নিবেদিত প্রেম আরাধনা পর্ব-১০

0
1574

#নিবেদিত_প্রেম_আরাধনা
||১০ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
“এভাবে বলছিস কেন? মেয়েটা তো তোর সংসারে কম তো খাটনি দেয় না। নাইন টু ফাইভ চাকরি করে আবার তোর সংসারও ঠিক রাখে। বুয়াও নাই। এতকিছুর পরও মেজাজ দেখায় না তোকে বা খালাম্মাকে। উলটা তুই মেজাজ দেখাস। বলি এত সবের বিপরীতে যদি ভালো দু’খানা কথা শুনতে চায়, তবে অসুবিধা কী?”

“ধুর! মনে আমার এত রঙ নাই। ওর কাজ রান্নাবান্না করা, ও সেটা করবে। আমি পুরুষ মানুষ একটু-আধটু বলতেই পারি, এমন তো সব পুরুষই করে। আমার মাও তো মানিয়ে নিয়ে সংসার করেছে, ও পারে না? ওর এত অহংকার এটুকুও সহ্য করতে পারে না।”

“কী যে বলিস না তুই আরাধ্য! আমাদের বউরা তো কোনো চাকরিও করে, বাঁধা কাজেরলোক। তাও এমন ভান করে যেন রাজ্যের কাজ করে বসে আছে। দিনশেষে বাড়ি ফিরার পর মিষ্টি দু’খানা কথা বলবে তো দূরে থাক, মেজাজ আর ভাবের ঠেলায় স্থানই পাই না। সারাদিন খিটখিট, অভিযোগ, মায়ের সাথে লাগালাগি তো আছেও।”

“আর বক মারিস না। এত ত্যাড়া হলে সংসার করার কী আছে? তালাক দিয়ে দে। নিবেদিতা আমার সাথে কাজ করেও যদি এমন মেজাজ দেখাতো তাহলেও আমি কবে…”

মুখে কুলূপ এঁটে যায় আরাধ্যের। নিবেদিতা আড়াল থেকে বের হয়ে যে দৃষ্টিগোচর হয়েছে এবার।

নিবেদিতা অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া নিয়ে বাঁকা হাসি দেয়। একদম বিদ্রূপার্থে সেই হাসি।

“কী হলো কথা থামালে কেন? ডিভোর্স দিতে তাই না? পুরো হিপোক্রেসি হয়ে গেল তো আরাধ্য মশাই। তোমার রাগ, মেজাজ দেখানো মেনে নিতে হবে। একটুও রিয়েক্ট করা যাবে না, তা তুমি আমাকে গায়ে পড়া সহ যা তা কথাই বলো না কেন। কিন্তু আমি মেজাজ দেখালে তালাক দিবে। তাহলে দেওয়া উচিত, তাই না?”

শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল শিহরণ চলে যায় আরাধ্যের। সে তো এমন কিছু চায়নি। বন্ধুদের সাথে তো সবাই-ই স্ত্রীর একটু-আধটু দুর্নাম করে, এ তো বিশেষ কিছু না।

তাছাড়া তালাকের কথাটি শুধু নিজের দাম বাড়াতেই বলা। নিবেদিতা এখন কেমন প্রতিক্রিয়া দেয় বন্ধুদের সামনে সেটা ভেবে গলা শুকিয়ে আসছে তার।

“নিবেদিতা, তুমি ভুল বুঝছো। আমি এভাবে বলতে চাইনি। আমরা অন্য বিষয়ে…”

“ওহ সেভ ইট। আমি সবই শুনেছি। কী যেন বলছিলে? মনে পড়েছে, নখরা উঠানোর হলে আমার মতো সেকেলে, ক্ষেত, ডাম্ব মেয়েকে বিয়ে করতে না। কারণ আমি তোমার অযোগ্য, যোগ্য হলো বড়লোকের সুন্দরী স্মার্ট মেয়ে।

তাহলে তেমন বিয়ে করতে। আমাকে কেন বিয়ে করতে গেলে? আর কী বললে তোমার মা সহ্য করতো, আমি কেন না? কারণ হলো তোমার মা পরনির্ভরশীল ছিল, তোমার বাবা টাকা না দিলে খেতেও পারতেন না। কিন্তু আমি তা নই। না আমি প্রেমে অন্ধ।”

মোকশেদা বেগমের কথা তুলায় তেঁতে উঠে আরাধ্য। রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। ক্ষোভ নিয়ে শুধায়,
“এবার কিন্তু বেশি বলছো নিবেদিতা। সামান্য একটা বিষয় নিয়ে সবসময় এত বড় ইশ্যু করার কী আছে?”

