নিঝুমপুর পর্ব-১+২

0
181

নিঝুমপুর -১
শানজানা আলম

আমাদের এই বাড়িটার নাম “চৌধুরী নিবাস”। খুবই কমন নাম, বাংলাদেশে যত চৌধুরী আছে, তাদের কমপক্ষে ষাটভাগ মানুষের বাড়ির নাম “চৌধুরী নিবাস”। তবে আমরা চৌধুরী নই। চৌধুরী ছিলেন যিনি বাড়িটা করেছিলেন, তিনি। তার নাম ছিল চৌধুরী এমাজউদ্দীন। এরশাদ সরকারের আমলে তিনি বিশিষ্ট শিল্পীপতি এবং গুরুত্বপূর্ণ আমলা ছিলেন। এই বাড়িটা তিনিই করেছেন। তিনিও এই বাড়িতেই থাকেন, তবে ঘরে না। বাড়ির কম্পাউন্ডের এক পাশেই তার কবর।
তার পরিবারের লোকজন দেশের বাইরে থাকে।

বাড়িটার অবস্থান আদাবর চার নম্বর রোডের একদম মুখেই। বেশ অনেকটা জায়গায় উঁচু প্রাচীর করা, লোহার গেট দেওয়া বাড়ি। পুরো গেট আমি কখনো খুলতে দেখিনি। একটা পকেটগেটে তালা দেওয়া থাকে, আমরা সেটাই ব্যবহার করি৷
গেট থেকে ঢুকে ছোট আঙিনায় কিছু গাছ লাগানো। একটা আমগাছ, একটা কামরাঙা গাছ আর দুটো কাঠাল গাছ। একটা স্বর্নচাপা গাছ বেশ বড় হয়ে উঠেছে। নারকেল আছে গোটা চারেক। এই গাছগুলো উঠানের মত আঙিনায় রোদ পড়তে দেয় না। বাড়ির সামনেটাও ছায়ায় ঢেকে থাকে।
তবে ছাদে অনেক রোদ পড়ে। আমরা এই বাড়ির ভাড়াটে। নিচতলা দোতলা মিলে আমাদের পরিবারের বেশ কিছু মানুষ এখানে থাকে।

যেমন বড়মামা। ওনার নাম তবারক হোসেন।
বড় মামা আমাদের বাড়ির মুরব্বি। তার কথায়ই এবাড়ির সব কিছু চলে। তার কথা বজ্র কঠিন এবং কোনো নড়চড় হয় না। বড় মামার একটাই মেয়ে, সেঁজুতি আপা, উনি বেশ সুন্দরী তবে আমার মামী নেই। কেন নেই সেটা আরেক গল্প, অন্য কখনো বলব।

নানীবু, নানীবুর বয়স আশির কাছাকাছি। সব কাজ করতে পারে, কিন্তু সারাদিন বাড়ির সবার ভুল ধরে বেড়ানো তার একমাত্র পছন্দের কাজ।

আমার মা আর আমি, আমার নাম নিঝুম, আমার মা তাসলিমা বেগম। মায়ের একমাত্র মেয়ে আমি। জ্ঞান হবার পর থেকে দেখছি আমি এই বাড়িতে, নানীবুর সংসারে। একটু বড় হয়ে জেনেছি, আমার মা এক বখাটে ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়েছিল, যে আমাকে মায়ের গর্ভে রেখে পালিয়ে গেছে, আর ফিরে আসে নি। এইকথা অবশ্য বলা নিষেধ। তবে সবাই জানে।
আমি কেন্দ্রীয় কলেজে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি।

আমার ছোটোমামা থাকে আমেরিকায়। সেখানে তার একটা বিশাল বাড়ি আছে। ফেসবুক ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলে সুন্দর সুন্দর ছবি আপলোড করেন। আমেরিকান মামীর সুন্দর সুন্দর ফর্সা আমাদের মামাতো ভাইবোন। এই পরিবারের ইনকাম মূলত ছোট মামার পাঠানো ডলার। তবে ডলার বলতে যে অনেক টাকার ছবি ভেসে আসে, সেরকম কিছু না। কয়েকমাস পর পর ছোটমামাকে টাকার জন্য ফোন করতে হয়। মামা তখন বিরক্ত হয়ে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেন।
এবং কেন কোনো আয়ের উৎস করা হচ্ছে না, এটা নিয়ে চেঁচামেচি করেন।

