#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_২
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
“কী ব্যাপার সিরাত? সকাল দশটা বাজতে চলল। তুমি এখনও কিছু রান্না করলে না কেন?”
মাহতাবের কথা শুনে লম্বা হাই তুলে বিছানার উপর বসে সিরাত উত্তর দেয়,
“আজকে আমার শরীরটা কেমন যেন করছে। বিছানা থেকে উঠতেই ইচ্ছা করছে না। তার উপর আমাদের মেয়ে নাবিহা আমাকে একদমই ছাড়তে চাইছে না আজ।”
“তাহলে আমরা কি না খেয়ে থাকব?”
“তা কেন? তুমি তোমার নতুন বউকে বলো আজকের রান্নাটা করে ফেলতে।”
সিরাতের কথা শেষ হতেই নিমু খানিকটা চেঁচিয়ে বলে,
“আমি রান্না করতে পারব না। আমার বাবার বাড়িতে আমি নিজের হাতে খাবার বেড়ে নিয়েও খাইনি কখনো।”
“স্বামীর ঘর করতে এসেছ, আর এখন এসব বলছ? আমিও বাবার বাড়ির সবার কাছে ভীষণ আদুরে ছিলাম। নিজের সংসারে এসে সবাইকেই মানিয়ে নিয়ে কাজ করতে হয়। বিয়ে সম্পর্কে বিন্দু মাত্র জ্ঞান না রেখে বিয়ে করে ফেললে?”
“এই চুপ করো তো তুমি। তোমার থেকে কোনো পরামর্শ চাইনি আমি।”
“তোমার মতো মেয়ের সাথে কথা বলার জন্য বসে নেই আমি বুঝলে?”
“এই তোমার মতো মেয়ে মানে কী হ্যা?”
“বিবাহিত পুরুষের সাথে সম্পর্ক করা মেয়েদের কী বলে জানো না?”
“সিরাত চুপ করো। কেন সকাল সকাল ঝগড়া করছ তুমি?”
মাহতাবের এমন কথায় সিরাতের চোখেমুখে ফুটে ওঠে বিরক্তির ছাপ।
“ঝগড়া আমি আগে শুরু করিনি মাহতাব। তাই ভুলেও আমাকে কিছু বলবে না তুমি।”
“আচ্ছা ভুল হয়েছে আমার। এখন কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরে যাও। আমরা দু’জন খেয়ে বের হব।”
“এক মিনিট! আমাকে কি তোমার নতুন বউয়ের কাজের লোক মনে হয়? আমি রান্না করব, আর সে খেয়ে পটের বিবি সেজে ঘুরবে? শখ তো মন্দ না!”
“তুমি কী চাচ্ছ বলো তো?”
“নাবিহা এখন ঘুমাচ্ছে। একটু আগেই ঘুমিয়েছে আমার মেয়েটা। ওকে রেখে এখন আমি কোথাও যাব না।”
“আগে তো নাবিহাকে ঘুমিয়ে রেখেই সব কাজ করতে।”
“তখন আমাদের বাসায় আর কেউ ছিল না। কিন্তু এখন তো আছে। শুনে রাখো, আমি তোমার এই উটকো ঝামেলার কোনো কাজ করতে পারব না।”
“সিরাত!”
“একদম চিৎকার করবে না। এখনো আশেপাশের কেউ তোমার খবরটা জানে না৷ তুমি চাইলে আমি নিজ দায়িত্বে সোসাইটির সবাইকে খবরটা জানাতে পারি। জানাব?”
“তুমি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?”
“একদমই না। তুমি যা করেছ তাতে ভয় দেখানোর কিছু নেই। আর তুমি কি ছোট বাচ্চা যে আমি ভয় দেখাব আর তুমি ভয়ে কাঁপবে? তুমি নিজেও জানো যে তুমি অন্যায় করেছ। তাই বলছি আমাকে বেশি রাগিয়ো না। এর ফল ভালো হবে না।”
“ধুর তোমার সাথে কথা বলাই বেকার। নিমু আজকের রান্নাটা তুমি করে নাও।”
“এসব তুমি কী বলছ মাহতাব? রান্না আর আমি? আমি আগে কখনো রান্না করিনি।”
নিমুর কথায় মাহতাব চোখ বন্ধ করে কয়েকবার শ্বাস ছেড়ে তাকে পাশে নিয়ে গিয়ে বলে,
“এখন বেশি ঝামেলা করো না। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেলে আমি আর সামলাতে পারব না।”
“মাহতাব তুমি কি ভয় পাচ্ছ? তোমার যদি এতটা সমস্যা থাকে তাহলে আমাকে বিয়ে করলে কেন? তবে কি তুমি আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করোনি? বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছ?”