“তুমিও এতক্ষণ বেশিই বলছিলে, তবুও তো আমি চুপচাপ শুনে গিয়েছি। এখন তুমি কেন নয়? যাকগে খুব সখ তো তোমার বড়লোকের ব্যাটি বিয়ে করার? ওখেহ, আমি তালাক দিচ্ছি, তারপর বিয়ে করে নিয়ো।”

কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নিবেদিতা যে দরজা দিয়ে লাগেজ নিয়ে ঢুকেছিল, সে দরজা দিয়েই লাগেজ নিয়ে বের হয়ে যায়। আরাধ্য অসাড় হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার কাছে এখনো সে নির্ভুল, তবুও প্রিয় মানুষের চলে যাওয়ার যন্ত্রণা, তা তো পুড়াচ্ছেই।

___

ভরা সন্ধ্যাবেলা আবরাহাম তার বাসার একটু কাছের পার্কে এসেছে। আবছা আলোয় অসংখ্য নরনারীর চলাচল দেখছে। যদিও কপোত-কপোতী আর বয়োজ্যেষ্ঠদের সংখ্যাই আনুমানিক বেশি। বয়োজ্যেষ্ঠদের অধিকাংশই হয়তো ডায়বেটিস, শরীর ব্যথার রোগী।

পার্কের সবকিছুর মাঝে যা স্পষ্টতর তা হলো অবহেলিত এক দল শিশু। এদের গায়ে নেই ভালো জামা-কাপড়, নোংরা দেহ, তো কারো নাক বেয়ে পড়ছে শ্লেষ্মা। ভদ্র সমাজ তাদের নাম দিয়েছে পথশিশু। আভিজাত এলাকার ভদ্রলোকদের কাছে তারা ঘৃণ্য বস্তু, দেখলেই গা গুলায়। বারংবার তিরস্কার করে তাড়াচ্ছে তাদের। তারাও আচ্ছা নির্লজ্জ প্রতিবারই ফিরে আসছে। পেটের ক্ষুধার নিকট যে লজ্জা ব্যর্থ সৈনিক।

এমন সময় খেয়াল করলো একজন তাগড়া যুবক এক আট-নয় বছরের ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। ইট দিয়ে কপাল কেটে রক্ত ঝরছে অবিরাম। আবরাহাম ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে দাঁড়ায়। যেই না পা বাড়াবে তখনই পরিচিত মেয়েলি কণ্ঠ শুনতে পায়।

“এই যে মিস্টার ইনহিউম্যান! এত মানবিক কেন আপনারা? বাচ্চাটাকে কী বাজে ভাবে আঘাত করেছেন! আপনাদের উচিত বেঁধে বেধড়ক পেটানো। বাপ-মা মানবিকতা, সভ্যতার শিক্ষা দেয়নি না কি? এত ছোট বাচ্চাকে… ছিঃ! আরে টাকা না দিলে ফিরিয়ে দিতেন। আঘাত করলেন কী করে?”

ছেলেটা আরও তেঁতে উঠে। সুখের কাছে এগিয়ে যেয়ে বলে,
“আপু এটার আপনার বিষয় না। নাক গলিয়ে শুধু শুধু ঝামেলা বাড়াবেন না। এই বেজন্মাকে আমি বহুবার যেতে বলেছি যায়নি।”

“কী করে যাবে বলেন? এদের বাপের তো আপনার বাপের মতো টাকা নাই। তাই এরা আপনার মতো বাপের টাকা মেরে আই মিন চুরি করে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরা তো দূরে থাক খেতেও পারে না।”

“শালি তুই কে রে বলার? আমি ওর মাথা ফাটাইসি, তোর ফাটাবো কী করবি?”

আরেকটু কাছাকাছি আসে যুবক। হয়তো শারীরিক ক্ষমতা বা যৌনআঘাতের ভয় দেখিয়ে দাবানোর ইচ্ছা। কিন্তু তাকে অবাক করে সুখ একবিন্দুও নড়ে না জায়গা থেকে। বরং, বুকের উপর দু’হাত ভাজ করে রেখে আলতো হাসে।

“আমি সচিব আরিফ মোতাহাবের মেয়ে। একটু অপেক্ষা কর কু*র বাচ্চা একটা কল দেই, দেখি কোন বাপের ক্ষমতা আছে তোরে বাঁচানোর।”

বলে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করতে নেয় সুখ। কিন্তু তার আগেই ছেলেটি তার গার্লফ্রেন্ডের হাত ধরে ভৌ দৌড় দেয়।

সুখ এবার ঘাড় ঘুরিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত বাচ্চা ছেলেটির দিকে তাকায়। টিস্যু এগিয়ে দিয়ে ইশারা করে মাথায় ধরতে।

“ইশ! কী পরিমাণ লেগেছে! এই নে এক হাজার টাকা। জুয়া-টুয়া খেলতে বসিস না। মাথায় ব্যান্ডেজ লাগাবি, আর ফলফলাদি সহ যা যা খেতে মন চায় কিনে নিবি।”

ছেলেটা মাথা কাত করে সায় জানায়। সুখ মৃদু হাসে। তারপর একটা নির্জন বেঞ্চে যেয়ে বসে একদৃষ্টিতে মানুষের আনাগোনা দেখতে শুরু করে। তার জীবনে মানুষেরই যে বড্ড অভাব।

স্কুলের বন্ধুরাও নামমাত্র। অর্থাৎ, সে তো তাদের বন্ধু, কিন্তু কেউ তার বন্ধু নয়। আত্মীয়-স্বজন নামক কোনো মানুষ তো জন্মের পর থেকেই দেখেনি সে।

“কী অবস্থা সুখপাখি? একা একা এখানে কী করো?”

চমকিত হয়ে পাশে তাকায় সে। আবরাহাম টোল পড়া হাসি দিয়ে তার পানে তাকিয়ে।

“এই তো একটু বসতে। মানুষজন দেখতে। আমার জীবন তো বড়োই নির্জন।”

“আহারে! এটুকু মেয়ের এমন দুঃখিনী ভাব। আরে তোমার বাবা সচিব, মা সরকারি কর্মকর্তা। তোমার কীসের টেনশন?

“তারা আমার পিতা-মাতা তা-ই সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা।” অবচেতন মনে উত্তর দিয়ে বসে সুখ।

“মানে? ”

ধ্যান ভঙ্গ হয় সুখের। গাঢ় দৃষ্টিতে আবরাহামকে দেখে। খুব করে মন চাচ্ছে এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রিয় মানুষটিকে নিজের বাস্তবতা বোঝাতে। কিন্তু না, এ করা যাবে না। নাহলে এ মানুষটির চোখেও নিজের জন্য ঘৃণা দেখতে পাবে। যেমনটা দেখা যায় এলাকার অন্যান্য লোকদের চোখে-মুখে।

___

নিবেদিতা মায়ের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এত বড়ো ধাক্কা খেয়ে বাড়িতে ফেরার পর প্রিয়জনদের সম্মুখে নিজেকে আর সামলাতে পারেনি সে। ভেঙে পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় সে।

নাদিরা খানোমের প্রেশার বাড়ছে তরতর করে। রৌদ্দুর সোহরাবও মেয়েকে কাঁদতে দেখে অস্থির অবস্থা। কিন্তু দুজনের একজনও মেয়েকে নিজেদের মন্দ অবস্থা বুঝতে দিচ্ছে না।

“কী হয়েছে মামনি? এভাবে না বলে কাঁদলে কীভাবে বুঝবো? তুই একবার বল কী সমস্যা, বাবা সব ঠিক করে দিব প্রমিস।”

নিবেদিতা আর নিজেকে আটকাতে রাখতে বৈবাহিক জীবনের বিগত দুই বছর সহ আজকে যা যা হয়েছে খুলে বলে সে। এও জানায় সে আরাধ্যের সাথে আর থাকতে ইচ্ছুক নয়।

নাদিয়া খানোম ও রৌদ্দুর সোহরাব যেন স্তব্ধ। মেয়ের সংসার এমন ভাবে ভেঙে গুড়িয়ে যাবে কখনো কল্পনাও করেনি সে।

“এট্টুনি কথাই তো কইসে এতে বাড়ি ছাইড়া আহাই তো পাপ। আবার কস ছেমড়ি তালাকের কথা। আমরা জামাইয়ের মাইর খাইয়াও আদর-আপ্পায়ন করসি, আর এডুক সহ্য করবার পারোস না? যত্তসব বেল্লা মাইয়ালোক! এর জন্যই কইসিলাম মাইয়া মানুষ, এত পড়াইস না। জবান যাইবো গা বাইড়া, দেখলি? কীয়ের জন্য ঝামেলা করবার চায় ও? ওর জামাই কি ওরে মারসে বা আরেকটা পিরিত করসে? এট্টুনি কথাতেই তেজ দেহায়। দেমাগের শেষ নাই!”

এতগুলো তিক্ত কথা শুনে আপনা আপনিই কান্না থেমে যায়। চোখ উঠিয়ে তাকিয়ে দেখে তার দাদী নূরুন্নাহার খাতুন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে অগ্নিময় চাহনি নিক্ষেপ করে রেখেছে তার দিকে।

নূরুন্নাহার খাতুন সাধারণত এ বাড়িতে থাকেন না। থাকেন তাঁর ছোটো ছেলের বাড়িতে, কারণ বড় ছেলের যেখানে অভাবের ছড়াছড়ি, সেখানে ছোটো ছেলের টাকার ছড়াছড়ি। আবার সেই ঘরে নাতি, অর্থাৎ পুত্রসন্তান, আর এই ঘরে শুধুই নাতনি। আর কন্যা সন্তান তার দু’চোখের বালিই বলতে গেলে, সর্বকালেই অপছন্দনীয়।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে