#নিবেদিত_প্রেম_আরাধনা
||১১তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নিবেদিতা দৃঢ় গলায় জবাব দেয়,
“মেয়েদের বেশি পড়াতে নাই, সব পড়া শুধু ছেলেদের জন্য রেজেস্ট্রি করা। অনেক পড়ালেখা করালেন তো আপনার নাতি অভ্রকে। সেই তো বেকার নেশাখোর, অপরদিকে আমি একটা সুনামধন্য প্রতিষ্ঠানে বেশ ভালো পজিশনে কাজ করি।
তোমার ছোটো ছেলে যাকে নিয়ে এত অহংকার তোমার। তার মাসিক আয় যেখানে পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার টাকা, আমি তার থেকে বেশ মোটা অংকের টাকাই কামাই করি। তোমাকে আমার দাদু অত্যাচার করেছে কি না জানি না।
তবে বুঝ হওয়ার পর থেকে তাকে তোমার কথার অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে দেখিনি। আর হ্যাঁ, তোমার জায়গা ছিল না যাওয়া, আমার কোনো অভাব নেই। তবে কেন আমি আরেকজনের কথা শুনে থাকবো? কেন?”
নুরুন্নাহার খাতুনের রাগে যেন ঘি পড়ে আরও। ভীষণ রকমের রেগে যেয়ে তেড়ে যেতে নেন তিনি নিবেদিতার দিকে। রৌদ্দুর সোহরাব সাথে সাথে মেয়ের সম্মুখে ঢাল হয়ে দাঁড়ান।
“মা, এখানে এসেছো থাকো, খাও। দয়া করে আমার মেয়ের বিষয়ে নাক গলাবে না। ও যথেষ্ট বড়ো হয়েছে নিজেরটা নিজেই বুঝবে। ওর কষ্ট কখনো তুমি বুঝতে পারবে না।”
বয়সের ভারে নুয়ে পড়া নারীটি ভেঙচি কাটে। তাচ্ছিল্যের সুরে শুধায়,
“যা তা কষ্ট এই মা*র। এতোই যহন ব্যাডায় ভালা না, তয় পিরিত করতে গেসিলো ক্যা? পিরিত কইরা বিয়া করসে এহন আবার ঢং লাগায়। এট্টুনি কতায় তোমার মাইয়ার চামড়া পুইড়া জায়গা, তাই নি? তাইলে বিয়ের আগের পিরিত কই গেল?
এহন নাটক মারায়! কত্ত কইরা কইসিলাম আমার নাতির লগে বিয়া দে ভালো হইবো। তহন তো জোর দিয়া বিয়ে করলো, এহন সংসার করতো না ক্যা? বিয়া যেহেতু করসে সইয়াই থাকতে হইবো। নিজে পিরিত কইরা নিজে দেইখ্যা, জাইনা, হুইনা বিয়া করসে না?”
কোনো উত্তর দিতে পারে না রমণী। বড় বড় পা ফেলে নিজের ঘরে যেয়ে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে মুখে ওড়না চেপে কেঁদে দেয়।
মনে মনে ভাবে,
– সে কি আদৌ জানতো এমন পরিবর্তন হবে আরাধ্যের? তার তো সদাই মনে হয় তার সাথে বসবাসকারী পুরুষটি আরাধ্য নয়, অন্যকেউ। সে আজও মেলাতে পারে না যাকে ভালোবেসেছিল সে আরাধ্য না কি যার সাথে সংসার করে সেই প্রকৃত আরাধ্য? আজ স্ত্রী হয়েছে বলেই কি তার সাথে এমন দুর্ব্যবহার? প্রেমিকাদের জন্যই বুঝি পুরুষের সব ভালো আচারণ, কেয়ারিং স্বভাব, সম্মান প্রদর্শন, প্রেমময় অনুভূতির প্রকাশটুকু তোলা?
___
আরাধ্য একা একা বসে আছে। হাতে প্রমোশনের লেটার, তাকে এম.ডি করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের। সে সফলতাকে সে সুখ ভেবে হাতড়ে বেড়িয়ে আছে, তা পেয়ে গেছে। তবে সুখ বা হৃদয়ের আনন্দ তা কি সত্যিই আছে?
নিজেই নিজেকে উত্তর দেয় সে,
“না, কোথাও নেই। বরং, অদ্ভুৎ রকমের শূণ্যতায় গ্রাসিত আমি। কেন সে আমাকে বুঝলো না কেন?”
“সে সত্যিই তোকে বুঝেনি না কি তুই তাকে? কোনটা সত্য?”
বিয়ারের ক্যানটা এগিয়ে দিয়ে শুধায় কবির।
“আমি ওকে কী বুঝিনি? আমি বারবার বললেও তোরে কেন বুঝতে চাস না? আমার মাথায় যদি দুশ্চিন্তা থাকে, চাপ থাকে, তাহলে মুখে কী করে ফুল ফুটবে? আমি কীভাবে রোমান্টিক দুটো কথা বলবো? ওর কি উচিত একজন আদর্শ স্ত্রীর মতোন আমাকে বুঝে মানিয়ে নিয়ে সাপোর্ট করা।
“দুঃখজনক বিষয় যে তুই এখনও তোর ভুলটা বুঝলি না। নিবেদিতা তোকে রোমান্টিকতা দেখাতে বলেনি। সে শুধু চায় তুই তাকে একটু সম্মান দে, যতোটা তোর জীবনের অন্যান্য মানুষদের দিস। তোর যতোই রাগ থাকুক, কখনো তুই তোর বসের উপর তা ঝাড়বি না।
তবে সে কেন? সে তো চায় না তুই মাথায় টেনশন নিয়ে মিষ্টি মুখে কথা বল। শুধু চায় তুই তোর সমস্যাটুকু তার সাথে শেয়ার কর, তোর সমস্যার জন্য তার সাথে রাগারাগি না কর। কারণ সে কখনোই দায়ী না তোর অফিসের সমস্যাগুলোর জন্য।”
বিরক্তির চোখে তাকায় আরাধ্য কবিরের দিকে।
“তুইও ওর কথা বলবি। অফ কোর্স বলবি না কেন? তোর বউয়ের বেস্টি যে। আমি আমার জায়গায় একদম ঠিক আছি। সংসার এমন ভাবেই হয়, এমন ভাবেই হয়ে এসেছে দেখেছি। আর ওরকম প্রতিক্রিয়া প্রকৃতিগত আমার থেকে আসে। আমি ইচ্ছে করেও করি না, আবার আমার নিয়ন্ত্রণেও না।”
কবির ফোঁস করে এক নিঃশ্বাস ফেলে। সেই সঙ্গে নির্গত হয় অনেকটা নিরাশা, সাথে পরাজয়স্বীকার।
“তুই যা বুঝিস, তা-ই তুই মানিস। অন্যকারো দৃষ্টিকোণ তোর বোধগম্য হয় না না কি বোঝার চেষ্টা করিস না আমি জানি না। শুধু বলবো তোর এই একরোখা স্বভাবের জন্য নিবেদিতাকে না হারিয়ে ফেলিস।”
আরাধ্য এক চুমুক বিয়ার গিলে নেয়। তার মুখে এবার আলতো হাসি।
“কিচ্ছু হবে না। ও অনেক ভালোবাসে আমাকে। এই রেগে আছে না? দেখবি কাল মিষ্টি করে দু’খানা কথা আর এই সুখবরটা দিলে সুড়সুড় করে আবার আমার আঙিনায় এসে পড়বো।”
“আই হোপ এমনই যেন হয়।”
আহত সুর কবিরের। হয়তো হৃদয়ের কোথাও তার প্রশ্ন, একটুও কি অনুতপ্ত হবে না এই পুরুষটি?
___
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অতীতে হারিয়ে যায় নিবেদিতা। কী সোনালী দিনগুলো ছিল তখন!
ক্যাম্পাসের কৃষ্ণচূড়া কিংবা বটগাছের তলায় বা লাইব্রেরি বইয়ে ঝুঁকে বসে থাকা যুবতী ছিল নিবেদিতা। আর পুরো ক্যাম্পাস বড়ো-ছোট সবার সাথে মিশে মাতিয়ে রাখা ফাস্টবয় আরাধ্য।
স্বভাব, আচারণে এক পৃথিবীর দুই প্রান্ত যেন। কোনোদিক দিয়েই যায় না। নিবেদিতা যেখানে নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের সাহিত্যপ্রেমী, শান্তশিষ্ট, ভাবুক, ঢিলাঢালা পোশাকের হিজাবী মেয়ে, সেখানে আরাধ্য উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের স্টাইলিশ, সুদর্শন, সাহিত্য বিমুখী, ক্রাশবয়।
তাদের প্রথম সাক্ষাৎও হয় কিছুটা নাটকীয়তার সাথে। সেদিন ছিল নিবেদিতার প্রথম দিন ভার্সিটিতে। সাজসজ্জা নিয়ে কখনোই অত চিন্তা ছিল না তার। তাই খুব সাধারণ একটা লোনের থ্রিপিস আর হিজাব পরেই ভার্সিটিতে যায় সে।
যথারীতি সিনিয়রগণ র্যাগিং করতে তৎপর। যদিও সিনেমা কিংবা ফেসবুকের গল্পগুলোর মতোন তেমন কঠোর বা আক্রমণাত্মক কিছু ছিল না। র্যাগিংয়ের ভুক্তভোগী হয় নিবেদিতা নিজেও।
তাকে পা থেকে মাথা অবধি দেখে আরাধ্য চোখ টিপ দিয়ে শুধায়,
“এ তো পুরাই ধার্মিক আপা। তা আপা একখান রবিন্দ্রনাথের কবিতা আবৃতি করেন?”
“আরে কাকে কী জিজ্ঞেস করছিস? একে তো গজল জিগা, গজল!” ঠাট্টা করে বসে শৈলী।
রমণী সেসবে গুরুত্ব না দিয়ে পরম আবেশে নিজের মতোন আবৃতি করতে শুরু করার। আবৃতি করার পুরোটা সময় সে যেন এক অন্যরকম ঘোরে ছিল।
“নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছ নয়নে নয়নে,
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে
হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।
বাসনা বসে মন অবিরত,
ধায় দশ দিশে পাগলের মতো।
স্থির আঁখি তুমি ক্ষরণে শতত
জাগিছ শয়নে স্বপনে।
সবাই ছেড়েছে নাই যার কেহ
তুমি আছ তার আছে তব কেহ
নিরাশ্রয় জন পথ যার যেও
সেও আছে তব ভবনে… (রবি ঠাকুর)”
নিবেদিতার রিনরিনে কণ্ঠে এমন মধুর কবিতা সবারই যেন হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আরাধ্য আনমনেই বলে উঠে,
“মিস. আপনার আবৃতি তো বেশ!”
ঘোর ভাঙে নিবেদিতার। খেয়াল করে দেখে প্রশংসাকারীকে। শুভ্রের কাছাকাছি বর্ণের লম্বাটে মুখের এক সুপুরুষ, তবে আকর্ষণীয় বিষয়টা হলো নাকের মাঝ বরাবর থাকা তিল খানা। মাত্র এটুকুই সাক্ষাৎ ছিল সেদিন নিবেদিতা ও আরাধ্যের। দ্বিতীয় সাক্ষাৎ নবীন বরণে কবিতা আবৃতি করার প্রস্তাবের বাহানায়। আরাধ্য বলতে গেলে ভক্ত ছিল নিবেদিতার কবিতা আবৃত ও গল্প পড়ে শুনানোর।
অতীতের বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে আসে নিবেদিতা। চোখ থেকে একবিন্দু অশ্রু ঝরে যায়। ভাবে,
-তবে তার কি দোষ? প্রিয় মানুষের বদলানোর ভয়ংকর যন্ত্রণা সহ্য করতে তো বাধিত নয় সে। তাহলে কী জন্য তার প্রেমে প্রশ্ন উঠে? তার নিবেদিত প্রেমের আরাধনা গভীরত্বে ধ্যান আদৌ কারো যায়!
চলবে…