নিবেদিত প্রেম আরাধনা পর্ব-১৮

0
1841

#নিবেদিত_প্রেম_আরাধনা
||১৮তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
আরাধ্য মায়ের ঘরে ঢুকে। তার আগমনের আভাস পেয়ে কী যেন বিড়বিড়িয়ে সাথে সাথেই মোনাজাত শেষ করেন মোকশেদা বেগম।

“তুমি বাবাকে নিয়ে কিছু বলছিলে মনে হলো?”

“না, না, কই? আমি তো অন্য দোয়া করছিলাম। তুই দুশ্চিন্তায় কী শুনতে না কী শুনে ফেলেছিস। এসব বাদ দে, ভাত দেই তোর।”

আরাধ্য কনফিউজ হয়ে পড়ে। সত্যিই সে ভুল শুনেছে কি না… কারণ মা তো বাবার বিষয়ে মন্দ বলে না কখনোই।

“আচ্ছা, ভাত দাও। কিন্তু শান্ত কই? আজকে তো কবিরেরও আসার কথা।”

“ওদের যেন কোন জায়গায় যেতে হবে। তিনটা বা সাড়ে তিনটার দিকে আসবে বলে গেল শান্ত।”

“তাহলে আমি তখনই খাবো ওদের সাথে। তুমি খেয়ে নাও।”

আরাধ্য শোবার ঘরে চলে যায়। ঘরে ঢুকতেই সে যেন আরও বেশি পোড়ে প্রেমানলে। কারণ এই পুরো ফ্ল্যাটটাই তো নিবেদিতার স্পর্শে সিক্ত, বিশেষ করে তাদের এই ঘরটা।

যুবকের চোখের কোণে নোনাজল এসে ভিড় জমায়। দমবন্ধ অনুভূতি বোধ হয় তার, যেন অক্সিজেন স্বল্পতা হচ্ছে ঘরটিতে। নিজেকে সামলাতে বারান্দার খোলামেলা পরিবেশে যেয়ে দাঁড়ায় সে। তাতে ভার বোধটা কমলেও পোড়ন বাড়ে আরও।

বারান্দাটা যে নিবেদিতার অতিপ্রিয়। প্রতিটি ফুল গাছ নিবেদিতার নিজ হাতে লাগানো, সাজানো, যত্ম নেওয়া। বেতের চেয়ারগুলো তার পছন্দের।

আনমনেই আরাধ্য ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বিড়বিড়ায়,
“নিবেদিতা তুমি দেখছো না তোমার অভাবে আজ ভালো নেই আমাদের একটু একটু করে গড়ে তোলা প্রেমের মসজিদ। তোমার অভিমানের শীতকালে আজ গোলাপ গাছের পাতাগুলো ঝরে শেষ। প্রতি নিয়তে পুড়ছে তোমার প্রেমিক তুমি হীনতায়।”

নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে যুবক কল করে প্রেয়সীকে। যদিও জানে নিবেদিতা তুলবে না তার কল, তবুও হৃদয়কে আশ্বাস দিতে তো আর ক্ষতি নেই।

নিবেদিতা বারান্দায় বসে চা পান করছিল, ভাবছিল নিজের অগোছালো হয়ে পড়া জীবনকে নিয়ে। এমন সময় কল আসে ফোনে। আরাধ্যের কল, উপেক্ষা করতে পারে না, রিসিভ করে ফেলে।

“চলে আসো না, নিবেদিতা। আমি আর পারছি না তোমার হারানোর নরকযন্ত্রণা আমায় শেষ করে দিচ্ছে।”

নিবেদিতার চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে অলক্ষ্যেই।
“ফিরার উপায় কি রেখেছো? আমি বারবার তোমার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি, ক্ষমা শুনে ফিরে যেতে যেতে ক্লান্ত। শুধু ক্লান্তই নই, নিজের চোখে নিচে নেমে গিয়েছি, নিচে নেমে গিয়েছে আমার আত্মসম্মান।”

“আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আই প্রমিজ, সত্যিই আর কখনো তোমার কষ্ট দিব না। তোমার গোলাম হয়ে থাকবো সারাজীবন। তুমি যেভাবে খুশি সেভাবে চলবে। আমি দরকার হলে চাকরি ছেড়ে দিবি, বাড়ি সামলাবো। তুমি নিজের স্বপ্ন পূরণ কোরো, আরও বড়ো হও নিজ ক্যারিয়ারে।”

নিবেদিতা আহত হয়। সে কখনোই তো আরাধ্যের গোলামি চায়নি। আরাধ্য তবে আজও বুঝলো না নিবেদিতা কষ্ট, ক্ষত, মনোবাসনা।

“আমার স্বপ্ন কখনোই ক্যারিয়া আকাশচুম্বী সাফল্য পাওয়া বা প্রচুর অর্থ-সম্পত্তির মালিক হওয়া ছিল না। আমার স্বপ্ন তোমার সাথে ছোটোখাটো একটা ছোট্ট সুখের নীড় বাধার ছিলে; যেখানে একে অপরের প্রতি কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা, সম্মান থাকবে।

আমি কখনোই তোমায় গোলাম বানাতে চাইনি, কারণ তুমি চাকর হলে আমি চাকরানী হব। বরং, তোমায় রাজার মতো রেখে আমি রাজরানী হতে চেয়েছি। কিন্তু আফসোস আমার কর্মে তুমি নিজে তো রাজা হলে কিন্তু আমি রাজরানী নয় চাকরানী হলাম।

একটা সত্য কি জানো? তুমি এখনও অনুতপ্ত নয় তোমার কাজের জন্য। তুমি এখনও ভাবছো তুমি অত কোনো ভুল করোনি। তোমার আকুতি, সিক্ত কণ্ঠ শুধু আমায় হারানোর ভীতি থেকে, আমার প্রতি ভালোবাসা থেকে। অনুতাপ থেকে নয়।”

নিবেদিতা কল কেটে দিয়ে নিজেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। দুই ফোঁটা নীরব অশ্রু গড়িয়ে পড়ে আরাধ্যের চোখ থেকে। তাদের চোখ থেকে নির্গত প্রতিটি অশ্রুকণা জানে তাদের নিবেদিত প্রেম আরাধনা।

___

আবরাহাম মুচকি মুচকি হাসছে নিবেদিতার কথা চিন্তা করে। সে ভেবেছে আজ সন্ধ্যা কোনো বাহানায় নিবেদিতাকে নিয়ে রমনা পার্কে যাবে। তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরপরই টুং করে বেজে উঠে।

আবরাহাম ফোন চালু করে দেখে ‘দুঃখমাখা সুখ’ আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকু এসেছে। এসেছে ম্যাসেজও।

লিখা,
– বলেছিলেন তো আমার বন্ধু হবেন মি. আবরাহাম, বলেছিলেন কথা বলার সঙ্গী হবেন। তো কোথায় আপনি? কোথায় আপনার কথার মূল্য? বন্ধু যদি হয়েই থাকেন, জবানের মূল্য যদি হয়েই থাকে, তবে আজ আমার সাথে শিশুপার্কে যাবেন।

আবরাহাম ছোট্ট এক দুঃখ, হতাশা জর্জরিত শ্বাস ফেলে। তার প্রেমময় সন্ধ্যা কাটানোর প্ল্যানিংটা যে ভেস্তে গেল। তবে কিছু তো করার নেই, বন্ধুত্বের প্রস্তাব যেহেতু গ্রহণ করেছে, সেহেতু তার আবদার পালন তো করতেই হবে। সুখকে “তৈরি থেকে” বাক্যটি টেক্সট করে সাথে সাথেই।

আলমারি খুলে একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার বের করলো। চলে গেল শাওয়ার নিতে। তার আবার এক অদ্ভুৎ স্বভাব যতোবার বাহিরে বের হবে, আর যতোবার বাহির থেকে আসবে, ততোবার গোসল করা আবশ্যক৷ এতোকিছুর মাঝে যুবক একবারও খেয়াল করলো না তার প্রতিটি পদক্ষেপ কেউ একজন গাঢ় দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে।

সেই মানুষটি হলো সুখ। তার দু’চোখ দুর্বিনের লেন্সে স্থির। ঠোঁটের কোণে ঝুলছে মিষ্টি এক হাসি। হাসি থাকবেই না কেন? ভীষণ আনন্দিত কিশোরী, আজ প্রথমবার সে ডেটে যাবে বলে কথা। আবরাহামের কাছে এ হয়তো সাধারণ এক ভ্রমণ বা সফর, তবে সুখের কাছে প্রেমময় এক সন্ধ্যা।

কিশোরী হর্ষধ্বনির সহিত বলে উঠে,
“আপনি আমার অতিপ্রিয়ই নয় শুধু মিস্টার, একমাত্র প্রিয়ও। আপনাকে কোনোভাবেই হারানো সম্ভব নয়, আপনি আমারই থাকবেন। এখন বন্ধু হয়ে পরে নাহয় সঙ্গী হয়ে থাকবেন।”

বারান্দা থেকে উঠে চলে গেল। আজ যে তাকে ভালোভাবে তৈরি হতে হবে। প্রিয় মানুষটির চোখে যে তার উদ্দেশ্যে মুগ্ধ দৃষ্টি থাকা আবশ্যক।

___

মোকশেদা বেগমে খাওয়া-দাওয়া সেড়ে অভ্যাস অনুযায়ীই শুয়ে পড়েন, কিন্তু আজ ঘুম আসছে না। কেমন যেন অপরাধবোধ হচ্ছে বিনা কারণেই। তসবিহ হাতে সারা ঘরময় হাঁটতে হাঁটতে আল্লাহর নাম নিচ্ছে। কী একটা মনে করে যেন ছেলের ঘরেও ঢুকেন।

আরাধ্য তখন ভাঙা হৃদয় নিয়ে বারান্দার ফ্লোরে হাটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে৷ মধ্যবয়সী নারীটি ছেলের এই দশা দেখেই আঁতকে উঠেন।

ছেলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে চিন্তিত ও উত্তেজিত ভঙ্গিমায় জিজ্ঞেস করেন,
“কী হয়েছে বাবা? এমন করে বসে আছিস কেন? অসুস্থ লাগছে?”

প্রশ্ন করতে করতেই তিনি ছেলের মাথার কাছে যেয়ে বসেন। তিনি চুলে হাত বুলাতেই আরাধ্য মাকে জড়িয়ে ধরে ঢুকরে কেঁদে দেয়৷

“মা ও আর আসবে না। ও আমায় ফিরিয়ে দিয়েছে মা। আমি কী করে থাকবো মা? মা তুমিই বলো আমি এমন কী বড়ো কষ্ট দিয়েছি ওকে? এমন কী বড়ো ভুল করেছি যার জন্য এত যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি পেতে হলো আমায়? আমি তো খারাপ স্বামী নই, তাই না? বাবাও তো এমন করতো, তবুও তো তোমার নিকট বাবা শ্রেষ্ঠ স্বামী ছিল। তবে নিবেদিতা কেন…?”

মোকশেদা বেগমের বুকটা ধ্বক করে উঠে। তবে কি নিজের সন্তানের বাবা তথা স্বামীর সম্মান রক্ষার্থে সন্তানের সুখকে বিকিয়ে দিচ্ছেন তিনি? এ তো পাপকার্য।

তিনি কিছুটা সময় নিয়ে শুধান,
“বয়সটা সতেরো ছুঁই ছুঁই যখন তোর বাবার সংসারে আসি। আমি ছিলাম গ্রামের বোকাসোকা, দশম ফেল ছাত্রী, তোর বাবা ছিল ঢাকা কলেজের অধ্যাপক। আমার ছিল না সাহিত্য নিয়ে কোনো ধ্যান-ধারণা, তোর বাবার জীবনের প্রতিটি পাতা জুড়েই ছিল সাহিত্য, হাদিস সহ নানা বই। বুঝতেই পারছিস আমি বামুন হয়ে চাঁদ হাতে পেয়েছিলাম।

তুই বড়ো হয়েছিস, জানিস কতোটা স্বপ্ন নিয়ে মেয়ে প্রথম দিন স্বামীর খাটে বসে। আমিও বাসর ঘরে স্বপ্নের ঝুড়ি সাজিয়ে বসেছিলাম। ভাবছিলাম সখী রিনার স্বামীর মতোন তোর বাবা শাড়ি উপহার দিয়ে সারা রাত জেগে আমার সাথে গল্প করবে না কি রীতির স্বামীর মতোন আঙটি হাতে পরিয়ে গান শুনাবে?

আমাকে অবাক করে আমার স্বামী মানে তোর বাবা এমন কিছুই করেনি। উপহার স্বরূপ আমাকে দিয়েছিল রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলী বইটি। আমি জিজ্ঞেসু ও অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন রবি ঠাকুরের বই পড়েছি কি না? জানালাম পড়িনি। আরও নানা নাম না শোনা লেখকের নাম নিলেন। তাদের নিয়ে গল্প করলেন। একাই গল্প করলেন, আমি তো কিছুই চিনি না, জানি না। শেষে জিজ্ঞেস করলেন সাহিত্য পছন্দ করো। আমি তো তখন সাহিত্যের মানেও জানতাম না।

শুনে ভীষণ হতাশ দেখালো তাকে। খেয়াল করবি তোর বাবা কখনো আমার সাথে আড্ডা দেয়নি, দুটো সুখ-দুঃখের কথা বলেনি। কারণ কী জানিস? তোর বাবা আমাকে কখনো কথা বলার মতোন মানুষই ভাবেনি। তার আড্ডার বিষয় যে আমার রুচি ও জানার বাহিরে। আমি ভীষণ কষ্ট পেতাম। সাধ্যমতো চেষ্টা করতাম তাকে খুশি করার। পারতাম না। তার প্রিয়-অপ্রিয় সবকিছুর খেয়াল রাখতাম, প্রিয় শার্টটায় ভাজ বা ময়লা পড়তে দেইনি, ধুলো পড়তে দেইনি তার সংগ্রহে থাকা একটি বইকেও। ধুলোয় এলার্জি থাকার পরও বইগুলো রোজ রোজ পরিস্কার করতাম, যদি তার মন পাই।

প্রতিনিয়তও নিজের হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা নিংড়ে তার জন্য একেক পদের নাস্তা, খাবার রান্না করতাম। তার জন্য কাজল পরতাম, পরতাম রেশমের শাড়ি, চুড়ি পরতাম যত্ন করে। কারণ রিনা বলেছিল উপন্যাসে নায়িকারা না কি এভাবেই সাজে। তবুও স্বামীর মন পায়নি। বরং, তার রাগ-ক্ষোভ বের করার বস্তু এবং ঘর ঠিক রাখার চাকরানী হয়ে গিয়েছিলাম। একসময় ক্লান্ত হয়ে উঠলাম, সব ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে মন চাইলো তোর আগমনে সেই পথে বাধা পড়লো। মা-বাবা বলল, মানিয়ে নেও মারে তো আর নাই। ঠিকই একদিন মুগ্ধ হয়ে মন দিবে।

উঠে-পড়ে সংসার করলাম, যত্নে গড়ে তুললাম এই সংসার, তোকে। তবে স্বামীর মন বা স্বামীর সুখ পেলাম না। ততদিনে তোর বাবার মন একটু নরম হয়েছে আমার প্রতি। সম্মানটা আগের মতোই না দিলেও মাঝেমাঝে আজকাল কিছু উপহার আনতো। জানি না তার উদ্দেশ্য কী ছিল, তবে আমার ক্ষত-বিক্ষতে হৃদয়ে একটু হলেও মলম লাগতো। ভালো থাকার জন্য কিছু তো চাই। আমি শত অসম্মানজনক পরিস্থিতির মাঝে সেই ভালো থাকার কারণ হিসেবে বেছে নিলাম সেই উপহারগুলোকেই। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস, তোর বাবা ছিল না কখনো আদর্শ স্বামী, না হয়েছিস তুই। মন্দই বলা যায় বটে তোকে স্বামী হিসেবে।”

মায়ের কথা শুনে স্তম্ভিত আরাধ্য৷ কয়েক মিনিট লেগে যায় তার মোকশেদা বেগমের কথাগুলো পরিপাক করতেই।

কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
“স-সত্যি বলছো? তবে তুমি এতো কাল যা বাবাকে নিয়ে তা ম-মিথ্যে?”

“হ্যাঁ, আমি আমার সন্তানের চোখে স্বামীর মান খোয়াতে চাইনি। আমি তো আমার স্বামীকে ভালোবেসেছি, মন-প্রাণ দিয়ে সে না বাসুক। আর তোর বাবা স্বামী হিসেবে খুব ভালো নাহলেও একজন মানুষ আর বাবা হিসেবে কিন্তু অমায়িক ছিল। আমি একটু অসুস্থ হলেই সে রাত রাত জেগে আমার যত্ন করতো, তোর অসুস্থতায় তো তার পাগলপ্রায় দশা। মানুষটা মৃত্যুশয্যায় তার সকল পাপের জন্য অশ্রুসিক্ত চোখে ক্ষমা চেয়ে গিয়েছে, তার জন্য আমার মনে কোনো অভিযোগ বা কষ্ট নেই। শুধু চাই যাতে জান্নাতটা নসীব হয় তার সাথে, ন্যায্য ভালোবাসা আর সম্মানটা পাই। আমার কাছে ওয়াদা কর কোনোদিন বাবার জন্য মনে এক কণা জল পরিমাণও অভিযোগ বা কলুষতা রাখবি না।”

মোকশেদা বেগম তাঁর হাত এগিয়ে দেয় পুত্রের দিকে। আরাধ্য সেই হাতে হাত রেখে কোনোরকম ‘হ্যাঁ’ উচ্চারণ করে। বস্তুত, সে হঠাৎ করেই এই কলুষিত বাস্তবতা মেনে নিতে পারছে না।

___

সুখের কদমে কদম মিলিয়ে হাঁটছে আবরাহাম। উদ্দেশ্য শহীদ জিয়া শিশু পার্ক। সুখের আবদারে রিকশা করে এসেছিল। শাহাবাগে আসতেই সবসময়কার মতোই শিশু পার্কের কিছুটা আগে থেকে জ্যাম।

আবরাহাম ট্রাফিক জ্যামের ক্ষেত্রে অত ধৈর্য্যশীল মানুষ কখনোই নয়। তাই না পেরে নেমে পড়লো রিকশা থেকে এখন বাকি পথ টুকু হেঁটেই যাচ্ছে।

পার্কের সদর দরজার সম্মুখে আসতেই আবরাহাম চলে গেল টিকেট কাটতে। সুখ পাশের এক ছোট্ট ফুড কার্ট থেকে একগাদা রুটি, কলা ও বিস্কুট কিনে নিল। আবরাহাম ফিরে এসে এসব দেখে অবাক।

“তুমি এগুলো দিয়ে কী করবে?”

“আরে আগে ধরেন তো! কেমন পুরুষ যে আপনি আল্লাহ জানেন!”

অগত্যা আবরাহাম প্যাকেটগুলো ধরলো। তারপর সুখের আদেশ অনুযায়ী তার পিছন পিছন চললো। কিশোরী একে একে বেশ কয়েকজন পথশিশু ও দুঃস্থ বৃদ্ধদের খাবারগুল দিল। আবরাহাম অবাক হয়ে গেল, এই বয়সে এমন জেদী, উড়নচণ্ডী এক কিশোরীর গরীবদের নিয়ে এতো ভালোবাসা দেখে।

“চলেন এখন ভিতরে যাই।”
সুখ খাবার দেওয়া শেষ হলে প্রস্তাব দিয়ে উঠে। আবরাহাম তাকে নিয়ে পার্কে ঢুকে। আবছা আলোয় দেখতে সদ্য পিতা-মাতা হওয়া দম্পতিদের খুনসুটি ও বাচ্চাদের আধো আধো বুলিতেই কলরব।

“কী অমায়িক এক পরিবেশ না মি. আবরাহাম? এই মানুষগুলোকে দেখতেই আমার এখানে আসতে ভালো লাগে। মনে হয় এই বাচ্চাগুলোর মাঝে নিজেকে দেখছি। ইশ! আমি যদি এদের জায়গায় হতাম।”

কিছুটা মলিন হয়ে পড়ে সুখের মুখশ্রী। পরক্ষণেই সে মেকি হাসি ফুটায়।

“আমি এমন জীবন পায়নি তো কী হয়েছে? আমার মেয়ে পাবে। আমার ছোট্ট এক সংসার হবে, যার আদুরে রাজকন্যা হবে আমার মেয়ে, ভালোবাসাময় রাজকন্যা।”

“এখনো নাক টানলে দুধ বের হয়। তার আবার চিন্তা বিয়ে, বাচ্চার। বলি স্বামী, সংসারের প্রেশার নেওয়ার ম্যাচুরিটি এসেছে? আর কে করবো তোমার মতো পিচ্চিকে বিয়ে? সে নিশ্চয়ই মদন কুমার হবে।”

“ম্যাচুরিটি না বয়সের সাথে আসে না। আসে তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে। আমার তা কম ছিল না। আর বলা তো যায় না কে বর হয়। ভাগ্যের উপর কার জোর আছে? দেখা গেল আপনিই সেই মদন হয়ে গেলেন মিস্টার।”

কপালে তর্জনী ঘর্ষণ করতে করতে মৃদু হাসে যুবক।
“আমার বয়স কত জানো? তোমার প্রায় দ্বিগুণ বয়সী আমি। একদম বেমানান আমার সাথে। তুমি বিয়ে করবে তোমার বয়সী খুব বেশি হলে ছয় বছরের বড়ো কাউকে। একসাথে বৃদ্ধ হবে। আমাকে বিয়ে করলে কয়দিন পর যখন চুলে পাক ধরবে, চেহারায় রিঙ্কেল ভাসবে তখনই সব আবেগ ফুড়িয়ে যাবে নে। লোকজন বলবে বুড়ার বউ, কষ্ট পাবে। সুতরাং, নতুন কাউকে নিয়ে স্বপ্ন সাজাও, মানানসই কাউকে নিয়ে।”

সুখ নির্বিকার। মনে মনে বলে,
“আমার তো মানানসই কাউকে চাই না, বেমানান আপনিটাকেই নিজের করে চাই। একসাথে বৃদ্ধ না হলাম, আপনার বৃদ্ধকালের সঙ্গী হলেই বা কম কীসে?”

এভাবেই কেটে যায় এক মলিন সন্ধ্যা সুখ ও তার প্রিয় মানুষটির।

___

কেটে গিয়েছে প্রায় পনেরো দিন আরাধ্যের সেই কলের। এরপর আর নিবেদিতা ও আরাধ্যের মধ্যে কোনো প্রকার কথাবার্তা হয়নি। যদিও আঁধার রাতে দুজনই দুজনার জন্য কাতর।

তবে আজকাল নিবেদিতা ও আবরাহামের সম্পর্ক বেশ গভীর হয়েছে আগের তুলোনায়। তারা একসাথে প্রায়শয়ই ব্রাঞ্চে যায়, যায় ডিনারে এবং হাঁটাহাঁটি করতে। বিষয়টা বন্ধুত্বপূর্ণ দেখালেও কিছুটা অন্য অনুভূতিও জড়িয়ে আছে।

মালিহা বিষয়টা খেয়াল করেছে। অনেকদিন ধরে নিবেদিতার বিষয়টা নিয়ে সরাসরি কথা বলবে বলে ভাবছে সে।

আজ নিবেদিতাকে কেবিনে একা বসে থাকতে দেখে কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেই ফেলে,
“তোর কি আবরাহাম স্যারের জন্য মনে কিছু আছে? ইউ নো হোয়াট আই মিন।”

নিবেদিতা তার প্রশ্নকে গুরুত্ব না দিয়েই বিরক্তির সুরে ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে উত্তর দেয়,
“আজাইরা কথা বলিস না তো। এমন কিছুই নয়। হি ইজ জাস্ট বিয়িং ফ্রেন্ডলি।”

নিবেদিতার হাত থেকে তার ফোন নিয়ে টেবিলে রেখে দেয় মালিহা। তার দুই হাত ধরে সিরিয়াস ভঙ্গিমায় তাকায়।

“লুক, আ’ম সিরিয়াস। স্যার তোর দিকে যেভাবে তাকায়, তোর সাথে যেভাবে কথা বলে, প্রসংশা করে, নানা বাহানায় ঘুরতে নিয়ে যায়, তা তোর জাস্ট ফ্রেন্ডলি মনে হয়? তুই একটা মেয়ে, মেয়েরা চার হাত দূর থেকেও কেউ প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকালে বুঝতে পারে। তুই এখনও বুঝিসনি সে তোর জন্য কিছু ফিল করে। লাইক সিরিয়াসলি!”

নিবেদিতা মাথা নত…
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে