#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_১১
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে চার/পাঁচজন ছেলেকে ইচ্ছামত মা*রছে সিরাত। রাগে তার পুরো মুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। পাশে একটা মেয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
“মেয়েদের দেখলেই জ্বালাতন করতে মন চায় তাই না? আজ তোদের সব শখ আমি মিটিয়ে দেব। পরিবার থেকে কোনো সুশিক্ষা পাসনি তাই না? নিজের মা, বোনের সাথেও এমন করিস? বোনের হাত ধরে বলিস, তোকে অনেক হ*ট লাগছে? কাছে টানতে ইচ্ছা করছে? বলিস না তো। তাহলে অন্যের বোনের দিকে কুনজর দিস কোন জ্ঞানে?”
আচমকা একজন সিরাতের হাত ধরে ফেলে। একজন ছেলের শক্তির সাথে সিরাত আর পেরে উঠছে না। সমস্ত শক্তি যেন শেষ হয়ে গিয়েছে এতক্ষণ যাবত ম*রামা*রি করে। হাতে ব্যথা অনুভব করে চোখ বন্ধ করে নেয় সিরাত।
“অনেকক্ষণ ধরে তোর বাড়াবাড়ি দেখছি। তুই একা আমাদের কুপোকাত করবি? এত সহজ নাকি? আগে তো শুধু ওই মেয়েকে ধরেছিলাম। এখন তোকেও নিয়ে যাব। চল আমাদের সাথে।”
সিরাত শত চেষ্টা করেও হাত ছাড়াতে পারে না। তার হুডির পকেটে সে সবসময় কিছু সেইফটি পিন রাখে। কায়দা করে অন্য হাতে সেই পিন বের করে ছেলেটার হাতে গেঁথে দেয়। ব্যথায় চিৎকার করে ওঠে সেই ছেলে।
“তোর এত বড়ো সাহস আমাদের সাথে লাগতে আসিস। এই তোরা ধর তো এটাকে।”
কথাটা বলে অন্য একজন সিরাতের কাছে এসে তার গায়ে হাত তুলতে গেলে পেছন থেকে কেউ সজোরে লাথি দেয় তার পিঠে। তার পেছন থেকে বেরিয়ে আসে অভি। সিরাত দু’জনকে দেখে দেহে প্রাণ ফিরে পায়। শক্তি ফিরে পায় শরীরে। আগন্তুক মেয়ের কাছে গিয়ে বলে,
“তোমাকে যারা যারা বাজে ভাষায় বাজে ইঙ্গিত দিয়েছে প্রত্যেককে নিজ হাতে শাস্তি দেবে তুমি। চলো আমার সাথে।”
ইতোমধ্যেই ছেলেগুলোর অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে অভি আর তার বন্ধু মিলে। সিরাত মেয়েটাকে সামনে এনে ব্যাগ থেকে স্টিলের স্কেল বের করে তার হাতে দিয়ে বলে,
“শুরু করো।”
মেয়েটা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সিরাতের দিকে। অতঃপর চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভেবে ইচ্ছামতো স্কেল দিয়ে আঘাত করে ছেলেগুলোর শরীরে। একদিকে ছেলেগুলোর চিৎকার অন্যদিকে উৎসুক জনগণের ভীড়। সবকিছু মিলিয়ে পরিবেশটা অন্যরকম হয়ে গিয়েছে।
নিজের রাগ মিটিয়ে মেয়েটা সিরাতকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। কৃতজ্ঞতার সুরে বলে,
“ধন্যবাদ আপু। এখানে এতজন থাকা সত্ত্বেও কেউ প্রতিবাদ করেনি। কেবল আপনিই এগিয়ে এসেছেন। আপনার এই উপকার আমি কখনো ভুলব না।”
“কান্না বন্ধ করো। তুমি কেন কাঁদছ? যারা অন্যায় করেছে তারা কাঁদবে। একটা কথা মনে রাখবে, নিজেকে কখনো দুর্বল ভাববে না। তুমি নারী, তুমি নিজেকে বাঁচানোর ক্ষমতা নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রেখেছ। যেকোনো পরিস্থিতিতে ভয় না পেয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে জানতে হবে। আজ যেমন ভয় পেয়ে জড়োসড়ো হয়ে ছিলে এমনটা আর কখনো করবে না। নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত প্রতিবাদ করবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে।”
“আপনার কথাগুলো আমি মনে রাখব আপু।”
“আচ্ছা নাম কী তোমার?”
