#নিবেদিত_প্রেম_আরাধনা
||১২ ও ১৩তম পর্ব|| (শব্দসংখ্যা- 3100+)
-ঈপ্সিতা শিকদার
মালিহা অফিসে ঢুকেই নিবেদিতার কক্ষে যায় তার অপেক্ষা করতে, মূলত ট্রিপে তোলা ছবি ও ভিডিওগুলো একসাথে দেখতেই তার এমনটা করা। দরজা খুললেই নিবেদিতা আগে থেকেই সেখানে কপালে হাত দিয়ে বসে আছে।
বড্ড বেশিই বিষণ্ণ লাগছে রমণীকে। ঠিক বিষণ্ণও নয়, বিধ্বস্ত লাগছে তাকে। ফ্যাকাসে ও রক্তশূণ্য মুখশ্রী, কান্নায় ফুলে লাল হয়ে উঠা চোখজোড়া, অগোছালোভাবে পরা হিজাব। আবার রোজকার নিয়মের বাহিরে যেয়ে বেশ আগেই অফিসে চলে এসেছে নিবেদিতা।
“কী রে আজ এত জলদি আসলি যে অফিসে? গুড গার্ল, রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে খুব ভোরে উঠেছিস তবে।” হালকা হেসে প্রশ্ন করে মালিহা
“যার নেই নিদ্রা, জীবন হয়ে উঠেছে বিভীষিকাময় তার আবার রাত আর ভোর!”
বিদ্রূপার্থেই বলে নিবেদিতা। মালিহার বুক ভার হয়ে উঠে, কপালে চিন্তার ভাজ দেখা দেয়। অবশ্য গতকাল রাতে যখন কবির জিজ্ঞেস করছিল নিবেদিতার বিষয়ে তখনই কিছুটা খটকা লেগেছিল তার।”
“এনিথিং রং দোস্ত? কিছু হয়েছে? তুই না আরাধ্যের বাসায় গেলি কথা বলতে?”
নিবেদিতা ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে উদাসীন ভাবে একে একে বলে উঠে সবকিছু। নিজের দাদীর বিষয়টিও বাদ রাখে না।
মালিহা ফুঁসে উঠে সব শুনে।
“একটা মানুষ এতোটা একরোখা কেমনে হতে পারে! এতবার বলার পর, বোঝানোর পরও কী করে নিজের দোষটা দেখেও না দেখার ভান করে থাকতে পারে? তুই এতদিন সংসার করেছিস কী করে এর সাথে? আমি হলে তো নিজে পাগল হয়ে একেও মেরে ফেলতাম। তার উপর জুটেছে আবার ঐ হারামি বুড়ি!”
কান্নায় ভেঙে পড়ে নিবেদিতা। কাঁদতে কাঁদতেই জাহির করে নিজের হৃদয়ের আর্তনাদ,
“আমি কী চাই ওর কাছে? টাকা-পয়সা, হীরা-মুক্তা বা কোনো মূল্যবান কিছু তো আমার চাওয়া নয়। সাধারণ একটা স্ত্রীর সম্মান টুকু চাই আমি। যেভাবে আমার বাবা আমার মাকে সম্মান করে, অতটুকু সম্মান চাই আমি।
এতটুকুও কী করতে পারে না আমার? বাড়িতেও শান্তি পাচ্ছি না দাদীর খোঁচা মারা কথাবার্তা আর গালিগালাজেম আমি পারছি আর নিতে এমন মানসিক যন্ত্রণা। ভিতরে ভিতরে মারা যাচ্ছি আমি।”
মালিহা কেবিনের দরজা খোলা রেখেই ভিতরে প্রবেশ করেছিল তখন। তাই কক্ষের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আবরাহাম স্পষ্ট শুনতে পারে নিবেদিতার কান্না ও আকুতি।
বুক মোচড়ে উঠে তার। তবে কি তার পছন্দের মানুষটি ভালো নেই বৈবাহিক জীবনে? যতোই হোক নিবেদিতাকে নিয়ে অতি সামান্য হলেও আবেগ-অনুভূতি তো আছেই তার হৃদয়ে। যুবকের খুব করে ইচ্ছে করে নিবেদিতাকে যেয়ে সামলাতে, তবুও নিজের ইচ্ছেকে মাটি দিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে সে।
মালিহা নিবেদিতাকে জড়িয়ে ধরে নিজেও কেঁদে দেয়। অশ্রু ভেজা গলায় বিড়বিড়ায়,
“তুই ওকে অনেক বেশি ভালোবাসিস, এজন্যই সব রাগ-অভিযোগ ভুলিয়ে বারবার চলে যাস। এটাকেই তোর দুর্বলতা ভাবে ও। ও জানে, মানে তুই চলে গেলেও ওর কাছেই ফিরে আসবি, ওরই থাকবি। দিস ইজ হোয়াই হি অলওয়েজ টেক ইউ ফর গ্রান্টেড।”
মালিহা বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তবে প্রকৃতপক্ষে একমাত্র নয়, নিজের বিশ মিনিটের বড়ো শান্তশিষ্ট যমজ বোন মাহিরাকে হারিয়ে সাত বছর বয়সে একমাত্র সন্তানে পরিণত হয়েছিল সে। নিবেদিতার মাঝে সে সবসময়ই মাহিরাকে খুঁজে পায়। নিজের এই বন্ধু রূপী বোনের কষ্ট কী করে মেনে নিবে সে।
ধীরে ধীরে সময় বাড়ার সাথে সাথে অফিসের সব কর্মচারী আসতে শুরু করে। নিবেদিতা নিজেকে সামলে নিয়ে মালিহাকে তার জায়গায় পাঠায়। নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সাথে কর্মজীবনকে না মেশানোর প্রচেষ্টা সর্বদাই।
___
মোকশেদা বেগম বাসায় ঢুকে আরাধ্যকে এলোমেলো হয়ে সোফায় শুয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে যান। বেশি অবাক হন বসার ঘরের অগোছালো, যা-তা অবস্থা দেখে। এখানে কাপড়, ওখানে ব্যগপত্র, খাবার। তার মনে প্রশ্ন উদয় হয়, নিবেদিতা কোথায়?
“রিজভি? রিজভি? অনেক বেলা হয়েছে তো আর কত ঘুমাবি? উঠ এখন।”
ছেলেকে ডাকতে ডাকতেই তিনি জিনিসপত্র উঠিয়ে গোছাতে শুরু করেন। মধ্যবয়স্ক নারীদের অগোছালো ঘর-বাড়ি কিছুতেই সহ্যকর নয়।
একটু বাদেই রিজভি ঘুম থেকে জেগে উঠে বসে। চোখ ডলতে ডলতে মাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে,
“আমাকে বললে আমিই তো নিয়ে আসতে পারতাম, তুমি একা আসতে গেলে কখন?”
“আমি কি বাচ্চা না কি? একাই আসতে পারি। তুই বল নিবেদিতা কোথায়? আর ঘরের এই অবস্থা কেন?”
আরাধ্য বিব্রত হয়ে পড়ে। কী উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না সে। একবার নিজের ও নিবেদিতা ব্যক্তিগত ব্যাপারে মাকে জড়িয়েছে সে, আবার তা করতে চাচ্ছে না।
“ও তো অফিসে গেছে। আমার দেরি হচ্ছে, আমি গোসলে গেলাম।”
কোনোরকম উত্তর দিয়ে বড় বড় পা ফেলে সেখান থেকে পালায় আরাধ্য।
মোকশেদা বেগম হতাশ হন। ছেলেকে নিজে আগলে বড় করেছেন, তবুও বাবার বাতাস যে কী করে গায়ে লাগলো তা ভেবেই পান না। তিঞ্জ নিজেই যেখানে এই যন্ত্রণা ভোগ করেছেন নিবেদিতাকে কী বোঝাবেন? আর কতবার-ই বা বোঝাবেন? ছেলের সামনে স্বামী ছোট হয়ে যাবে বলে ছেলেকেও কিছু বলতে পারেন না।
আরাধ্য অফিসে যাওয়ার জন্য খুব আয়েশ করে তৈরি হয়। প্রোমোশনের পর আজ তার প্রথম দিন অফিসের। সকল কর্মচারীর সিনিয়র হিসেবে পা রাখবে সে, ভাবতেই উত্তেজনা খেলা করছে মনে।
নিবেদিতাকে নিয়ে বর্তমানে তার মনে কোনো আক্ষেপ বা চিন্তা নেই। যুবক পূর্ববর্তী ঘটনাগুলোর সাপেক্ষে ভেবেই নিয়েছে যতো যাই হোক নিবেদিতা তার সাথে রাগ করে থাকতে পারবে না।
তবে অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়ি স্টার্ট করার আগে নিবেদিতাকে দুই বাক্যের একটা টেক্সট পাঠায় সে।
– অভিনন্দন মিসেস নিবেদিতা। আপনার স্বামী এখন এম.ডি আর আপনি এম.ডিয়ের ওয়াইফ।
___
লাঞ্চ আওয়ার, রেস্টুরেন্টে বসে খেতে খেতে এনা গোমেজের দেওয়া নতুন প্রজেক্টটা সম্পর্কে আলোচনা করছে নিবেদিতা, মালিহা ও আবরাহাম। বর্তমানে আবরাহামের সবচেয়ে বিশ্বস্ত দুজন কর্মচারী ও প্রজেক্ট হেড তারাই।
আলোচনার সময়ই নিবেদিতার ফোন শব্দ করে উঠে। নিবেদিতা লজ্জাজড়িত হাসি দিয়ে “এক্সকিউজ মি” বলে ফোন হাতে নেয়।
হয়তো নরম মনা কোনো নারী হলে বা তাদের সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক হলে নিবেদিতা বিজয়ীর ন্যায় আনন্দ পেতো আজ কিংবা আনন্দে কেঁদেই দিতো। নিবেদিতারও চোখে অশ্রু চলে আসে, তবে আনন্দ নয় কষ্ট উপেক্ষিত হওয়ার কষ্টে।
প্রেমিক বা প্রিয়তম থেকে কতক্ষণ উপেক্ষা সহ্য করতে পারে একজন নারী? নিবেদিতারও সহ্যের বাধ ভেঙে যাচ্ছে। ভালোবাসার নদের উপর তিক্ততার বালি পড়ছে। খুব শিঘ্রই কি তবে মৃত্যু হতে চলেছে তার ভালোবাসার নদের?
নিবেদিতার কান্না খেয়াল করে আবরাহাম ও মালিহা উভয়েই। মালিহা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
“তুই ঠিক আছিস দোস্ত?”
আবরাহাম চুপ থাকে যাতে রমণী বিব্রত না হয়। আগে থেকেই মানসিক ভাবে ক্ষত-বিক্ষত থাকায় এই সামান্য আঘাতেই নিবেদিতা মানসিক ভাবে খুব বেশিই ভেঙে পড়ে।
তার একে একে মনে পড়ে যাচ্ছে সব তিক্তকর স্মৃতি, দাদীর সকল তিক্ত বাণী। রমণী সেখানেই কেঁদে দেয়, মাথা ঘুরাচ্ছে তার।
ব্যক্তিত্বসম্পন্ন যেই মেয়েটি আপনজন ব্যতীত কারো সম্মুখে কাঁদেনি সে পুরো রেস্টুরেন্ট ভর্তি মানুষের সম্মুখে কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। মালিহা ও আবরাহাম বহু চেষ্টার পরও তাকে শান্ত করতে ব্যর্থ হয়। একসময় সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে নিবেদিতা।
আবরাহাম তাড়াতাড়ি তাকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে উঠে হাসপাতালের দিকে ছুটে। এতোটাই ভয়ে আর তাড়ায় ছিল সে যে মালিহাকেও নিতে ভুলে যায়। মালিহা একটা রিকশায় চড়ে আবরাহামের গাড়ির পিছনে যায়।
ইমারজেন্সিতে ভর্তি করা হয় নিবেদিতাকে। নিবেদিতাকে ভিতরে নেওয়ার পরপরই মালিহা হাসপাতালে আসে। নিবেদিতার কেবিন থেকে ডাক্তার বেরিয়ে আসলেই।
উৎকণ্ঠিত হৃদয়ে ছুটে তার নিকট যায় আবরাহাম ও নিবেদিতা।
“ডক্টোর, নিবেদিতা কেমন আছে? শি ইজ ফাইন রাইট?”
চল্লিশ উর্ধ্ব ডাক্তার সাহেব মৃদু হাসেন আবরাহামের এমন ভঙ্গিমা দেখে। তিনি ভেবেই নেন নিবেদিতা আবরাহামের স্ত্রী।
“ডোন্ট ওয়ারি স্যার, ইউর ওয়াইফ ইজ আউট অফ ডেঞ্জার নাউ। অতিরিক্ত স্ট্রেস ও টেনশনে পাস আউট করেছে। একদম সঠিক সময়ে এসেছেন আপনি, নাহলে বড়ো অঘটনও ঘটতে পারতো।”
“ওকে, ডক্টোর।”
স্ত্রী বলায় একটু বিব্রত হয় আবরাহাম। এদিকে মালিহা ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা ভাবছে।
একটু বাদেই জ্ঞান ফিরে নিবেদিতার। খবর পেয়েই মালিহা ও আবরাহাম দুজনেই যায় তার কেবিনে।
“তুমি তো একদম ভয় পায়িয়ে দিয়েছিলে নিবেদিতা।” বলতে বলতে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে আবরাহাম।
“আপনার জন্যই তো বেঁচে গেল স্যার। আপনি সাথে না থাকলে আজ কী যে হতো।”
নিবেদিতা কৃতজ্ঞচিত্তে হাসে।
“ধন্যবাদ স্যার।”
“ধন্যবাদের কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু একটা উপদেশ দেওয়ার আছে। জানো একসময় সিগারেট খুব প্রিয় এক নেশা ছিল আমার, বলতে গেলে ভালোবাসাই। আমার স্ট্রেস যে কমাতো। একদিন জানতে জানতে পারলাম ভিতরে ভিতরে মেরে ফেলছে আমাকে এই প্রিয় নেশা।
তাই বিভীষিকাময় এই আপন জিনিসটিকে পর করে দিয়েছিলাম। মুক্ত করেছিলাম নিজেকে তার বেড়াজাল থেকে। এমন অনেক প্রিয় মানুষও থাকে আমাদের জীবনে, যাদের আমরা ভালো তো বাসি, কিন্তু তার আমাদের একটু একটু করে মারে।
এদের জীবনের রাখতে নেই। তাই এই ভালোবাসার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হওয়াই শ্রেয় এবং আবশ্যক। ভাববে না আমি তোমার ব্যক্তিগত বিষয়ে দখলদারি করছি, আমি শুধু নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করলাম।”
নিবেদিতা চুপ করে থাকে, উত্তর দেয় না। মালিহাই তার হয়ে আগ বাড়িয়ে বলে,
“না, স্যার। ওর মাইন্ড করার কী আছে? আপনি তো ভালোর জন্যই বলেছেন। ওর উলটো ভালো লেগেছে, তাই না নিবিপাখি?”
নিবেদিতা চোখের ইশারায় সায় জানায়।
“আচ্ছা, বিকেলে আমার ফার্ম হাউজে ছোট্ট একটা গেট টুগেদার আছে। গ্রামের দিকে। তোমরাও চলো। ভালোও লাগবে, স্ট্রেসও রিলিজ হবে খোলামেলা পরিবেশে।”
নিবেদিতা না করতেই যাচ্ছিলো, কিন্তু তার আগেই মালিহা ‘হ্যাঁ’ বলে দেয়। সাথে এও জানায় যে তাদের সাথে কবিরও থাকবে।
আবরাহাম আলতো হেসে নিবেদিতার দিকে তাকায়। মালিহা মনে মনে বলে,
“আল্লাহ, আমি যা ভাবছি তা-ই কী হতে চলেছে?”
চলবে…