নিঝুমপুর-৫
নিচে নেমে এলাম চিলেকোঠা থেকে, অর্ধেক সিঁড়িতে এসে ডাকলাম, সেজুআপা, নিচে ডাকছে। আমার ডাকে ওরা হয়তো ছিটকে আলাদা হয়ে গেল! দৃশ্যটা কল্পনায় ভেসে উঠলো চোখের সামনে।
আপাকে ডেকে আমি নিচে নেমে গেলাম। সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে দেখলাম, আপা ঠোঁট মুছতে মুুছতে নিচে নামছে।
আবুল হাসান নামের ভদ্রলোকের বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ হতে পারে। বেশিও হতে পারে। সেঁজুতি আপার বয়স কুড়ি কিংবা একুশ!
তার সাথে কিভাবে আলাপ, সেটা জানতে ইচ্ছে করছে।
সত্যি বলতে আবুল হাসানকে আমার খারাপ লাগে নি। মোটাফ্রেমের চশমায় বেশ ভালো লাগে দেখতে।
রাতে বিছানায় শুয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপা, আবুল হাসান সাহেবকে আগে থেকে চেনো?
সেঁজুতি আপা না তাকিয়ে বলল, আড়ি পাতা আর উঁকি দেওয়ায় তুই প্রাইজ পাবি নিঝু!
এটা তো উত্তর হলো না।
আমি উত্তর দিব না।
আমি সবাইকে বলে দিই যদি?
বল! কিন্তু কি বলবি?
এই যে তোমরা, একাকী ঘরে……
সেঁজুতি আপা হেসে বলল, বল গিয়ে। ভালোই হয় তাহলে।
বলো না, কাহিনীটা জানতে ইচ্ছে করছে।
পরে বলব। এখন না৷
কথা এগুতে পারল না৷
কয়েক দিন কেটে গেল। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেলাম নতুন বাসিন্দাসহ। একদিন কলেজ থেকে ফিরে দেখি ডাইনিংয়ে দুজন অপরিচিত মানুষ ভাত খাচ্ছে। একজন বেশ বয়স্ক, আরেকজন ইয়াং ছেলে, আমাদের বয়সের আশেপাশেই হবে। ময়না খালা খেতে দিচ্ছে।
মায়ের কাছে জানতে পারলাম, একজনের নাম ছবি, আমাদের বয়সের ছেলেটা। ঢাকায় এসেছে কোচিং করতে। ময়না খালার সতীনের ছেলে।
আর বয়স্ক লোকটি ময়না খালার স্বামী। ছেলেকে কোথায় রাখবে এই চিন্তা করে ময়না খালার কাছে নিয়ে এসেছে। ময়না খালাও তো সম্পর্কে মা ই হয়। ছবি ভালো থাকবে।
ময়না খালা গজ গজ করতে করতে বলেছে, এর মায়ের জন্য আমি সংসার হারা হইছি, এরে আমি রাখতে পারব না।
ময়না খালার স্বামী মনে হলো এই কথা শুনলেন না। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, শলা আছে? দাঁতের ফাঁকে মাংস ঢুইক্কা রইছে!
আমি একটা টুথপিক দিলাম।
তিনি দাঁত খুচতে খুচতে গেলেন ধলু মামার ঘরে।
সন্ধ্যায় তিনি বের হলে আসপাশ ঘুরে দেখতে। আর ফিরলেন না। জানা গেল তিনি লঞ্চে উঠে চলে গেছেন ছবিকে রেখে। ছবি বেচারা মুখ শুকনো করে সিঁড়িতে বসে রইল।
রাতে আমি ডাকলাম, খেতে এসো।
আপনি কি পড়েন?
হ্যা পড়ি।
কোন ক্লাশে?
কলেজে পড়ি, তোমার থেকে ক্লাশে ছোট। কিন্তু আমাকে নিঝু আপা ডাকবে।
নিঝু আপা, আমাকে লঞ্চঘাট থেকে লঞ্চে তুলে দিতে পারেন? আমি ঢাকায় কিচ্ছু চিনি না।
আমিও সদরঘাট চিনি না। ধলু মামাকে বলব দিয়ে আসতে। কোচিং করবে না?
না। আমাকে আব্বা কোনো টাকা পয়সা দিয়ে যায় নি।
আমি কিভাবে কোচিং করব!