“পুষ্প।”
সিরাত পুষ্পকে পাশে রেখে আশেপাশের মানুষজনের দিকে তাকিয়ে কঠোর কণ্ঠে বলে,
“বিনা টিকেটে সার্কাস দেখা শেষ? ভিডিয়ো করেছেন তো অনেকেই। এসব ভিডিয়ো অনলাইনে কী ক্যাপশন দিয়ে ছাড়বেন? একজন মেয়ের এমনই হওয়া উচিত। এভাবেই প্রতিবাদ করা উচিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এসবই লিখবেন তো? নাকি একজন মেয়ে কতটা উশৃংখল হলে ছেলেদের সাথে এভাবে মা*রামা*রি করতে পারে সেটা দেখুন আপনারা, এমন ক্যাপশন দিবেন? না মানে আপনাদের যোগ্যতা তো এটুকুই। আপনারা বিনা আমন্ত্রণে সার্কাস দেখতে চলে আসেন। কিন্তু প্রতিবাদ করার সময় হয়ে যান ভেজা বিড়াল। এই যে এখানে এতজন ছেলে আছেন, প্রত্যেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু এই অসভ্য ছেলেগুলোর অসভ্যতামি দেখলেন। একজনেরও সাহস হলো না প্রতিবাদ করার। এমন মেরুদণ্ডহীন কা*পুরুষ হওয়ার থেকে আপনাদের জন্ম না হলেই বোধহয় ভালো হতো তাই না?”
সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে রাগে শরীর কাঁপে সিরাতের। অভি তার কাছে এসে বলে,
“শান্ত হ, এখানে আর কোনো ঝামেলা করিস না। পুলিশ আসছে। এবার যা করার ওরা করবে। তুই আমাদের সাথে চল।”
“একটু দাঁড়া।”
পায়ে ব্যথা লাগায় হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে সিরাতের। তবুও পুষ্পর কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বলে,
“একা বাড়ি যেতে পারবে তো?”
“হ্যা পারব। সামনের দুইটা মোড় পার হলেই আমার হোস্টেল।”
“হোস্টেলে থাকো তুমি?”
“হ্যা।”
“আচ্ছা সাবধানে চলাফেরা করবে। তুমি প্রথম বর্ষে পড়ো তাই না?”
“হ্যা আপু।”
“আমাকে আপু ডাকতে হবে না। আমি তোমার সমবয়সী।”
সিরাতের কথা শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে পুষ্প। এই অবাক হওয়ার কারণ সিরাত জানে। তাই মুচকি হেসে বলে,
“এভাবে তাকাতে হবে না। যাও হোস্টেলে ফিরে যাও।”
ধীরে ধীরে রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়। অভি সিরাতের কাছে এসে বলে,
“এখন তুই বাড়িতে চল।”
“আমি না ঠিকমতো হাঁটতে পারছি না। ডান পায়ে খুব ব্যথা করছে।”
কথাটা বলা শেষ হওয়ার আগেই তৎক্ষনাৎ একজন সিরাতকে কোলে তুলে নেয়।
“আরে ইভান, কী করছিস তুই? নামিয়ে দে আমাকে।”
“একদম চুপ করে থাকবি। রোমান্স করার জন্য কোলে তুলে নেইনি তোকে। হাঁটতে পারছিস না। তাই বাধ্য হয়ে তোকে স্পর্শ করতে হলো। নয়তো কখনেই তোকে স্পর্শ করতাম না।”
এতক্ষণ যাবত স্মৃতিচারণ করছিল সিরাত। সেদিন প্রথমবারের মতো কোনো ছেলে তাকে স্পর্শ করেছিল। ভেতরে সংকোচবোধ থাকলেও সেদিন সিরাত ইভানকে কিছুই বলেনি। কারণ সে জানত, ইভান কখনো তার অসম্মান করবে না। বিয়ের আগে সেই স্পর্শ ছিল সিরাতের জীবনে প্রথম এবং শেষ স্পর্শ। ঘটনার প্রায় ছয় বছর পার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজও সিরাত কিছুই ভুলতে পারেনি।
“ভালো আছিস?”
পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠে সিরাত। এতদিন পর সেই মানুষটার কণ্ঠ শুনে পেছন ফিরে তাকায় সে। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে,
“ইভান!”
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে তাকিয়েও কোনো এক অজানা কারণে চোখ সরিয়ে নেয় সিরাত। স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দেয়,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?”
“সব সময় যেমন থাকি। বিন্দাস!”
“একাই এসেছিস? নাকি পরিবারসহ?”
“তুই হয়তো রুলস ভুলে গিয়েছিস। আজ এখানে শুধুমাত্র বন্ধুদের ডাকা হয়েছে। তাদের পরিবারসহ ডাকা হয়নি।”
“ওহ্ হ্যা মনে ছিল না।”
“এত তাড়াতাড়ি বুড়ি হয়ে গেলি?”
“স্মৃতিশক্তি কমে গিয়েছে। এত স্মৃতি মনে রেখে কী হবে বল?”
দু’জনের কথার মাঝে একজন দৌড়ে এসে সিরাতকে জড়িয়ে ধরে।
“দোস্ত কেমন আছিস তুই? জানিস তোকে আমি অনেক মিস করেছি। অবশেষে তোর সাথে আবার দেখা হলো আমার।”
সিরাত হাসিমুখে বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমি খুব করে চাইছিলাম যেন আজ তোর সাথে দেখা হয় আমার। তোর সাথে আমার দেখা হওয়াটা ভীষণ জরুরি ছিল মাওয়া।”
পুরোনো বন্ধুদের ফিরে পেয়ে প্রত্যেকের মুখেই আজ তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেছে। এগারো জন বন্ধু আজ আবার এক হয়েছে। একে একে প্রত্যেকে এক জায়গায় এসে দাঁড়ায়। অতঃপর স্ক্রিনে বড়ো করে ভেসে ওঠে একটা ভিডিয়ো। সাথে ভেসে আসে সিরাতের কণ্ঠস্বর।
“ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ, সময়টা ২০১৩ সাল। জেএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ভর্তি হলাম রেটিনায়। পড়াশোনা করতে এসে পরিচয় হলো একঝাঁক নতুন মুখের সাথে। একেকজনের একেকরকম ব্যক্তিত্ব। কেউ হাসিখুশি তো কেউ গম্ভীর। কেউ চঞ্চল তো কেউ শান্ত। নয়জন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হয় আমার এবং মাওয়ার। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে আমাদের মাঝে। সে কি শক্ত বন্ধন আমাদের! মাত্র কয়েক মাসে আমরা সবাই হয়ে উঠি একে-অপরের জানের জান দোস্ত। আমি আর মাওয়া তখন ভিন্ন স্কুলের বাসিন্দা। ফলস্বরূপ তাদের থেকে আলাদা হওয়ার ভয় কাজ করা শুরু করল মনে। দু’জনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম ওদের স্কুলে ভর্তি হব। এরমাঝে জেএসসি পরীক্ষা হয়ে গেল। পরীক্ষার পর সবাই মিলে একসাথে মিলিত হলাম ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে। সেই দিনকেই আমাদের বন্ধুমহলের জন্মদিন হিসেবে ঘোষণা করলাম আমরা। সিরাত, তারিন, মাওয়া, উর্মি, নকশি, তামান্না, অথৈ, নাবিল, ইভান, অভি, ফারহান, এই এগারো জনের সংমিশ্রণে তৈরি হওয়া বন্ধুমহলের আমরা নাম দিলাম ওয়ার্ল্ড অফ স্টার!
দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল ওয়ার্ল্ড অফ স্টার এর দশ বছর। এই দশ বছরে সবার জীবনের গল্প পাল্টেছে। তবে পাল্টায়নি শুধু আমাদের বন্ধুমহলের গল্প। আমরা বড়ো হয়ে গিয়েছি ঠিকই, তবে আমাদের বন্ধুত্ব আজও টিকে আছে। অস্তিত্বের লড়াইয়ে টিকে আছে ওয়ার্ল্ড অফ স্টার এর গল্প।”
চলবে??