নিভৃতে তেজস্বিনী পর্ব-০৩

0
490

#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_৩
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“দণ্ডবিধি আইন ১৮৬০-এর ৪৯৪ বিধান অনুযায়ী, প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ব্যতিত যদি কোনো ব্যক্তি দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন তাহলে এই ধারার বিধানমতে স্ত্রী ফৌজদারি মা ম লা করতে পারবেন। এমন অবস্থায় স্বামীর অপরাধ প্রমাণিত হলে সাত বছর পর্যন্ত কা*রাদ*ণ্ড ও অর্থদ*ণ্ডে দ*ণ্ডিত হবেন।”

ঘরে প্রবেশ করার আগ মুহূর্তে সিরাতের মুখে এমন কথা শুনে থেমে যায় মাহতাব৷ বিষ্ময়কর চাহুনি নিয়ে সে তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে। স্বামীর এমন চাহুনি দেখে মুচকি হাসে সিরাত।

“আরে তুমি কখন এলে? আসলে আমি আমার এক বান্ধবীর সাথে কথা বলছিলাম। সে আবার উকিল। অনেক দিন পর আমাদের কথা হলো।”

মাহতাব সিরাতের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,

“এসব কী বলছিলে তুমি?”

“কোন সব?”

“মা ম লা নিয়ে কথা বলছিলে শুনলাম।”

“ওহ্ এই ব্যাপার। তুমি আমার অনুমতি ব্যতিত দ্বিতীয় বিয়ে করেছ না? তাই আর কি ওকে সব বিস্তারিত জানালাম। তখনই এসব বলল।”

মাহতাব আচানক সিরাতের হাত ধরে নরম স্বরে বলে,

“আমি তোমার আর আমাদের মেয়ের সব রকম ভরণপোষণের দায়িত্ব নিব। কোনো অবহেলা করব না। তুমি দয়া করে রাগের বশবর্তী হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ো না।”

“হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত তো আমি নিব না। শোনো, তুমি আমার কথামতো চললে আমি চুপ থাকব। কিন্তু আমাকে রাগালে বিষয়টা তেমন একটা ভালো হবে না।”

“কী চাও তুমি?”

“আমার প্রথম শর্ত হলো তুমি আর নিমু যে স্বামী-স্ত্রী এটা বাইরের কাউকে জানানো যাবে না। কারণ আমি চাই না আমার মেয়ের সামনে কেউ বলুক, তোমার বাবা তো তোমার জন্য সৎ মা এনেছে নাবিহা। নাবিহা জানবে নিমু আমাদের বাসায় কিছুদিনের অতিথি হয়ে এসেছে। তোমার একটা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমার সন্তানের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হোক এটা আমি কখনোই চাইব না। আমার কথা বুঝতে পেরেছ?”

“তারপর?”

“আমার দ্বিতীয় শর্ত হলো তুমি নিমুকে অন্য কোথাও রাখতে পারবে না। ওকে এখানেই থাকতে হবে। এবং ওকে আমার কথামতো চলতে হবে।”

“নিমু কেন তোমার কথামতো চলবে?”

“কারণ আমার কথা না শুনলে তোমরা ভালো থাকতে পারবে না। তুমি তো আমার ভালো থাকার কথা একবারও ভাবোনি। কিন্তু আমি তোমাকে ভালো থাকার একটা সুযোগ দিলাম। দ্বিতীয় বিয়ে করেছ না? এক নারীতে তো আসক্ত থাকতে পারলে না। সুতরাং তোমার ভালো থাকার মেয়াদ এমনিতেও ফুরিয়ে আসছে। তাই আমাকে শান্ত রাখলে তোমার জন্যই সেটা কল্যাণকর হবে।”

“আর কোনো শর্ত আছে?”

“আমার তৃতীয় শর্ত হলো তুমি ভুলেও আমার কাছে আসতে পারবে না। স্বামীর অধিকার তো মোটেই ফলাতে পারবে না। আমার কোনো কাজে বাঁধা দিতে পারবে না। যদি আমার উপর জোর করো তাহলে আমার পুলিশকে কল করতে এক মিনিট সময়ও লাগবে না।”

“এগুলো কী রকম শর্ত তোমার?”

“আমার এই তিনটা শর্তে যদি তুমি রাজি না হও তাহলে তোমার ভালো থাকার দায়িত্ব কেবল তোমার। পরবর্তীতে তোমার সাথে যা যা হবে তার জন্য তুমি আমাকে দায়ী করতে পারবে না।”

মাহতাব চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভেবে বলে,

“ঠিক আছে। আমি তোমার সব শর্তে রাজি।”

“তবে হ্যা, নাবিহার সামনে আমরা স্বাভাবিক থাকব। কারণ পারিবারিক সমস্যার কারণে ওর মনে কোনো প্রভাব পড়ুক তা আমি চাই না।”

“তুমি যা বলবে তাই হবে।”

কথাটা বলে মাহতাব ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সিরাত জানে, মাহতাব এত সহজে সব মানবে না৷ সেটার জন্য দ্বিতীয় পরিকল্পনা তৈরি আছে তার। কথাটা ভেবে মুচকি হাসে সে।

নিমুর কাছে এসে মাহতাব বসতেই সে বলে ওঠে,

“তুমি কি ওই মেয়ের কোনো ব্যবস্থা করবে না?”

“করব, কিছুটা সময় দাও আমাকে।”

“সময় দাও মানে? আর কত সময় চাও তুমি? ওই মেয়েকে নাকি তুমি ভালোবাসো না? তাহলে ওর হাতে তালাকনামা কেন ধরিয়ে দিতে পারছ না?”

