নারী নারীত্ব সতী সতীত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
5

#নারী_নারীত্ব_সতী_সতীত্ব_ইত্যাদি_ইত্যাদি
#শেষ_পর্ব
#ইসরাত_ইতি

“এই তিহান, শোনো শোনো!”

বন্ধুদের মায়েরা স্কুলের মাঠ থেকে ছুটে এসে তিহানের পথ আগলে দাঁড়ালো। শিশু তিহান হকচকিয়ে উঠলো একইসাথে,এতজনের আক্রমণে।

“তোমার মা কেমন আছে? সে ভালো আছে? স্কুলে যায়?”

তিহান জবাব দিতে মুখ খুলবে ঠিক তখুনি সেলিনা গেট পেরিয়ে এসে ছো মেরে তিহানের হাত টেনে নিয়ে যায় ওখান থেকে। তার আচরণ বেশ অস্বাভাবিক, রুক্ষ। এতো পরিচিত মুখ গুলোকে যেন চিনেও চিনেন না, তিনি পালাতে চাইছে এখান থেকে নাতীকে নিয়ে।

তিন মাস। তিন মাস হয়ে গিয়েছে ঐ দূর্ঘটনার। একটা দূর্ঘটনা, সুস্মিতা যেখানে থেমে গিয়েছিল। গোটা দুনিয়া চলেছে,দৌড়েছে,ছুটেছে। সুস্মিতা নড়তেও পারেনি। চার দেয়ালের একটি কামরার মাঝে স্থির তার জীবন।

বাইরে কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে সুস্মিতা ধীর পায়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখে সেলিনা তিহানকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নতমস্তকে। সুস্মিতা নিষ্প্রাণ চোখে তার শাশুড়িকে দেখে। আগে একটু যা সুস্মিতাকে ফিরে দেখতো, এখন সুস্মিতার দিকে তাকাতেও তার বড্ড ঘেন্না। সুস্মিতার রান্না তিনি খাননা। তার শাশুড়ির ঘৃণা প্রকাশের ধরণ এ পর্যন্তই। কারণ যত যাই হোক, তিনি নাতীর খাতিরে ছেলের সাথে সুস্মিতার ছাড়াছাড়ি করাতে পারবেন না, পারবেন না সমাজে ধিক্কার শোনার ভয়েও।
এ সমাজ এখন বেশ উন্নত যে, ধর্ষিতাদের জন্য এই সমাজে আলাদাই সহানুভূতি। আড়ালে আবডালে হাসাহাসি করে মরছে মরুক। উপরে সবাই বেশ দরদ দেখিয়ে চলে।

হ্যা হাসছে সবাই। সুস্মিতা সবার চোখে উপহাসের হাসি দেখতে পায় তার জন্য। পাড়ার পরিচিত সবজি ওয়ালা থেকে শুরু করে তার স্কুলের পিয়ন চাচা, সবাই যখন সুস্মিতার দিকে তাকায়, ওর মনে হয় তাদের চোখ হাসছে। বাইরে তো তিন মাসেই যায়নি কোথাও ও।
শেষ বেরিয়েছিল স্কুলে রিজাইন লেটার জমা দিতে।

সেলিনা পাশ কাটিয়ে চলে যায় নিজের ঘরে। তিহান মা’কে বলে,“দাদী আজ আমাকে কি করেছে জানো আম্মু?”

_কি করেছে?

_খামচি দিয়েছে হাতে।

_তা কেন?

_জানি না। আন্টিরা জানতে চাইলো তুমি কেমন আছো। আমি বলবো তার আগেই দাদী খামচি মেরে টেনে আনলো।

সুস্মিতার মুখটায় কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেলো না। বরং সে হাঁটু ভেঙে বসলো ছেলের সামনে, নাভিশ্বাস ফেলে বললো,“আন্টিরা সবসময় আমার কথা জিজ্ঞেস করে?”

_হ্যা।

মুখে ম্লান হাসি টেনে সুস্মিতা বলে,“এরপর থেকে জিজ্ঞেস করলে বলবে আম্মু খুব ভালো আছে। সুন্দর করে বলবে। কেমন?”

তিহান মাথা নাড়ায়। সুস্মিতার কল বেজে ওঠে, মায়ের ফোন। কলটা রিসিভ না করে সুস্মিতা ফোনটা চুপচাপ রেখে দেয়। ও বাড়ির কল রিসিভ করা মানেই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হতে হবে সুস্মিতাকে, অসুস্থ হয়ে পরতে হবে। তাদের প্রশ্ন গুলো এমন হবে,সাইফ কেমন আচরণ করছে, সাইফ খারাপ ব্যবহার করছে কিনা, সাইফ ছাড়াছাড়ি করার কথা বলছে কিনা।

এসবের জবাব দিয়ে ইতিমধ্যে হাঁপিয়ে উঠেছে সুস্মিতা। তাদের জানিয়েছে, সাইফ একটু মহাপুরুষ ধাঁচের মানুষ সম্ভবত। এই এতো গুলো দিন হয়ে গিয়েছে হাজী বাড়ির ছেলে সাইফুল ইসলাম সাইফের মান খোয়ানোর, এখন অবধি সুস্মিতার মতন এক অশুদ্ধ প্রাণীকে নিজ ঘরে, কামরায় মানছে। এখন অবধি এসে ঘাড় ধাক্কা দেয়নি।

সুস্মিতা ওসব ভাবতে ভাবতে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসে,ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস।

“সাইফ আপনার কোয়ালিটি চেকার গুলো তিন লট মাল দেখেনি। আপনি এই ব্যাপারে খবর রেখেছেন?”

ডাইং ইনচার্জের কথায় সাইফ অন্যমনস্ক ভাব কাটিয়ে সাড়া দেয়। লোকটা সাইফের মুখভঙ্গি লক্ষ্য করে অবাকের সুরে বলে,“আপনাকে এমন লাগছে কেন ? ইজ এভরিথিং ফাইন? খুব অ্যাবসেন্ড মাইন্ডেড আপনি!”

সাইফ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়াতেই লোকটা অপ্রতিভ গলায় বলে ওঠে,“আপনার মিসেস কেমন আছেন আ…আই মিন….”

এবার সাইফ ঠান্ডা গলায় বলে,“ভালো।”

জবাবটা ঠান্ডা হলেও শ্রুতিকটু ছিলো। সাইফের ভেতরটা চাপা ক্রোধে ফাটছে, বাইরে সেটা অপ্রকাশিত। লোকটাকে এক্সকিউজ মি বলে পাশ কাটিয়ে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে দুহাত মুষ্টিমেয় করে কপাল ঠেকিয়ে বসে থাকে চুপচাপ। টেবিলের ওপর ঠান্ডা হচ্ছে তার লাঞ্চ, দুই তিনটা মাছি এসে খুব আয়েশ করে খাচ্ছে সুস্মিতার রাঁধা সজনে ডাঁটা দিয়ে কালবাউস মাছের তরকারি আর সাদা ভাত।

আচানক কলটা বেজে উঠে সাইফের ঝিমুনি ভঙ্গ করে। সেলিনার ফোন দেখতে পেয়ে সাইফ রিসিভ করে চুপ থাকে। ওপাশ থেকে সেলিনার থমথমে গলা শোনা যায়,“বীণার ছেলের মুসলমানির দাওয়াতে যাবি তুই?”

_বাড়ি এসে এই ব্যাপারে আলোচনা করি আম্মা? আমি ব্যস্ত!
সাইফ সামান্য বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে। সেলিনা গলার স্বর কিঞ্চিত খাদে নামিয়ে বলে,“না না, বাড়িতে এইসব আলোচনা কিভাবে করবি তুই? শোন, তোর বৌ নিয়া তুই গেলে আমি যাবো না বলে দিলাম। আমি হাঁপিয়ে উঠছি মানুষের কথায়, খোঁচাখুঁচিতে। আমি যাবো না।”

নাভিশ্বাস ছাড়ে সাইফ এইবার, মায়ের কথার পিঠে শান্ত গলায় বলে,“সুস্মিতা কোথাও যাবে না। তুমি যাও আজ রওনা করে,তিহানকে নিয়ে যাও।”

_আর তুই যাবি না?

_নাহ।

কল কেটে চেয়ার ঠেসে চুপচাপ বসে থাকে সাইফ। আর আধাঘণ্টা পরে ছুটি, অথচ তার হাত চলছে না। তার ইচ্ছে করছে সারারাত এখানে বসে কাজগুলো করতে। ভেতর থেকে বাড়িতে যাওয়ার মতো উদ্দীপনা কাজ করে না ইদানিং।

সন্ধ্যার পর থেকে সুস্মিতা বাড়িতে একা। তিহান ওর দাদীর সাথে বেড়াতে গিয়েছে ফুপির বাড়িতে। প্রায় তিন ঘন্টা ধরে একা সুস্মিতার কাছে মনে হচ্ছে তার মতো অসহায় এই দুনিয়ায় আর কেউ নেই। চারিদিক অন্ধকার লাগছে, পরিবেশটাও কেমন ভুতুড়ে।
হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে সুস্মিতা গুটিয়ে থাকে। ইদানিং ধরে তার একটা সমস্যা হয়েছে। একা নির্জনে তার কেমন হ্যালুসিনেশন হয়। এই সমস্যার কথা কাউকে বলেনি সে। সাইফকেও না।
রাত সাড়ে আটটা পেড়িয়ে গেলেও সাইফের কোনো হদিস না পেয়ে সুস্মিতা ফোনটা হাতে তুলে নেয়। তবে কল করে না। ওর হাতের আঙ্গুল থিতিয়ে আসে, ওর গলা জড়িয়ে যায়। সেই কবে তাল কেটেছে ওদের, এখন সুস্মিতা সেধে সেধেও কল করতে পারে না। যদি সাইফের বিরক্ত গলা শুনে ফেলে? তাহলে সবকিছুর পেছনে সুস্মিতার অশুদ্ধ হওয়াকে দায় বানিয়ে সুস্মিতা মরমে মরে যাবে।

কলিং বেল বাজতেই সুস্মিতা হকচকিয়ে উঠে সোজা দাড়িয়ে যায়। চঞ্চল পায়ে ছুটতে ছুটতে গিয়ে দরজা খুলে দেখে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সাইফ। টানা চার ঘন্টা পরে নিজের জগতে একজন মানুষের অস্তিত্ব পেয়ে সুস্মিতা জাপটে ধরে সাইফকে।
সাইফ চমকায়, পর পর ধাতস্থ হয়ে বিরক্ত গলায় বলে, “ঘুমাওনি এখনো।”

সুস্মিতা মাথা তোলে, অবাক চোখে চেয়ে অস্ফুটে বলে,“রাত আটটা বাজে,এখনি কি ঘুমাবো? আমি ঘুমালে দরজা খুলতো কে?”

সাইফ জবাব না দিয়ে হাতের বাজারের ব্যাগটা রান্নাঘরে রেখে হনহন করে শোবার ঘরে ঢোকে। সুস্মিতা ওর পেছন পেছন গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সাইফকেই দেখতে থাকে নির্নিমেষ।
রাতের খাবারটা খায় দু’জন একসাথে বসে। সুস্মিতা টুকটাক সাইফের অফিসের কথা জানতে চায়, সাইফ সহজ তবে নিচু গলায় জবাবও দেয়। নিজে থেকে একটা কথা বলে না, বলার আগ্রহ পায়না।

এরপর যখন শুতে গেলো, সুস্মিতার পাশে শুয়ে সাইফ সিলিংয়ের দিকে দৃষ্টি রেখে চুপচাপ শুয়ে থাকলো। আর সুস্মিতা দেখতে থাকে মানুষটাকে। এতদিন, টানা তিন মাস তিহান ওর মস্তিষ্ক ব্যস্ত রাখতো বলে এ কথা মাথায়ও আসেনি ওর। আজ হুট করে মাথায় আসতেই সুস্মিতা উঠে বসলো। নিমিষেই হাঁসফাঁস করে উঠলো বক্ষপট, আপনা আপনি ওর হাত চলে যায় সেখানে। কম্পমান স্বরে সুস্মিতা ফিসফিসিয়ে বলে,“তুমি আমায় আদর করো না কেন?”

অন্যমনস্ক ভাব কেটে যায় সাইফের। সুস্মিতার অস্বাভাবিক মুখ চোখের ভঙ্গি দেখে সে উঠে বসে। সুস্মিতার কথার জবাবে কিছু বলতে যাবে তার আগে সুস্মিতা আবার বলে,“কেন আসো না তুমি আমার কাছে?”

নিরবে শ্বাস ফেলে সাইফ শীতল স্বরে বলল,“ঘুমাও প্লিজ।”

সুস্মিতা সাইফের “প্লিজ” শোনে না। ক্রমশ ওর মুখ চোখের ভঙ্গি এলোমেলো হয়, শরীর জুড়ে মৃগী রোগীর কাঁপন ওঠে, কন্ঠ জড়ায়,“না বলো কেনো তুমি আমাকে আদর করো না? আমি তো সুস্থ। তোমার চাহিদা জাগে না?”

সাইফ স্থির বসে আছে। সুস্মিতার কেমন পাগল পাগল লাগছে, হাঁটুতে ঘষে এগিয়ে গিয়ে সাইফের ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে সাইফের হাত দু’টো টেনে নিয়ে নিজের গাল চেপে ধরে আকুল হয়ে বলে,“এই দেখো। আমি তোমার সুস্মিতা। সে-ই আগের সুস্মিতাই। আমার গলার স্বর, আমার চোখ, আমার ঠোঁট দেখো। তুমি কেন আমার কাছে আসছো না?”

সাইফ ক্রন্দনরত সুস্মিতার দুই হাত আলতো করে সরিয়ে দিয়ে অবনত গলায় বলে,“থামবে তুমি? একটু ঘুমাতে দাও, তুমিও ঘুমাও!”

সুস্মিতা মুখ তুলে চায়, এক হাতে চোখের নোনাজল মুছে বলে,“তুমি কি ছাড়াছাড়ি চাও?”

_না।
সাইফ তৎক্ষণাৎ জবাব দেয় যান্ত্রিক মানবের মতন,কোনো ভাবাবেগ নেই গলাতে। ওর “না” তে কোনো জোর না পেয়ে সুস্মিতা কেমন দুলে ওঠে। অথচ সুস্মিতা আশা করেছিল সাইফের না টা হবে অন্যরকম। ঠিক সেদিনের মত শক্তিশালী, যখন পরিবারের সামনে সাইফ বলেছিল সুস্মিতাকে ছাড়া সাইফ আর কাউকে বিয়ে করবে না।

সেই একই সাইফ সুস্মিতার সামনে বসে আছে, কিন্তু একই নয়। এই সাইফের “না” বলার ধরণ শুনে সুস্মিতার মরে যেতে মন চাচ্ছে।

বুক ভরে দম ছেড়ে সুস্মিতা দু’হাতে নিজের গাল চেপে জল মোছে, ক্ষীণ আওয়াজে বলে,“তিহানের জন্য ডিভোর্স চাইছো না?”

কোনো কথা আসছে না সাইফের। যেন বোবা হয়েছে। সুস্মিতা অস্পষ্ট হেসে নিজেই আবার বলে,“অথচ আমাদের সম্পর্কের শুরুটা তিহানের জন্য হয়নি। তিহানের জন্য আমাদের সম্পর্ক হয়নি, আমাদের সম্পর্কের জন্য তিহান হয়েছে। আমাদের সম্পর্ক টিকে থাকলে আমাদের জন্য থাকবে, তিহানের জন্য না। বলো তালাক চাও তুমি? তোমার কি গা ঘিন ঘিন করছে সংসার করতে আমার সাথে?”

বুকের ভেতরটা জ্বলছে সুস্মিতার, ও বেশ বুঝতে পারছে ওর সাথে খুব খারাপ কিছু একটা হবে। হয়তো ওর দম পরে যাবে। তবুও নিজেকে শান্ত করতে পারেনা সে।

কিন্তু হঠাৎ,একটা অকল্পনীয় কান্ড ঘটে গেলো ওর সাথে, যার কথা সুস্মিতা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।
সাইফ চুলের মুঠি ধরলো ওর, পর পর তিন চারটা থাপ্পড় মেরে উগড়ে দিলো গত তিন মাসের,প্রতিটা দিনের হতাশা, চেঁচিয়ে উঠলো সুস্মিতার প্রতি জমে থাকা সমস্ত আক্রোশ নিয়ে,“কি দরকার ছিল? কি দরকার ছিল বলো! কেন আমার এমন দিন দেখতে হলো। একটুও দায় কি তোমার নেই সুস্মিতা? আসলেই কি নেই? একটা ছাপোষা গৃহিণী জীবন কাটালে খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো?”

সুস্মিতা, গত তিন মাস আগের ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া আঠাশের ভদ্রমহিলা নতুন করে আর ভাঙে না। শুধু এক জন্মের বিস্ময় নিয়ে দেখতে থাকে সাইফকে, যে কিনা নিজের চুল টানছে উন্মাদের মতন।

সুস্মিতা জমে গিয়েছে,তবে গলা চলছে ওর, শ্বাস ফেলে বলে,“গৃহিনী মহিলাদের সাথে কখনো এসব হয়না বোলছো?”

টকটকে দু’টো লাল চোখ তুলে সাইফ বলে,“হয়তো তোমার সাথে হতো না! হ্যা হতো না।”

সাইফ কি বলছে সাইফ জানে না। সাইফ এটাও জানে না সাইফ সুস্মিতার সাথে কি করছে। সুস্মিতা সেদিন ভেঙেছিল শুধু, তবুও সুস্মিতা কই মাছের প্রাণ বিধায় বেঁচেছিল। আজ সুস্মিতাকে জানে মারার পাঁয়তারা করছে সাইফ নিজের হতাশা ঝাড়তে।

সুস্মিতা সাইফের শেষ কথাটা শুনে হাসে, বলে, “আমি চাকরি কেন করতাম না? পড়াশোনা কেন শেষ করেছিলাম তবে? আমার বাপ মা নেই? তাদের খাওয়াতে হতো না? তাদের ছেলে নেই….”

_তাদের ছেলে নেই সেই দায় আমার ছিল না তাইনা?

সাইফ যা বলছে তা সাইফ বলছে না, সাইফের মধ্যে এক পিশাচ ভর করেছে,সেই পিশাচ বলছে। সুস্মিতা নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দেয় এটা ভেবে। পরপর বলে,“আচ্ছা ওসব কথা বাদ। আসল কথায় আসি। আমার সাথে যেটা হয়েছে সেটা যদি ঐ বাসে না হয়ে এই ঘরে হতো এর দায় কার ওপর চাপাতে তুমি? তোমরা?”

সাইফ জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। পা মাথা তারও জ্বলছে, হাত নিশপিশ করছে। এবার গিয়ে দুম করে গাঁয়ে সমস্ত জোর খাটিয়ে দেয়ালে একটা ঘুষি মেরে দেয়, তবে ওখানেই থামে না সে, লাগাতার ঘুষিতে হাতটাই ভেঙে ফেলতে চায়। একটু চেষ্টা তার, এতে করে হলেও যাতে হতাশা কাটে। রোজ রোজ এক রেইপ ভিক্টিমের স্বামী হয়ে বাঁচার চরম হতাশা।

সুস্মিতা শান্ত দৃষ্টিতে তার সামনে অস্থির মানুষটাকে দেখছে। আট বছরের সংসারে মানুষটা তাকে ভালোবেসেছে, মাঝে সাঝে কথার আঘাতে কাঁদিয়েছে, রাগ দেখিয়েছে, আবার আদর করেছে। তবে কখনো সুস্মিতা সাইফের গলার কাঁটা হয়নি, আজ হলো, সাইফ না পারছে উগড়ে দিতে, না পারছে গিলতে। খুব অসহায় লাগছে সাইফকে। সকল জাগতিক অনুভূতি পাশে সরিয়ে সুস্মিতার এখন শুধু মায়া হচ্ছে সাইফের জন্য।

নাকের কাছটা কেমন ভেজা ঠেকল হঠাৎ, সুস্মিতা হাত ছুঁয়ে দেখলো রক্ত। সাইফের থাপ্পড়ে রক্ত ঝড়ছে। শাড়ির আঁচলে মুছে নিয়ে সুস্মিতা বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। সাইফকে উদ্দেশ্য করে নির্লিপ্ত গলায় বলে,“এসো। থামো। ঘুমাও। প্লিজ।”

সাইফ থামলো হঠাৎ। যে বিধ্বংসী ঝড়টা তুলেছিল আচমকা, আচমকা থামিয়ে দিয়ে সুস্মিতার দিকে তাকাল‌। এতক্ষণে সাইফ হুঁশ ফিরে পেয়ে ছুটে এসে সুস্মিতাকে ধরলো, উদ্বিগ্ন গলায় বললো,“আমার মাথা ঠিক নেই সুস্মিতা। আমার সময় চাই। একটু সময় দাও।”

সুস্মিতা দশ মিনিট আগে মরে গিয়েছে। মৃত সুস্মিতা মলিন হেসে বললো,“অভক্তি কাটাতে সময় চাইছো? আচ্ছা। দিলাম।”

সাইফের দু’হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সুস্মিতা এলোমেলো পায়ে হেঁটে বেলকোনিতে বসে, বেলকোনির দরজা লাগিয়ে দিতে দিতে বলে,“ঘুমাও তুমি। আমি পরে আসবো।”

এরপর দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে, আঁচল ছড়িয়ে মেঝেতে বসে থাকে সুস্মিতা। বাইরের আকাশে ঝকঝকে এক চাঁদ, যেন পৃথিবী জুড়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। সুস্মিতা চুপচাপ ঐ চাঁদ দেখে। টের পেলো বেঁচে থাকতে চাঁদটাকে যতটা ভালো লাগতো,এখন মরে যাওয়ার পরেও খারাপ লাগছে না।

“সমাপ্ত”

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে