নিজেকে ভালোবাসি পর্ব-০৪

0
989

#নিজেকে_ভালোবাসি

#পর্ব-৪

রুহির কান্না থামে না। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হয়। নিজের গালে চড় মারতে ইচ্ছে করে।
কিভাবে পারলো সে? কিভাবে সব ভুলে শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরল! কেন সে এমন দায়িত্বহীন হয়ে পড়লো! কদিন আগেও তো মনে ছিল জন্মদিনের কথা তবে আজ কেন ভুলে গেল?এমন তো হওয়ার কথা নয়। এতো দিন যে ভয়টা পেয়েছিল তাই হলো। অর্কর একটু ছোঁয়াতেই সে ব্যস্ত হয়ে নিজের ভুবন সাজাতে শুরু করেছে।
রুহীর সব রাগ অর্কর উপরে আছড়ে পড়ে। কেন সে রুহীর জীবনে এলো। কেন?
কান্না মুছে রুহী আয়নার সামনে দাঁড়ায়।
নিজেকে দেখে নিজেরই হাসি পায়। আস্তে আস্তে সব খুলে রাখে। মুখ ধুয়ে জামা বদলায়। কোনো প্রসাধনী নেই। সাধারণ জামা, বাধা চুল। যেমনটি হওয়া উচিৎ। নিজেকে নিয়ে ভোলার জন্য সে নয়। তার অনেক দায়িত্ব।
বিকেলে সবাই চলে এলো। দিশা নিশাকে সবাই উইশ করছে সাথে গিফটও এনেছে।

রুহী মৌকে গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোরা জানলি কি করে আজ ওদের জন্মদিন?

মৌ বলল, মাহিরা আপু বলেছে। তিনি দিশা-নিশার সাথে গল্পে গল্পে আগেই জেনে রেখেছিলো।

সবার শেষে অর্ক হাসি মুখে ঢোকে।
অর্ককে দেখতেই রুহি চোখ সরিয়ে নেয়। কোনো ভাবেই রুহির চোখ অর্ক যেন পড়তে না পারে। আজ অর্ক যা ভাবছে তা হবার নয়। রুহীর মায়ের সাথে সকলে কুশল বিনিময় করে একে একে ছাদে চলে যায়।
রুহীদের ছাদটা বেশ সুন্দর। অনেক গাছ গাছালি দিয়ে ঘেরা। সাদমান আর নওশীন দিশা নিশার সাথে খেলা করছে।
দিশা নিশা এবার সাত বছরে পড়লো। বয়স অনুযায়ী ওরা বেশ গুছিয়ে কথা বলে। দেখতে অনেকটা রুহীর মতোই। বড় বড় চোখ ঠিক যেন রুহীর ফটোকপি। শুধু রুহীর চুল সোজা আর ওদের চুলগুলো কোঁকড়ানো। অবশ্য কোঁকড়ানো চুলে ওদের দেখতে আরও মিষ্টি লাগে।

ছাদে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করছে। রুহী এমন ভাবে চলছে যেন অর্কর কোনো অস্তিত্বই নেই এখানে। কিছুক্ষণ পরে নাস্তার ডাক পড়ায় সবাই নিচে নামতে থাকে।
অর্ক হঠাৎ রুহীর হাত পেছন থেকে টেনে ধরে। সামনের অনেকেই তা খেয়াল করে। কিন্তু না বোঝার ভান করে নেমে যায়।

–কি ব্যাপার আমাকে যেন চোখেই দেখছেন না আপনি?
রুহির বুক ধকধক করে। যে সময়টাকে সে ভয় পাচ্ছিল তা চলে এসেছে। কি বলবে সে?
যে ভাবেই হোক শক্ত থাকতে হবে।
রুহি চোখ নামিয়ে রাখে।
–কোনো সমস্যা? আমি খেয়াল করছি আপনি আমাকে এড়িয়ে চলছেন।
গলার স্বর নামিয়ে অর্ক বলে, নাম জানার ইচ্ছে নেই আপনার?

রুহি অস্থির হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। হঠাৎই দেখে দিশা নিশা উঁকি দিচ্ছে। ওদের ডেকে নিজের দুপাশে দাঁড় করিয়ে দেয় রুহী।
অর্কর চোখে চোখ রেখে বলে, দিশা নিশা আর আমার মা, এদের নিয়েই আমার জীবন। আমার দিন এদের দিয়েই শুরু এদের দিয়েই শেষ। এরচেয়ে বেশি কিছু আমার জীবনে নেই। নতুন কিছু চাইও না আমি আমার জীবনে। আমি চাই না কোনো নতুনের ডাকে আমার পরিবারের দায়িত্ব থেকে আমি সরে যাই।
এবার বলেন আপনি কি আমাকে সেই নাম বলতে চান?
রুহি ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে অর্কর দিকে তাকায় কিন্তু অর্কর স্বচ্ছ দৃষ্টির কাছে টিকতে পারে না। আবার চোখ নামিয়ে নেয়।

অর্ক দিশা নিশাকে বলে তোমরা নিচে যাও তো সোনা। আমরা একটু পরে আসছি।

–রুহি!
রুহি চমকে তাকায়।
–আমার ভালবাসার নাম রুহী।
আমি যাকে ভালবাসি তার নাম বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই বরং গর্ব আছে।
আমার ভালোবাসা এতো স্বার্থপর নয় রুহী। তোমার বাচ্চা, তোমার মা সব তোমারই অংশ। আমি এর সবটুকু নিয়েই তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে আমি নিজের মতো সাজিয়ে ভালোবাসি না। বরং তুমি যেমন তোমাকে তেমন ভাবেই ভালোবাসি।
আমি হঠাৎ দেখা কোন নারীর প্রেমে পরি নি। আস্তে আস্তে ভালোবাসা অনুভব করেছি। আমি এমন একজন মানুষকে ভালোবাসি যার মন অনেক সুন্দর, যে সবাইকে ভালবাসা বিলায়,শত কষ্টেও হাসতে জানে, হাসাতে জানে।

অর্ক একটু থেমে বলে, তুমি তোমার পরিবারকে আমার সামনে দাঁড় করাচ্ছো তো!
আমি তোমার পরিবারকে ভালোবাসবো, তাদের সাপোর্ট দিবো এই ভেবে তুমি কখনও আমাকে হ্যাঁ বলো না, প্লিজ! আমার ভালোবাসার অপমান হবে তাহলে। আমি চাই তুমি তোমার জন্য আমাকে বেছে নাও। আমি চাই তুমি দিশা নিশার মা হয়ে নয়, দায়িত্বের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে স্বাধীন মিষ্টি একটা মেয়ে হয়ে নিজের জন্য সিদ্ধান্ত নেও যে মেয়েকে আমি বৃষ্টিতে নিজের মত ভিজতে, খিলখিলিয়ে হাসতে দেখেছি। আমি সেই মেয়েটিকে চাই।
আমি আমার ভালোবাসার কথা তোমাকে জানালাম। এবার তুমি কি চাও ভেবে দেখো। তুমি সময় নাও, চিন্তা করো। আমি অপেক্ষা করবো।

অর্ক চলে যেতে গিয়েও আবার থেমে বলে,
নিজেকে ভালোবাসতে শেখো রুহী। নিজেকে
ভালোবাসলে, মূল্যায়ন করলে সামনে যত ভয়ংকর সময়ই হোক না কেন তা সহজে পার করা যায়। জীবনটা এতোটাও কঠিন না, যতটা তুমি ভাবছো।

অর্ক নিচে নেমে যায়।
কনে দেখা আলোয় ছাদে একা দাঁড়িয়ে রুহীর চোখ থেকে শুধু জল গড়িয়ে পরে।

——-
নিচে নাস্তা খাওয়া শেষে চা পর্ব চলছে। রুহী আর রুহীর মা রান্নাঘরে ব্যস্ত। গিফট সব রুহির রুমে তাই দিশা-নিশা উসখুস করতে থাকে। নওশীন ওদের নিয়ে রুমে ঢুকে বলে, গিফটগুলো তোমাদের পছন্দ হয়েছে কিনা খুলে দেখো তো! ওরা খুশিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পিছন পিছন সবাই একে একে রুহীর রুমে ঢোকে।
মাহিরা হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বলে, হায়! হায়! এগুলো কার?
সবার ওদিকে চোখ যায়। দেখে ড্রেসিং টেবিলে চুড়ি, দুল,মেকাপের জিনিস রাখা।

মাহিরা আবার বলে, দিশা এগুলো কার? রুহী তো সাজে না।
দিশা গিফট খুলতে খুলতে বলে ওগুলো তো মামনির। আজকে মামনি খুব সুন্দর করে সেজেছিল। কিন্তু আমাদের জন্মদিন যে আজ ভুলেই গেছে। তাই পরে অনেক কান্নাকাটি করে সব খুলে ফেলেছে। কতদিন পর আজ মামনি সেজেছিল। কি সুন্দর লাগছিল তাই না নিশা?
–আজকে আমাদের খুব মজা হচ্ছে। কতদিন পর আমাদের আবার জন্মদিন হলো। আগে আব্বুর কত বন্ধু আসত গিফট নিয়ে। আজকে মামনির বন্ধুরা এসেছে গিফট নিয়ে।

আব্বুর কথা বলায় সবাই যেন একটু চমকে ওঠে।

নিশা আবার বলে, মামনি তখন যেমন সাজতো আজকেও সেজেছিল। খামখা খুলে ফেললো। আব্বু আজকে দেখলে বলত আর কত সাজবে শেলকা ?? হি.. হি.. হি..।
দিশা হেসে বলে, শেলকা নারে বোকা “শালিকা”।
সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।
মাহিরা বলে, তোমার আব্বু তোমার মামনিকে শালিকা বলতো?
–হ্যাঁ আন্টি।
–কিন্তু শালিকা তো খালাকে বলে আম্মু কে না।

দিশা বলল, আম্মুকে তো বলতো না মামনিকে বলতো।
–আম্মুকে বলতো না মানে?
–আম্মু তো আম্মু মামনি তো মামনি।

মাহিরা অস্থির হয়ে পড়ে। বলে, দিশাসোনা খুলে বল তো আম্মু আর মামনি কি আলাদা বলছো তুমি?
–হ্যাঁ আন্টি, মামনি তো আমাদের খালামনি!

সবাই যেন সম্বিত হয়ে গেল।
–রুহি তোমাদের খালামনি?
–হ্যাঁ। আগে আব্বু আম্মু নানু মামনি মানে খালামনি আমরা সব একসাথে একটা বড় বাসায় থাকতাম। আম্মু ঘরের সব কাজ করত আর মামনি শুধু সাজগোজ করত আর ঘুরে বেড়াতো। আর নানুমনির বকা খেত। হিহি!
আমাদের দুইটা টিম ছিল। আম্মু আর নানুমনি এক টিম আর আব্বু আর মামনির আরেক টিম। আমরা আব্বুর টিমেই থাকতাম আর নানুমনি আর আম্মুকে সবাই মিলে জ্বালাতাম। আব্বু আমাদের জন্য চকলেট আনলে আগে মামনিকে দিতো। মামনি নাকি বাসার সবচেয়ে বড় বাচ্চা। হি হি।

নিশা বলে মামনি খালি সাজগোজ করত বলে আব্বু বলতো শালিকার বিয়েতে আমি একটা বড় ড্রেসিং আয়না গিফট করবো। হি..হি..। আগে কত মজা হত! তাইনা দিশা?
নওশীন থেমে থেমে বলল, তোমাদের আব্বু আম্মু এখন কোথায়?
দিশা বলল, ওরা তো দু বছর আগে একটা বিয়েতে গিয়েছিল আর ফিরে আসে নি। নানুমনি বলেছে ওরা এক্সিডেন্ট করে আল্লার কাছে চলে গেছে আর কখনও আসবে না। আব্বু আম্মু আমাদের জন্মদিন করার কিছুদিন পরই আল্লাহর কাছে চলে গিয়েছিল। তারপর থেকে আমাদের বাসায় আর মেহমান আসে না জন্মদিনও হয় না। এরপরের জন্মদিনে আমরা গিফট পেয়েছি ঠিকই কিন্তু নানুমনি আর মামনিকে দেখেছি জড়াজড়ি করে অনেক কাঁদতে।
আমাদের আব্বু আম্মু ওয়ার্লডের বেস্ট আব্বু আম্মু ছিল!
মাহিরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। মৌ, নওশীন চোখের পানি আটকাতে পারে না।

দিশা নিশা অবাক হয়ে যায়। গিফট রেখে বলে, আন্টি আমরা কী কোনো ভুল কথা বলে ফেলেছি? তোমরা কাঁদছো কেন? আমরা কি গিফট নষ্ট করে ফেলেছি? কিন্তু তোমাদের জিজ্ঞেস করেই তো গিফট খুলেছি। আমরা তো দুষ্টুমি করি নাই। আমরা অনেক লক্ষী । নানু বলেছে দুষ্টুমী করলে নানুমনির অনেক কষ্ট হয়। সারাদিন অনেক কাজ করে তো!

সাদমান এসে জাপটে ধরে বাচ্চা দুটিকে। ওর চাপা কান্নার আওয়াজ শুনতে পায় সবাই।

নওশীন এসে বলে, তোমরা কোনো দুষ্টুমি করনি সোনা, তোমরা অনেক অনেক বেশী লক্ষী মেয়ে।

হঠাৎই রুমের পরিবেশ চাপা কষ্টে ভরে যায়।
নওশীন সাদমানকে বলে আমি এখানে থাকতে চাচ্ছি না সাদমান! তুই কি আমাকে নিয়ে যাবি?
মৌ বলে, আমিও বের হবো আপু।
সবার মন এতো খারাপ হয় যে খাওয়া দাওয়া তো দূর রুহীর সামনে যেতেও কেমন অস্বস্থি হয়।

মাহিরা ঘুরে দেখে রুহির মা দাঁড়িয়ে নিরবে কাঁদছে। মাকে জড়িয়ে ধরে মাহিরা বলার চেষ্টা করে, আন্টি রুহী….. দিশা-নিশা বাবা মা……… কিন্তু কিছুই স্পষ্ট বলতে পারে না শুধু কাঁদতে থাকে।
সাদমান এসে বলে, আন্টি আমরা আজ আসি। আরেকদিন না হয় আসবো। বলে সবাই একে একে বের হয়ে যায়। রুহির মা কাউকে বাধা দেয় না। সবার মনের অবস্থা বুঝতে পারেন তিনি।

রুহীর বড় বোন রোমানা আর সাব্বিরের যখন বিয়ে হয় তখন রুহী ছিল তেরো বছরের চঞ্চল কিশোরী। সাব্বিরের বাবা বেঁচে নেই । মা ছেলের ছোট সংসারে রোমানা খুব সুখেই ছিল। দুবছরের মাথায় সাব্বিরের মা মারা যাওয়ায় অনেকটা জোর করেই রুহী ও তার মাকে সাব্বির তাদের সংসারে নিয়ে যায়। বোন দুলাভাইয়ের আদরে রুহী অনেকটাই আহ্লাদী হয়ে উঠে। বিয়ের পাঁচ বছরে অনেক দোয়া মানতের পর দিশা ও নিশার জন্ম হয়। সেদিন রুহীর দুলাভাই হসপিটালে বাচ্চাদের মতো অনেক কেঁদেছিল। রুহীর মাকে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, আম্মু দেখেন আমি মেয়ে পছন্দ করি বলে আল্লাহ আমাকে জমজ দুই দুইটা মেয়ে দিয়েছে।
রুহীর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, শালিকা তোমার আদরে কিন্তু আমার দুটো পরী ভাগ বসিয়েছে।
সেদিন সবাই আনন্দের কান্না কেঁদেছিল।
রুহীর দুলাভাই ছিল রুহীর বাবা, বড় ভাই, বন্ধু সব। ওর সকল আবদার কেউ প্রশ্রয় দিক না দিক সাব্বির ঠিকই দিতো। রুহীর পরম আস্থার জায়গা ছিল সে।
একটা এক্সিডেন্ট রুহীদের সুন্দর সুখী নিশ্চিতের জীবন মুহূর্তেই তছনছ করে দেয়। দিশা নিশার তখন কেবল পাঁচ বছর। ওদের সামলাতে গিয়ে রুহী ভুলেই যায় কদিন আগে সেও একটা বাচ্চা ছিল সবার কাছে।
দায়িত্বহীন রুহী হঠাৎ পুরুষবিহীন এ সংসারের পুরো দায়িত্ব নিয়ে নেয়। আর্থিক দিক থেকে তেমন টানা পোড়ান ছিল না কিন্তু নিজেদের বাসায় ফিরে বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করা, নিজের পড়াশোনা, বাজার, বিল সব কাজ সামলাতে রুহীর বেশ হিমসিম খেতে হতো। অল্প কদিনেই রুহী বুঝে যায় নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় রুহীর নেই। দিশা নিশা এখন ওর দায়িত্ব। ওর বোন দুলাভাই যেভাবে ওকে পরম মমতায় আগলে রেখেছিল তেমনি রুহীকেও এমন মমতা দিয়ে দিশা নিশাকে বড় করতে হবে। দিশা-নিশা ও তাদের ভবিষ্যতের চিন্তা ছাড়া বাকি সব কিছু থেকে রুহী চোখ বন্ধ করে নেয়। জীবনে কারো সাহায্য ছাড়া একাই চলবে আর বাচ্চাদের বড় করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।

ঝিনুক চৌধুরী।।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে