#নিজেকে_ভালোবাসি
#পর্ব-৩
ধানমন্ডির মিটিং যেমন তেমন করে অর্ক শেষ করে। রুহির যেন কিছুতেই আজ মন নেই। সাদমান তার প্ল্যান সম্পর্কে অর্ককে কিছুই জানায় নি। তাই রুহীর এমন আনমনা হওয়ার কারণ অর্ক বুঝতে পারে না।
— কফি খাবেন মিস রুহী ? পাশে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। চলেন ওখানে যাই। তারপর না হয় আপনি বাসায় যেয়েন।
রুহি মাথা নেড়ে সায় দেয়। সে বোঝে, ওখানে অর্ক মেয়েটার সাথে দেখা করবে।
রুহির পা যেন চলতে চায় না। কিন্তু জীবনের বাস্তবতা তো মানতে হবে।
সুন্দর নিরিবিলি একটা রেস্টুরেন্টে কফি সামনে নিয়ে বসে আছে দুজন। বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। দুজনই যেন কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না।
হঠাৎ অর্কর পেছন থেকে নায়রা বলে, অর্ক, তুমি ফোন ধরছো না কেন?
রুহী দেখলো সুন্দরী বললে কম হবে একেবারে পুতুলের মত একটা মেয়ে অর্কর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। মেকআপ, চুলের স্টাইল,বেশভোসা সব কিছুতেই আধুনিকতার ছোঁয়া।
অর্ক পেছন ফিরে বলে, ও তুমি এসে গেছো। সরি, মিটিং এ ফোন মিউট করেছিলাম অন করতে ভুলে গেছি।
নায়রা বলে, আগে থেকে লোকেশন ঠিক ছিল বলে আসতে পারলাম। না হলে তো তোমাকে খুঁজেও পেতাম না।
রুহীর দিকে তাকিয়ে নায়রা বলে, ও কে?
অর্ক বলল, পরিচয় করিয়ে দেই তিনি হচ্ছেন রুহী, আমার অফিস কলিগ। আর এ হচ্ছে নায়রা।
রুহী মিষ্টি হাসি হেসে বলে, নাইস টু মিট ইউ। আপনারা গল্প করুন আমি ওদিকে আছি।
অর্ক সাথে সাথে বলে, আপনি বৃষ্টির মধ্যে বাসায় চলে যাবেন না প্লীজ। আমি আসছি একটু পর।
রুহী হেসে বলে, বৃষ্টি না কমা পর্যন্ত আমি যাচ্ছি না।
রেস্টুরেন্টের সাথে একটা লম্বা বারান্দা চলে গেছে। রুহি বারান্দার এক কোনায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে। দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
আজ চোখ মুছতেও ইচ্ছে করছে না।
কেন জীবনটা হঠাৎ এমন হয়ে গেল? সবার আদরের, চঞ্চল, আহ্লাদি মেয়ে ছিল আর এখন! দীর্ঘ শ্বাস ফেলে রুহী। রঙীন স্বপ্ন তার কখনোও দেখা হবে না। সেই দিনের পর থেকে বাচ্চা দুটোকে নিয়ে চলতে চলতে রুহী পণ করেছিল কোনো দিন আর নিজেকে নিয়ে ভাববে না। বিয়ে, ভালোবাসার পথে হাঁটবে না।। চলেও যাচ্ছিল দিন। কিন্তু অর্ককে দেখার পর সব যেন ওলোটপালট হয়ে গেছে। নিজেকে নিয়ে ভাবতে বড় ইচ্ছে করে।
কেন সে একটা স্বাভাবিক জীবন বেঁছে নিতে পারে না?
বৃষ্টিতে হাত বাড়িয়ে ছুয়ে দেয় রুহী। তার বুকের জমা কষ্ট যেন বৃষ্টির সাথে মিশে যাচ্ছে।
নায়রাকে বিদায় দিয়ে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রুহীকে দেখছিল অর্ক। রুহীর চোখের পানি অর্কর দৃষ্টি এড়ায় না।
আস্তে করে রুহীর পাশে এসে দাঁড়ায় সে।
রুহীর মত বৃষ্টিতে হাত বাড়িয়ে দেয়।
হাত বাড়িয়েই দুজন দুজনার দিকে তাকায়। অর্ক তার হাতের মুঠোয় ধরা বৃষ্টির জল রুহীর হাতে ঢেলে দেয়।
রুহীর হাতটাকে নিচ থেকে আলতো করে ধরে রাখে কিছুক্ষণ। এরপর হঠাৎ ই হেঁটে চলে যায়।
রুহী অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে অর্কর চলে যাওয়ার দিকে।
অর্ক কি বুঝালো?
মনে হলো যেন অর্ক তার সমস্ত ভালবাসা মুঠোয় ভরে রুহীর হাতে ঢেলে দিয়ে গেল।
*******
মাহিরাকে কল করে রুহীর মা বলল, আজ অফিস শেষে সবাই আমার বাসায় চলে আসবে। রাতের দাওয়াত রইলো তোমাদের।
মাহিরা আনন্দিত কন্ঠে বলে, অবশ্যই আসবো আন্টি। কিন্তু মেন্যু কি কি যদি জানাতেন তবে সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে আসতাম। জানেনই তো সারাদিন কামলা খাটি এ অফিসটায়। ভাল খাবারের গন্ধ পেলে মনে অনেক এনার্জি পাই। হি হি!
রুহীর মা হেসে আইটেমগুলোর নাম বললে মাহিরা গদগদ হয়ে বলে, আরে আন্টি, এত আইটেম কি একবারে খাওয়া যায়? রয়ে সয়ে খেতে হয়। কিছু যদি মনে না করেন তবে আমরা বিকালেই আসি?
–তাহলে তো খুবই ভালো হয়। দিশা নিশাও অনেক খুশি হবে। ছাদে তোমরা বিকালে আড্ডা দিতে পারবে। তুমি রুহীকে জানিয়ে দাও যে তোমরা আসছো।
মাঝে মাঝেই অফিসের কাজে রাত হয়ে যায় রুহীর। মাহিরা বা নওশীনকে সঙ্গে নিয়ে সাদমান রুহীকে বাসায় পৌঁছে দেয়। সাদমান গাড়িতেই বসে থাকে। তবে মাহিরা বা নওশীন নেমে রুহীকে দায়িত্ব সহকারে বাসায় দিয়ে আসে। যেন আশেপাশে কেউ রুহীর রাত করে ফেরা বা কোনো ছেলের সাথে আসা নিয়ে কোনো কথা বলতে না পারে। রুহীর মার সাথে তাদের এভাবে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে মাহিরার সাথে। কেউই বেশি সময় বসে না বলে তিনি বক্সে ভরে সব সময় হাতে করা কিছু না কিছু রান্না তাদের সাথে দিয়ে দেন। তাদের চোখেমুখে আনন্দ দেখে তিনিও আনন্দ পান। অফিসের এই বাচ্চাগুলোকে বেশ আদর করেন তিনি। আজকাল ওদের বড্ড আপন লাগে তার।
মাহিরা সবাইকে ঘোষণা করে দেয় আজ বিকালে অফিস ছুটি। সবার বিকাল থেকে রুহীর বাসায় দাওয়াত। সবাই খুশিতে চিৎকার দিয়ে ওঠে।
মাহিরা যেহেতু ডিসিশন দিয়েছে সুতরাং অর্ক আর কিছু বলতে পারে না। আসলে মাহিরার উপর অর্কর তেমন খবরদারি চলে না।
অর্কর কেবিনে এসে দাঁড়ায় রুহী।
মা আজ সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে অথচ রুহী তা মাহিরার কাছ থেকে জেনেছে। নিজের বাসার দাওয়াতে তো আর সবার সাথে অফিস থেকে যাওয়া যায় না। তাই দুপুরের দিকেই রুহি বাসায় ফিরতে চায়।
–কিছু বলবেন মিস রুহি, বলতেই অর্কর মোবাইল বেজে উঠে। ইশারায় অপেক্ষা করতে বলে অর্ক ফোন ধরে।
হ্যালো মা…. হু… আচ্ছা . ও….. বিয়ের তারিখ কত বললে…. আচ্ছা…. দেখ তুমি যা মনে কর…… শপিং তুমিই করে ফেলো। মেয়েদের কেনাকাটায় আমাকে কেন টানছো?…..তুমি যা ভাল মনে কর…. হ্যাঁ মা, তোমার পছন্দই ফাইনাল…ওকে।
রুহির হৃদয়টা ভেঙে চুরচুর হয়ে যাচ্ছিল। তবু কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে জিজ্ঞেস করে, আপনার বিয়ে, স্যার?
অর্ক ল্যাপটপে চোখ রেখে বলে, কার বিয়ে?
–আপনার?
ল্যাপটপ নামিয়ে মুচকি হাসি হেসে অর্ক বলে, আমার বিয়ে মানে?
–আপনি যে ফোনে বললেন?
–আমি কি বললাম? বিয়ে করছি বললাম কি? কনেটা কে, শুনি?
রুহি গলার স্বর নামিয়ে বলে, গতকাল যার সাথে দেখা করলেন।
অর্ক জোরে হেসে ওঠে।
–আপনি ধরেই নিয়েছেন যে ওটা আমার পাত্রী?
নায়রা তো আমার কাজিন সিসটার। কানাডায় থাকে। আমি সময় বের করতে পারিনি বলে গতকাল রেস্টুরেন্টে দেখা করতে এসেছিল। ওর বিয়ে দুমাস পর। মা সেকথাই বলছিল। মা নায়রার জন্য গিফট কিনতে চায়। তাই বলছিল আমি শপিং এ যাবো কিনা। মা আগামীকাল নায়রার সাথেই আমেরিকায় যাচ্ছে। আশা করি আমি আপনাকে ব্যাখ্যা দিতে পেরেছি।
রুহি লাজুক মুখে হাসে। মনের ঘন কালো মেঘ যেন মনের অজান্তেই সরতে থাকে।
–এবার বলুন কি জন্যে এসেছেন?
–আমি একটু তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে চাচ্ছি। বিকালে তো আপনারা যাবেন। আম্মুকে একটু হেল্প করা দরকার। তাই আগে যেতে চাচ্ছি।
–ঠিক আছে। আপনি যান।
রুহি বের হচ্ছিল এমন সময় অর্ক বলে, মিস রুহি আপনাকে একটা কথা বলি?
রুহী জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে অর্ক সামনে এগিয়ে এসে বলে, আমি কিন্তু আমার বিয়ের পাত্রী ঠিক করে ফেলেছি। বিয়ে করলে আমি তাকেই করবো।
নাম জানতে চান?
রুহীর মুখ লাল হতে থাকে। মৃদু কণ্ঠে বলে, আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি কি করে…..
–আপনি কনে দেখা আলো সম্পর্কে জানেন?
রুহী অবাক চোখে তাকায়।
অফিসের দরকারী আলাপ ছাড়া অর্ক আর কিছু জানে বা জানার আগ্রহ আছে বলে কেউ মনে করে না। সেখানে কনে দেখা আলো এ ধরনের কথায় রুহীর একটু অবাক হওয়ারই কথা।
–গোধূলীর কিছুটা আগে মেয়েদেরকে নাকি বেশ সুন্দর লাগে। ঐ সময় কোন মেয়েকে দেখে পছন্দ হলে তাকে পাওয়া যায়, সে আলোই কনে দেখা আলো।
রুহীর কিছুটা কাছে এসে গলা নামিয়ে অর্ক বলে, আজ বিকালে আপনার বাসার ছাদে কনে দেখা আলোয় আমি আপনাকে তার নাম বলব।
রুহি আর দাঁড়ায় না। লজ্জা রাঙ্গা মুখ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
রুহী যেন আজ উড়ে উড়ে যাচ্ছে। কিছুই দেখতে বা শুনতে পাচ্ছে না। চারিদিকে শুধু গান বাজছে। মুখের হাসি বন্ধ হচ্ছে না।
লোকে দেখে কি বলবে! যা বলার বলুক। আজ কিছুই পরোয়া করে না সে। একটা দোকানে ঢুকে লিপস্টিক,কাজল, নেইলপালিশ আরও কত কি কিনলো। আজ ইচ্ছে মত সাজবে। যেমন আগে সাজতো। সুন্দর একজোড়া ঝুমকা কিনলো, সাথে চুড়ি। বাসায় এসে সোজা রুমে ঢুকে আরাম করে সাজতে বসলো।
রুহির মা দেখেছে রুহীকে ফিরেছে। কারও আশায় না থেকে তিনি তার কাজেই মন দিলেন।
রুহীর বাবার গড়া দোতালা এ বাসাটা। নিচ তালা ভাড়া দেয়া। ভাড়াটিয়ার বাচ্চাদের সাথে দিশা নিশা নিচে খেলা করছে। রুহি এসেছে তা তারা খেয়াল করে নি। পরে রুমে ঢুকে দিশা নিশা থ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
–মামনি তুমি এত্তো সুন্দর করে সেজেছো! কত দিন পর তুমি এভাবে সাজলে!
রুহি আজ সুন্দর একটা নীল জামা পরেছে। সাথে ছোট নীল টিপ। গোলাপি লিপস্টিক। কানে সিলভার ঝুমকা। চোখে কাজল। পিঠ অবদি লম্বা চুল ছেড়ে দিয়েছে। এমন সাজগোজ দীর্ঘ দিন করে নি সে।
নিশা বলল, আজ অনেক মজা হবে। আজ মামনি সেজেছে। আজ অনেক মেহমান আসবে। অনেক দিন পর জন্মদিনে এতো মজা হবে।
রুহি চমকে ওঠে, জন্মদিন? কার? মুহূর্তে হিসাব মিলিয়ে দেখে আজ তো দিশা নিশার জন্মদিন। এজন্যই মা অফিসের সবাইকে দাওয়াত করেছে। আর সে ভুলেই বসে আছে!
–আমাদের গিফট কোথায় মামনি?
রুহি কি উত্তর দিবে বুঝে পায় না। চোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়তে থাকে। দিশা নিশাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে রুহী।
নিশা বলে, তুমি কাঁদছো কেন মামনি? গিফট আনতে ভুলে গেছো? সমস্যা নাই, কালকে দিও। আমরা রাগ করবো না। আমরা তো লক্ষী মেয়ে। আবার খেলতে নীচে চলে যায় দুইবোন।
কিন্তু রুহির কান্না থামে না। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হয়। নিজের গালে চড় মারতে ইচ্ছে করে।
কিভাবে পারলো রুহী?
কি ভাবে সব ভুলে সে শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরল সে! কেন সে এমন দায়িত্বহীন হয়ে পড়লো! এমন তো হওয়ার কথা নয়।
চলবে।।
ঝিনুক চৌধুরী।।