#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_১০
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
মাঝরাতে কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সিরাত। ঘড়ির কাঁটায় জানান দিচ্ছে, রাত একটা ছুঁই ছুঁই। এমন সময় কে কলিংবেল বাজাচ্ছে সেটা বোধগম্য হয় না সিরাতের। এক পা, দুই পা করে এগিয়ে দরজা খুলে মাহতাবকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে ভ্রূদ্বয় সংকুচিত হয়ে আসে তার।
“তুমি ড্রিংক করেছ মাহতাব?”
মাহতাবের চোখগুলো ভীষণ লাল হয়ে আছে। শার্টের কয়েকটা বোতাম খোলা, চুলগুলো এলোমেলো। সিরাতকে দেখে তার দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুমি এখানে কী করছ? নিমু কোথায়?”
“তোমার বউ কোথায় সেটা জানার মতো অযথা সময় আমার কাছে নেই। এত রাত অবধি বাইরে ছিলে। তার উপর ড্রিংক করে ফিরেছ। সমস্যা কী তোমার?”
আচানক হু হু করে কান্না শুরু করে মাহতাব। সিরাত কিছু বুঝে ওঠার আগেই দরজার পাশ ঘেঁষে মেঝের উপর বসে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নেয় সে। সিরাত চুপচাপ মাহতাবের পাশে বসে তাকে পর্যবেক্ষণ করে। কিছুক্ষণ পর শান্ত স্বরে প্রশ্ন করে,
“কী হয়েছে তোমার? তোমাকে গত কয়েকদিন যাবত লক্ষ্য করছি আমি। কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“গত নয় দিনে আমি বড়ো বড়ো তিনটা অর্ডার হারিয়েছি। একেকজন একেক রকম বাহানা দিচ্ছে। একদিকে ব্যবসার অবস্থা খারাপ হচ্ছে, অন্যদিকে বাবা আমাকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সবদিক থেকে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে খুব শীঘ্রই আমি পথে বসে যাব।”
“নতুন বউ আসতে না আসতেই তোমার অবনতি শুরু হলো? তোমার কথা ভেবে আসলেই আমার খারাপ লাগছে!”
মাহতাব সিরাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
“মজা করছ তুমি?”
“এসব বাদ দাও। আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো।”
“কী প্রশ্ন?”
“নিমুর সাথে তোমার পরিচয় কীভাবে হয়েছিল?”
“ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল আমাদের।”
“নিমু কি শুরু থেকেই জানত যে তুমি বিবাহিত?”
“না, আমি তো অন্য অ্যাকাউন্ট থেকে কথা বলতাম। সেখানে সবাই জানত আমি অবিবাহিত।”
কথাটা শুনে সিরাতের চোখের কোণে পানি জমে যায় রাগে। হাতের মুঠ শক্ত হয়ে আসে। সে আরো কিছু প্রশ্ন করতে যাবে তার আগেই মাহতাব সিরাতের কাঁধে মা থা রেখে ঘুমিয়ে যায়। সিরাত মাহতাবের হাত ধরে তাকে টেনেহিঁচড়ে ভেতরে নিয়ে যায়। চুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“অন্য মেয়েদের সাথে সম্পর্ক গড়ার খুব শখ তোমার তাই না? এই শখ যদি আমি না ঘুচিয়েছি তো আমার নামও সিরাত নয়।”
কিছু একটা ভেবে সিরাত মাহতাবকে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। নাবিহার থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বিছানায় শুইয়ে দেয়। অতঃপর মাহতাবের ফোনটা হাতে নিয়ে তার আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে লক খুলে ফোন চেক করতে শুরু করে। নিমুর সাথে মাহতাবের কীভাবে পরিচয় হয়েছিল, কীভাবে তারা সম্পর্কে জড়ায় সবকিছু পেয়ে যায় অন্য একটা আইডিতে। ভাগ্যক্রমে সেই আইডি লগইন করা ছিল মাহতাবের ফোনে। ফোনের প্রাইভেট স্পেস এ মাহতাবের সাথে নিমুর ঘনিষ্ঠ অবস্থার একটা ভিডিয়ো দেখে আপনাআপনি সিরাতের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে । মেঝের উপর বসে অঝোরে কাঁদে সে। একজন নারী সবকিছু পারে। কিন্তু নিজের স্বামী কিংবা প্রিয় মানুষের আশেপাশে অন্য নারীকে সহ্য করতে পারে না। সে যত কঠিন মনের মানুষই হোক না কেন!
প্রথম যেদিন মাহতাবের সাথে সিরাতের দেখা হয় সেদিন মাহতাব বলেছিল,
“আমার কিন্তু সংসারী মেয়ে পছন্দ। তুমি বিয়ের পর লেখাপড়া করবে তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। তুমি তোমার মতো করে থাকতে পারবে। কিন্তু আমি যতক্ষণ বাড়িতে থাকব কিংবা তোমার সাথে থাকব ততক্ষণ আমি ব্যতিত আর কোনোদিকে মনোযোগ দিতে পারবে না তুমি। বেশি বন্ধুবান্ধব বানানোর প্রয়োজন নেই। আমিই হব তোমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। যদি আমার ইচ্ছার মর্যাদা তুমি রাখতে পারো তাহলে কথা দিচ্ছি, তোমাকে ভালবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখব আমি।”
সিরাত সেদিন মাহতাবের কথা রেখেছিল। মানুষটার ইচ্ছার মর্যাদা দিয়েছে সে। তবে মাহতাব কথা দিয়ে কথা রাখেনি।
“তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে মাহতাব, আমাকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখবে। কিন্তু তুমি কথা রাখলে না। আমি সারাজীবন ভালোবাসা, বিশ্বাস আর সম্মান ছাড়া তোমার কাছে কিচ্ছু চাইনি। যেখানে আমার পুরো দুনিয়া জুড়ে তুমি ছিলে সেখানে তোমার দুনিয়ায় আমি কোথাও নেই। বিয়ের আগে আমি যেমন ছিলাম তেমন সিরাতকে তুমি চাওনি। সেজন্য নিজেকে পাল্টে ফেলেছিলাম। তুমি চেয়েছিলে, বিয়ের পর আমার কোনো ছেলে বন্ধু থাকা চলবে না। বেশি বাইরে যাওয়া যাবে না। সংসার সামলাতে হবে মনোযোগ দিয়ে। আমি মেনে নিয়েছিলাম তোমার সকল শর্ত। বিনিময়ে চেয়েছিলাম শুধু তোমাকে। কিন্তু তুমি কথা দিয়ে কথা না রাখা মানুষ। এমন মানুষের প্রতি আমার আজন্ম ঘৃণা জন্মাক। যে পুরুষ আমি ব্যতিত অন্য নারীকে ছুঁয়েছে স্বেচ্ছায়, সেই পুরুষ আর কখনো আমার না হোক। আমি তোমাকে ভালোবাসি না মাহতাব, ভালোবাসি না তোমাকে!”
চোখের পানি শুকানোর আগেই রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যায়। আজ আর ঘুমাতে পারে না সিরাত। ওয়াশরুমে গিয়ে ঝর্ণা ছেড়ে তার নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদে সে। ভোর রাতে ঠাণ্ডা পানি শরীরে লাগার ফলে কেঁপে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে। প্রচন্ড ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে গোসল করে বের হয় সিরাত। তার সকল দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা রাতের আঁধারের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। প্রতিটা দিন একটু একটু করে ভেতর থেকে শেষ হয়ে যাচ্ছে সে। কিন্তু বাইরের মানুষকে এসব দেখানো যাবে না। কারণ মানুষগুলো বড্ড স্বার্থপর। অন্যের কষ্টে আনন্দ পায় তারা। ঠাট্টা করে, উপহাস করে, হাসাহাসি করে। এমন স্বার্থপর দুনিয়ায় নিজের কষ্টগুলো কাউকে দেখাতে নেই।
সকালে তীব্র মা থা ব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙে মাহতাবের। চোখ মেলে পাশে মেয়েকে দেখে তার দিকে এগিয়ে যেতে ধরলে সিরাত মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। কঠোর কণ্ঠে বলে,
“তুমি ড্রিংক করেছ গতকাল। এই অবস্থায় মেয়েকে ছুঁতে পারবে না তুমি। নিজের ঘরে গিয়ে গোসল করে নাও যাও।”
“আমি সারারাত এখানেই ছিলাম?”
“হ্যা এখানেই ছিলে।”
“তুমি ঘুমাওনি? আর এত সকালে গোসল করেছ কেন তুমি? চুল ভেজা কেন? রাতে কি আমাদের মাঝে কিছু হয়েছিল?”
মাহতাবের প্রশ্নে সিরাত রাগে চিৎকার করে বলে,
“কী হবে আমাদের মাঝে হ্যা? তোমার মতো একজনের সাথে এক বিছানায় থাকতে রুচিতে বাঁধে আমার। তাই সারারাত না ঘুমিয়ে মেঝের এক কোণ বসে ছিলাম। এসবের কারণে মা থায় যন্ত্রণা হচ্ছিল। তাই গোসল করেছি।”
“স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন করেছি। তার জন্য এত রেগে যাচ্ছ কেন?”
“তোমার কাছে যা স্বাভাবিক সেটাই আমার কাছে ভীষণ অস্বাভাবিক। এখন কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাও।”
মাহতাবকে তবুও বসে থাকতে দেখে সিরাত পুনরায় বলে,
“কী হলো? বেরিয়ে যাও!”
বিরক্তি নিয়ে বের হয়ে যায় মাহতাব। সিরাত মেয়েকে নিয়ে বিছানার উপর বসে চুপচাপ বসে থাকে।
“গুড মর্নিং মাম্মা”
“গুড মর্নিং বাবু। ঘুম কেমন হলো?”
“ভালো।”
“চলো তোমাকে দাঁত ব্রাশ করিয়ে দিই।”
“মাম্মা আজ আমাকে সাজিয়ে দিবে?”
“হঠাৎ সাজতে ইচ্ছে করছে কেন?”
“এমনি।”
“আচ্ছা আজ আমরা দু’জনেই সাজব। শাড়ি পরব কেমন?”
“আচ্ছা।”
“এখন তাড়াতাড়ি চলো। ফ্রেশ হয়ে এসে খেতে হবে তো।”
মেয়েকে দাঁত ব্রাশ করিয়ে দিয়ে ভালোভাবে চোখমুখ ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে গালে চুমু এঁকে দেয় সিরাত।
“এই মেয়েটা একদম আমার মতো হয়েছে। শুনেছি ছোটবেলায় আমিও এমন ছিলাম। সাজগোজ নিয়ে আমার মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ কাজ করত। মেয়েটা মায়ের মতো হয়েছে এই ভালো। বাপের মতো হলে তো চরিত্র নিয়ে সন্দেহ থাকত। আমার লক্ষ্মী মেয়েটা সব সময় যেন আমার মতোই থাকে।”
আনমনে কথাটা ভেবে সিরাতের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
চলবে??