#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_১৮
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
“নিজের বাচ্চাকে শেষ করতে একবারও ভাবলে না তুমি? এরপরেও নিজেকে মানুষ হিসেবে এখনো পরিচয় দিতে লজ্জা করে না তোমার?”
সিরাতের কথায় চমকে ওঠে নিমু। ঠাণ্ডার মধ্যেও সে ঘামছে। তার এমন অবস্থা দেখে সিরাত একটা টিস্যু এগিয়ে দেয়।
“এই ঠাণ্ডার মাঝেও ঘামছ কেন? ভয় পাচ্ছ বুঝি আমাকে?”
“এসব কী বলছ তুমি? তোমাকে কেন ভয় পেতে যাব আমি? আর কোন বাচ্চার কথা বলছ তুমি হ্যা?”
“২০২১ সালের নভেম্বর মাসের তিন তারিখ তুমি তোমার অনাগত সন্তানকে হ*ত্যা করেছ। যে ডাক্তারের কাছে তুমি সেবা নিয়েছ সে নিজে আমাকে সবকিছু বলেছে। তুমি যখন তোমার প্রথম স্বামীর কাছ থেকে ডিভোর্স নিয়েছ তখন তুমি অন্তঃসত্ত্বা ছিলে। কিন্তু সেটা তোমার প্রাক্তন স্বামী জানত না। তার থেকে এত বড়ো সত্যিটা গোপন করে তুমি ডিভোর্স নিয়েছ। কি ঠিক বলছি তো?”
নিমুর শ্বাস নেওয়ার গতি মুহূর্তের মধ্যেই বেড়ে যায়। সিরাত দুই হাত দূর থেকেও যেন তার শ্বাস-প্রশ্বাস এর শব্দ শুনতে পায়। এই মুহূর্তে বাসায় নিমু আর সিরাত ছাড়া কেউ নেই। সকালেই নাবিহাকে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে সে৷ তুবা এসেছে নিয়ে গিয়েছে নাবিহাকে। মাহতাবকে রাফি ডেকে নিয়েছে ঘন্টা খানেক আগে৷ বাসায় রয়ে গিয়েছে কেবল সিরাত আর নিমু।
অনেক্ক্ষণ যাবত নিমুকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে সিরাত বলে,
“তোমার ছোট ভাইয়ের নাম তো নাফি তাই না?”
নিমুর যেন এখন জান যায় যায় অবস্থা হয়ে গিয়েছে। সে নিজ মনে ভাবছে,
“এই মেয়ে এসব জানল কীভাবে!”
নিমুর মনের কথাটা যেন বুঝতে পারে সিরাত। তাই নিজে থেকেই বলে,
“ভাবছ তো যে আমি এসব কীভাবে জানলাম? আসলে পাপ কখনো চাপা থাকে না৷ আমি তোমাকে তোমার বান্ধবীর সাথে কথা বলতে দেখে ফেলেছিলাম একদিন। সেদিন তোমার কথা শুনে আমার সন্দেহ হয়েছিল। তাই সুযোগ বুঝে আমি আমার এক বন্ধুর কাছে যাই তোমার বিষয়ে সবকিছু জানার জন্য। সে একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তাই তোমার বিষয়ে সবকিছু জানতে আমার খুব বেশি সময় লাগেনি। তোমার সমস্ত অতীত তো আমি অনেক আগেই জেনে গিয়েছিলাম। এতদিন চুপ করে শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে আজ সেই দিন এসেই গেল।”
আচানক নিমু সিরাতের দিকে তেড়ে আসে৷ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“আমার বিষয়ে এতকিছু জানতে তোমাকে কে বলেছে হ্যা? এত বেশি জেনে তুমি একদম ঠিক করোনি সিরাত। এবার তোমার জীবন নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যাবে।”
সিরাত হেসে পাল্টা প্রশ্ন করে,
“যে নিজের অনাগত সন্তানকে মা*রতে পারে সে চাইলে সবকিছুই করতে পারে। এই যে তুমি কিছুদিন আগে নাবিহার ক্ষতি করতে চেয়েছিলে। কী ভেবেছিলে? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারব না? আমার মেয়ে আমার পৃথিবী। তার কেউ ক্ষতি করতে চাইবে আর সেটা আমি মা হয়ে বুঝব না? এটা তো হতে পারে না তাই না? সেদিন ইচ্ছাকৃতভাবে তুমি আমার মেয়ের খাবারে অতিরিক্ত মাত্রায় ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলে কৌশলে। তো তোমাকে একটা কথা জানিয়ে রাখি। এই বাসার সর্বত্র গোপন ক্যামেরা লাগানো আছে। কাজটা আমিই করেছি। তাই এই বাসায় কখন কি হয় সবকিছু আমি ঘরে বসেই জানতে পারি। সেদিন ভাগ্যক্রমে আমার মেয়ে বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু তুমি চাইলেও বাঁচতে পারবে না!”
সিরাতের কথা বলার মাঝেই কলিংবেল বেজে ওঠে। সিরাত নিমুর কাছে এসে কানের কাছে ফিসফিস আওয়াজে বলে,
“তোমার জীবনের শেষ সময়ের গণনা শুরু করে দাও।”
কথাটা বলে সিরাত সদর দরজা খুলে দেয়। মাহতাবকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে সে কিছুই বলে না। পাশে রাফিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,
“ভেতরে আসুন আপনারা।”
এতক্ষণ যতটুকু শক্তি নিজের মাঝে অবশিষ্ট ছিল রাফিকে দেখে সেটুকু শক্তিও যেন বিলীন হয়ে যায় নিমুর। নিজের প্রাক্তন স্বামীকে দেখে দু’পা পিছিয়ে যায় সে।
রাফি কোনো কথা না বলে নিমুর কাছে গিয়ে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে নিমুর দুই গালে পরপর ছয়/সাতটা থা*প্পড় বসিয়ে দেয়। নিজেকে সামলাতে না পেরে নিমু মেঝের উপর পড়ে যায়৷ তার ঠোঁট কেটে অনর্গল র*ক্ত পড়ছে। রাফি পুনরায় তাকে আঘাত করতে গেলে সিরাত থামিয়ে দেয়।
“শান্ত হন। আগেই বলেছি উত্তেজিত হয়ে কিছু করবেন না। এতে ক্ষতি আপনারই হবে।”
সিরাতের কথা শুনে রাফি থেমে গেলেও মাহতাব থামে না। নিমুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বিধ্বস্ত গলায় প্রশ্ন করে,
“কেন করলে এমন? আমাকে কেন ঠকালে? আমি তোমার জন্য কী করিনি? সবকিছু করেছি তোমার সুখের জন্য। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেছি তোমার পেছনে। যতটা আমি সিরাতের জন্য গত পাঁচ বছরেও খরচ করিনি, তার চেয়েও বেশি বিগত দেড় বছরে তোমার জন্য খরচ করেছি। ভালোবাসা, সুখ, আভিজাত্য সবকিছু দিয়েছি তোমাকে। রাণী করে রেখেছি। আর সেই তুমি আমাকে এভাবে ঠকালে?”
নিমু কোনো উত্তর দিতে পারে না। চুপচাপ গালে হাত রেখে কাঁদতে থাকে। মাহতাব ধীরে ধীরে নিজের বেল্ট খুলে হাতে পেচিয়ে নেয় সযত্নে। অতঃপর চোখ বন্ধ করে বিরতিহীনভাবে নিমুর গায়ে একের পর এক আঘাত করে। নিমুর চিৎকারে কেঁপে ওঠে সিরাত। মাহতাবকে আজ প্রচন্ড অশান্ত লাগছে। বিয়ের এত বছরে এর আগে কখনো মাহতাবের এমন রূপ দেখেনি সিরাত। তার চোখে আজ ভয়ংকর রাগ দেখতে পাচ্ছে সে। কিন্তু এভাবে মা*রলে যেকোনো মুহূর্তে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিরাত মাহতাবের কাছে যায়।
“মাহতাব একটু শান্ত হও। এভাবে ওকে মে*রো না। মেয়েটা ম*রে যাবে মাহতাব৷ প্লিজ থামো তুমি।”
অনেক চেষ্টা করেও মাহতাবকে থামাতে পারে না সিরাত। শেষে বাধ্য হয়ে চিৎকার করে বলে,
“ওকে তিলে তিলে শেষ করার জন্য সব ব্যবস্থা আমি আগে থেকেই করে রেখেছি। এবার তো থেমে যাও!”
সিরাতের এমন কথা শুনে সত্যি সত্যিই থেমে যায় মাহতাব। বেল্ট দূরে ছুঁড়ে দিয়ে বলে,
“মানে? কী করেছ তুমি?”
“কেন? এখন থামলে কেন? কখন থেমে তোমাকে শান্ত হতে বলছি। কথা কানে যায় না তাই না?”
মাহতাব সিরাতের দুই বাহু ঝাঁকিয়ে বলে,
“কী করেছ তুমি ওর সাথে?”
সিরাত কিছু বলে না। নিমু মেঝের উপর শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। সেদিকে কারোর ধ্যান নেই। মাহতাব, রাফি দু’জনের ধ্যান এখন সিরাতের দিকে। তাদের দু’জনকে অপলক দৃষ্টিতে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সিরাত বলে,
“আমাকে যতটা শান্তশিষ্ট এবং ভালো মেয়ে মনে হয় আমি ততটা ভালো মেয়ে নই। ছোট থেকেই আমি ভীষণ জেদি। চোখের সামনে অন্যায় হলে মেনে নিতে পারি না আমি। নিমু আমার সাথে যা করেছে সেইসব চুপচাপ মেনে নেওয়া আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিল না। নিমু শুধু আমার সংসার ভাঙেনি। ওই মেয়ে আমার সন্তানকে মা*রার চেষ্টা করেছে। ওর পরিকল্পনা অনেক গভীর ছিল। শেখ পরিবারের মালকিন হতে চেয়েছিল সে। কিন্তু বেচারি হয়তো জানত না বাপেরও বাপ থাকে। আমি তার থেকে দুই কাঠি উপরে চলি এটা সে বুঝতেই পারেনি। যেদিন দেখলাম আমার সন্তানকে মা*রার জন্য সে প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ওকে আমি শান্তিতে বাঁচতে দিব না। আর তাই!”
“আর তাই?”
“বাংলাদেশে থেকে অপরাধীর যোগ্য শাস্তি নিজের চোখে দেখাটা স্বপ্ন হয়েই রয়ে যাবে। তাই আমি আইনের উপরেও আস্থা রাখতে পারিনি। আমি হয়তো চাইলে অনেক কিছু করতে পারতাম। কিন্তু আমার মতো একই অবস্থায় হাজারো মেয়ে আছে। সবার এত ক্ষমতা নেই। তাই বলে কি তারা তাদের অন্যায়কারীদের শাস্তি দিতে পারবে না? অবশ্যই পারবে। আজ আমার মতো একজন সিরাত জন্ম নিয়েছে। আগামীকাল যেন আমার মতো আরো দশজন সিরাত জন্ম নেয় সেটাই চাই আমি। বাকি গল্পটা না-হয় পুরো দেশবাসী জানুক!”
নিজের ফোন বের করে ফেসবুকে গিয়ে লাইভ চালু করে সিরাত।
চলবে??