#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_২১
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
“আমার বাড়িতে তোমার কোনো জায়গা নেই। বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।”
বাবার কথায় হতভম্ব হয়ে যায় মাহতাব। এতদিন সে সিরাতের সাথে যেখানে ছিল সেটা ভাড়া বাসা ছিল৷ যেহেতু সিরাত সেখানে নেই, আর সম্পূর্ণ বাসা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে তাই মাহতাব সেই বাসা ছেড়ে বাবার কাছে এসেছে। কিন্তু বাড়ি ফিরে এমন কিছু শোনার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না।
মারজিয়া শেখ স্বামীর কাছে এসে নরম কণ্ঠে বলেন,
“শোনো না, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে। ওকে এখন বের করে দিয়ো না। তাছাড়া তোমার সম্পত্তিতে তো মাহতাবের ভাগ আছে।”
মারজিয়া শেখের কথায় নজরুল শেখের ভ্রূদ্বয় সংকুচিত হয়ে আসে।
“ভাগ? কীসের ভাগ? মাহতাবের কোনো ভাগ নেই আমার সম্পত্তিতে।”
“এসব কী বলছ তুমি? ভাগ নেই মানে?”
“যা শুনেছ তা ঠিকই শুনেছ। কেন মাহতাব, সিরাত তোমাকে কিছু জানায়নি?”
বাড়ি ফিরে খাবার টেবিলে বসে সবেমাত্র খাবার মুখে নিয়েছিল মাহতাব৷ বাবার এহেন কথায় তার গলা দিয়ে আর কোনো খাবার নামে না। কাঁপা কাঁপা গলায় সে প্রশ্ন করে,
“কী জানানোর কথা বলছ তুমি?”
“তুমি যে মুহূর্তে সিরাতকে ডিভোর্স দিয়েছ সেই মুহূর্ত থেকে আমার সম্পত্তিতে তোমার আর কোনো ভাগ নেই। সেই সম্পত্তির সম্পূর্ণ টাকা সিরাতের কাছে চলে যাবে। না, সে এই টাকা ভোগ করবে না। গরীব, অসহায় মানুষদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেই এই টাকাগুলো তার প্রয়োজন। মেয়েটা এত ভালো যে একটা টাকাও নিতে চায়নি। কিন্তু আমার কথা রাখতে সে রাজি হয়েছে। প্রায় সত্তর লক্ষ টাকা আমি গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেব। আমার কষ্টে অর্জিত টাকার এক অংশ ও তুমি পাবে না।”
মাহতাবের যেন পায়ের তলার মাটি সরে যায় বাবার কথা শুনে। এমনিতেই তার মা*থার উপর দশ লক্ষ টাকার দেনা। তার উপর সে এখন বেকার। এই মুহূর্তে বাবা তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে রাস্তায় রাত কাটানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না তার কাছে!
“বাবা তুমি আমার সাথে এমন করতে পারো না। আমি তোমার ছেলে। তোমার সম্পত্তির উপর আমার পূর্ণ অধিকার আছে।”
“তুমি কি ডিভোর্স পেপারে সই করার সময় কাগজের লেখাগুলো পড়নি মাহতাব? ওখানে তো আমার করা এই উইল এর কাগজ ছিল। সেখানে তুমি সই করে দিয়েছ। সুতরাং তোমার কোনো অধিকার নেই আমার সম্পত্তির উপর।”
“বাবা!”
“আর একটা কথাও বলবে না তুমি। এই মুহূর্তে তুমি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও।”
রাগে, কষ্টে, দুঃখে মুখের ভাত রেখে উঠে পড়ে মাহতাব। তার চোখ থেকে যেন আজ র*ক্ত ঝরছে। ছেলেকে উঠতে দেখে দ্রুত ছেলের দিকে এগিয়ে আসে মারজিয়া শেখ।
“বাবা তুই মুখের ভাত রেখে উঠে যাস না। অন্তত খাবারটুকু খেয়ে নে।”
“এই ভাত আমার গলা দিয়ে নামবে না মা!”
এক থালা ভাতের মধ্যে হাত ধুয়ে খাবার টেবিল ছেড়ে চলে যায় মাহতাব। যাওয়ার আগে বাবার দিকে একবার তাকিয়ে বলে যায়,
“তুমি যার জন্য আমার সাথে এমন করলে তাকে আমি কিছুতেই সুখে থাকতে দিব না বাবা।”
ছেলের চলে যাওয়া মেনে নিতে পারেন না মারজিয়া শেখ। স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
“তুমি মানুষ নও, তুমি পাষাণ। আমার ছেলেটার মুখের ভাত কেঁড়ে নিলে তুমি। ওই এক বাইরের মেয়ের জন্য তুমি আমার ছেলের সাথে যা করলে সেটার জন্য একদিন পস্তাতে হবে তোমাকে। মিলিয়ে নিয়ো আমার কথা।”
স্ত্রীর কথায় কর্ণপাত করেন না নজরুল শেখ। নিজের করা ছোট্ট লাইব্রেরিতে এসে তিনি কয়েক বছর আগের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
“ওই বাইরের মেয়েটা না থাকলে আজ আমি বেঁচে থাকতাম না। সেদিন যদি উপরওয়ালা ওই মেয়েটাকে আমাকে বাঁচানোর জন্য না পাঠাত তাহলে যে এতদিনে আমি মাটির নিচে শুয়ে থাকতাম। সিরাত ছিল বলেই আমি আজও বেঁচে আছি। সেই মেয়েটার কষ্ট আমি চুপচাপ কীভাবে দেখব? আমার ছেলে আসল হিরা চিনতে পারেনি সেটা তার ভুল। কিন্তু যে আমার জীবন রক্ষা করেছে তার কষ্টের কারণকে এমনি এমনি ছেড়ে দিতে পারি না আমি। ছেলের জন্য আমারও মন কাঁদে। তবে তাকে যে মানুষের মতো মানুষ করতে পারিনি আমি। তার প্রায়শ্চিত্ত তো আমাকে করতেই হবে। সেটা না-হয় এভাবেই করলাম।”
বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাহতাব পাগলের মতো ছুটে যায় তুরাগের কাছে। তুরাগের বাড়িতে গিয়ে তাকে বলে,
“তুই সিরাতকে মা*রতে চাস না? আমি তোর পাশে আছি। ওই মেয়ের মৃ*ত্যু আমি নিজের চোখে দেখতে চাই।”
তুরাগ মাহতাবের দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“শান্ত হ মাহতাব। আগে বল তো তোকে এমন অশান্ত লাগছে কেন?”
গ্লাসের সম্পূর্ণ পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিয়ে মাহতাব তুরাগের দিকে তাকায়।
“তুই কি সেদিনের লাইভ দেখিসনি?”
“দেখব না কেন? লাইভ তো এখন ভাইরাল। আমার মনে হয় এতক্ষণে বাংলাদেশের সবাই ওই লাইভ দেখে ফেলেছে।”
“আমার সম্মানহানি যে করল তাকে কি এমনি এমনি ছেড়ে দিতে পারি আমি? তাছাড়া কেবলমাত্র সিরাতের জন্য আমার বাবা আমাকে তার সমস্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছে। আমার মেয়ের থেকেও আমাকে দূরে করে দিয়েছে। আজ আমি সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি তুরাগ। আমার জীবন থেকে যে মেয়েটা সবকিছু কেঁড়ে নিয়েছে তাকে আমি ছাড়ব না।”
“আচ্ছা শোন, আমাদের ঠাণ্ডা মা*থায় সবকিছু করতে হবে। সিরাত যেমন আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে, তেমনই তোর জীবনও নষ্ট করেছে। আমরা দু’জন মিলে ওকে ভয়া*নক মৃ*ত্যু দিব।”
একদিকে মাহতাব আর তুরাগ সিরাতের জন্য মৃ*ত্যুর নীলনকশা তৈরি করছে, অন্যদিকে নিমু হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ছক কষছে কীভাবে সিরাতের ক্ষতি করা যায়।
নিজের সাজানো সংসার ছেড়ে চলে আসার দুই দিন পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু নিজেকে এখনো স্বাভাবিক করতে পারেনি সিরাত। যতই হোক, নিজের হাতে গড়ে তোলা সংসার তো!
সিরাতের মন ভালো করার জন্য বন্ধুরা সবাই মিলে পরিকল্পনা করে ওকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য তারিনের বাসায় নিয়ে এসেছে। প্রথমে সে আসতেই চায়নি। কিন্তু সবার জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে ঘর থেকে বের হয়েছে সে।
সিরাতের চোখ হাত দিয়ে ঢেকে উর্মি একটা ঘরের সামনে এসে থামে। অতঃপর নকশিকে চোখের ইশারায় দরজা খুলতে বলে।
“কী শুরু করেছিস তোরা বল তো? আর কতক্ষণ এভাবে আমার চোখ ঢেকে রাখবি?”
“এইতো হাত সরিয়ে নিচ্ছি।”
উর্মি হাত সরালে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় সিরাত। সম্পূর্ণ ঘরটা বিভিন্ন রঙের বেলুন আর ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। মেঝের উপর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লেখা,
“নীলাদ্রির মুখে হাসি মানায়, বিষন্নতা নয়।”
টেবিলের উপর ফুল দিয়ে সাজানো একটা কেক রাখা। কেকের উপর গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
“তোর বন্ধুরা সব সময় তোর পাশে আছে রাত!”
এসব দেখে আপনাআপনি সিরাতের চোখে পানি চলে আসে। সবার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই ইভান তার দিকে একটা টিস্যু এগিয়ে দেয়।
“চোখের পানি মুছে নে। তোর চোখে পানি মানায় না। তোর চোখে তেজস্বী ভাবটাই মানায়।”
এক পলক ইভানের দিকে তাকিয়ে টিস্যু নিয়ে চোখের পানি মুছে নেয় সিরাত। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ভালোবাসি, তোদের ভীষণ ভালোবাসি আমি। সেই ছোট থেকে তোরা আমার পাশে আছিস। আমার ভালো সময়ে পাশে না থাকলেও খারাপ সময়ে আমার মনে সাহস যোগানোর জন্য তোরা সদা প্রস্তুত থাকিস। আমি কি সত্যিই এতটা ভাগ্যবতী? যে তোদের মতো বন্ধু পেয়েছি!”
অথৈ সিরাতের কাছে এসে তাকিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তোর মতো একজন মেয়ে আমাদের বন্ধু এটা তো আমাদের সৌভাগ্য রাত। তোর থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে দোস্ত।”
“শুধু তাই নয়। জানিস রাত? তোকে দেখে আমি প্রতিনিয়ত বাঁচার উৎসাহ পাই। আমার জীবনের গল্পটা ভীষণ জটিল। সেই জটিল গল্পে আমি আজও টিকে আছি তোকে দেখে।”
উর্মির কথায় অবাক হয় সবাই। সিরাত তার কাছে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে,
“কী হয়েছে তোর? তুই তো আগে এমন উদাসীন ছিলি না উর্মি। হঠাৎ করে কী এমন হলো যে তুই এতটা পরিবর্তন হয়ে গেলি?”
“আমার গল্পটা তোরা সবাই শুনবি?”
“হ্যা শুনব, বল তুই।”
তামান্নার কথায় টুপ করে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে উর্মির চোখ থেকে।
চলবে??