নিঝুমপুর পর্ব-৩+৪

0
159

নিঝুমপুর -৩

রাতে খাবার সময় বড় মামা আমাদের জানালেন, ছোট মিয়া একটু সমস্যায় আছে, আপাতত সে আর টাকা দিতে পারবে না। এখন যেহেতু নিঝুম সেঁজুতি দুজনেই পড়াশোনা করছে, ওদের পড়ার খরচের জন্য হলেও আমাদের একটা উপায় বের করতে হবে।

সেঁজুতি আপা বলে উঠল, আমরা একটা রেস্টুরেন্ট করতে পারি। ভাতের হোটেল।

বড়মামা কটমট করে তাকালেন। সেঁজুতি আপা চুপ করে গেলেন।

বড় মামা বললেন, রান্না ঘরের পাশে একটা রুম আছে, এই রুমটা সাবলেট দিলে কিছু টাকা আসবে। ছাদের পাশের চিলেকোঠাও ভাড়া দেওয়া যেতে পারে।

ধলু মামা বললেন, আমারে যে বেতন দেয়, ওইটা তো ধরাই হয় না, ওইটা নিয়ে কাজ চালান আপাতত। বাড়িতে নতুন মানুষ ঢোকান লাগবে না। দুই দুইটা যুবতী মাইয়া বাড়িতে। আপনেদের সাথে এক হাড়িতে খাই এত বছর, কোনোদিন তো কিছু দেই নাই!

এটা ভুল কথা, ধলু মামা প্রায়ই বাজার করে আনে। কারন আমাদের ছোটোমামার ডলারে আমাদের বাড়িভাড়া, পড়াশোনা, নানীবুর ওষুধ, জামা কাপড়, বাজার এত কিছু পোষানো সম্ভব হয় না।
ধলু মামা নিজেই কাঁচা বাজার করে দেয়, ইলিশ মাছ কিনে আনে। আমরা কিছু মনে করি না৷ রিক্সাভাড়া লাগলেও ধলুমামার কাছ থেকে দশ বিশ টাকা নিয়ে যাই, আমি, সেজু আপা দুজনেই।

না না, ওইটা তোমার বৃদ্ধ বয়সের সম্বল, ওইটায় হাত দিবা না৷ আমাদের মেয়েদের নিয়ে কোনো ভয় নাই।

বলেই মামা বিব্রতবোধ করলেন। মনে হয় মায়ের অপকর্মের কথা মনে পড়ে গেল।

ঠিক আছে, মিস্ত্রি লাগাই তাইলে? গতমাসের ভাড়া তো জমা দেওয়া হয় নাই এখনো।

লাগিয়ে দেন, রুমটা একটু ঝাড়ামোছা করে চুনকাম করলেই সুন্দর হয়ে যাবে। চিলেকোঠার ঘরে যে থাকবে, তার টয়লেট ওয়াশরুম হবে নিচে। সেখানে থাকবে ব্যাচেলর।
এটা একটা সমস্যা। স্টোভে রান্না করতে পারবে।
আর ঘরের মধ্যে একজন মহিলাকে রাখা যেতে পারে।

পরের দিনই ধলু মামা মিস্ত্রি ডেকে কাজে লাগিয়ে দিলেন। রান্নাঘরের পাশের রুম থেকে কয়েক বস্তা মালামাল বের হলো। আমাদের সব পুরোনো কাপড়, বইখাতা, খেলনা। এগুলো ভাঙারীর দোকানে বিক্রি করে সাতশ পঁচিশ টাকা পাওয়া গেল। রুমটা ফাঁকা করার পরে দেখা গেল বেশ ভালো লাগছে, চুন করার পরে তো চেহারাই বদলে গেল। সারাবাড়ি থেকে কাঁচা চুনের গন্ধ আসতে লাগল।
আমাদের লোহা লক্করের গেটে ঝুলানো হলো টুলেট। একরুম এবং চিলেকোঠা ভাড়া দেওয়া হইবে।
ছোটো পরিবার/ব্যাচেলর।

আমার ধারনা হয়েছিল কেউ আসবে না, কিন্তু দুদিন পরে একজন এসে গেটে নক করল। চিলেকোঠার ঘরটা দেখতে চায়।

ধলুমামা তাকে চিলেকোঠার ঘরটা দেখালো। ভাড়া হবে তিন হাজার টাকা। দুই মাসের অগ্রীম টাকা দিতে হবে।
লোকটি রাজী হলো, তবে টয়লেট নিচে শুনে তার আগ্রহ শূন্য হয়ে গেল।

চিলেকোঠার ঘরে কোনো সাবলেটই উঠতে চাইল না। আমাদের রান্নাঘরের পাশে এক মহিলা উঠলেন, কোন একটা এনজিওতে ছোটখাটো চাকরি করেন, ঢাকায় একাই থাকেন, পরিবার থাকে গ্রামে।
চার হাজার টাকায় রুমটা ভাড়া হয়ে গেল।
এক ছুটির দিনে উনি উঠে পড়লেন। ওনার নাম রোজিনা। বয়সটা ঠিক বোঝা গেল না৷ চল্লিশের কমই হবে।

আমরা ভেবেছিলাম চিলেকোঠা ভাড়া হবে না। সেঁজুতি আপা অবশ্য খুশি হয়েছিল, কারন তাহলে সে তার খাতা বই নিয়ে চিলেকোঠায় উঠে যাবে।
তবে মাসের পাঁচ তারিখে এক ভদ্রলোক এসে বললেন, তিনি চিলেকোঠায় উঠতে চান। সম্ভব হলে আজই।
ওনার নাম হাসান। আবুল হাসান।
বাথরুম নিচে বলে তার সমস্যা নেই, তবে তাকে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারলে ভালো হয়। এজন্য সে পে করতে প্রস্তুত। ধলুমামা তিন বেলা খাবার আর পানিসহ তার ভাড়া ধার্য করলেন ছয় হাজার টাকার।
হাসান নামের ভদ্রলোক খুশি মনেই উঠে পড়লেন চিলেকোঠায়।

নিঝুমপুরে আরো দুজন বাসিন্দা বাড়ল।

চলবে

শানজানা আলম

নিঝুমপুর -৪
নতুন বাসিন্দা আসায় আমাদের জীবনধারায় তেমন পরিবর্তন হলো না। ধলুমামা বাজার করেন আগের মত। ময়না খালা কাটাকুটি সেরে গোসল করে চুল আঁচরে নেয়। মা আর নানীবু রান্না ঘরে রান্না বান্না করেন। নানী বু সবার সাথে খিট খিট করেন।

সাবলেট আন্টি রাত দুপুরে কিচেনে রান্না করেন। তখন ধরাম ধরাম, টকাস টকাস শব্দ হয়। মনে হয় মশলা পিষেন। মা একদিন বললেন, আপনার দরকার হলে, মশলা আমাদের ফ্রিজে থেকে নিয়েন, রোজ রাতে বাটনা বাটা লাগবে না।
কিন্তু এতেও কোনো কাজ হলো না। আবুল হাসান সাহেব বেশ ভালো মানুষ। একটু উদাসীন ধরনের মনে হয়। বেশ বইপত্র নিয়ে এসেছেন, পড়াশোনা করেন, ল্যাপটপে মনে হয় লেখালেখিও করেন! উনি একটা পত্রিকায় ফিচার লেখক হিসেবে কাজ করেন সম্ভবত।

সেঁজুতি আপা একদিন বলল এটা। ওনার নাকি সুন্দর সুন্দর কবিতা আছে।

তুমি কিভাবে জানলে?

ওনার ফেসবুক প্রোফাইল খুঁজে বের করেছি।

কেন? কী দরকার ছিল?

সেঁজুতি আপা রহস্য করে বলল, দরকার ছিল না, আবার ছিল।

ওহ আচ্ছা।

তুই একটা কাজ কর, হাসান সাহেবকে এক কাপ কফি দিয়ে আয় তো নিঝু!

কফি! আমি কেন তাকে কফি দিতে যাব!

একা থাকে, পরিবারের সবাই দূরে, তাই দিবি।।

নাহ, আমার এত গরজ নাই বাবা, তুমি যাও।

সেঁজুতি আপা উঠে সত্যিই তিন কাপ কফি বানালো, তারপর দুটো কাপে নিয়ে বলল, ছাদে চল।

কেন?

কফি খাবি তাই।

তুমি তিনকাপ কফি দুটো কাপে নিলে কেন?

এমনিই। আয় ছাদে আয়।

আমরা ছাদে গেলাম। আবুল হাসান সাহেব নিজের ঘরে চেয়ার টেবিলে বসে কিছু লিখছিলেন।

সেঁজুতি আপা দরজা নক করে বলল, আসব?

ওহ তোমরা, এসো।।

কফি খাবেন তো, কফি নিয়ে এসেছি।

হ্যা সিওর, কফিতে আমার আপত্তি নেই। ভাবছিলাম একটা স্টোভ বা সিলিন্ডার নিয়ে নিব, কিন্তু সময় পাচ্ছি না।

সেঁজুতি আপা সেলফ থেকে একটা কাপে ওনাকে কফি ঢেলে দিলো, যেন আপা জানে, এখানে একটা কাপ আছে।

চল নিঝু, আমরা সিঁড়ি ঘরে বসি।

আহা চলে যাচ্ছ তোমরা?

আপা বলল, হুম।

নিচ থেকে আমাকে মা ডাকল, নিঝুউউ, আমি কফি না খেয়ে নেমে আসছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, আবুল হাসান সাহেব অপরিচিত কেউ না। আপা ওনাকে এ বাড়িতে এনেছে। কতটুকু নিচে নেমে আবার উপরে চলে এলাম আড়ি পাততে।

দরজা চাপানোই ছিল। আমি উঁকি দিয়ে দেখলাম, হাসান সাহেব আর সেঁজুতি আপা দুজন দুজনকে চুমু খাচ্ছে!

চলবে

শানজানা আলম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে