#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_৫
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
গালে হাত দিয়ে র*ক্তচক্ষু নিয়ে সিরাতের দিকে তাকিয়ে আছে মাহতাব। সিরাত হেসে চোখের ইশারায় বোঝায়,
“খুব লেগেছে তাই না?”
মাহতাবের যেন সহ্য হয় না এই চাহুনি। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই নজরুল শেখ হুংকার দিয়ে ওঠেন। ছেলের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,
“আমার ছেলে হয়ে তুমি কীভাবে পারলে এমন কাজ করতে?”
মাহতাব জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিয়ে বলে,
“বাবা তুমি আমাকে ভুল বুঝছ।”
“ভুল বুঝছি আমি? তাহলে ঠিক কোনটা? তুমিই বলো আমাকে।”
মাহতাব কোনোকিছু না বলে এক ধ্যানে সিরাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। স্বামীর এমন চেহারা দেখে সিরাত নজরুল শেখের কাছে এগিয়ে এসে বলে,
“বাবা আপনার ছেলের কাছে এই মুহূর্তে বলার মতো কিছুই নেই। সে এই মেয়েকে বিয়ে করে এই বাসায় নিয়ে এসেছে প্রায় দশ/বারো দিন হয়ে গেল। এতদিন আমি চুপ ছিলাম। কিন্তু আজ আপনার ছেলে আমাকে কী বলেছে জানেন?”
“কী বলেছে?”
“সে বলেছে, আমি তোমাকে কেন ভয় পাব? আমার তো টাকার অভাব নেই। আমি চাইলেই টাকা দিয়ে সবার মুখ বন্ধ করে দিতে পারি। তোমার যা ইচ্ছা করে নাও। আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে এই বাসাতেই থাকব। এসব শোনার পরেও কি আমার চুপ করে থাকা ঠিক হতো বাবা?”
সিরাতের কথা শুনে নজরুল শেখের রাগ তরতরিয়ে বেড়ে যায়। রাগ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সিরাত বলে,
“আমি সহজসরল বলে নাকি তার আমাকে আর ভালো লাগে না। মানে ভালো জিনিস আপনার ছেলের ঠিক পছন্দ হয় না। তার সেসবই পছন্দ যেসব জিনিস আগেই ব্যবহার করা হয়ে গিয়েছে।”
নিমুর মুখ রাগে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। এর মাঝেই কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে সিরাত দরজা খুলে দেয়। তার বাবা, মা, ফুপি, আর দু’জন বোন এসেছে।
“ভেতরে এসো তোমরা।”
ভেতরে এসে সিরাতের থেকে চার বছরের বড়ো ফুপাতো বোন মাহতাবের কলার ধরে চিৎকার করে বলে,
“তোমার সাহস হলো কীভাবে আমার বোনকে ঠকানোর? এত স্পর্ধা কোথায় পেলে তুমি?”
“আহা আপু শান্ত হও তুমি। ওর কলার ছেড়ে দাও।”
বোনের মুখে এমন কথা শুনে অবাক হয় মালিহা। মাহতাবের কলার ছেড়ে দিয়ে বোনের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,
“তুই শান্ত আছিস কীভাবে রাত? এই ছেলে তোর মতো একজনকে ঠকিয়ে আরেকটা বিয়ে করল আর তুই চুপচাপ সব মেনে নিচ্ছিস?”
“কে বলল মেনে নিচ্ছি? সে হয়তো আমাকে চেনে না। কিন্তু আমার বাড়ির মানুষজন তো আমাকে চেনে। আমি কি সত্যিই মেনে নেওয়ার মতো মেয়ে আপু?”
“না!”
“আজকে তোমাদের সবাইকে আমি বিশেষ একটা কারণে ডেকেছি।”
“কী কারণ?”
শাশুড়ি মারজিয়া শেখের প্রশ্নে সিরাত উত্তর দেয়,
“আপনার ছেলে যে আমাকে ঠকিয়ে অন্য একজনকে বিয়ে করল তার শাস্তি দিতে হবে না বলুন মা?”
“এসব কী বলছ তুমি বউমা? আমার ছেলেকে কী শাস্তি দিতে চাও তুমি?”
“আমি ভাবছি এখন এখানে পুলিশ ডাকব। আপনার ছেলে আমাকে বলেছে পুলিশকে নাকি তার পকেটে নিয়ে ঘোরে সে। আমিও দেখতে চাই কতজন পুলিশকে সে নিজের পকেটে রাখে।”
“শান্ত হও তুমি। নিজের স্বামীকে এখন জেলে ঢোকাবে তুমি? কেমন মেয়ে তুমি হ্যা? মানছি আমার ছেলে ভুল করেছে। কিন্তু এই সমাজে দুই বউ নিয়ে অনেক মানুষ সংসার করছে। তার জন্য কি এখন আমার ছেলেকে জেলের ভাত খেতে হবে নাকি?”
“মারজিয়া!”
স্বামীর চোখ রাঙানো দেখে চুপ হয়ে যায় মারজিয়া শেখ। কিন্তু সিরাত চুপ করে থাকে না। শাশুড়ি মায়ের কাছে গিয়ে বলে,
“এটা বড়ো কোনো অন্যায় নয় তাই না মা? তাহলে আমি এক কাজ করি। বাবাকে আরেকটা বিয়ে করিয়ে দিই। এমনিতেও আপনার সাথে এক বাড়িতে এতগুলো বছর ধরে বাবা যে অনেক কষ্টে সংসার করছে এটা আমি জানি। আপনি এমন একজন মানুষ যার জন্য মাত্র এক বছরের সন্তানকে কোলে নিয়ে আমাকে আমার শ্বশুর বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। কেবল আপনার জন্য আমাকে আলাদা বাসায় থাকতে হয় এখন। নতুন শাশুড়ি মা এলে আমারই ভালো হবে।”
ছেলের বউয়ের মুখে এমন কথা শুনে মারজিয়া শেখ বিরক্তিকর চাহুনি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আপনমনে বলে ওঠে,
“অসভ্য মেয়ে একটা!”