“সব কিছু এত সহজ নয়। একে তো আমি ওকে না জানিয়ে তোমাকে বিয়ে করেছি। তার উপর সিরাত যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। এই মুহূর্তে যদি আমি ওর হাতে তালাকনামা ধরিয়ে দিতে চাই তো ওই মেয়ে আমার হাতেই হাতকড়া পরিয়ে দেবে।”

“তাহলে কি তুমি এখন ওকে ভয় পেয়ে চুপ করে থাকবে?”

“ভুলে যেও না নিমু, আমাদের একটা সন্তান আছে। আমার সিরাতের প্রতি আর কোনো আগ্রহ না থাকলেও সন্তানের প্রতি ভালোবাসা আছে। আমি আমার মেয়েকে অনেক ভালোবাসি। এখন যদি সিরাত আমার কাছ থেকে আমার মেয়েকে দূরে সরিয়ে দেয় তখন কী হবে? তোমার কথা শুনে আমি এত দ্রুত তোমাকে বিয়ে করলাম। এটা করেই তো ঝামেলার সৃষ্টি হলো।”

“ওহ্ তাই? তাহলে তুমি কী চাইছিলে? বিয়ে ছাড়াই দিনের পর দিন আমার সাথে থাকতে চাইছিলে? বিয়ের আগে আমাদের মধ্যে অনেক কিছু হয়েছে। আমরা একসাথে থেকেছি। এসবের জন্য আমার সমস্যা হয়েছে। তাই বিয়ের জন্য তোমাকে চাপ দিয়েছি। ভুলটা কী করেছি আমি?”

“বিয়ে করেছি তো? তাহলে পুরোনো কথা কেন তুলছ?”

“কারণ তুমি আমাকে দোষারোপ করছ তাই।”

“এখন আমার তর্ক করতে ভালো লাগছে না। আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি।”

মাহতাব ফ্রেশ হতে গেলে নিমু ফোন হাতে নিয়ে তুলিকে কল দেয়। কল রিসিভ করলে সে বলে,

“হ্যালো তুলি?”

“হ্যা নিমু বল।”

“আগামীকাল দুপুরের পর আমি তোর সাথে দেখা করব। আমরা যেখানে সব সময় দেখা করি ওখানে তিনটার মধ্যে চলে আসিস।”

“আচ্ছা।”

কল কেটে দিয়ে নিমু মোবাইলে ফেসবুক স্ক্রল করতে শুরু করে। মাহতাব ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বলে,

“ক্ষুধা লেগেছে আমার। আমার জন্য খাবার নিয়ে এসো।”

“আমি একটু নাটক দেখছি। তুমি রান্নাঘরে গিয়ে একটু কষ্ট খাবার নিয়ে নাও।”

“এসবের মানে কী নিমু? আমার খাবার আগে নাকি তোমার এই নাটক দেখা আগে?”

“আরে বাবাহ তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন? নিজের খাবারটুকু নিজে নিয়ে খেলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?”

স্ত্রীর এমন ব্যবহারে বেশ অবাক হয় মাহতাব। বিয়ের আগে প্রায় সময় নিমু মাহতাবের জন্য রান্না করত। মাহতাব গেলে নিজে হাতে সবকিছু নিয়ে এসে খাইয়ে দিত। আর আজ সেই মেয়ে তার খাওয়ার গুরুত্ব দিচ্ছে না। এসব ভেবে ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।

রান্নাঘরে গিয়ে নিজের খাবার নিয়ে চেয়ারে বসে খেয়ে নেয় মাহতাব। খাওয়ার সময় তার মনে পড়ে, আগে সে খাওয়ার সময় সিরাত পাশে বসে থাকত। তার কখন কী লাগবে সবদিকে নজর ছিল মেয়েটার। মাহতাব ভেবেছিল, হয়তো নিমুও এমন হবে। বিয়ের আগের নিমুর সাথে এখনকার নিমুর কোনো মিল খুঁজে পায় না সে।

খাওয়া শেষে মাহতাব মেয়ের কাছে যায়। মেয়েকে এখনো জেগে থাকতে দেখে সিরাতকে প্রশ্ন করে,

“মামনি এখনো ঘুমায়নি যে?”

“সন্ধ্যা থেকেই কান্না করছে। না তো খাচ্ছে, আর না তো ঘুমাচ্ছে। একটু আগে ঘুমিয়েছিল। আবার উঠে গিয়েছে।”

মাহতাব মেয়েকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করে। বাবার কোলে উঠে মেয়ের কান্না থেমে যায়। বাবাকে পেয়ে সে যেন ভীষণ খুশি হয়েছে। কান্না থেমে গিয়ে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে নিমিষেই।

“আমার আম্মুটার কী হয়েছে শুনি? কান্না করছ কেন তুমি আম্মু?”

আধো আধো কণ্ঠে নাবিহা জবাব দেয়,

“বাবা আমার ঘুমাতে ইচ্ছা করছে না।”

মেয়ের কথা শুনে মাহতাব হেসে বলে,

“তাহলে কী করতে ইচ্ছা করছে?”

“তোমার সাথে বেরু করতে যাব।”

“কিন্তু এখন তো রাত হয়ে গিয়েছে আম্মু। তোমাকে আমি কাল সকালে বেরু করতে নিয়ে যাব কেমন? এখন তুমি ঘুমিয়ে যাও।”

বাবার কথা শুনে মেয়ের মনটা হয়তো খারাপ হয়ে যায়। সে ঠোঁট ফুলিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে।

চলবে??

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে