#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_৯
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
জরুরি একটা কাজে মাহতাবের সাথে কথা বলার জন্য তার ঘরে এসে মেঝের এক কোণে গাইনী ডাক্তারের ভিজিটিং কার্ড পড়ে থাকতে দেখে ভ্রূদ্বয় সংকুচিত হয়ে আসে সিরাতের। কার্ডটা হাতে নিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে লক্ষ্য করে ঘরে মাহতাব কিংবা নিমু কেউই নেই। চারপাশে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সিরাত।
ফোন হাতে নিয়ে একটা নাম্বারে ডায়াল করে অপরপাশ থেকে কল রিসিভ হওয়ার অপেক্ষা করে সিরাত।
“হ্যালো কে বলছেন?”
“আসসালামু আলাইকুম। আমি সিরাত বলছি। ডাক্তার আফিফা আফরোজ কি আজ রোগী দেখবেন?”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আজকে ম্যাম আসবেন না। আগামী চার দিন ম্যাম ছুটিতে থাকবেন। এরপর রোগী দেখা শুরু করবেন পুনরায়।”
“আচ্ছা আপনি আমার সিরিয়াল নাম্বারটা লিখে রাখুন। ম্যাম এলেই আমাকে জানাবেন।”
“ঠিক আছে।”
কথা বলা শেষে কল কেটে দিয়ে সিরাত নাবিহার পাশে শুয়ে তাকে ফিডিং করায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটা ঘুমিয়ে যায়। একদম ছোট থেকেই নাবিহা ঘুম কাতুরে স্বভাবের মেয়ে। মেয়ের পাশে শুয়ে কখন যেন সিরাতের চোখ লেগে আসে ঘুমে। ইদানীং রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না তার। অনিয়মিত ঘুমের কারণে শরীরও কেমন ক্লান্ত লাগে। ফোনের রিংটোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় সিরাতের। গ্রুপ কল দেখে সাথে সাথে কল রিসিভ করে সিরাত। চিরচেনা মানুষগুলোর ছবি দেখে আপনাআপনি ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে তার।
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কী অবস্থা ম্যাম আপনার?”
তামান্নার কথার প্রতুত্তরে সিরাত বলে,
“এতদিন পর আমার কথা মনে পড়ল তোদের?”
“একদম আমাদের দোষ দিবি না। আমাদের কারোর সাথে কোনো যোগাযোগ রেখেছিলি নাকি তুই? তারিন ছাড়া কারোর সাথেই তো যোগাযোগ রাখিসনি।”
“অথৈ তুই আজকাল রাগ করতে শিখেছিস? কবে থেকে তোর এত উন্নতি হলো?”
“সবারই উন্নতি হয়েছে। শুধু তোর অবনতি হচ্ছে, যা আমরা মেনে নিতে পারছি না।”
ফারহানের কথায় মুখ শুকিয়ে আসে সিরাতের। প্রায় পাঁচ বছর পর সবার সাথে কথা হচ্ছে তার। কিন্তু এখানে দুইজন নেই। এটা দেখে সিরাত প্রশ্ন করে,
“আগে বল বাকি দু’জন কোথায়? কলে আমরা নয়জন আছি। ওদের দু’জনের সাথে কি তোদের কারোর কোনো যোগাযোগ নেই?”
“ওদের কেন খুঁজছিস তুই? তুই কি কারোর কথা ভাবিস? ভেবেছিস কখনো?”
অভির এমন উত্তরে সিরাত কিছু বলতে যাবে তার আগেই উর্মি বলে ওঠে,
“এই খবরদার তোরা দু’জন এখন একদম ঝগড়া করবি না। সিরাত আর অভি, দু’জন ভালো করে শোন আমার কথা। আজ তোরা ঝগড়া শুরু করলে তোদের বাড়িতে গিয়ে মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে আসব বলে দিলাম।”
এতক্ষণ ধরে খুব মনোযোগ দিয়ে সবার কথা শুনছিল নকশি। বোনের পাশে গালে হাত বসে দিয়ে নাবিল বলে,
“আমাদের ভাই-বোনকে সবাই ভুলে গিয়েছে। কেউ একবারও আমাদের কথা বলল না।”
“আরেহ মিস্টার প্লেবয় যে!”
সিরাতের মুখে পুরোনো সেই ডাকনাম শুনে নাবিল উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে,
“সুন্দরী তুই ভুলে যাসনি আমাকে?”
“তোকে কীভাবে ভুলব বল? তোর মতো প্লেবয় আমাদের বন্ধুমহলে আর একটাও তো নেই ভাই।”
কথাটা বলে হেসে ওঠে সিরাত। স্কুল, কলেজের প্রায় অর্ধ শতাংশ মেয়ের সাথে এই ছেলের ভাব ছিল। মেয়েদের কাছে সে “নাবিল ভাইয়া” নামেই পরিচিত ছিল। কত মেয়ে যে তাকে ভাইয়া থেকে প্রেমিক বানাতে চেয়েছে তার নির্দিষ্ট হিসাব সিরাত কিংবা বাকি বন্ধুদের কাছে নেই। অন্যদিকে নাবিলের যমজ বোন নকশি সম্পূর্ণ বিপরীত। শান্তশিষ্ট মেয়েটার প্রধান কাজই ছিল পড়াশোনা করা। অন্যরা যেখানে আড্ডা দিতে ব্যস্ত তখন নকশি বইয়ে মুখ গুঁজে পড়তে ব্যস্ত। পড়ুয়া এই মেয়ের প্রেমে পড়ে পড়াশোনা বিমুখ ছেলে ফারহানও বই পাগল হয়ে উঠেছিল। পুরোনো কথাগুলো মনে পড়ে সিরাতের বিষন্নতা কেটে যায়।
“প্লেবয় ভাইকে মনে রাখলি। কিন্তু শান্ত মেয়েটার কথা ভুলে গেলি বল?”
তারিন মজা করে বলে,
“নকশি পিঠা খাব। বানিয়ে নিয়ে আয়।”
নকশি কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দেয়,
“সিরাত তো এখন পাক্কা গৃহিণী হয়ে গিয়েছে। আমাদের এখন রান্না করে খাওয়ানোর দায়িত্ব ওর। কিরে নকশি পিঠা বানাতে পারিস তো?”
“না পারলেও তোদের জন্য শিখে নেব। তোরা কবে আসবি শুধু সেটা বল।”
“এজন্যই তো সবাইকে একসাথে কল দিলাম আমি। আগামী সতেরো তারিখ আমাদের বন্ধুমহল তৈরি হওয়ার দশ বছর পূর্ণ হবে। সেদিন আমরা সবাই একসাথে দেখা করব। আজ ডিসেম্বর মাসের দুই তারিখ। তার মানে আমাদের হাতে সময় আছে মাত্র পনেরো দিন। তারপর আমরা সবাই আবার একত্রিত হব। সকল মান-অভিমান ভুলে আমরা প্রত্যেকে সেই দশ বছরের পুরোনো আমি রূপে ফিরব।”
তারিনের কথায় সিরাত শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“ওরা আসবে তো?”
“হ্যা, সবাই আসবে।”
“তুই নিশ্চিত তারিন? ওদের সাথে যোগাযোগ হয়েছে?”
“না, তবে আমি কথা দিচ্ছি ওদের দু’জনকে আমি যেভাবেই হোক সেদিন নিয়ে আসব।”
“কোথায় দেখা করতে চাচ্ছিস তোরা?”
তামান্নার প্রশ্নের উত্তরে তারিন বলে,
“সেটা এখনো ঠিক করা হয়নি। ঠিক হলে তোদের জানাব।”
“উফ্ আমার তো ভেবেই আনন্দ হচ্ছে। আমরা এগারো জন আবার একসাথে হব।”
এটুকু বলে অথৈ নিজে থেকেই গান গাওয়া শুরু করে। এই মেয়ের গানের গলা অসাধারণ। দিন নেই, রাত নেই, অথৈ এর কাছে সব সময় গান শোনার আবদার করত বাকিরা। অথৈ খুশিমনে সবাইকে গান শোনাত। অন্যদের মতো না না বলে ন্যাকামি করত না কখনোই।
অথৈ এর সাথে গলা মেলায় নাবিল। এই দু’জন বেশ কয়েকবার জুটি বেঁধে গান গেয়েছে। স্কুলের বিদান অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠান, সবখানেই গানের জন্য প্রশংসিত হয়েছে তারা। একটা সময় তাদের বন্ধুত্ব প্রেমে রূপ নিয়েছিল। তাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক কেন যেন পূর্ণতা পায়নি। বাকি বন্ধুরা শত চেষ্টা করেও তাদের এক করতে পারেনি। বন্ধুত্ব ঠিকই ছিল, কেবল বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল প্রেমের।
গান শেষে সিরাত নকশিকে জিজ্ঞেস করে,
“তোর তো ফারহানের সাথে বিয়ে হয়েছে। তাহলে তোরা এখন আলাদা কেন?”
“আরে ওর তো অন্য জেলায় পোস্টিং হয়েছে। আমি ওর সাথেই থাকি। কিছুদিনের জন্য বাবার বাড়িতে ঘুরতে এসেছি। কয়েকদিন পর চলে যাব।”
“এখন আর একা একা আসতে হবে না তোমার। আমি তো সতেরো তারিখের আগেই যাব। সবার সাথে দেখা করে একেবারে চলে আসব দু’জন।”
“আচ্ছা।”
“আমাদের মেয়েদের বেশিরভাগেরই তো বিয়ে হয়ে গেল। তামান্না, উর্মি আর অথৈ তোরা তিনজন কি বিয়ে করবি না?”
“অথৈ এবং উর্মির কথা জানি না। কিন্তু আমার কাবিন হয়েছে৷ আগামী বছরের শুরুতে উঠিয়ে নেবে।”
“পাঁচ বছরে সবকিছু বদলে গেল তাই না? ছোট ছোট আমরা আজ বড়ো হয়ে গিয়েছি। আগে আমাদের সামলাত সবাই। আর এখন আমরা কেউ কেউ একাই গোটা সংসার সামলাচ্ছি। কেউ বা সংসার সামলানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছেলেরা চাকরি করতে ব্যস্ত। আর মেয়েরা বউ হতে ব্যস্ত। সময়গুলো এত দ্রুত কেন চলে যায় বল তো?”
সিরাতের কথায় সবাই পুরোনো দিনের কথা ভাবলেও অভি খোঁচা দিয়ে বলে,
“তুই আগের কথা ভাবছিস কেন? বিয়ের জন্য তো পাগল হয়ে গিয়েছিলি। সুখে থাকার জন্য সবকিছু ছেড়ে বিয়ে করলি। এখন খুব সুখে আছিস তো?”
“আহ্ অভি! এমনিতেই মেয়েটা ভালো নেই। এসব বলে ওর কষ্ট আর বাড়িয়ে দিস না।”
“ওকে বলতে দে তারিন। পুরোনো সব রাগ জমিয়ে রেখেছে তো। আজ সেসব উজাড় করে দিক।”
“জানি অভির সাথে যা হয়েছে সেটা ঠিক হয়নি৷ কিন্তু এতে তোর একার দোষ নেই। তোরা তিনজন সমানভাবে দায়ী। তোরা দু’জন তো ঝগড়ায় মেতেছিস। আরেকজনের কোনো খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না।”
অথৈ কথা শেষ করার আগেই উর্মি বলে ওঠে,
“এসব বাদ দে। অতীত ভেবে বর্তমানের সময়গুলো নষ্ট করিস না। পাঁচ বছর তো এভাবেই কেটে গেল। এখন সবাই নতুন করে ভাব সবকিছু।”
চলবে??