#নিবেদিত_প্রেম_আরাধনা
||১৭তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
সুখ স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বের হয়েছে। যদিও তার যাওয়ার মন নেই। তবে পরীক্ষা যেতেই হবে।
উদাস মনে কাঁচিগেট পাড় হয়ে বের হয়ে গাড়িতে উঠে বসে। ঠিক তখনই রহিম মোল্লার ডাক কানে আসে।
“মামনি, এট্টুনি দাঁড়াও। আমি আসতেছি।”
সুখ গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করতে আদেশ করে ড্রাইভারকে। রহিম মোল্লা এসে আবরাহামের লিখা চিরকুটটি এগিয়ে দেয়।
“ছোটো বাজানে দিয়েছে তোমাকে দিতে বলে। এখন আমি যাই আম্মাজান।”
আবরাহাম তাকে চিরকুট লিখেছে কথাটা মস্তিষ্কে ধারণ করতেই মন নেচে উঠে তার। প্রসন্নচিত্তে রহিম মোল্লার উদ্দেশ্যে বলল,
“চাচা, একটু দাঁড়ান। এইটা আপনার জন্য আমার তরফ থেকে উপহার। আমি বানিয়েছি।”
ব্যাগ থেকে বিরিয়ানির বক্সটা এগিয়ে দেয় কিশোরী। রহিম মোল্লার কী একটা আনন্দে চোখে জল চলে আসে। আজ অবধি সবাই তাঁকে খুশি হয়ে টাকা দিয়ে বোধ করিয়েছে কতোটা ভালো ভৃত্য তিনি, আজ প্রথম কেউ তাঁকে এত ভালো এক উপহার দিয়ে বুঝালো তিনি কত আপনের মতোন উপকার করেছেন।
“তোমারে আল্লাহ সুখী করুক মা৷ অনেক সুখে সুখী করুক।”
তিনি চলে যান টিফিন বক্স নিয়ে। সুখের ইশারায় গাড়ি চলতে শুরু করে। সুখ চিরকুটটি খুলবে এর পূর্বেই খেয়াল করে চিরকুটের এক ভাজে লিখা ‘টু প্রিয় অসুখ’। বুক ধ্বক করে উঠে তার৷ তবে কি চিঠিতে আবরাহাম প্রত্যাখান করেছে তার প্রস্তাবকে? তীব্র বেদনা ও ভীতির ছাপ নিয়ে চিরকুটটি পড়তে শুরু করে কিশোরী।
‘প্রিয় অসুখ,
সুখিনীর অসুখ নাম শুনে নিশ্চয়ই মন খারাপ করে বা গাল ফুলিয়ে বসে আছো। তবে রাগ কোরো না অসুখ নামটা আদর-ঠাট্টায় দেওয়া। কারণ তুমি তো অসুখের মতোই জড়িয়ে নিলে আমায় শক্ত ভাবে, আর মুক্তিই দিচ্ছো না। হলাম তোমার বন্ধু আমি। হলাম তোমার পথপ্রদর্শক, পরমর্শদাতা। তবে ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা আমার থেকে কোরো না। তোমার মাঝে এখন ভালোবাসা নয় আমায় নিয়ে বয়ঃসন্ধিকালের আবেগ ডানা মেলছে। মেচ্যুউরিটি আসার সাথে সাথে এই আবেগ কেটে যাবে অনায়াসেই।
– আবরাহাম
আবরাহামের চিঠি পড়ে কিছুটা হতাশ হলে খুশিও হয়। এই রূঢ়ভাষী মানুষটার বন্ধুত্ব প্রাপ্তিই বা কম কীসে?
আপন মনেই বিড়বিড়ায় সুখ,
“আপনি জানেন না আমার কতোটা জুড়ে আপনি মি. আবরাহাম। মানলাম বয়ঃসন্ধিকালের আবেগ, তবুও আপনাকে ছাড়া অচল আমি। কারণ আমার হৃদয়ের বেদনা প্রতিমুহূর্ত দ্বিগুণ হারে বাড়তে থাকে আপনি হীনা থাকলে। আমি আপনি নামক নেশায় জর্জরিত, নিবেদিত আমি প্রেম আরাধনায়।”
___
মিটিং শেষে মালিহার সাথে কথায় কথায় আবরাহাম জানতে পারলো নিবেদিতার সিদ্ধান্তের কথা। তার মনে যেন লাড্ড ফুটতে শুরু করে আনন্দে।
মনে মনে বলে,
‘এটাই সঠিক সুযোগ নিবেদিতার মনে জায়গা করার।’
নিবেদিতা একগাদা ফাইল নিয়ে বসেছে, যা তাকে দেওয়া হয়েছে তা তো আছেই, যা দেওয়া হয়নি তাও। নারীদের দুঃখ ভুলার বা রাগ বের করার এক বিশেষ ব্যবস্থা হলো অতিরিক্ত মাত্রায় কাজ করা বা কাজে ডুবে যাওয়া।
কাজ করতে করতে কখন আঁধার নেমে গিয়েছে আকাশের বুকে বুঝতেই পারেনি নিবেদিতা। মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য মালিহাও নেই, সে ক্লায়েন্টের সাথে রেস্টুরেন্টে মিটিং সেড়ে সেখান থেকেই সোজা বাড়ি ফিরেছে।
হুট করেই কেউ কানের কাছে ‘ভাউ’ বোধক শব্দ করায় পিলে চমকে উঠে রমণীর। সেও চেঁচিয়ে উঠে আতঙ্কে। তাকিয়ে দেখে আবরাহাম।
বুক হাত দিয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে শুধায়,
“আপনি তো ভয় পায়িয়ে দিয়েছিলেন মিস্টার।”
আবরাহাম সেই তিল চমকানো হাসি দেয়। সেই নিষ্পাপ হৃদয় ছোঁয়া হাসি দেখে নিবেদিতাও নিজের রাগ বা ভয় ধরে রাখতে পারে না। হেসে দেয় বটে।
“এভাবে ভয় দেখানোর কোনো মানেই হয়? বিনা কারণে কার্য কিন্তু ধ্বংসও ডেকে আনে।”
“সে হিসেবে তো জনাবা আমার বলা উচিত ভয় না পেলেও পারতে। অনেক ক্ষেত্রে বিনা কারণের কার্য ভালোই ডেকে আনে। এই যেমন আমার এই কাজ।”
নিবেদিতা বুকে দু’হাত ভাজ করে রাখে। তার মলিন মুখশ্রীতে এখন অনেকটাই সতেজ।
“তা কী ভালো ডেকে আনলেন মশাই?”
“এই যে তোমার মুখের হাসি। তাও বা কম ভালো কীসে?”
নিবেদিতার কেমন যেন অদ্ভুৎ দৃষ্টিতে তাকায়। কিছুটা বিস্ময় ছিল তাতে। আবরাহাম বুঝতে পেরে কথা ঘুরাতে চেষ্টা করে।
“তা ম্যাম আজ কি বাড়ি ফিরার নিয়ত নেই না কি? অফিস আওয়ার শেষ হয়ে সাড়ে আটটা বেজে গিয়েছে। আমার অফিসে কিন্তু শোয়ার জায়গা নেই বলে রাখি।”
সাড়ে আটটা বেজে গিয়েছে শুনে অবাক হলো নিবেদিতা। তাড়াতাড়ি হাতঘড়িতে চোখ বুলালো।
“সরি, সরি। আমি খেয়ালই করিনি এতোটা বেজে গিয়েছে। আমি এখন বের হই। অফিস থেকে বাসা অনেক দূরে, যেতে যেতেই দশটা বেজে যাবে।”
সে নিজের হ্যান্ডব্যাগ গুছাতে শুরু করে। নিষ্পলক তাকিয়ে আবরাহাম প্রস্তাব রাখে,
“আমি ড্রপ করে দেই? আড্ডা দিতে দিতে পৌঁছে যাবো গন্তব্যে, এমনিতেও অনেক কথা জমে আছে।”
ভ্রু কুঁচকে তাকায় রমণী। শুকনো ঢোক গিলে যুবক।
“মানে তুমি একা মেয়ে, এত রাতে কোনো বিপদ-আপদও হতে পারে। তাছাড়া এখন সিএনজি পাওয়ার চান্সও কম। পুরুষ হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে না? আমিই ড্রপ করে দেই।”
নিবেদিতা একবার ভাবে। উপলব্ধি করে সত্যিই এখন একা যাওয়াটা নিরাপদ হবে না। সে রাজি হয়। অতঃপর দুজন একসাথে যাত্রা শুরু করে গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে।
আবরাহাম ইচ্ছে করেই ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গানটি ছাড়ে। নিবেদিতা জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বাহিরে দৃষ্টি স্থির রাখে।
“জীবনের আকাশে অনেকেই আসে সূর্যের রূপ ধরে, অথচ তারা হয় ভাসমান মেঘ। তাদের স্থায়িত্ব ক্ষণিকের হয়। এ নিয়ে মন খারাপ করতে নেই। বরং, নিজের সূর্যকে খুঁজে নিতে হয়।
আমি শুনেছি তোমার ডিভোর্সের বিষয়ে। এ নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা কোরো না। লাইফ ইজ এ জার্নি, ট্রাই টু ইঞ্জয় ইট।”
যুবকের কথায় তার দিকে চোখ তুলে তাকায় রমণী। মৃদু হাসে।
“মানুষের স্থায়িত্ব ক্ষণিকের হলেও, ভালোবাসা চিরকাল জীবিত থাকে হৃদয়ে। প্রেম হাজার বার হলেও ভালোবাসা একবারই হয়, একজনের সাথেই হয়, সারাজীবনের জন্যই হয়।”
নিবেদিতার এই কথা অনেকটা নড়বড়ে করে দেয় আবরাহামের উদ্দেশ্যকে। তবুও নিজেকে সামলে নেয় সে। এড়িয়ে যেতে অন্য বিষয়ে কথা বলতে শুরু করে।
__
দুপুরবেলা, আরাধ্য আজ অফিসে যায়নি। অনেকদিনের লিভ বাকি পড়ে আছে তার, সেই হিসেবে দু’দিনের ছুটি নিয়েছে সে। যোহরের নামাজ সেড়ে বাসায় ঢুকে নিজের ঘরে যাওয়ার সময় মায়ের ভারাক্রান্ত কণ্ঠ কানে আসে তার। যা শুনে তা কাঁপিয়ে তুলে তাকে।
শুনতে পায় মোকশেদা বেগম জায়নামাজে বসে দু’হাত তুলে বলছেন,
“আল্লাহ, আমি তোমার কাছে বারংবার চেয়েছি আমার স্বামীর মতো নিষ্ঠুর, নির্দয়া যাতে আমার ছেলে নাহয়। তুমি তা-ই….”
চলবে…