আমাদের সাথে আরো দুইজন মানুষ থাকে। তারা আমাদের কোনো আত্মীয় স্বজন নয়। একজন হলেন বাকের মিয়া, এই বাড়ির কেয়ার টেকার। আমরা তাকে ধলু মামা ডাকি। সে এই বাড়ির বহু পুরাতন বাসিন্দা, তার জন্যই একটা রুম আর কিচেন, বাথরুম করা হয়েছিল নিচতলায় গ্যারেজের পাশে। সেখানেই সে থাকে, বিপত্নীক, এক ছেলে নারায়ণগঞ্জে থাকে।
এখন আর এই বাড়ির দেখাশোনা করার কিছু নেই, তবুও ধলু মামা থাকে। আমাদের সাথেই খায়। বাড়িওয়ালার ছেলে মাসে মাসে তাকে বেতন পাঠিয়ে দেয়।

আরেকজন ময়না খালা। মূলত সে গৃহপরিচারিকা। তবে তার স্ট্যাটাস আমাদের সবার চাইতে ভালো। সে খুব সুন্দর করে গুছিয়ে শাড়ি পরে, চুল আচরায়। তরকারি কোটাকুটি করা ছাড়া তাকে অন্য কোনো কাজ করতে দেখা যায় না। বরিশালের পাঁচমিশালি শুদ্ধ বাংলায় সে কথা বলে। তার বিয়ে হয়েছিল কিন্তু স্বামী তাকে ছেড়ে দিয়ে আরেকটা বিয়ে করেছে। সে ইগো প্রবলেমের কারনে আর সে ঘরে ফেরত যায় নি।

মোটামুটি এই হলো আমাদের বাড়ির লোকজন। এই বাড়ির নাম চৌধুরী নিবাস হলেও, আমি এর একটা গোপন নাম দিয়েছি।
এই নামটা আমি অন্য কাউকে বলি নি।
সেই নামটা এখন বলছি, আমি এই বাড়ির নাম দিয়েছি
“নিঝুমপুর”।

চলবে

নিঝুমপুর- ২

একটা বিষয় খেয়াল করেছেন, এই নিঝুমপুরের বাসিন্দা সবাই একা। কারো কোনো সঙ্গী বা সঙ্গিনী নেই। তবে সবাই যে দুঃখী, তা নয়। সবাই একত্রে ভালো আছে। এই যে আমাদের ধলু মামা, উনি একাই রান্না করে খেতেন এক সময়ে। একদিন নানীবু দেখলেন, উনি নাকি ঢেড়স সিদ্ধ পাতে নিয়ে ভাত খেতে বসেছে।
আমার নানীবু বললেন, তুমি একলা একলা কোন ছাতা রান্না করো, আমাগো লগে দুইটা ডাইল ভাত খাও। পরের বেলায় ধলু মামা আমাদের সাথে খেতে এলো। এখন সে যে আমাদের আপন কেউ নয়, সেটা আমরা ভুলেই গেছি। ময়না খালার সাথে তার খুবই খাতির। দুজনে সুখ দুঃখের আলাপ করে ছাদে বসে। নানীবু একবার কথা পেরেছিলেন, ময়নাকে বিয়ে দিবা নি, ধলুর লগে!

বড়মামা কঠিন দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়েছেন নানীবুর দিকে। কথা আর আগায় নি। ধলু মামাকে দেখলে চট করে বোঝা যায় না, উনি কেয়ারটেকার গোছের কেউ। সব সময় ধোঁয়া জামাকাপড় পরে ফিটফাট হয়ে চলাফেরা করেন।

আমার বড় মামা খুবই বদমেজাজী ছিলেন। তখন তারা বরিশালের মেহেন্দিগন্জে থাকতেন। সেজুআপা তখন বেশ ছোটো৷ একবার কোনো কারনে তিনি রেগে গিয়ে পানির গ্লাস ছুড়ে মেরেছিলেন। বড়মামীর কপাল কেটে গিয়েছিল। বড় মামীর বাবা খবর পেয়ে এসে মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন তবে সেঁজুতি আপাকে নিলেন না। তার আদরের মেয়েকে এতদিন এইসব অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে ভেবে তিনি লজ্জিত। মাসখানেকের মধ্যে মামার কাছে তালাকের নোটিশ চলে এলো। শুনেছি মামীর আবার বিয়ে হয়েছে। ঢাকায়ই কোথাও থাকে।
তবে এই বিষয়েও কথা বলা নিষিদ্ধ।
আমাদের এই বাড়ির নাম হওয়া উচিত নিষিদ্ধ বাড়ি। সব কিছুই নিষিদ্ধ। জোরে কথা বলা নিষিদ্ধ, কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করা নিষিদ্ধ।