“এতক্ষণ চুপ করে সবকিছু দেখলাম। কিন্তু আর নয়। আমার মেয়েকে আমি কিছুতেই এখানে আর থাকতে দিব না। আমার একমাত্র মেয়ে কষ্ট পাবে আর আপনার ছেলে ভালো থাকবে সেটা কিন্তু আমি হতে দিব না বেয়াই সাহেব।”
শাহেদ ইসলামের কথায় সহমত জানায় সিরাতের মা ইতি ইসলাম। বাবা-মায়ের এমন অবস্থা দেখে সিরাত বলে,
“তোমাদের আমি এই কারণে এখানে ডাকিনি মা যে তোমরা আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে।”
“মানে কী রাত? আমার মেয়ে দিনের পর দিন এখানে থেকে কষ্ট পাবে আর আমরা চুপচাপ দেখব?”
“না মা, আমি জানি তোমাদের খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি তো আমার সংসার ছেড়ে কোথাও যাব না।”
“আপু তুই এখনো এসব বলছিস? এটা কি আর তোর সংসার আছে?”
“তুবা সংসার কিন্তু আমারই। আমি একটু একটু করে আমার এই সংসার সাজিয়েছি। আমার পাঁচ বছরের শ্রম আছে এই সংসারে। আমার ছোট্ট এই সংসার নিয়ে আমি কত স্বপ্ন বুনেছি তুই জানিস? সেই সংসার ছেড়ে তো আমি কোথাও যাব না।”
“তোর সুখের সাম্রাজ্যে যে এখন নতুন রাণী এসেছে রাত।”
“তাতে কী হয়েছে আপু? উটকো এক ঝামেলার জন্য আমি নিজের সাম্রাজ্য ছেড়ে দিব কেন? দুই দিনের এই মেয়ে এসে আমাকে আমার সংসার থেকে বের করে দেবে। আর আমি অসহায় মেয়ের মতো মুখে কাপড় গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে যাব এই বাসা ছেড়ে? তা তো হবে না।”
“তাহলে কী করতে চাইছ তুমি?”
“ফুপি মা আমি আজ তোমাদের এখানে ডেকেছি আমার একটা সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য।”
“কী সিদ্ধান্ত?”
বাবার প্রশ্ন শুনে সিরাত কিছুক্ষণ চুপ থেকে লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে বলে,
“আজ থেকে মাহতাবের সাথে যা যা হবে তার জন্য কেউ আমাকে দায়ী করতে পারবে না। কিন্তু আমার সামান্য ক্ষতি হলেও তার সমস্ত দায়ভার নিতে হবে মাহতাবকে। মাহতাবের নিমুকে ডিভোর্স দিতে হবে না। কিন্তু সে ভুল করেও আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা ভাবতে পারবে না। যদি আমার উপর সে এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রী কোনো প্রকার অত্যা*চার করে তাহলে সেই মুহূর্তে তাদের বিরুদ্ধে আমি যেকোনো স্টেপ নিতে পারব। এতে করে কেউ আমার কাছে এসে কৈফিয়ত চাইতে পারবে না। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো মাহতাব নিমুকে নিয়ে অন্য কোথাও যেতে পারবে না। ওদের এখানেই থাকতে হবে। নতুবা আমি ওদের বিরুদ্ধে মা*মলা করব।”
“এসব কী বলছ তুমি? আমি কি তোমার দাস?”
“একদমই না, তুমি আমার দাস নও। তবে আমার কথা না শুনলে তোমার বাবার সম্পত্তি থেকে তুমি বঞ্চিত হবে।”
“মানে?”
“মানেটা আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি। তুমি যদি সিরাতকে ডিভোর্স দাও কিংবা ওর কোনো ক্ষতি করো তাহলে তোমার জন্য বরাদ্দ আমার সমস্ত সম্পত্তি ট্রাস্টে চলে যাবে।”
“বাবা!”
“সিরাতকে আমি এমনি এমনি শেখ পরিবারের বউ করে আনিনি। এই মেয়েটা আমার জীবন বাঁচিয়েছিল। নিজের জীবন ঝুঁকির মাঝে রেখে আমাকে বাঁচিয়েছে। সে শুধু আমার বউমা নয়, সে আমার মেয়ে। তোমরা অনেক কিছুই জানো না সিরাতের বিষয়ে। আমি চেয়েছিলাম আমার ছেলের সাথে মেয়েটা সুখে থাকুক। কিন্তু মাহতাব, তুমি আজ আমার সমস্ত বিশ্বাস ভেঙে ফেললে।”
বাবার কোনো কথায় যেন বোধগম্য হয় না মাহতাবের কাছে। কী বলছে এসব তার বাবা!
“বাবা আমি তোমার কোনো কথায় বুঝতে পারছি না।”
“বুঝতে হবে না তোমাকে। তুমি শুধু আমার কথা বুঝলেই হবে।”
কথাটা বলার সময় সিরাতের ঠোঁটে আপনাআপনি হাসি ফুটে ওঠে।
চলবে??