উৎসব সাড়া দিল না তখন বুঝে গেলাম ছেলেটা ঘুমিয়ে তো গিয়েছে, কিন্তু এই ঘুম আর ভাঙবে না। জানিস? সেদিন আমার বুক ফেটে কান্নার আওয়াজ পুরো এলাকা শুনেছে। আমি তো ওর আশায় বাড়ি ছেড়েছিলাম। কিন্তু ওই ছেলে আমার কথা একবারও না ভেবে আমার হাতটা চিরদিনের মতো ছেড়ে দিল!”
মুহূর্তের মাঝেই পুরো ঘর পিনপতন নীরবতায় ছেয়ে গেল। কেবলমাত্র শোনা গেল একজন মেয়ের ফুঁপিয়ে কাঁদার আওয়াজ। কাঁদতে কাঁদতে উর্মি অভিযোগের সুরে বলে,
“কী দোষ ছিল আমার? আমি তো তাকে ভালোবেসে তার সাথে ঘর বেঁধেছিলাম। তবুও কেন আমাকে ছেড়ে গেল সে? উৎসব চলে যাওয়ার পর আমি পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম। বাবা কোনোভাবে এই খবরটা পেয়ে আমাকে ওই ছোট্ট ভাড়া বাসা থেকে নিয়ে এসেছিল। আমি জীবন্ত লা*শের মতো বাঁচতে শুরু করি। এভাবেই সপ্তাহ খানেক পার হয়ে যায়। স্বামী হারানোর শোক কাটানোর আগেই বুঝতে পারি আমি অন্তঃসত্ত্বা। এটা শোনার পর আমি নতুন করে বাঁচার জন্য কিঞ্চিৎ আশা পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার সেই আশায় ভাটা পড়ল। আমার মাতৃত্বের স্বাদ আর গ্রহণ করা হলো না রে। আমার সন্তানও আমাকে ছেড়ে চলে গেল। দুনিয়ার আলোও দেখল না অভিমান করে। বাবার কাছে চলে গেল সে। তিনটা বছর পেরিয়ে গেল। তিনটা বছর ধরে জীবন্ত লা*শ হয়ে বেঁচে আছি আমি। আমি এতটাই অভাগী যে না পেলাম স্বামী সুখ, আর না পেলাম সন্তান সুখ!”
সিরাত নিজেকে সামলাতে পারছে না কোনোভাবেই। মুখে দুই হাত চেপে হু হু করে কেঁদে ওঠে সে। তারও যে সন্তান আছে। সন্তানের সামান্য জ্বর হলেও ছটফট করে সে। সেখানে পরপর এতগুলো ধাক্কা মেয়েটা কীভাবে সামলে উঠল কে জানে!
উর্মি নিজের বুকের কাছে হাত নিয়ে আহাজারির সুরে বলে,
“এখানটায় না বড্ড যন্ত্রণা হয়। রাতে ঘুমাতে পারি না আমি। দম বন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় কেউ বোধহয় আমার ক’লি’জা টেনে বের করে নিচ্ছে। মৃ*ত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করি প্রতিনিয়ত। কিন্তু কেউ আমার কষ্ট বোঝে না। এই সমাজে যার কষ্ট সেই শুধু বোঝে। বাকিরা তো গল্প খোঁজে!”
আচমকা অথৈ নাবিলকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। এমন কিছুর জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। সবাই খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। নাবিল পাথরের মতো ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে একই জায়গায়।
“আমি তোকে হারাতে চাই না নাবিল৷ তুই আরও দশটা মেয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বল, ঘুরতে যা। আমার কোনো আপত্তি নেই। শুধু আমাকে ছেড়ে যাস না। আমি যে তোকে বড্ড ভালোবাসি রে। হয়তো অভিমান করে দূরে আছি। তবে কী জানিস? আমি প্রতিটা মুহূর্তে গুমরে গুমরে ম*রি। তোকে না পাওয়ার কষ্ট আমাকে শান্তিতে দুদণ্ড ঘুমাতে দেয় না। আমার বুকটা কেমন খালি খালি লাগে। উর্মির উৎসবের মতো তুই এতটা স্বার্থপর হবি না তো? আমাকে একা ফেলে কোথাও চলে যাবি না তো? পরাণ রে, আমি যে তোরে ছাড়া কিচ্ছু ভাবতে পারি না পরাণ!”
অথৈ এর এমন কাজে সবাই ‘থ’ বনে গিয়েছে। অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সেদিকে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে আপনমনে বলে যায়,
“যেদিন তোকে অন্য একজনের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখলাম সেদিন আমার পুরো দুনিয়া ওলট-পালট হয়ে গিয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, আমার ভালোবাসা হেরে গেল। আমি জানি সেদিন তোকে ফাঁসানো হয়েছিল। তবুও কেন যেন মেনে নিতে পারিনি আমি। তুই তো শুধু আমার। তোর বুকে অন্য কেউ কেন মা*থা রাখবে বল? তোর বুকে শুধু এবং শুধুই আমি মা*থা রাখব। এটা আমার অধিকার। অনেক হয়েছে অভিমানের পর্ব, আর না। অনেকগুলো দিন আমি তোকে ছেড়ে বাঁচার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি তোকে ছাড়া একটা দিনও ভালো থাকতে পারিনি।”
“আচ্ছা বাবা শান্ত হ তুই। আমি কোত্থাও যাব না তোকে ছেড়ে। এই আমিটা তো তোরই।”
“সত্যি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবি না তো?”
“তোকে ছেড়ে যদি চলে যাওয়ারই হতো তাহলে এতদিনে আমি বউ নিয়ে ঘুরতাম বুঝলি?”
“নাহ্ তোর কথা আমি বিশ্বাস করি না৷ তুই এক্ষুণি আমার সাথে কাজি অফিসে চল। আজই আমরা বিয়ে করব।”
“এহ্ এখনই বিয়ে করব মানে কী হ্যা?”
“যদি আবার তুই হারিয়ে যাস? আবার কেউ তোকে আমার থেকে কেঁড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে?”
“আচ্ছা সবাইকে সাক্ষী রেখে তোকে কথা দিচ্ছি, দুই পরিবারকে জানিয়ে যত দ্রুত সম্ভব তোকে আমার ঘরণী করে আনব।”
ওদের দু’জনের এমন কান্ড দেখে সিরাত হতাশ কণ্ঠে বলে,
“আজ নাকি তোরা আমার মন ভালো করার জন্য এতসব আয়োজন করেছিলি? এখানে তো দেখছি বিয়ের পাকা কথা চলছে।”
মাওয়া সিরাতের এমন হতাশ চেহারা দেখে হেসে উত্তর দেয়,
“ভালোই তো হলো। তোর জন্য একজন নিজের মনে জমে থাকা দুঃখের কথা বলতে পারল। অন্যদিকে দু’জন ভালোবাসার মানুষ অভিমান ভুলে আবার এক হলো।”
সিরাত মাওয়ার কথায় পাত্তা না দিয়ে উর্মির কাছে চলে যায়। উর্মির মা*থায় হাত বুলিয়ে দেয় পরম যত্নে।
“আমার জীবনের গল্পটা হয়তো অনেক মেয়েকে স্বাধীনভাবে বাঁচতে উদ্বুদ্ধ করবে। কিন্তু তোর গল্পটা সেই মানুষদের বাঁচতে সাহায্য করবে যারা কঠিনভাবে ভালোবেসে মারাত্মকভাবে হেরে গিয়েছে। তোর মধ্যে যে তেজস্বী রূপ আছে সেটাকে এবার মেলে ধর উর্মি। জীবন কখনো থেমে থাকে না। যে কষ্ট তুই পেয়েছিস তা জয় করা সহজ নয়। সমাজ কী বলবে? অন্যরা কী বলবে? এসব না ভেবে বেঁচে থাকার মতো করে বেঁচে থাক। তোর যা করতে ভালে লাগে সেটাই কর৷ প্রয়োজনে জবাব দিতে শেখ। ঘরকুনো হয়ে লুকিয়ে থাকা কোনো সমাধান নয়। জানি তুই নতুন করে আর কারোর সাথে জীবন শুরু করতে পারবি না। তাতে কী? একা বাঁচতে শেখ তুই। এমনভাবে বাঁচ যেন তোকে দেখে আর পাঁচটা মানুষ বেঁচে থাকার শক্তি পায়, উৎসাহ পায়।”
উর্মি অশ্রুসিক্ত নয়নে সিরাতের দিকে তাকালে সে চোখের ইশারায় তাকে বোঝায়,
“তুই পারবি!”
চলবে??