সেঁজুতি আপা ইডেনে পড়ে বোটানিতে। তার একটা বড় সময় কলেজেই কেটে যায়। আমাদের অবশ্য বেশি ক্লাশ হয় না। সারাবছরই কলেজে কোনো না কোনো পরীক্ষার সিট পড়ে থাকে। দুটো কোচিং করিয়ে পড়াশোনা টিকিয়ে রাখা হচ্ছে আমার।

কোচিং থেকে বাসায় ফিরে দেখলাম মামার ঘরে বেশ গম্ভীর মিটিং চলছে। বিষয়টা জটিল মনে হলো। আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা করলাম।

নানী বু চি চি করে কাঁদছেন আর বলছেন, কুলাঙ্গার পেটে ধরছি আমি!

আমার মা বলল, এইভাবে বইলো না মা, এতদিন তো দিছে, এখন মনে হয় আসলেই সমস্যা!

মামা কিছু বলছেন না।

যা বুঝলাম, ছোটো মামার কাছে টাকা চাওয়া হয়েছিল। মামা এবারে বলে দিয়েছেন, আর টাকা পয়সা দিতে পারবেন না। এবারে যেন নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করে নেওয়া হয়।

বিষয়টা চিন্তার। বড় মামা টুকটাক ব্যবসার চিন্তা করেছিলেন, তবে তার সাথে কারো বনিবনা হয় না।
এই বাসার ভাড়া আট হাজার টাকা, দীর্ঘ আঠারো বছরে এই বাসা ভাড়া মাত্র একবার বেড়েছে বছর দুই আগে। আগে সাত হাজার ছিল, দুই বছর ধরে আট হাজার দেওয়া হচ্ছে।
এই টাকা অবশ্য বাড়িওয়ালার খুব একটা কাজে লাগে এমন নয়, তবে বাড়িটার পানির ট্যাংকি পরিস্কার করাতে হয়, পেছনের ঝোপঝাড় পরিস্কার করাতে হয়, পুরো বাড়ির বাইরের বাতিগুলোর কারেন্ট বিল আসে সেটা দিতে হয়।এইসব খাতেই টাকা পয়সা লাগে।

সব চাইতে বড় বিষয়, আমাদের বাসার বাজারখরচ চলে ছোটো মামার টাকায়।

ঘরে গিয়ে দেখলাম সেঁজুতি আপা ফিরেছে।
মনোযোগ দিয়ে একটা আর্ট পেপারে পাতার ছবি আঁকছে৷
আমাকে দেখে মুখ তুলে বলল, নিঝু, শুনেছিস ঘটনা?

আমি বললাম, কোন ঘটনা?

কেন, আড়ি পাতিস নি? তোর তো আড়িপাতা স্বভাব আছে।

আমি বললাম, মামা টাকা পাঠাবে না, সেটা?

হুম।

শুনলাম।

তোকে তো চিন্তিত মনে হচ্ছে না!

চিন্তা করলে তো টাকা চলে আসবে না। তোমাকেও তো চিন্তিত মনে হচ্ছে না।

আমি চিন্তিত না তাই চিন্তিত মনে হচ্ছে না। আমি ঠিক করেছি, অনলাইনে একটা পেজ ওপেন করব। জামাকাপড় বেচব, খাবার দাবার বেচব। পড়ার খরচ উঠে যাবে।

আমাকে পার্টনার করে নিও। আমি তোমার জামাকাপড় প্যাকেট করে দেব।

সেঁজুতি আপা হি হি করে হেসে উঠলেন। আমিও হাসলাম।আমাদের দুই বোনের হাসি শুনে ময়না খালা উঁকি দিলেন। নিচ থেকে বড়মামা জিজ্ঞেস করলেন৷ এত জোরে হাসে কে?

ময়না খালা বলল, কে আবার, সেজু আর নিঝু হাসে!

চলবে

শানজানা আলম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে