নিঝুমপুর পর্ব-১১+১২+১৪

0
141

নিঝুমপুর -১১

মোকলেস আলীকে আমরা দুইবোন সাবলেট আন্টির ঘটনা জানালাম না। কারন এটা বলার মত কোন ঘটনা না৷ মোকলেস আলীর কাছে একটা ফোন এলো আন্টির অফিস থেকে। সম্ভবত এটা মিথ্যা কথা, ফোন এসেছে থানা থেকে সম্ভবত, মোকলেস আলী গেল সেখানে খুঁজতে।

তবে আন্টিকে আনা গেল না। আবুল হাসান সাহেব মোকলেস আলীর সাথে গেলেন তবে বিশেষ কাজ হলো না। এই দেশে সাধারণ মানুষেট মামলা মোকদ্দমার ঝক্কি হয় সাংঘাতিক। মাদক মামলা থেকে রেহাই পাওয়া খুব একটা সহজ বিষয় না। আন্টিকে কোর্টে চালান করা হয়েছে। সেখান থেকে কারাগারে নিয়ে যাবে। ভালো উকিলের খরচ চালানো মোকলেস আলীর সামর্থ্যের বাইরে।
এসব বিষয় চুপেচাপে বাসায় ঘটতে লাগল আর আমরা ভাব করলাম, আমরা কিছুই জানি না।

এই বিপদের মধ্যে একটা সুখবর হলো, ছবি মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। সে ফোর্থ হয়েছে। ছেলেদের মধ্যে সেকেন্ড। এই খবর বাসায় আসার পরে সব চাইতে খুশি হলো ময়না খালা। সে বার বার বলতে লাগল, পোলাটা মায়ের মত খাইস্টা না, ব্রেন্ট ভালো! একটু পড়ালেকা করল না, সে নাকি মেডিকেলে চান্স পাইলো!

কয়েকটা কোচিং সেন্টার থেকে ছবির খোঁজে বাসায় এলো। ছবি তাদের কাছে কোচিং করেছে, এটা ছবিকে বলতে হবে, তাদের সাথে ছবি তুলতে হবে। ছবির জন্য তারা খাম নিয়ে এসেছে। খামে কি আছে, আমার দেখার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ছবি রাজী হলো না। সে তার কোচিংয়ের ভাইয়া ছাড়া কারো কাছে পড়েছে, এটা বলতে রাজী হলো না।

ছবির এই সাফল্যে বড়মামাও খুশী হলেন। ধলু মামা বাজারে গেল। বাজার থেকে গরুর মাংস নিয়ে এলো।
ব্যপক উৎসাহে বাড়িতে গরুর মাংস আর খিচুড়ি পাক হলো। ছবি লজ্জা পেলো মনে হয়। এক ফাঁকে এসে আমাকে বলে গেল, আপা, আপনি না থাকলে আমি তো কিছুই পারতাম না!

আমি হেসে বললাম, পারতে, তুমি তো সবই পেরেছিলে প্রথম দিন যে ভাইয়া টেস্ট নিলো, আমি তো দেখেছিলাম।

আপনি আমার ছোট না হলে আপনাকে একটা সালাম করতাম!

এই সেরেছে! থাক, এত আদিখ্যেতা দেখাতে এসো না আবার।

সত্যি বলতে ছবি যে আমার চাইতে বড়, এই বিষয়টা আমার মনেই ছিল না। খুবই হাস্যকর বিষয়।

সেঁজুতি আপা আমাকে জিজ্ঞেস করল, তোর সাথে ওর এত ফিসফাস কি? ওকে তো দেখলাম পরীক্ষা দিতেও নিয়ে গেলি!

আমি একটু রহস্য করে হাসলাম শুধু। থাকুক আপা একটু চিন্তায়!

মোকলেস আলীকে চিন্তিত দেখায় না, তবে তার চুল পেকে গেল কয়েকদিনে। একদিন সকালে সে বড় মামার কাছে গিয়ে বলল, সে বাড়ি যেতে চায়। অনেক দিন তো হলো, রোজিনা নাই, ভাড়াও দিতে পারবে না।

বড় মামা তাকে বললেন, ভাড়া দিতে হবে না। সে যেন রোজিনা আন্টিকে না ছাড়িয়ে কোথাও না যায়।

