নিঝুমপুর -৭
মোকলেস আলীর গভীর রাতে আগমনের কারন জানা গেল, একটা কাজে ঢাকা এসেছেন। দিন কয়েক থাকতে হবে। সচিবালয়ে তার কাজ আছে। তাই রোজিনা আন্টির ঘরেই থাকবেন।
বড় মামা বিষয়টা পছন্দ করলেন না। ঘরের মধ্যে বাইরের মানুষ, তাও একজন বয়স্ক পুরুষ, তিনি সোজাসাপটা বললেন, এরকম কোনো কথা ছিল না৷ বাড়িতে মেয়ে যুবতী আছে, আম্মারও পর্দা নষ্ট হবে। মোকলেস আলী যেন বাইরে থাকে।
মোকলেস আলী বললেন, ভাই সাহেব, এইটা কেমন কথা বলতেছেন?
আমি আমার বউয়ের ঘরে থাকব না তো কোথায় থাকব!
বড় মামা বললেন, সেটা আমার দেখার বিষয় না৷
তবে সাবলেট আন্টি চিন্তিত হলেন না৷ বরং খুশি হলেন।
এতই খুশি হলেন যে রাতে মশলা পিশতে বসে গেলেন, স্বামীর জন্য রান্না করবেন।
রাত দুটোর সময় আমাদের রুমের দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। ঘুম চোখে দরজা খুলে দেখি, সাবলেট আন্টি। হাসিমুখে আমাদের খেতে ডাকতে এসেছেন।
সেঁজুতি আপা উঠল না। সে এত রাতে সেহেরি খানা খাবে না৷ আমাকে যেতে হলো৷
গিয়ে দেখি ছবিও বসা। বাসার ছেলেমেয়েদেরকে সাবলেট আন্টি ডেকে নিয়েছেন।
মোকলেস আলী অত্যন্ত বেশি কথা বলেন।
বুঝলা বউ, কালা বিলাইডা ছাও দিছে পাঁচটা। এক্কেরে ধবধবা!
রাত দুপুরে তার বাড়ির কুত্তা বিড়ালের গল্প শুনে সাবলেট আন্টি হেসে গড়িয়ে পড়ছেন। আমরাও হাসার চেষ্টা করছি, তবে হাসি পাচ্ছে না।
মোকলেস আলীর যাওয়ার কোনো লক্ষন দেখা গেল না। সে আস্তানা গাড়ল ধলু মামার ঘরে। সারাক্ষণ বাইরে থাকে। রাতে ফিরে ওখানে ঘুমায়।
ছবির জায়গা হলো আবুল হাসান সাহেবের ঘরে।
ছবিও অবশ্য বাসায় থাকে না। সকালে উঠে চলে যায় টিউশনিতে। সেখান থেকে ফিরে ফার্মগেট যায়। সারাদিন থাকে, রাত নয়টার পরে বাসায় আসে। অল্প কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আমার সাথে তার দেখাই হয় না।
বাড়িতে অনেক মানুষ এখন। সাবলেট আন্টি আর মোকলেস আলী বাদে বাকিরা সবাই একত্রে খায়।
সাবলেট আন্টির দিনে অফিস থাকে। মোকলেস আলী দিনে বাসায় থাকে না।
একদিন দুপুরে মোকলেস আলী বাসায় ফিরে এলেন। তখন দুপুরের খাবার সময়। তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবে সবার সাথে খেতে বসে বললেন, দেখি একটা প্লেট দেন। বেজায় খুদা লাগছে, যেন দীর্ঘদিন সে এ বাড়ির বাসিন্দা।
এখানেই তার খাওয়ার কথা!
বড়মামা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এখানে খাবেন?
হুম, ভাইজান যে কি বলেন! ভুখ লাগছে খাবো না? আমার বউ থাকলে তো চিন্তা লাগত না, সে তো চাকরিজীবী! এখন দুপুরের সময় আমি কই খাব!
খুবই অকাট্য যুক্তি। তাকে প্লেট দেওয়া হলো। খেতে বসে মোকলেস আলী, সেঁজুতি আপাকে বললেন, দেখু একটা কাঁচা মরিচ দাও তো!
মোকলেস আলীর এই উপদ্রব একদিনে কমল না। সেদিন শুরু হয়ে প্রতিদিন দুপুরেই সে বাসায় ফিরে। বাড়ির সামনে বালতিতে জল ভরে গোসল করে খেতে বসে। খাওয়ার পরে ধলু মামার ঘরে ভাত ঘুম দেয় নাক টেনে।
বড়মামা ঠিক করলেন, রোজিনা আন্টিকে বাসা ছেড়ে দিতে বলবেন।
রোজিনা আন্টিকে বড়মামা ঘর ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেন। রোজিনা আন্টি তাকে মিন মিন করে বললেন, মোকলো আলী যে ব্যবসা করতেন, সেইটায় ধরা খেয়েছেন। এখন হাতে কোনো টাকা পয়সা নেই! কোথায় যাবে মানুষটা!
মাস ঘুরে এলো৷ ছবি একদিন আমার হাতে একটা খাম দিয়ে বলল, এইখানে দুই হাজার টাকা আছে।
টাকা?
হুম৷ টিউশনির বেতন পাইছি।
তো আমাকে দিচ্ছ কেন?
বাজার সদাইয়ে কাজে লাগান আপা। আমি একটা বাড়তি মানুষ আছি। থাকছি, খাচ্ছি।
খাম ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, টাকা দিতে হবে না। ভর্তি পরীক্ষার সময় অনেক খরচ। নিজের কাছে রেখে দাও।
ছবি তর্ক না করে ফেরত নিয়ে নিলো।
চলবে
শানজানা আলম
নিঝুমপুর -৮
সাবলেট আন্টি বা মোকলেস আলী কেউই ঘর ছাড়ার লক্ষ্মণ দেখালো না। তারা ভালোই আছে, মোকলেস আগে সারাদিন বাইরে থাকত, এখন বাড়ির ভেতরেই থাকে। সকালে রাতে বউয়ের সাথে বসে খেলেও দুপুরে আমাদের সাথে খায়।
তবে মোকলেস আলী বেশ কাজের লোক বলে মনে হলো। ছাদের কিনারে পাকুর গাছ বড় হয়েছিল। সে একদিন লুঙ্গি কাছা দিয়ে পাকুর গাছ কেটে ফেলল।
শুধু কাটলই না, শেকড় বাকড় উপরে ফেলে দিলো।
ছাদের বড় ট্যাংকিটা দীর্ঘদিন অকেজো হয়ে পড়েছিল। মোকলেস আলী সেই ট্যাংকি ধুয়ে ফেলল, একটা পুরোনো মোটর পড়েছিল ধলু মামার বিছানার নিচে, সেটা সাড়াই করে পানি তোলার ব্যবস্থা করল। এখন দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা পানি থাকে। পানি তোলার কোনো চিন্তা থাকে না। ধলু মামা নিশ্চিন্ত থাকেন।
বাড়ির পাশে দেয়ালের সাথের প্যাসেজে ময়লা জমে ছিল, সেটাও পরিস্কার করে ফেলল একদিন।
সামনের উঠানের এক কোণে কিছু ইট ছিল, সেগুলো ভেঙে খোয়া করে প্যাসেজে দিয়ে একটা রাস্তার মত করে ফেলল বাড়ির পেছনদিকে যাওয়ার জন্য।
মনেই হলো না, সে এই বাড়িতে সাবলেট থাকে। মনে হলো, এই বাড়ির কেয়ার টেকার আসলে ধলুমামা না, মোকলেস আলী। মোকলেস আলীকে দায়িত্ব দিয়ে ধলুমামা নিজের ছেলের বাড়িতে বেড়িয়ে এলেন দিন সাতেক।
এক সকালে একটা বড়গাড়ি করে একজন ভদ্রলোক এলেন আমাদের বাড়িতে। তিনি এসে সেঁজুতি আপুকে খুজলেন।
সেঁজুতি আপু আসার আগেই বড় মামার সাথে তার কথা বলতে হলো। তিনি জানালেন, তাকে সেঁজুতি আপার মা পাঠিয়েছে। আপাকে এক নজর দেখতে চান, তিনি খুবই অসুস্থ। সেঁজুতি আপুর মা, আমাদের বড়মামী শুনেছিলাম ঢাকায়ই থাকে।
ভদ্রলোক আপাকে কয়েকবার বলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। বড় মামাও বললেন, তুমি ইচ্ছা করলে যাইতে পারো, তোমার খুশি। আমি বাঁধা দিতেছি না। আমি ভেবেছিলাম সেঁজুতি আপা যাবে, তবে আপা রাজী হলো না। অপরিচিত কোনো জায়গায় সে যাবে না।
ছবি এসেছে প্রায় দুই মাস হয়ে গেছে। তার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ডেট দিয়েছে। তবে তাকে পড়াশোনা করতে দেখি না খুব একটা। দুই মাসে সে বেশ চালু হয়েছে। একদিন দুটো শার্ট আরেকটা প্যান্ট কিনে এনে আমাকে দেখিয়েছে। জুতাও কিনেছে দেখলাম। আগে একটা বোকা বোকা চেহারা ছিল, সেলুন থেকে চুল দাঁড়ি সব সাইজ করে চেহারা ভালো করে ফেলেছে।
কোচিং-এর ভাইয়া তাকে একটা ফোন দিয়েছে, যখন তখন কাজে লাগলে যেন যোগাযোগ করতে পারে।
এখন আমাদের বাড়িতে সে শুধু ঘুমাতেই আসে। বেশিরভাগ দিন রাতে খায়ও না।
আমাকে একদিন বলল, আপা আমার পরীক্ষা শুক্রবার। নয়টার মধ্যে হলে ঢোকা লাগবে।
আমি বলল, ভালো তো, যাও পরীক্ষা দিয়ে এসো।
-আপনি যাবেন আমার সাথে?
-পরীক্ষা কোথায়?
-সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে।
-ওহ কাছেই তো!
-হুম।
-বাড়িতে জানিয়েছ?
-কাকে জানাব?
-তোমার আব্বা?
-সে বেশি পড়াশোনা জানা লোক না, এইসব বুঝবে না।
না জানাই ভালো।
-ওহ আচ্ছা।
-তোমার মা?
ছবি কোনো উত্তর দিলো না।
শুক্রবারে আমি গেলাম ছবির সাথে। কত কত মানুষ যে পরীক্ষা দিতে এসেছে, তার কোনো হিসেব নাই।
দেখছ৷ কত মানুষ!
হুম!
তোমার প্রিপারেশন কেমন?
বেশি ভালো না।
আচ্ছা সমস্যা নাই। এরপরে ঢাকা ভার্সিটির ফর্ম তুলো।
আচ্ছা।
ছবি পরীক্ষা দিতে ঢুকল। আমি বসে থাকলাম রাস্তার পাশে পরীক্ষা শেষ না হওয়া অবধি।
চলবে
শানজানা আলম