#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_৬
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
চোখের কোণে পানি আর চোখে ভ*য়ংকর রাগ নিয়ে সিরাত একমনে চেয়ে আছে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে। রাগে হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এসেছে তার। তবুও চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে না সে।
“তুমি আমার গায়ে হাত তুললে মাহতাব?”
“হ্যা তুললাম। তোমাকে আমি অনেক ভালো ভেবেছিলাম। মনে করেছিলাম তুমি আমাকে ভালোবাসো। তোমার উপর বিশ্বাস ছিল আমার। কিন্তু আজ তুমি আমার সমস্ত বিশ্বাস ভেঙে দিলে। এতদিন তোমার সমস্ত কথা মেনে নিয়েছিলাম বাবার কথা ভেবে। আমার পরিবারে একমাত্র বাবা তোমাকে পছন্দ করে৷ আমার মা কিংবা আমার বোন, কেউই তোমাকে সহ্য করতে পারে না। আসলে তোমার মতো মেয়েকে সহ্য করা যায় না।”
“ওহ্ তাই? আচ্ছা তুমি কী ভেবেছিলে বলো তো? তুমি আমাকে ঠকিয়ে, আমাদের সন্তানের কথা না ভেবে অন্য একজনকে বিয়ে করে বাসায় তুলবে আর আমি তোমাদের সাদরে বরণ করে নেব? বিশ্বাসের কথা তো তোমার মুখে মানায় না মাহতাব। যে পুরুষ ঘরে বউ রেখে বাইরে অন্য নারীদের সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটায় সে আর যাইহোক বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। যে নিজেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে জানে না সে কোন মুখে বিশ্বাসের কথা বলে হ্যা?”
সিরাতের চিৎকারে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয় নিমু। মাহতাব অবাক চোখে সিরাতের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার চোখগুলো অস্বাভাবিক রকমের লাল হয়ে আছে। রাগে পুরো মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। ওষ্ঠদ্বয় অনবরত কাঁপছে। এর আগে কখনো সিরাতের এমন রূপ দেখেনি মাহতাব। ভীষণ অস্বাভাবিক লাগছে মেয়েটাকে।
দু’হাতে চুল মুষ্টিবদ্ধ করে লম্বা শ্বাস ছেড়ে সিরাত মাহতাবের কাছে এগিয়ে যায়।
“মিস্টার শাহরিয়ার মাহতাব এতদিন আপনি আমার শান্তশিষ্ট রূপ দেখেছেন। দেখেছেন অতি সাধারণ একজন মেয়ের তার স্বামীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা। আজ আমি মুমতাহিনা ইসলাম সিরাত কথা দিচ্ছি, ঠিক এই মুহূর্ত থেকে আপনি প্রতি পদে পদে অনুভব করবেন জীবন কতটা কঠিন। আমি যদি আপনার জীবন ন*র*ক বানিয়ে না ছেড়েছি তো আমি চলে যাব। হ্যা, আপনার জীবন থেকে আমি বহুদূরে সরে যাব যদি আপনার ভালো থাকা আমি কেঁড়ে নিতে না পারি।”
আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না সিরাত। চোখের পানি মুছে ঘরে চলে যায়। বিছানার উপর নাবিহা ঘুমিয়ে আছে। ঘন্টা খানেক আগেই ঘুমিয়েছে। এখন তার ওঠার সময় হয়ে গিয়েছে। মেয়ের পাশে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দেয় সিরাত। তার ডান গালে এখনো কিঞ্চিৎ ব্যথা করছে। বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে লাল হয়ে আছে গালের একপাশে।
“মাম্মা!”
মেয়ের ডাকে সিরাত ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলে,
“আমার লক্ষ্মী মেয়েটার ঘুম হয়েছে?”
নাবিহা এপাশ-ওপাশ গড়াগড়ি খেয়ে বলে,
“হুম।”
“ক্ষুধা লেগেছে তোমার আম্মু?”
“হুম মাম্মা।”
কথাটা বলার সময় নাবিহা ঠোঁট উল্টিয়ে ফেলে। ক্ষুধা লাগলে সে বরাবরই এমন করে। মেয়ের এমন চেহারা দেখে সিরাত তাকে কোলে তুলে নিয়ে গালে চুমু খেয়ে বলে,
“আমার মেয়েটা অনেক সুন্দর মাশাআল্লাহ। তুমি আমার অনেক লক্ষ্মী মেয়ে আম্মু।”
“মাম্মা আমি বেরু করতে যাব।”
“এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। আমি আগামীকাল তোমাকে নিয়ে বের হব।”
“আমি নানুমনির কাছে যাব।”
“আজই তো এসেছিল সবাই। আচ্ছা, আমরা কয়েকদিন পর গিয়ে সবার সাথে দেখা করে আসব ঠিক আছে?”
“ওকে মাম্মা।”
“তুমি এখন এখানে চুপটি করে বসে খেলা করো। আমি কয়েক মিনিটের মধ্যে তোমার জন্য খাবার বানিয়ে আনছি।”
মেয়েকে রেখে সিরাত রান্নাঘরে চলে যায়। মেয়ে আর নিজের জন্য খাবার বানানোর সময় রান্নাঘরে নিমুর আগমন ঘটে। নিমুকে দেখেও সে না দেখার ভান করে নিজের মতো কাজ করতে থাকে।
“আজ তো কেবল একটা থা*প্পড় খেয়েছ। এরপর আমার সাথে লাগতে আসলে ফল ভালো হবে না মনে রেখো।”
নিমুর কথাটা যেন একদমই পছন্দ হয় না সিরাতের। কিন্তু মুখে কিছু না বলে সে আপনমনে কাজ করে। কড়াইয়ে তেল দিয়ে তার মধ্যে ইচ্ছে করেই দূর থেকে সবজি ছেড়ে দেয়। পাশেই ছিল নিমু। গরম তেল ছিটকে গিয়ে পড়ে নিমুর শরীরে। আচমকা এমন কিছুর জন্য হয়তো প্রস্তুত ছিল না সে। সাথে সাথে চিৎকার করে ওঠে। সিরাত নিমুর কাছে দাঁড়িয়ে কানের পাশে মুখ নিয়ে ফিসফিস আওয়াজে বলে,
“জ্ঞানী ব্যক্তি কখনো নির্বোধের সাথে তর্কে জড়ায় না। সে নিজের কাজ দিয়ে নিজের যোগ্যতা এবং ক্ষমতা প্রমাণ করে। কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী আমি। অযথা আমার সাথে লাগতে গেলে ফল কেমন হবে সেটা আশা করি বুঝতে পেরেছ।”
খাবার বেড়ে নিয়ে ফ্রিজ থেকে এক বোতল পানি বের করে ঘরে চলে যায় সিরাত। নিমুর হাতের একপাশে বেশ ভালো রকম তেল ছিটকে এসেছে। ফলস্বরূপ প্রচন্ড জ্বা*লাপো*ড়া শুরু হয়েছে সেই স্থানে। বেসিনে পানি ছেড়ে দিয়ে সেখানে হাত রেখে রাগে ফুঁসতে থাকে নিমু।
“তোমাকে আমি ছাড়ব না সিরাত। তুমি জানো না আমি কে! তুমি কার জীবন নষ্ট করবে সেটা নিয়ে আমার কোনো মা*থা ব্যথা নেই। তবে তোমার জীবনের ভালো সময়গুলো খুব দ্রুত শেষ হতে চলেছে।”
ঘরে এসে বাচ্চাকে খাইয়ে দিয়ে সিরাত নিজেও খেয়ে নেয়। এরপর রান্নাঘরে গিয়ে সবকিছু ধুয়ে পরিষ্কার করে আবার ঘরে চলে আসে। নাবিহার সাথে বেশ কিছুক্ষণ খেলে তাকে বিছানার উপর রেখেই আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজেকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে সে। মুখে হাত দিয়ে লক্ষ্য করে, মুখটা কেমন মলিন হয়ে আছে। অনেক দিন হলো নিজের যত্ন নেওয়া হয় না তার। কোমড় ছাড়িয়ে যাওয়া চুলগুলো কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে আছে। চোখের নিচে কালো আস্তরণ পড়েছে। ঠোঁটগুলো কালচে রং ধারণ করেছে। নিজেকে দেখে ভেতর থেকে কেবল দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে সিরাতের।
“কত-শত দিন পেরিয়ে গেল নিজের যত্ন নেওয়া হয় না আমার। আগের আমি নিয়ম করে দুই বেলা নিজের যত্ন নিতাম। অথচ এখন নিজের দিকে তাকানোরও সময় হয় না আমার। মা হওয়ার পরেও এতটা উদাসীন ছিলাম না, যতটা এই কয়েক দিনে হয়ে গিয়েছি। না, এবার আমার নিজেকে নিয়ে ভাবতে হবে। আমার মেয়েটাকে নিয়ে ভাবার সাথে সাথে নিজের ভালোমন্দের কথাও ভাবতে হবে আমাকে।”
ওয়াশরুমে গিয়ে মুখ ভালোভাবে ক্লিনজার দিয়ে ধুয়ে একটা ক্লে মাস্ক লাগিয়ে নেয় সিরাত। মিনিট বিশেক সেটা রেখে ধুয়ে ফেলে। অতঃপর ঘরে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মুখে, হাতে, পায়ে ক্রিম লাগিয়ে নেয়। ঠোঁটে একটা স্লিপিং মাস্ক লাগিয়ে চুলে হাত দেয় সে। চিরুনি দিয়ে ভালোভাবে চুল আঁচড়িয়ে বিনুনি গাঁথে চুলে।
“এখন থেকে এভাবেই একটু একটু করে নিজের যত্ন নিতে হবে। অন্য সবার কথা ভাবার আগে এখন থেকে আমি নিজেকে নিয়ে ভাবতে চাই। হ্যা, আজ থেকে সিরাত সবার আগে নিজের কথা ভাববে। নিজের মেয়ের মেয়ের কথা ভাববে। বাকি সবকিছু চুলোয় যাক৷”
ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে উঠে একটা আচারের বোয়াম নিয়ে মেয়ের পাশে বসে আচার খেতে শুরু করে সিরাত। হঠাৎ ডাইনিং টেবিলের পাশ থেকে চিৎকার শুনে সিরাত বোঝার চেষ্টা করে বাইরে হয়েছে কি!
“এসব কী রান্না করেছ তুমি? লবণ আর মরিচের মাঝে মাছ ডুবিয়ে রেখেছ? কোনো মানুষ এটা খেতে পারবে? আজকাল মন কোথায় থাকে তোমার? ঝালে জীবন বেরিয়ে যাচ্ছে আমার।”
রাগে চিৎকার করে কথাগুলো বলে ওঠে মাহতাব। ঘর থেকে সিরাত স্পষ্ট শুনতে পায় কথাগুলো।
“আমি তো ঠিকভাবেই রান্না করেছি। তুমি এমন করছ কেন?”
“নিজেই খেয়ে দেখো কেমন রান্না করেছ তুমি!”
নিমু চামচের মধ্যে একটু মাছের ঝোল নিয়ে মুখে দিতেই ইয়াক করে ফেলে দেয় সব। মুখে হাত দিয়ে বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তরকারিতে মারাত্মক লবণ আর মরিচের স্বাদ ছাড়া কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না৷
সিরাত এসব শুনে আমের আচার চিবোতে চিবোতে গুনগুনিয়ে গায়,
“আমার এই বাজে স্বভাব কোনোদিন যাবে না!”
চলবে??