আচ্ছা, আপাতত খেতে এসো।
ছবির জায়গা হলো ধলুমামার ঘরে। এরকম অদ্ভুত সব মানুষের ভীড় বাড়ছে নিঝুমপুরে।
চলবে
নিঝুমপুর -৬
ছবি একটু চুপচাপ। ময়না খালা তো খুবই বিরক্ত। সে ছবিকে দেখতেই পারে না। খুবই রুড ভাবে কথা বলে।
বেচারা মরমে মরে যাচ্ছে। কেউ তাকে সদরঘাটে দিয়ে আসছে না। ময়না খালা সতীনের ছেলে, তোর মা আমার সংসার ভাঙছে, এসব বলে গালাগাল করে। আমার মা আর নানী বু কিছু বলে না, হিসেবের সংসারে চাল বেশি লাগছে, তাদের মুখ কালো থাকে। ধলু মামা তাকে মাঝে মাঝে বলে, সারাদিন ঘরের মধ্যে কি করো, বাইরে যাইয়া বসো।
ছবি চুপচাপ বসে থাকে বাড়ির সামনে স্বর্নচাঁপা গাছটার নিচে। মাঝে মাঝে বই নিয়ে পড়াশোনাও করতে দেখা যায় তাকে।
সেঁজুতি আপার এসব নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। তাকে আবুল হাসানের সাথে খুব একটা দেখা যায় না।
সে তার মতন আছে।
আমি ছবিকে একদিন বললাম, চলো তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই।
ছবি ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল, কোথায় আপা?
আমাদের কোচিংয়ের ভাইয়াকে তোমার কথা বলেছিলাম। উনি বলেছে, ওনার বন্ধু আছে, ফার্মগেটে মেডিকেল কোচিং করায়। তোমাকে নিয়ে সেখানে নিয়ে যাবে।
আমার তো টাকা পয়সা নাই।
সমস্যা নাই, সেটার একটা ব্যবস্থা করে দিবে ভাইয়া।
আমাদের ম্যাথ করায় এজাজ ভাইয়া। ওনাকে ছবির কথা বলায় উনি বলল, ছবিকে নিয়ে আসতে।
এজাজ ভাইয়ার সাথে আমরা সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে থেকে লেগুনায় চেপে ফার্মগেটে গেলাম। একটা গলির মধ্যে অন্ধকার ধরনের একটা বাড়ি। সেখানে নিচতলার একটা ঘরে কিছু ছাত্র পড়াশোনা করছে।
এজাজ ভাইয়া আলাপ করিয়ে দিলেন ছবিকে সবুজ ভাইয়ার সাথে। সবুজ ভাইয়া নাকি সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে পড়ছেন। উনি কয়েকটা ব্যাচ প্রাইভেট পড়ান।
ছবি বেশ দেরি করে ফেলেছে। তাই সবুজ ভাইয়া ছবিকে কিছু কোশ্চেন পেপার দিয়ে সলভ করতে বললেন।
ছবি ইতস্তত করে সলভ করতে শুরু করল। আমার বোর লাগছিল, মোটামুটি ধাচের ছাত্রী আমি, পড়াশোনা করতে হয়, তাই করি আর কি! টাইন্যা টুইন্যা পাশ করলেই খুশী, এত পড়ার কথা আমার ভালো লাগছিল না। ছবিকে রেখে যেতেও পারছিলাম না৷
প্রায় ঘন্টাখানেক পরে ছবির কোশ্চেন সলভ করা দেখে সবুজ ভাই বললেন, ছবিকে পড়াবেন। কোনো টাকা পয়সা লাগবে না, তবে তার কিছু কাজ টাজ করে দিতে হবে। তার একটু উপকারও হবে আর ছবির পড়াশোনাও হবে।
ছবি পারবে তো?- এজাজ ভাই জিগ্যেস করলেন!
ছবি ঘাড় নাড়ল, পারবে।
আবারও লেগুনায় চেপে ফিরে এলাম।
ফেরার পথে ছবিকে বললাম, তুমি একা একা যেতে পারবে?
ছবি আবারো ঘাড় নাড়ল, পারবে।
ঠিক আছে। ভাড়া টাড়া আছে সাথে?
ছয়শ টাকা আছে।
ছবিকে একটা টিউশন জোগাড় করে দিলে ও চলতে পারবে। তাই একটা কাগজে লিখে বাসার রোডে কামাল স্টোরে লাগিয়ে দিয়ে এলাম আমার ফোন নম্বর দিয়ে। এখানে অনেক মানুষ আসে। ছবির একটা টিউশনি জোগাড় হয়ে যাবে।
আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, দুইদিনের মধ্যে ফোন চলে এলো।
ছবি একটা টিউশনি পেয়ে গেল। ক্লাশ থ্রি এর একটা ছেলেকে পড়াতে হবে, সাড়ে তিন হাজার টাকা দিবে।
ছবিকে মোটামুটি গুছিয়ে দিয়ে ভালো লাগছে।
একদিন মাঝরাতে গেটে ঠক ঠক আওয়াজ হলো।
ধলু মামা জানতে চাইল, কে এসেছে এতরাতে!
ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো, আমি মোকলেস আলি। রোজিনা বেগমের স্বামী। আপনেদের সাবলেট রোজিনা।
চলবে
শানজানা আলম