#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_১২
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
“সিরাত তোমার সমস্যা কোথায় বলো তো? তুমি নাবিহাকে নিয়ে বের হয়েছ ভালো কথা। কিন্তু আমাকে আর নিমুকে ঘরের মধ্যে রেখে সদর দরজায় তালা লাগিয়ে বাসার পানির লাইন, ইলেক্ট্রিসিটির লাইন সব বন্ধ করে দিয়েছ কেন?”
ফোনের ওপাশ থেকে মাহতাবের বিরক্তিতে ভরা কণ্ঠস্বর শুনে সিরাত বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দেয়,
“এপার্টমেন্ট এর সবাই জানে বাসায় কেউ নেই এখন। এজন্য তালা দিয়ে এসেছি।”
“বাসায় কেউ নেই মানে? আমরা তো বাসায় আছি।”
“এটা তো সবাই জানে না। শোনো, এখন যদি তুমি চিৎকার করো কিংবা দরজায় শব্দ করো তাহলে সবাই জেনে যাবে ভেতরে তোমার সাথে নিমু আছে। নিমু আমাদের আত্মীয় এটাই জানে সবাই। এখন সব সত্যি জানলে কী হবে জানো তো? তাছাড়া তুমি সবাইকে উল্টাপাল্টা বুঝ দিতে পারবে না। কারণ যা রটে তার কিছু তো বটে। এই প্রবাদ বাক্য শুনেছ তো?”
“এসবের কোনো মানে হয় সিরাত? তুমি কেন এমন করছ?”
“ভালো কাজই তো করেছি। তোমাদের রোমান্স করার সুযোগ দিলাম। আমি আর আমার মেয়ে বাসায় নেই। এই সুযোগে যদি তোমরা আমাদের বিপদে ফেলার জন্য কিছু করো তখন কী হবে? তোমাদের একটুও বিশ্বাস নেই। তাই এটা করতে হলো আমাকে।”
“সারাদিন আমরা না খেয়ে থাকব?”
“একদিন না খেলে কেউ ওপরে চলে যায় না। তাই এত ন্যাকামি করার কিছু নেই। চুপচাপ বসে থাকো। আমাদের ফিরতে রাত হবে। আর হ্যা, বারবার কল দিয়ে বিরক্ত করবে না আমাকে।”
কল কেটে দেয় সিরাত। তার মুখে শয়তানি হাসি বিরাজ করছে এখন।
“সবে তো শুরু। এখনো অনেক কিছু দেখা বাকি তোমাদের। আর কয়েকটা দিনের অপেক্ষা। তারপর তোমাদের ভালো থাকার দিন শেষ!”
আপনমনে কথাগুলো বলে নাবিহার কাছে যায় সিরাত। মাওয়ার কোলে বসে খেলছে নাবিহা। এটা দেখে সিরাত মাওয়ার পাশে বসে বলে,
“বাচ্চাদের ভালোই সামলাতে পারিস মনে হচ্ছে। তা তুই বাচ্চা নিবি কবে?”
“এখনো বিয়েই করলাম না। আর তুই আছিস বাচ্চা নিয়ে।”
“বিয়ে করিসনি মানে?”
“এত অবাক হচ্ছিস কেন?”
“তোর আর ইভানের কাহিনি ভুলে গেলি? তোদের দু’জনের ঝামেলার জন্য আমি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েও আমি ভর্তি হই ড্যাফোডিল এ। এরমাঝে আমার বিয়ে হয়ে যায় মাহতাবের সাথে। বিয়ের পর আমি সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। আর তোদের সাথে যোগাযোগও বন্ধ করে দিলাম। পরপর দু’টো ঝামেলার কারণে সবাই আমাকে ভুল বুঝল। বিশেষ করে অভি আর ইভান!”
“আমি বিয়ে করিনি রাত। আমার সাথে যা হয়েছে তারপর ওকে বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। আমি তোদের থেকে দূরে চলে গিয়েছিলাম ঠিকই, তবে বিয়ের জন্য নয়। আমাকে বাবা বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। চাইলেও তোদের কারোর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি আমি।”
“অভিকে সব বলেছিস?”
“না বলিনি। আর তুইও বলবি না।”
“কেন মাওয়া? তুই তো সব জানিস। অভি আজও আমায় ভুল বুঝে যাচ্ছে। যে ছেলেটা সবসময় আমার পাশে থেকেছে, আমাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করেছে আজ সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে চারটে ভালো কথা বলে না। আমাকে দেখলেই যেন ওর ভেতরে ঝড় বয়ে যায়। ওর অভিযোগের দৃষ্টি আমি নিতে পারি না। কষ্ট হয় আমার।”
“অভি তো জানে না যে আমি সব জানি। ওকে ওর মতো থাকতে দে। পুরোনো কথা টেনে কষ্ট পাওয়ার দরকার নেই।”
“চিঠিটা কবে পেয়েছিলি তুই?”
“বাইরে চলে যাওয়ার পর পেয়েছিলাম।”
“দেরিতে হলেও তো পেয়েছিলি। আর কারোর সাথে না হোক, একটা বার অভির সাথে যোগাযোগ করতে পারতি।”
“ইচ্ছে হয়নি।”
“মাওয়া!”
মাওয়া মলিন হাসে। সিরাত আর কিছু না বলে নাবিহাকে নিয়ে অন্য পাশে সরে যায়। পেছন থেকে অভি ডেকে বলে,
“তুই আমাকে যে কাজ দিয়েছিলি সেটা হয়ে গিয়েছে।”
“সব খোঁজখবর পেয়েছিস?”
“হ্যা, এই খামের ভেতরে সব আছে। দেখে নিস।”
সিরাত খাম নিয়ে ব্যাগের ভেতর রেখে অভিকে ডাক দেয়।
“অভি আজও ভুল বুঝে মুখ ফিরিয়ে রাখবি ভাই? কথা বলবি না আমার সাথে?”
“ভুল বোঝার তো কিছু নেই। বরং যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। এতদিন পর সবাই একসাথে হয়েছি। পুরোনো কথা ভেবে মন খারাপ করিস না।”
সিরাত বলার মতো আর কিছু পায় না। তিক্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সবার মাঝে মিলিয়ে যায়। আসার পর থেকে ইভান ঠিকভাবে একবারও সিরাতের দিকে তাকায়নি। শুধু নাবিহাকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলেছিল।
রাত আটটা বাজার সাথে সাথে সিরাত সবার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“আমার এখন যেতে হবে। বাচ্চাকে নিয়ে বেশি রাত অবধি বাইরে থাকি না আমি। আবার সবার সাথে দেখা হবে৷ আজকের মতো আমাকে বিদায় দে তোরা।”
নকশি সিরাতের কাছে এসে বলে,
“এখনই চলে যাবি? আর একটু থাক না।”
“না রে, আজ আর থাকতে পারব না। সবার সাথে দেখা হলো তো। আবার দেখা হবে আমাদের। চিন্তা করিস না। বাকি কথা পরে হবে। আজ আসি।”
“আচ্ছা আমি এগিয়ে দিয়ে আসি চল।”
নাবিল নাবিহাকে কোলে নিলে সিরাত সবার থেকে বিদায় নিয়ে নেয়। তারপর বেরিয়ে যায় নাবিলের সাথে। রাস্তায় নাবিলকে প্রশ্ন করে,
“অথৈ এর সাথে সব ঠিক করা যায় না?”
“আমি অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে আমার সাথে কথা বলতে নারাজ।”
“তোকে আমি একবার একটা কথা বলেছিলাম। মনে আছে তোর?”
“কোন কথা?”
“মেয়েদের ভালোবাসা খুব তীব্র হয়। কিন্তু তার থেকেও বেশি তীব্র হয় ঘৃণা। মেয়েরা শত অবহেলার পরেও থেকে যায় বলে তাদের বারংবার কষ্ট দেওয়া বোকামি। কারণ তারা একবার মুখ ফিরিয়ে নিলে তাদের আর ফেরানো যায় না!”
“হুম মনে আছে।”
“আমার কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল তো?”
“এতগুলো বছর পেরিয়ে গেল। অথৈ না তো আমার সাথে সব ঠিক করল। আর না তো অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হলো।”
“এতদিনেও যখন বিয়ে করেনি তখন শেষ একটা চেষ্টা কর।”
“আমি কীভাবে কী করব? কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। ওকে না পেয়ে আমিও ভালো নেই রাত। কিন্তু সেটা ওকে কে বোঝাবে?”
“আমি বোঝাব, আমরা সকলে মিলে ওকে বোঝাব। আপাতত তুই ফিরে যা। গাড়ি পেয়ে গিয়েছি। আমরা আসি।”
“সাবধানে যা। আর গিয়ে একটা কল দিস।”
“আচ্ছা।”
বড়ো রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে নাবিল ভাবে,
“তোর কথার গুরুত্ব আরো আগে দিলে হয়তো আজ আমরা আলাদা হতাম না রাত। বড্ড ভুল করে ফেলেছি আমি!”
বাসায় ফিরতে প্রায় নয়টা বেজে যায় সিরাতের। দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই ইলেক্ট্রিসিটি চলে আসে। একইসাথে পানির লাইনও চলে আসে। সকাল থেকে না খেয়ে থেকে মাহতাব আর নিমুর চোখমুখ শুকিয়ে গিয়েছে। সিরাত দু’জনের এমন চেহারা দেখে ভীষণ মজা পায়। মজার ছলে বলে,
“আহারে এ কি অবস্থা তোমাদের! সকাল থেকে কিছু খাওনি তোমরা?”
মাহতাব রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,
“মজা নেওয়া বন্ধ করো। সব সময় এসব ভালো লাগে না। আমাদের সাথে কেন এমন করছ তুমি? একটু তো ভালো থাকতে দাও আমাদের।”
“ভালো থাকতেই তো দিয়েছি। আর কত ভালো থাকতে চাও?”
“এটাকে ভালো থাকা বলে? প্রতিদিন একটা না একটা ঝামেলা করছ। তুমি কী বাচ্চা?”
“এখন এত কথা না বলে গোসল করতে যাও তোমরা। প্রতিদিন গোসল করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।”
নিমু এতক্ষণ চুপচাপ সবকিছু দেখছিল। মাহতাবের সাথে উঠে চলে যাওয়ার সময় সিরাতের দিকে রাগী চোখ নিয়ে তাকালে সিরাত হেসে বলে,
“যাও যাও তাড়াতাড়ি গোসল করে এসো। তোমার শরীর থেকে কেমন বিদঘুটে গন্ধ বের হচ্ছে।”
কথাটা বলে নাকে হাত দিয়ে সিরাত নিজের ঘরে চলে যায়। পেছন ফিরে না তাকিয়েও সে বুঝতে পারে, নিমুর চোখমুখ রাগে লাল হয়ে আছে।
চলবে??