মোকলেস আলী এই বাড়ির সদস্য হয়ে থাকতে শুরু করল।

চলবে

নিঝুমপুর -১২

দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল নিরিবিলি। আবুল হাসান সাহেবের মা একদিন এলেন আর মেয়েকে নিয়ে। সারাদিন থাকলেন আমাদের বাড়িতে। বিকেলে যাওয়ার সময়ে বড় মামাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। খুব আশ্চর্য বিষয় হলো, বড় মামা কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না। রাজী হলেন সহজেই। তার পরের শুক্রবারে সেঁজুতি আপার সাথে আবুল হাসান সাহেবের বিয়ে হলো। বিয়ের পরে আপা আর হাসান সাহেব, সরি সাহেব বলছি কেন! ওনাকে এখন দুলাভাই বলতে হবে। দুলাভাই আমার ডাকতে ইচ্ছে করে না। হাসান ভাই বলা যাক বরং! তো যা বলছিলাম, আপা আর হাসান ভাই চলে গেল তাদের ফ্ল্যাটে। আমি, ছবি, ধলু মামা, মোকলেস আলী আমরা গিয়ে আপা আর হাসান সাহেবকে পৌঁছে দিয়ে এলাম।

আপা চলে যাওয়ার পরে আমি কিছুটা একা হয়ে গেলাম। যদিও আপার সাথে আমার অনেক বেশি কথা হতো না, তবু রাত বিরেতে একা থাকতে হতো না।

হাসান সাহেব চলে যাওয়ার পরে ছবি চিলেকোঠায় থাকতে শুরু করল। তার ক্লাশ শুরু হলে হলে চলে যাবে। তার আগ অবধি এখানে থাকবে।

ধলু মামার ছেলে এসেছিল। সে চাচ্ছে মামা তার সাথে গিয়ে থাকুক। এখানে আর কত দিন! কম তো বয়স হয় নি! এবারে আরাম করুক!

ধলু মামা যেতে রাজী হলো। প্রতিমাসে সে এসে দেখে যাবে। আর মোকলেস আলী তো রইলই বাড়ির দেখাশোনা করার জন্য। ধলু মামা চলে গেল ছেলের সাথে।

এখন নিচতলায় থাকে মোকলেস আলী। ধলু মামার কাজগুলো সে করে। চিলেকোঠায় থাকে ছবি।
বাড়িভাড়া থেকে আয় ইনকাম বন্ধ হয়ে গেছে। আমাকে কোচিং ছেড়ে দিতে হলো।

একদিন দুপুরে বাড়িতেই ছিলাম। ছবি সাধারণত দুপুরে থাকে না। কোথা থেকে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপা, কোচিংয়ে যাচ্ছেন না?

না, কেন?

এমনিই, এজাজ ভাইয়ার সাথে দেখা হলো, তার কাছে শুনলাম।

আপাতত আর যাব না৷

আচ্ছা… কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল ছবি।

★★★

মাস কেটে গেল আরেকটা।
একদিন সকালে দেখি যে ভদ্রলোক সেঁজুতি আপাকে খুঁজতে এসেছিলেন, উনি এসেছেন।

তার কাছ থেকে জানতে পারলাম সেঁজুতি আপার মা আমাদের বড় মামী মারা গেছেন। উনি আপার জন্য ছয় লাখ টাকা আর কিছু গয়না রেখে গেছেন। আপা তো নিজের বাসায় আছে এখন। আপাকে পেলেন না।
তাই মামার সাথে কথা বলছেন।
বড় মামা বললেন, সেঁজুতি মায়ের টাকা নেবে কিনা সেটা তার বিষয়, আমি তাকে জানাতে পারি। জোর করতে পারি না।

আপাকে ফোন করা হলো। লাউডস্পিকারে দিয়ে মামা তাকে জানালেন, তোমার মা কিছু টাকা রেখেছেন। তুমি কি নিতে চাও?
আমি মোটামুটি শতভাগ নিশ্চিত আপা টাকা নেবে না।
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে আপা বলল, সে টাকা নিতে চায়। মায়ের স্মৃতি গয়নাও।

ভদ্রলোক ভালো মানুষ। উনি আপাকে দেখা করে সব বুঝে নিতে বললেন।

সেঁজুতি আপা গেল এবং টাকা গয়না নিয়ে বাড়িতে চলে এলো।

টাকা গুলো বড় মামাকে দিয়ে বলল, আপাতত কয়েক মাস এই টাকায় চলতে পারবে।
আর গয়নাগুলো দিলো আমাকে।

নিঝু, এই গয়না তুই রাখ। তোর তো বিয়ে হবে নাকি!
আমার তো মায়ের সাথে কোন স্মৃতি নেই, স্মৃতিচিহ্ন রেখে কি হবে!

তুমি এজন্য টাকা আর গয়না নিয়েছ?

আপা বলল, হুম। আমি না নিলে অন্য কেউ ভোগ করত! আমাকে দিয়েছে, আমি নিয়েছি! না নিয়ে ইগো দেখানোর কিছু নেই! না চাইতেই আমি স্বামী সংসার সন্তান স্বচ্ছলতা সব পেয়েছি! আমার আর কোন দুঃখ নেই!

আপার গয়না আমি নিলাম! ভালোবাসা ফেরাতে নেই! কিন্তু এই গয়না আমার কাছে অর্থনৈতিকভাবে মূল্যহীন!

রাতে খাবার টেবিলে মামা বড়মামা বললেন, নিঝুম, আবার কোচিং শুরু কর। পরীক্ষার তো বেশি বাকি নেই!

আমি রাজী হলাম। তবে পরীক্ষা দিতে ইচ্ছে করছে না।
তাই আর কোচিংয়ে গেলাম না। কোচিংয়ের সময়টাতে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি শুরু করলাম।

চলবে

নিঝুমপুর- ১৩

ছবির মেডিকেলে ভর্তিসহ আনুষঙ্গিক বেশ কিছু টাকা লাগবে। ছবির বাবা তাকে রেখে গেছে তো গেছে, আর একবারো আসে নি। ছবিও বাড়ি যায় নি।
সেখানে টাকা দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। তবে ছবিকে ভর্তি করে দিলেন বড় মামা। সেঁজুতি আপুর দেওয়া টাকা থেকে ছবি ভর্তি হলো। একসময় তার ক্লাশও শুরু হলো। আমাদের বাড়ি থেকে সে হলে চলে গেল।

আমার পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেল একসময়। ভালো নাই করতে পারি, তবে ফেল করব না। শেষ মুহূর্তে বইখাতা ঘেটে পরীক্ষায় বসলাম। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে অফুরন্ত অবসর পাওয়া গেল। সারাদিন বাসায়ই থাকি। ভর্তি কোচিং না করে টুকটাক ফ্রিল্যান্সিং শেখার চেষ্টা করছি। পড়াশোনা না করলেও যাতে কিছু করে চলা যায়! তবে ঠিক পারফেক্টলি কোন ইনকাম করতে পারছিলাম না। ছবি কোচিংয়ের ভাইয়াদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে, একগাদা শিট দিয়ে গেছে। খাটের নিচে ঢুকিয়ে রেখেছি।

আমাদের বাড়িওয়ালা ফোন করেছিল। গত কয়েকমাসে কোন ভাড়া জমা হয় নি ব্যাংকে। ধলু মামাও চলে গেছে। তাই আমাদের উপরে বোধহয় আর ভরসা করতে পারছে না। মামার মুখ শুকনো হয়ে গেছে এই ফোন আসার পরে। কাউকে কিছু না বলে একা একা সারাক্ষণ চিন্তা করছেন।

এক সকালে একজন লোক এলো আমাদের বাড়িতে। চেহারার একপাশ ঝলসে গেছে। মনে হয় কেউ এসিড দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। এরকম লোক আমাদের বাড়িতে কারো পরিচিত হতে পারে, ঠিক জানি না।

লোকটি নিচে বসে আছে। সে আসার থেকে বাড়ির পরিবেশ কেমন পাল্টে গেল। বড়মামা লোকটিকে চলে যেতে বলছেন। লোকটি কিছু বিষয় নিয়ে তর্ক করার চেষ্টা করছে। আমি নিচে নামব ভাবছিলাম, কিন্তু রুমের ছিটকিনিটা বাইরে থেকে কেউ বন্ধ করে রেখেছে। জোরে কয়েকবার মাকে ডাকলাম, ময়না খালাকেও ডাকলাম কিন্তু কাজ হলো না। এত ডাকাডাকি না করে ঘুমিয়ে পড়লাম। আজ কোথাও যাব না, সারাদিন ঘুমাব।

আমার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। মা এসে বসেছে আমার পাশে।

-নিঝুম, ওঠ।

উঠে বসলাম চোখ ডলে।

-কিছু হয়েছে মা?

মা কিছু বলল না।

-কি বলবে বলো?

-তোর পড়াশোনার খবর কি?

-খবর ভালোই।

-হুম।

-বাড়িওয়ালা ফোন করেছিল। আমাদের বাড়িটা ছেড়ে দিতে হবে। ডেভলপারকে দিয়ে দিবে কয়েকমাস পরে।

-ও আচ্ছা।

-গত কয়েকমাস আমাদের ভাড়াও পায়নি, সেটা অবশ্য দিতে বলে নি।

-হুম।

তবে এটা বলতে মা আসে নি, আরো কিছু বলতে চায়।

-কিছু বলবে মা?

-আজ যে লোকটা এসেছিল, তোর সাথে কথা বলতে চাইলে কথা বলবি না। খুব খারাপ লোক।

-ঠিক আছে মা।

-তুই উঠে ফ্রেশ হয়ে নে, আমি কিছু খেতে দিচ্ছি।

-আচ্ছা।

আমাকে খাবার দেওয়ার কথা বলে মা চলে যেতে যেতে পা ফসকে সিঁড়ি থকে পড়ে গেল। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল মনে হয়। আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখি, মা অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমি চিৎকার করে মামা আর নানীবুকে ডাকলাম।

……..

চলবে না,
শানজানা আলম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে