#নিবেদিত_প্রেম_আরাধনা
||১৬তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
আবরাহাম খামে ‘দুঃখমাখা সুখ’ লিখা দেখেই বুঝতে পারে চিঠিটা কার। বিরক্তিকর এক ভঙ্গিমায় বিড়বিড়ায়,
“দুঃখমাখা সুখ? লাইক সিরিয়াসলি? সোনার চামচ মুখে নিয়েই তো জন্মেছে। একেই হয়তো বলে সুখে থাকতে দুঃখে মরে। যত্তসব নাটক।”
খামটা আক্রোশে ফেলে দিতে নিয়েও কী মনে করে ফেলে না যুবক। তবে পড়েও না। যেভাবে ছিল সেভাবেই রেখে দেয়। যদিও কোথাও না কোথাও ভিষণ করে পড়তে মন চাচ্ছে চিঠিটা। কিন্তু ঐ যে আক্রোশ, এর জন্যই উপেক্ষা।
কাচঘেরা দামী আলমারি থেকে প্রয়োজনীয় পোশাকাদি বের করে বাথরুমে চলে যায় শাওয়ার নিতে। তার দু’বার গোসল করার অভ্যাস বিদেশে থাকাকালীন সময় থেকেই। তারপর রোজকার নিয়মমাফিক ডিনার করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
কিন্তু অবাককর কাণ্ড, আজ তার চোখজোড়ায় ঘুম হানা দিচ্ছে। কেমন উত্তেজনা বোধ হচ্ছে, যেন কী একটা জানেনি সে, করেনি সে। হয়তো সুখের চিঠি পড়ার প্রতি ঝোঁক থেকেই অস্থিরতা।
আর কৌতূহল চাপিয়ে রাখতে না পেরে বেডের সাইডের ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে খামটা হাতে নেয়। চিঠি বের করে পড়তে শুরু করে তা।
‘প্রিয় আবরাহাম,
জানি আমার সম্বোধনটি আপনার পছন্দ হয়নি। তবে আপনার পছন্দ হওয়া বা না হওয়াতে তো সত্য বদলাবে না, না বদলাবে বাস্তবতা। আর বাস্তবতা তো জানি আমি।
জানি কতোটা প্রিয় আপনি, আমার ভাবনা, চিন্তা-চেতনা, মস্তিষ্ক জুড়ে আপনার বাস। আমি মদ-সিগরেটে আবরাহাম সাহেব আপনাতে আসক্ত। তবে আফসোস আপনি আমাকে ভালোবাসা তো দূরে থাক বিন্দু পরিমাণ আকর্ষণের অনুভূতি নিয়েও যে কখনো দেখেননি, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। যাকগে আমার প্রণয় জাহির করতে বা প্রেম নিবেদন করতে এই চিঠি নয় মোটেও।
চিঠিটা লিখা শুধু একটি কারণেই আপনার প্রতিবার বলা একটা কটুকথা, যা পুরোটাই মিথ্যে। তার সত্যতা জানাতে। বারবার তো বললেন আমি সোনার চামচ নিয়ে জন্মানো মেয়ে, আদর-সোহাগ পেতে পেতে মাথায় চড়ে বসেছি। সোনার চামচ নিয়ে জন্মেছি ঠিকই, পয়সার মাঝে থেকেছি ঠিকই, কিন্তু সুখ বা আদর তা এই সুখের ভাগ্য আদৌ জুটেছে। এত যখন শোনালেন একটু জানবেন না কতোটা সুখে সুখী আমি?
ছোটো থেকে বড়ো হয়েছি একা একা। সকালবেলা মম ডে-কেয়ারে রেখে যেতো সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরার সময় নিয়ে যেতো। নিয়ে যেয়েও কী? তারা আমাকে কোনোরকম খায়িয়ে নিজের ঘরে চলে যেতো। কত কাঁদতাম, ভয় পেতাম একাকী ঘুমাতে। আকুতি-মিনতি করতাম একটু আমার সাথে শোয়ার জন্য। কিন্তু না তারা আমাকে একাই ছেড়ে দিতো। তখন রাত বিভীষিকাময় লাগতো, আজ যদিও সে বন্ধু বড়ো। তাও যেমন তেমন ভাবে নিজ পিতামাতার সঙ্গেই বড়ো হচ্ছিলাম।
কিন্তু সাত বছর বয়সের পর থেকে বাবা-মাকে একদমই পাওয়া যেতো না তখন কাছে। যখনই তারা বাড়ি ফিরতে নিজ নিজ বন্ধু, বান্ধুবী নিয়ে ফিরতো। আমি দুপুরবেলা স্কুল থেকে ফিরে একাই থাকতাম বাড়িতে, সকাল সকালই বুয়া এসে রান্নাবান্না আর বাদবাকি কাজ সেড়ে চলে যেতো। তাও যা তা ভাবে চলছিলাম মানিয়ে নিয়ে।
একদিন কিছু কারণ বশত স্কুলে প্রথম পিরিয়ডের পর ছুটি দিয়ে দেয়। আমাকে আমার বান্ধুবীর মা বাসার সামনে দিয়ে যায়। চাবি দিয়ে দরজা খুলে শুনতে পাই একজোড়া নর-নারীর হাসাহাসি ও কথোপকথনের শব্দ আসছে মম-ড্যাডের বেডরুম থেকে। আমার শিশুমন উৎফুল্ল হয়ে উঠে কত দিন পর বাবা-মায়ের সাথে সময় কাটাতে পারবো ভেবে।
কিন্তু দরজা ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই যা দেখতে পাই… ড্যাড অন্য এক নারীর সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় শুয়ে ছিল বিছানাতে। তারাও আমাকে দেখে অবাক। বাবা চক্ষুলজ্জায় বারবার নজর এড়াচ্ছিল আমার। কিছু বলবেন তার পূর্বেই আমি ছুটে আমার রুমে যেয়ে দরজা লক করে দেই। ছোটো ছিলাম তখন, কিন্তু অতোটাও অবুঝ নয়। ভিতরে ভিতরে ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাই। তারপরও ভাবতাম বাবা এমন হলেও মাটা ভালো। ভাগ্যের পরিহাস তাকে কিছুদিন পর একই দশায় মমকে…
তো দেখেন পয়সাই আছে আমার কাছে, আর কিছু নেই। একটা মানুষও নেই আমার জীবনে প্রকৃত অর্থে যে আমাকে ভালোবাসে। পাড়া-পড়শীরা সবাই জানে মম-ড্যাডের ক্যারেক্টারের বিষয়, সবাই ঘৃণ্য দৃষ্টিতে দেখে আমাকে। আপনার দাদীজানও তাই। পাড়ার বা স্কুলের ছেলেদের বাজে দৃষ্টি তো সর্বদাই… আত্মীয়-স্বজন বলতে কোনো মানুষকে আমি কখনো দেখিই নাই। আমার বন্ধুরা অবধি শুধু আমার পয়সা উড়ানোর জন্য আমার সাথে থাকে। আমার পিছনে আমাকে নিয়ে মহা করা, তারাও যে জ্ঞাত মম-ড্যাডের বিষয়ে।
একটু ভালোবাসা, একটু আদরের জন্য রীতিমতো বছর বছর ধরে তৃষ্ণার্ত আমি। বিন্দু পরিমাণ ভালোবাসাও কি আমার প্রাপ্য নয়? এতোটা অপরাধী আমি?
না, ভালোবাসার ভিক্ষে আমি চাইবো না। ভালো না বাসেন বন্ধু তো হতে পারেন আমার, প্লিজ। আমি এই প্রথমে জীবনে কাউকে পেয়েছি যারা আমাকে আমার মম-ড্যাডকে দিয়ে বিচার করেনি। যে আমার অত্যন্ত প্রিয়তে পরিণত হয়েছে। আপনার বন্ধুত্বেরও কি অযোগ্য আমি? আমার কথা বলার একটা মানুষও নেই। হয়ে যান না আমার কথা বলার সঙ্গী!
ইতি,
দুঃখমাখা সুখ।’
আবরাহাম চিঠিটা পড়ে স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে খাটে। এটুকু মেয়ে এতোটা মানসিক যন্ত্রণাদায়ক পরিবেশে আছে তা অবিশ্বাস্য লাগছে তার। অনুতাপ বোধও হচ্ছে ভীষণ সেসময় মেয়েটাকে অত কথা বলে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। কিছু একটা ভেবেই সে খাট থেকে নেমে পড়ার টেবিলে কাগজ-কলম নিয়ে বসে। ছোট্ট এক চিরকুট লিখেই তৃপ্তিকর হাসি নিয়ে তন্দ্রায় ডুবে যুবক।
____
নিবেদিতার নির্ঘুম রাত্রি কাটছে। নীরব কান্নায় বালিশ সিক্ত হচ্ছে প্রতিমুহূর্ত। কেন এত কষ্ট ভালোবাসায়? কেন এত পরীক্ষা?
জীবনটা কোনো নাটক কিংবা সিনেমা থেকে কম নয়। তবে আমরা পরিচালক কিংবা লেখক নয় চরিত্র শুধু, যাদের দড়ি ঐ উপরওয়ালার হাতে স্থির।
তবে কতো ভালোই না হতো নিজের জীবনের রাইটার বা ডিরেক্টর হতে পারলে! এটা অসম্ভব তারপরও আকাঙ্ক্ষিত। এমনটা হলে আজ নিশ্চয়ই এই সময়ে নিবেদিতার কান্নায় বালিশ না সিক্ত হয়ে আরাধ্যের বক্ষে মিশে সে নিজেই ভালোবাসায় সিক্ত হতো।
কাঁদতে কাঁদতেই সে ডুবে যায় আরাধ্যের সাথে জড়িত এক আদুরে স্মৃতির মাঝে। দিনটি ছিল শুক্রবার। আকাশটা সকাল থেকেই গুমোট ভাব নিয়ে আছে, যেন ক্ষুব্ধ সে কারো উপর, একটু পরেই বর্ষণ হবে তার ক্রোধের। তবে সেই একটু পর আর আসছিল না।
নিবেদিতার এমন আবহাওয়া খুবই পছন্দনীয়। সে দেব-কোয়েলের মুভির “রিমঝিম ধারাতে চায় মন হারাতে” গানটি মোবাইলে ছেড়ে নিমাই ভট্টাচার্যের ‘মেমসাহেব পড়তে বসেছে। এমন সময় পড়ায় ব্যাঘাত বাধিয়ে মেক্সিমাসের টাচ স্ক্রিন ফোনটি বেজে উঠে তীব্র শব্দে।
বিরক্তি নিয়ে কল রিসিভ করে নিবেদিতা। সে কিছু বলবে তার পূর্বেই আরাধ্য অপরপাশ থেকে বলে উঠে,
“এখনই বাসার নিচে আসো। আমি রিকশা দাঁড় করিয়ে রেখেছি। না আসলে কিন্তু মরা মুখটা দেখবে আমার। নীল রঙের শাড়িই পরনে চাই কিন্তু।”
এমন কথা শুনলে প্রেয়সীরই আতঙ্কিত হওয়ার কথা, নিবেদিতার তো প্রাণের চেয়েও প্রিয় আরাধ্য, সে কাতর হয়ে কোনোরকম মায়ের নীল রঙের একটা শাড়ি গায়ে প্যাঁচিয়ে নিয়ে উপরে বোরখা পরে নেয়। মাকে কতশত কোচিং, হামিদ স্যারের জরুরি বিশেষ ক্লাসের বাহানা দিয়ে বাসা থেকে বের হয়।
বাসার সামনেই রিকশা দাঁড় করানো ছিল। কিছু না ভেবেই চড়ে বসে রমণী। কল করে আরাধ্যকে। কিন্তু বজ্জাত ছেলে কল আর রিসিভ করে না। রিকশা মেইন রোডে এসে থামে, সাথে সাথেই কোথা থেকে এসে চড়ে বসে আরাধ্য।
“এটা কোনো কথা হলো নিবেদিতা? কত করে বললাম শাড়ি পড়তে, তাও…!” কিছুটা দুঃখ, কিছুটা রাগ ছিল আরাধ্যের কণ্ঠে।
নিবেদিতা হেসে দেয় খিলখিল করে। ছেলেটাকে মুখ ফুলালে অতিরিক্তই হাস্যকর লাগে।
“আরে বাবু মশাই, ভিতরে শাড়িই পরেছি। এখন যদি মায়ের সামনে দিয়ে ড্যাংড্যাং করে শাড়ি পরে বের হতাম, মা ঠ্যাং-ই না ভেঙে দিতো আমার! আমি কিন্তু বেশ রেগে, আপনি এমন দোহায় দিয়ে ডাকলেন কোন দুঃখে?”
প্রশ্নটা করা শেষেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। বিন্দু বিন্দু জলকণা ছুঁয়ে দেয় কপোত-কপোতীর মুখশ্রী। রিকশা থামে, নিবেদিতা খেয়াল করে জায়গাটা বেলি রোড।
আরাধ্য রিকশা থেকে নেমে তার দিকে হাতে থাকা একগুচ্ছ কদম ফুল এগিয়ে দিয়ে শুধায়,
“আজ আমরা রূপা আর হিমু হয়ে বেলি রোডে বৃষ্টি বিলাশ করবো একে অপরের সাথে। এই শ্রাবণের মন মাতানো বর্ষণে আমরা সিক্ত হবে আমাদের নিবেদিত প্রেম আরাধনার বৃষ্টিতে।”
নিবেদিতা সেদিন বৃষ্টিস্নাত হওয়ার পুরোটা সময় অবাক চোখে তাকিয়েছিল আরাধ্যের দিকে। মনে হচ্ছিলো এতোটা প্রেম সুখ বুঝি তার জীবনে লিখা ছিল? সে হয়তো জানতো না একটি কথা।
যে বিষয়ের সূচনা সুন্দর হয়, তার সমাপ্তি মন্দ হোক না হোক পরিণাম ততোটা কুৎসিত ও হৃদয় বিদারক হওয়া আবশ্যক।
পুরোনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুমে তলিয়ে যায় নিবেদিতা। দুঃখবিলাসিনীর চোখে অবশেষে শান্তির নিদ্রা হানা দেয়৷
___
আরাধ্য সারা ঘর জুড়ে পায়চারী করছে। না বসে শান্তি পাচ্ছে, না দাঁড়িয়ে থেকে। তার হৃদয়ের চারিধারে শূণ্যতা। ভালোবাসার এমন এক শূণ্যতা, যা পূরণ করতে পারে একমাত্র নিবেদিতা নামক নারীটি।
“নিবেদিতা প্লিজ চলে আসো। আমি আর পারছি না তোমায় ছাড়া। আমার শ্বাসরুদ্ধকর অনুভূতি হচ্ছে নিবেদিতা। আমার মনে হচ্ছে এই ঘোর কালো আঁধারে আমি তলিয়ে যাবে, মরণ হবে আত্মার। আমাকে শাস্তি দাও, বাসিন্দা করো চৌদ্দ সিকের, তবুও ছেড়ে যেয়ো না।”
কথাগুলো বিড়বিড়াতে বিড়বিড়াতেই চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। এই মুহূর্তে ছাদে কারো উপস্থিতির আভাস পায়। অবচেতন মন ভেবে নেয় মানুষটি তার মা।
তাই না দেখেই আবেদন করে,
“মা প্লিজ আমাকে একা ছেড়ে দাও।”
“একা ছাড়লে হবে বন্ধু? এতোদিন পর এসেছি।”
পরিচিত কণ্ঠ শুনে পিছন ঘুরে তাকায় আরাধ্য। মানুষটিকে দেখে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না, দৌড়ে যেয়ে ‘দোস্ত’ বলে জড়িয়ে ধরে তাকে। যুবকটি আর কেউ নয় আরাধ্যের প্রাণপ্রিয় বন্ধু ও কাজিন শান্ত।
আরাধ্য যতোটা একরোখা ও রাগচটা স্বভাবের, শান্ত ততোটাই সহনশীল, বুঝদার ও শান্তশিষ্ট ছেলে। আরাধ্যের কাছে সবসময়ই শান্ত তার পরামর্শদাতা ও পথপ্রদর্শকের মতোন। কিন্তু প্রায় দু’বছর ধরে এই প্রিয় মানুষটির সাথেই কথা হয় না তার।
আজ আর দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না আরাধ্য। প্রকাশ করে নিজের হৃদয়ের আর্তনাদ,
“দোস্ত, জানিস নিবেদিতা না আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমি কীভাবে থাকবো ওকে ছাড়া তুই বল? তুই তো জানিস আমি ওকে কত ভালোবাসি সেই ভার্সিটি লাইফ থেকে। আমার তো বাঁচা-মরা এক লাগছে। আমি কী করবো, কোথায় যাবো ওকে ফিরে পেতে আমি কিচ্ছু বুঝছি না। কিচ্ছু না!”
আরাধ্যকে উত্তেজিত হতে দেখে তাকে শান্ত করে শান্ত। স্থির ভাবে শুধায়,
“আমি আন্টি থেকে সব শুনেছি। এতো ভালোবাসিস তুই, তবে আঘাত করলি কেন মেয়েটাকে? কেন সব বিগড়ানোর পর বলছিস ভালোবাসি, সব ঠিক রাখতে কেন নয়? মেয়েটা দিনের পর দিন কষ্ট ছিল, তুই কষ্ট লাঘোব করবি তো দূরে থাক, বুঝলিও না। দোষ তো তোর কম নয়।”
“আমি ভাবিনি শান্ত। আমার এটুকু ক্রিয়ায় এতো বড়ো প্রতিক্রিয়া পাবো। আমি তো আউট অফ দ্য বক্স কিছু করিনি।”
“তুই শুধু তোর দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টা দেখছিস। শুধু ভাবছিস তুই অত বড়ো কিছু করিসনি নিবেদিতার সাথে। বুঝছিস না তোর অল্প আঘাতেই ও কত অধিক কষ্ট পায়। কারণ মেয়েটা তোর থেকে এসব এক্সপেক্টই করে না। তুই চিন্তা কর একবার তুই আগে কতোটা আগলে রাখতি ওকে, হঠাৎ করে এমন আচারণ বিয়ের পর… নিবেদিতা এমন বদলে গেলে তোর কেমন লাগতো একবার ভাব?”
আরাধ্যকে আসলেই ভাবিয়ে তুলে শান্তের বাণীগুলো। কেমন যেন লাগে কথাগুলো হৃদয়ে যেয়ে।
“আমি এত প্রেশারে থাকি। আমি ইচ্ছা করে করি না এসব, হয়ে যায়। আমি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।”
শান্ত মৃদু হাসে।
“রাগ উঠলে কি তোর মাকেও কি যা তা বলিস? আর বন্ধুদের সামনে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে ওসব কথা, তাও কি রাগের মাথায়? মোটেও না, নিজেকে বড়ো দেখানোর প্রচেষ্টা শুধুই। একটা কথা মনে রাখিস স্ত্রীকে ছোটো করে বা ধমকের উপর রাখলে কেউ সাহসী পুরুষ হয় সকলের কাছে, বরং এক কাপুরুষ হয়। আর স্ত্রীকে মানিয়ে, নিজে মেনে চললে এবং যোগ্য সম্মান ও ভালোবাসা দিলে কেউ বউয়ের গোলাম বা লুতুপুতু বউ পাগল স্বামী হয় না, বরং আদর্শ পুরুষ হয়। তোর চিন্তা-ভাবনাই ভুল, মানসিকতাও।”
আরাধ্য নির্বিকার। সে চাইলেও কিছু বলতে পারছে না। এই একটি মানুষ যার কথা সে পুরোপুরিই মানে, আর সেই মানুষটিই তাকে আজ আয়না দেখাচ্ছে। কিন্তু মনে মনে ভাবে,
-তবে কি বাবা আদর্শ পুরুষ ছিল না? ছিল না সঠিক তার মানসিকতা? তবে মা কেন তাকে ভালোবাসতো এতো?
শান্ত তার ভাবনার মাঝেই বলে উঠে,
“জানিস রবি ঠাকুর কী বলেছেন? ‘লোকে ভুলে যায়, দাম্পত্যটা একটা আর্ট, প্রতিদিন ওকে নূতন করে সৃষ্টি করা চাই’। তুইও ভুলে গেছিস, সম্পর্ককে ফেলে রেখেছিস অযত্নে, ভালোবাসার মানুষটিকে রেখেছিস অবহেলায়। কখনও ভেবেছিস তোর অবহেলায় ফেলে রাখে রত্নটাকে কেউ আগলে নিলে কী হবে? তখন তো খুব করে বলবি মেয়েটা বেইমান ছিল।
ভালোবাসা খাঁটি স্বর্ণের মতোন হলেও সম্পর্ক হলেও একখণ্ড লোহা, যা অযত্নে ঘরে ফেলে রাখলে মরীচা পড়বেই। আর খাঁটি স্বর্ণ অবহেলা করে যেখানে সেখানে রাখলে কেউ না কেউ আত্মসাৎ করবেই।”
শান্তের বলা শেষ দু’বাক্য বিভীষিকাময় লাগে আরাধ্যের নিকট। ভয়ে ঘাম ঝরে যায় তার। নিবেদিতা তার, শুধুই তার। অন্যকেউ তাকে কখনোই ছুঁতে কেন সে দৃষ্টিতে দেখতেও পারবে না।
আরাধ্যের আতঙ্কিত মুখখানা দেখে বিশ্বজয়ের হাসি দেয় শান্ত। বিড়বিড়ায়,
“তীর তাহলে ঠিক স্থানেই লেগেছে। আমি এসেছি, আই উইল ফিক্স এভ্রিথিং ভাই।”
“আচ্ছা, এত ভাবিস না। চল এখন ঘুমাবি। চেহারা সুন্দর না থাকলে নিবেদিতা ভাবীর পাত্তা পাবি না।”
টেনে ঘরে নিয়ে যায় শান্ত আরাধ্যকে। যদিও যুবক প্রেয়সীর যন্ত্রণায় তখনও কাতর।
চলবে…