#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_১৭
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
“মিস্টার মাহতাব শাহরিয়ার শেখ আপনাকে এই মুহূর্তে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে।”
ঘুম থেকে উঠে বাসায় পুলিশকে দেখে যে অবাক মাহতাব হয়েছিল তার ঘোর কাটার আগেই নতুন করে অবাক হলো সে।
“আমাকে থানায় যেতে হবে? কিন্তু কেন? কী অপরাধ আমার?”
“আপনার নামে ফাইয়াজ রাহমান কেস করেছেন। বাকি কথা থানায় গিয়ে হবে। চলুন আমাদের সাথে।”
“কিন্তু অফিসার আমি কী করেছি? সেটা তো বলুন।”
“এত কথা আমরা এখানে বলতে পারব না। আপনি আমাদের সাথে থানায় চলুন। বাকি কথা ওখানেই জানতে পারবেন।”
মাহতাব আর কিছু বলতে পারে না। মাঝে নিমু এসে অনেক কিছু বললেও কোনো কাজ হয় না। পুলিশ জোর করে মাহতাবকে ধরে নিয়ে যায়।
সিরাত দূর থেকে সব দেখে মুচকি হাসে। নিমু মন খারাপ করে সোফায় বসে পড়ে।
থানায় গিয়ে মিস্টার ফাইয়াজ রাহমানকে বসে থাকতে দেখে মাহতাব দ্রুত বলে ওঠে,
“মিস্টার রাহমান এসবের মানে কী? আপনি কেন আমার নামে থানায় অভিযোগ করেছেন?”
“আপনার জন্য আমার কোম্পানির দশ লক্ষ টাকা লস হয়েছে। অর্ডার নিয়েও যথাসময়ে আপনি ডেলিভারি করেননি। আমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েও এমন করার কারণে আপনার নামে আমি কেস করতে বাধ্য হয়েছি।”
“আপনার ম্যানেজার নিজে কল করে আমাকে ডেলিভারি দিতে মানা করেছে। লস তো হয়েছে আমার।”
“মিথ্যা বলছেন আপনি। আমার ম্যানেজার আপনাকে কল করে এসব বলেছে তার কোনো প্রমান আছে আপনার কাছে?”
“আমার ফোনে সব রেকর্ড করা আছে। এখনই দেখাচ্ছি আপনাকে।”
কথাটা বলে ফোন বের করে সবগুলো কল রেকর্ড চেইক করেও মিস্টার তৌহিদের সাথে কথা বলার রেকর্ড খুঁজে পায় না মাহতাব। হতাশ হয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়ে সে।
“আমার ফোনে কল রেকর্ড ছিল। এখন খুঁজে পাচ্ছি না।”
“যে কথা হয়ইনি তার রেকর্ড পাবেন কীভাবে?”
“আমি মিথ্যা বলছি না। আপনারা ইচ্ছা করে আমাকে ফাঁসাচ্ছেন!”
“আপনার মতো সাধারণ একজনকে ফাঁসিয়ে আমার লাভ কী? এসব কথা বন্ধ করুন৷ হয় আমার দশ লক্ষ টাকা আমাকে ফেরত দিন, নতুবা আপনাকে জেলে যেতে হবে।”
“মিস্টার ফাইয়াজ রাহমান ঠিকই বলেছে। আপনার কাছে এখন এই দুইটা উপায় আছে। যেকোনো একটা করতে হবে।”
পুলিশের কথা শুনে ঘাবড়ে যায় মাহতাব৷ এমনিতেই তার সময় খারাপ যাচ্ছে। ব্যবসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে দশ লক্ষ টাকা জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব তার কাছে।
“কী হলো? চুপ করে আছেন কেন আপনি? টাকা ফেরত দেবেন নাকি জেলে যাবেন?”
“আচ্ছা আমাকে সাত দিন সময় দিন। আমি কথা দিচ্ছি এর মধ্যে আপনার সব টাকা আমি দিয়ে দিব।”
“মুখের কথায় তো আমি আপনাকে বিশ্বাস করব না।”
ফাইয়াজ রাহমান একটা কাগজ বের করে মাহতাবের সামনে রেখে বলে,
“এখানে সই করে দিন। সাত দিনের মধ্যে যদি আপনি দশ লক্ষ টাকা আমাকে না দেন তাহলে আমি আপনার বিরুদ্ধে লিগ্যাল অ্যাকশন নিতে বাধ্য হব।”
মাহতাব ভয়ে ভয়ে কাগজে সই করে দেয়। সে এখন সবদিক থেকে ফেঁসে গিয়েছে। যেদিকেই যাক না কেন, বিপদ তার পিছু ছাড়বে না এখন!
বাসায় ফিরে কারোর সাথে কোনো কথা না বলে ঘরে গিয়ে চুপচাপ দরজা লাগিয়ে দেয় মাহতাব। সিরাত কলে ফাইয়াজ রাহমানকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে।
নাবিহাকে কোলে নিয়ে একটা রেস্তোরাঁয় বসে আছে সিরাত। বিশেষ একজনের জন্য সে এখানে অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর কাঙ্খিত মানুষটিকে আসতে দেখে হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে।
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আপনিই সিরাত?”
“জি আমিই সিরাত। বসুন প্লিজ।”
দু’জন মুখোমুখি বসে পড়ে। সিরাত তাদের জন্য দুই কাপ কফি আর একটা মিল্কশেক অর্ডার দেয় নাবিহার জন্য।
“মিস্টার রাফি, সরাসরি কাজের কথায় আসি আমরা?”
“জি অবশ্যই। আমাকে আগে বলুন তো, আপনি নিমুকে কীভাবে চেনেন?”
“সেই প্রশ্নের উত্তর পরে জানাব আপনাকে। আগে আপনি বলুন, নিমুর সাথে আপনার সম্পর্ক কী?”
“আমাদের বিষয়ে না জেনে নিশ্চয় আপনি আমার সাথে দেখা করতে আসেননি?”
“আমি সবকিছুই জানি। কিন্তু আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।”
“নিমু আমার প্রাক্তন স্ত্রী।”
“পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিল আপনাদের?”
“না, আমরা দু’জন একে-অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম।”
“কতদিনের সম্পর্ক ছিল আপনাদের?”
“প্রেম আর বিয়ে মিলিয়ে এক বছর নয় মাসের সম্পর্ক ছিল।”
“আপনাদের বিবাহবিচ্ছেদ কেন হলো?”
“নিমুর ভাষ্যমতে আমি শারীরিকভাবে অক্ষম৷ তাই সে আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে।”
“সে ডিভোর্স চাইল আর আপনি ডিভোর্স দিয়ে দিলেন?”
“না দিয়ে উপায় ছিল না। এসব নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু আপনি এতকিছু জানতে চাইছেন কেন?”
“কারণ নিমু আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী!”
সিরাতের কথা শুনে রাফি চমকে ওঠে। তার এমন চাহুনি দেখে সিরাত বলে,
“চার মাস হয়ে গেল আমার জীবনে এক ফোঁটা শান্তি নেই। এই চার মাসে একটা দিনও আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। ওই মেয়েকে একা দোষ দিব না আমি। আমার স্বামী না চাইলে সে কিছুই করতে পারত না৷ এক হাতে তো আর তালি বাজে না। কিন্তু নিমু মাহতাবের কাছে যে পরিচয় দিয়ে বিয়ে করেছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। সে নিজের অতীত লুকিয়ে মাহতাবকে বিয়ে করেছে। আমি এসব কিছুই জানতে পারতাম না যদি না নিমুর বিষয়ে খোঁজ নিতাম। শুরু থেকেই ওই মেয়ের উপর সন্দেহ ছিল আমার। আর আজ সব সন্দেহ দূর হয়ে গেল।”
“নিমু আমাকে কখনোই ভালোবাসেনি। কেবল আমার অর্থ দেখে আমাকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু করোনার সময় আমি চাকরি হারাই। আমার সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছিল ওই সময়। তখনই সে হাজার রকমের বাহানা দেখিয়ে আমার থেকে দূরে সরে গেল।”
“আপনি হয়তো ওর বিষয়ে আরো একটা কথা জানেন না যেটা আপনার জানা জরুরি।”
“কী কথা?”
“নিমু যখন আপনাকে ডিভোর্স দেয় তখন সে দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। সে বাচ্চা চায়নি। বাচ্চা হলে আপনার সাথে ওর বিবাহবিচ্ছেদ হতো না। তাই সে বাচ্চাকে নষ্ট করে ফেলে। তার প্রমাণ আমার কাছে আছে।”
সিরাতের কথাটা যেন রাফি মেনে নিতে পারে না। তার মুখ থেকে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। রাফিকে হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে দেখে সিরাত তাকে এক গ্লাস পনি এগিয়ে দিয়ে বলে,
“ঠিক আছেন আপনি? প্লিজ শান্ত হন। এখন রাগ করার সময় নয়। আমাদের ঠাণ্ডা মা*থায় ওদের শাস্তি দিতে হবে। রাগ করলে আপনারই ক্ষতি হবে। আপনার সাথে যে মানুষটা অন্যায় করেছে সে কিন্তু দিব্যি ভালো থাকবে। তাই যা করবেন ভেবেচিন্তে করুন।”
ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নেয় রাফি। রাগে তার মস্তিষ্ক কাজ করছে না।
“আমি ওই মেয়েকে ছাড়ব না। প্রথমে আমার জীবন নষ্ট করেছে। আর তারপর আমার নিষ্পাপ বাচ্চাটা দুনিয়ার আলো দেখার আগেই তাকে মে*রে ফেলল!”
“আপনি এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না তাই না?”
“না, আমি কিচ্ছু জানতাম না। আমার বাচ্চা ওর গর্ভে বড়ো হয়ে উঠছিল আর আমি সেটা কখনো জানতেই পারিনি। জানলে হয়তো আমার বাচ্চাকে আমি এভাবে শেষ হতে দিতাম না!”
কথাটা বলে বাচ্চাদের মতো কেঁদে ওঠে রাফি। সিরাত তাকে স্বান্তনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। একজন মা কীভাবে তার সন্তানকে শেষ করতে পারে সেটা বুঝে উঠতে পারে না সে!
“আমি বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা। কিন্তু এই মুহূর্তে ভেঙে পড়া কোনো সমাধান নয়। আমিও এক বাচ্চার মা। বাচ্চা হারানোর কষ্ট কেমন হতে পারে সেটা অনুভব করতে পারি আমি। নিমুর মতো মেয়েরা কেবল টাকা আর আভিজাত্য বোঝে। আমি নিশ্চিত, আমার স্বামী ওর এসব বিষয় জানে না। জানলে কখনোই ওকে বিয়ে করত না। তাই ওই মেয়ে যা যা অন্যায় করেছে তার জন্য মারাত্মক শাস্তি প্রাপ্য ওর!”
চলবে??