“বিষয়টা এমন নয় নিমু। আমি ভেবেছিলাম সিরাত তেমন ঝামেলা করবে না। করলেও ওকে সামলে নিতে পারব আমি। কিন্তু সিরাত এখন যা করছে সেটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল।”
“তুমি আমাকে বলেছিলে তোমার প্রথম স্ত্রী অনেক শান্ত, ভদ্র। সহজে তর্ক করে না। তোমার সব কথা মেনে চলে। কিন্তু আমি তো সব বিপরীত দেখছি।”
“সিরাতের এমন রূপ দেখে আমিও অবাক হয়েছি। ওও এতদিন এমন ছিল না।”
“অথচ আমাকে দেখে এমন হয়ে গেল তাই না? এভাবে চললে ওই মেয়ের সাথে এই বাসায় একসাথে আমি থাকতে পারব না।”
“এখন মেজাজ খারাপ করে কোনো লাভ নেই। আমার একটা কাজ আছে। আমি বাইরে যাচ্ছি। বিকালে ফিরে আমরা এসব নিয়ে আলোচনা করব। এই সময়টুকু তুমি ওর সাথে কোনো ঝামেলা করো না। এটা আমার অনুরোধ। আর সিরাত যদি কিছু বলে তাহলে সেটা চুপচাপ মেনে নেবে। কারণ এই মেয়ে এখন যা আচরণ করছে তাতে আমাদের সাথে যা কিছু করে ফেলতে পারে।”
“তার মানে আমি ওর সব কথা মেনে চলব তাই তো? তুমি কি আমাকে তোমার স্ত্রী আর মেয়ের দেখভাল করার জন্য বিয়ে করেছ?”
“না, আপাতত যা বলছি সেটা করো। বিকালে বাসায় এসে আমি নিজে সিরাতের সাথে কথা বলব। তুমি চিন্তা করো না।”
নিমু রাগ নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। মাহতাব সিরাতের কাছে এগিয়ে এসে মেয়ের পাশে বসে কপালে চুমু দেয়। অতঃপর সিরাতের উদ্দেশ্যে বলে,
“আমি একটা কাজে বাইরে যাচ্ছি। জানি তুমি আমার উপর অনেক রেগে আছো। কিন্তু এই মুহূর্তে নিমুর সাথে আর কোনো ঝামেলা করো না সিরাত। আমি বাসায় ফিরে একটা সিদ্ধান্ত নেব। ততক্ষণ পর্যন্ত একটু চুপচাপ থেকো।”
সিরাত শান্ত স্বরে বলে,
“কী সিদ্ধান্ত নেবে তুমি? আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত?”
মাহতাব কিছু না বলে এক পলক সিরাতের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সিরাত দরজার পানে চেয়ে মুচকি হাসে। চোখের কোণে পানি জমলেও এবার সে আটকে নেয় সেই পানি। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে দেয় না।
“পাঁচ বছর তোমার সাথে সংসার করেছি আমি। পাঁচটি বছর নিজের পুরোনো রূপ ভুলে শুধুমাত্র তোমার জন্য নতুন রূপে নিজেকে সাজিয়েছি আমি। চারপাশে এত এত বিবাহবিচ্ছেদ দেখে আমি ভয় পেয়েছিলাম। তাই তোমার মনের মতো হওয়ার চেষ্টা করেছি সব সময়। কিন্তু ছেলেদের তো একজনে বেশি দিন মন টেকে না। সমস্যা নেই মাহতাব। তুমি যে সিরাতকে সহজসরল বলে অবজ্ঞা করেছ এবার সেই সিরাতের আসল রূপ দেখবে। আমি এমন একজন হব যাকে দেখে এই সমাজের অনেক মেয়ে নিজেদের পাল্টানোর উৎসাহ পাবে। তুমি ভুল জায়গায় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ মাহতাব!”
ঘরের মাঝে পায়চারি করছে নিমু। রাগে তার শরীর জ্ব*লে যাচ্ছে। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে পাশের টেবিলে শব্দ করে সে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
“আমি এমনি এমনি মাহতাবকে বিয়ে করিনি। সিরাত, তুমি ভাবছ তো যে আমার উপর হ*ম্বিত*ম্বি করবে? তাহলে ভুল ভাবছ তুমি। আমি অবিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও মাহতাবকে বিয়ে করেছি। তার পেছনে অবশ্যই কারণ আছে। যদিও ভেবেছিলাম তুমি তেমন ঝামেলা করবে না। কিন্তু একবার যখন ঝামেলা করে ফেলেছ তখন তোমাকে তো আমি ছেড়ে দিব না।”
আপনমনে কথা বলে নিজের ফোনটা হাতে নেয় সে। একটা নাম্বারে কল দিয়ে অপেক্ষা করে অপর পাশের ব্যক্তির হ্যালো বলার আশায়।
“হ্যালো”
কাঙ্ক্ষিত মানুষের কণ্ঠ শুনে নিমু বলে ওঠে,
“কেমন আছিস?”
“ভালো থাকি কীভাবে বল? তুই আমাদের কাউকে কিছু না বলে বিয়ে করে ফেললি। একবার জানাবি তো নাকি?”
“রাগ করিস না তুলি। আমি আসলে কাউকে জানানোরই সময় পাইনি। হঠাৎ করেই আমি আর মাহতাব বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাই তেমন কাউকে জানানো হয়নি।”
“মাহতাব ভাইয়া না বিবাহিত? তাহলে তোরা এত জলদি বিয়ে করলি কেন?”
“আমার একা থাকতে সমস্যা হচ্ছিল। একটা আশ্রয়স্থলের প্রয়োজন ছিল আমার। তাই এই মুহূর্তে ওকে বিয়ে করা ছাড়া আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না।”
“আচ্ছা তারপর বল, হঠাৎ আমাকে কল দিলি যে?”
“আমি তোর সাথে দেখা করতে চাই তুলি।”
“বিশেষ কোনো প্রয়োজন?”
“দেখা করে সব বলব। তুই আগামীকাল ব্যস্ত থাকবি?”
“না, তেমন কোনো কাজ নেই আগামীকাল।”
“ঠিক আছে। আমি তোকে আজ রাতে দেখা করার সময় আর ঠিকানা জানিয়ে দিব। এখন রাখি।”
“আচ্ছা।”
চলবে??