#নারী_নারীত্ব_সতী_সতীত্ব_ইত্যাদি_ইত্যাদি
#পর্ব_২
#ইসরাত_ইতি
মস্তিস্ক তখন নিশ্চল সাইফের। ও একটা বিশ্রী ঘোরের মধ্যে আছে, যেটা থেকে বেরুতে পারছে না কোনো মতেই। চোখের সামনে সবকিছু দেখছেও ওলটপালট। দেখছে তিহানকে নিয়ে ও আর সুস্মিতা শুক্রবার বিকেলে ফ্যান্টাসি কিংডম ঘুরতে এসেছে, ওরা আনন্দ করছে। সুস্মিতা সাইফের সাধ্যের মাঝে একটু আধটু আবদার করছে ঠোট ফুলিয়ে। কতটা চমৎকার সেই কাল্পনিক দৃশ্যটা। অথচ সামনের দৃশ্যটা কতখানি নির্মম, ভয়ংকর! সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জংলি ছাপার ইউনিফর্ম পরিহিত লোক গুলোকে সাইফের তার চেয়ে বেশি নির্মম মনে হচ্ছে যারা অকপটে বলাবলি করছে তার বৌয়ের ব্যাপারে। সাইফের একবার ইচ্ছা করলো ঐ লোক গুলোর মুখ বরাবর লাথি মারতে। ওদেরকে থামিয়ে দিতে।
“রিকভার হতে সময় লাগবে। আপাতত এতো খোঁচাখুঁচি করবেন না। একটু সময় দিন। এই ওষুধ গুলো আনুন।”
সুস্মিতার কথা জানতে গেলে ডাক্তারের ধমক খেয়ে গুটিয়ে যায় সাইফ। হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেদিকে তার ভাবলেশহীন দৃষ্টি মেলে।
পাশ থেকে দু’জন নার্স হেঁটে যাচ্ছিল বলতে বলতে,“আরে ভয়াবহ ব্যাপার। কামড়ে কামড়ে কি অবস্থা করেছে। এবড়োথেবড়ো ভ্যাজাইনা। কি জানোয়ার। গলায় ফাঁসের দাগ আছে। সব কয়টা কম বয়সী ছেলে, একজন বাসের হেল্পার, একজন কন্ডাক্টর আর ড্রাইভার। ঝোঁকের মাথায় করে ফেলেছে তো, পরিণতি কি হতে পারে ভাবেনি। সাভার ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ায় আজ আর্মির টহল ছিল। ধরা খেয়ে গিয়েছে।”
“এবড়ো থেবড়ো ভ্যাজাইনা ”। সাইফ শব্দটা শোনা মাত্রই নার্সটির মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। কিছুক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে থেকে সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সংযুক্ত বাথরুমে গিয়ে হরহর করে বমি করে। হঠাৎ খেয়াল এলো,আজ গোটা দিন শিপমেন্টের ঝামেলায় কিছু খাওয়া হয়নি তার।
আর্মির এক লোক গিয়ে সাইফকে ততক্ষণে শক্ত হাতে ধরে। কিছুটা সময় দেয় ওকে নিজেকে সামলাতে। তারপর এক বোতল পানি এগিয়ে দিয়ে বলে,“আপনি বসবেন? বসুন।”
সাইফ বসে না। বমি করে হাপাচ্ছে, চোখ দু’টো এক নিমিষেই টকটকে লাল হলো। ঘুর্ণায়মান চোখের দৃষ্টি তখন আশপাশটা দেখছে, দেখছে কিছু কৌতুহলী ভাবাবেগ শূন্য দৃষ্টি তাকে খুব কৌতুহল নিয়ে দেখছে একজন রেইপ কেসের ভিকটিমের হাজবেন্ড হিসেবে। ওরা কি করুণার চোখে চাইছে?
ওপাশে পুলিশের লোক এসেছে, সাভার থানা থেকে। তারা কথা বলছে আর্মির লোকগুলোর সাথে। মাঝখানে সাইফ দাঁড়িয়ে আছে কাঠ পুতুলের মতন, একজন রেইপ কেসের ভিকটিমের হাসবেন্ডের মতন।
ধর্ষক তিনজনকে হাতেনাতেই ধরা হয়েছে। তারা পুলিশি হেফাজতে। সাইফ এখানে দলবল নিয়ে এদের আসার দরুণ প্রচন্ড বিরক্ত। ওর মন চাইলো পুলিশের লোকগুলোর মুখেও তিন চারটা লাথি মারতে।
“আপনি ঠিক আছেন?”
সাইফ দুলছে, এক কনস্টেবলের নজরে পরতেই সাইফ চোখমুখ কঠিন করে মাথা নাড়ায়। ওকে দেখাচ্ছে একটা শক্ত প্রস্তরখণ্ডের ন্যায়। গলার স্বরও তেমন। ওর সামনের পুরুষগুলোকে চমকে দিয়ে বলে ওঠে,“এসব আপনারা জানাজানি করবেন?”
লোকগুলো ভীষণ অবাক। একজন বললো,“বিষয়টা লুকিয়ে কি করবেন? কালপ্রিটদের শাস্তি পেতে হবে না?”
_না,ঐ বাইরের প্রেস বা জার্নালিস্ট…..
বেশি কিছু বলতে হয়নি, এক আর্মির লোক বলে ওঠে,“আমরা প্রেসের সামনে ইন্টারভিউ দিলে ভিকটিমের নাম পরিচয় উল্লেখ করি না। দুশ্চিন্তা করবেন না। ওনার জ্ঞান ফিরলে, একটু সুস্থ হলে ওনার একটা বয়ান নিতে আসবে সাভার থানা থেকে। আপনাদের ঝামেলা এ পর্যন্ত, আইনের ওপর ভরসা রাখুন।”
সাইফ আইনের ওপর ভরসা রাখবে কি না বোঝা গেলো না। আপাতত এই লোকগুলোর সামনে থেকে তার গিয়ে কোথাও লুকাতে ইচ্ছে করছে।
কোথাও,কোনো নির্জন জায়গায়।
“একি আপনি মেডিসিন গুলো আনলেন না? ইনজেকশন গুলো পুশ করতে হবে পেশেন্টকে, জলদি করুন।”
সুস্মিতার কেবিন থেকে একজন সিনিয়র নার্স মাথা বের করে গলা উঁচিয়ে বলতেই সাইফ নড়েচড়ে ওঠে। আরো একবার ফ্যাকাশে মুখে হাতের কাগজটা দেখে ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে যায় করিডোর ধরে।
⚫
ইনজেকশন দু’টো এনে নার্সের হাতে দিতেই ফোনটা বেজে ওঠে সাইফের। বড় বোন রিনার নাম্বার থেকে কল এসেছে । ওপাশে তিহানের কান্না মিশ্রিত গলার স্বর শুনে ছ্যাত করে ওঠে বুকটা।
“আব্বু আম্মু কই? দাদী আমাকে ফুপির বাসায় রেখে কোথায় গিয়েছে? তোমরা আসছো না কেন?”
ছেলের কথায় সাইফ জবাব দিতে পারে না। তার দৃষ্টি জরুরি বিভাগের সাত নাম্বার মহিলা কেবিনের দরজায় নিবদ্ধ। একজন নার্স হঠাৎ বলছে,“পেশেন্ট সেন্সে এখন। ফারজানা এর বাড়ির লোক কোথায়? ফারজানা?”
ফারজানা নামের নার্সটি নিজের ডেস্ক থেকে উঠে আশেপাশে তাকায়। সাইফকে চোখে পরতেই বলে ওঠে,“আপনি যান। আপনার ওয়াইফ সেন্সে আছে। বেশি কথা বলবেন না।”
সাইফ নার্সের দিকেও তাকিয়ে আছে ফ্যালফ্যাল করে। তার নিজের বর্তমান অনুভূতি নিয়ে সে দ্বিধান্বিত। তার এখন আশপাশের পরিবেশটা কেমন অদ্ভুত লাগছে। সে যাবে ভেতরে? গিয়ে দাঁড়াবে সুস্মিতার সামনে? কি বলবে?
ভেবে পাচ্ছে না সাইফ। নার্স দু’জন প্রথম থেকেই সাইফের ওপর বিরক্ত বেশ। লোকটাকে তাদের আচরণে বোকা টাইপ মনে হচ্ছে। যেন কিছু জানে না, বোঝেনা, যেন নড়চড় নেই।
“কি হলো যান? ম্যাডাম একটু পর রাউন্ডে আসবে। দেখা করে আসেন তার আগে।”
বেডে সোজা করে শুইয়ে রাখা হয়েছে সুস্মিতাকে। পা থেকে গলা অবধি সাদা চাদরে আবৃত। ডান হাতটা,যেটাতে স্যালাইন চলছে সেটা তুলে রাখা হয়েছে সুস্মিতার পেটের ওপর।
কেবিনের দরজা ভেজিয়েই সাইফ ঘুরে তাকিয়ে সুস্মিতার পা মাথা দেখলো। কপালে গজ কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ করেছে। তবে গালে খামছির দাগ স্পষ্ট।
সাইফ এগিয়ে যায় ধীর পায়ে। তারপর যখন সুস্মিতার পিটপিট করে তাকানো দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিললো, সাইফ স্থির হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল ঠাঁয়।
সুস্মিতার চোখ জোড়া ছিল টকটকে লাল। যেন ওর চোখ থেকেও রক্ত নামছে শরীর অশুদ্ধির। সুস্মিতা পাথুরে চোখে তাকিয়ে আছে সাইফের দিকে। না কথা বলার মতো অবস্থা আছে,না নড়াচড়া করার মতো অবস্থা। আপাতত মনে হয়না কোমরের নিচ থেকে কোনো জোর পাবে ও।
দু’চোখে সুস্মিতার পানি নেই। সাইফকে দেখেও ও ভাঙে না কোনো অদ্ভুত কারণে। কেন জানি আর পাঁচটা মেয়ের মতো চিল্লিয়ে কাঁদতে পারছে না। ওর মস্তিষ্ক ওকে আপাতত বলছে,“সুস্মিতা তোর গলায় ফাঁস পরতে গিয়েও পরেনি। তুই বেঁচে আছিস। একটু ধৈর্য্য রাখ। একটু ব্যাথা টা গা সয়ে যাক। তারপর কাদিস।”
সুস্মিতার ভেতর থেকে কোনো এক সুস্মিতা বুঝি তাকে সান্ত্বনা দেয়। পর পর হাতের আঙুল নাড়িয়ে সাইফকে কিছু বলতে চায় সে।
সাইফ এগিয়ে গিয়ে বুঝতে চাইলো সুস্মিতাকে। অদ্ভুত ভঙ্গিতে বললো,“তিহানের কথা জানতে চাইছো? তিহান আছে। ওর বড় ফুপির কাছে। খেয়েছে।”
এই এতটুকুই সাইফ বলতে পারে। এরপর স্তম্ভিত হয়ে যায় তার সামনে শুয়ে থাকা সুস্মিতার হঠাৎ বাঁধভাঙা কান্নায়। এতক্ষণের সুস্মিতা ব্যর্থ নিজেকে ধরে রাখতে। শরীরি ব্যাথা, মানসিক যন্ত্রণা তার চোখের উষ্ণ জল হয়ে গড়িয়ে নামে। বুকটা হাঁপরের মতন ওঠানামা করে।
বাতাসের ঝাপটায় একটা তাসের ঘর যেমন হুরমুরিয়ে পরে যায়। আজ সুস্মিতার নারী সত্তাটা ঠিক ওভাবেই গড়িয়ে পরেছে। শুধু গড়িয়ে পরেনি, সুস্মিতার নারী সত্তাকে পিষে দেওয়া হয়েছে। এমন ভাবে চুরমার হয়েছে ও, আর গড়বে না সুস্মিতাখণ্ড গুলি।
আর এরপর? এরপর কি হবে?
⚫
সেলিনা বেগম সাইফের ছোটো বোন বীণাকে নিয়ে এসেছে। ভেতরে ঢুকতেই মাথায় হাত চেপে আহাজারি শুরু হলো ভদ্রমহিলার। সাইফ তখন কেবিন থেকে বেরিয়ে বাইরে, একপাশে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বীণা ছুটে এসে ভাইকে ধরে । গিয়ে একবার উঁকি দেয় ভেতরের কেবিনে। সুস্মিতাকে চোখ বুঁজে শুয়ে থাকতে দেখে বীণা পিছিয়ে এসে ভাইকে বলে,“এগুলা কিভাবে হইছে?”
সাইফ নির্লিপ্ত,মরা মানুষের মতো দাঁড়িয়ে, অস্ফুটে বললো,“এগুলো কিভাবে হয়েছে তা দিয়ে কি করবি? এগুলো হয়েছে, এটাই তো! তাইনা?”
সেলিনা এবার মেঝেতে ধপ করে বসে পরে আহাজারি শুরু করে দেয়,“কোনো দরকার আছিলো? কোনো দরকার আছিলো চাকরি করতে যাওয়ার? ”
_আম্মা চুপ করো। এখন এসব ভাল্লাগছে না।
সাইফের নিষ্প্রাণ ধমকে থামলো না সেলিনা। কাঁদছে সে, বরং আগের থেকেও উচু গলায় আহাজারি করছে,“মানুষরে মুখ দেখানোর পথ আর থাকলো না রে। আর তিহান? তিহানের কি হবে? ও কি শুনে শুনে বড় হবে? হায় হায়, আল্লাহ কি পাপের শাস্তি দিতেছে এইগুলো!”
সেলিনা থামবে না এখন। সাইফ সেলিনাকে না থামিয়ে ঢুকে পরে সুস্মিতার কেবিনে। সুস্মিতা ততক্ষণে চোখ মেলেছে, শাশুড়ির কথাগুলো দিব্যি শুনেছে সে।
এতক্ষণ সুস্মিতা শুধু নিজেকে নিয়ে ভেবেছিল। তার শাশুড়ি এসে মনে করিয়ে দিলো আসল কথাটা,তাইতো! মানুষ জনের কাছে কিভাবে মুখ দেখাবে তার শাশুড়ি?
ধর্ষিতা হওয়া মারাত্মক একটি অপরাধ। কিন্তু সুস্মিতা সেধে সেধে এই অপরাধে জরায়নি তো! সে কি করে বুঝতো অত ছোটো ছোটো ছেলেগুলো তাকে নারী হিসেবে সম্মানের চোখে না দেখে একদলা মাংসপিণ্ড ভাববে শুধু!
তবে কি সত্যিই সুস্মিতার বাইরে বেরোনো উচিত হয়নি? কোনো না কোনো ভাবে হলেও দোষটা সুস্মিতারই?
ওর নাজুক মস্তিষ্ক এসব ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয়। সাইফ এসে ওর হাতের স্যালাইনের সুইটা ঠিক করে দেয়। ঠিক তখন সুস্মিতা সাইফের মুখ দেখলো। এই সাইফ,তাকে বিয়ে করে বিয়ের প্রথম রাতে যখন বুঝেছিল সুস্মিতা অনাঘ্র। সুস্মিতাকে কত আদর মাখিয়ে দিয়েছিল গর্বে। ওকে কত আহ্লাদে বলেছিল,“আমার সুস্মি। সুস্মি সোনা আমার। আমি তোমাকে নিয়ে গর্ব করি।”
সুস্মিতা লজ্জায় মিইয়ে গিয়েছিল সাইফের পাগলামি দেখে। ঐ পাগলামি কোনো নারীর প্রথম পুরুষ হবার গর্বের পাগলামি।
সুস্মিতা চাক্ষুষ দেখেছিলো নারী সতীত্ব নিয়ে তার বৈধ পুরুষের আবেগ। সাইফ শুদ্ধ পুরুষ ছিলো, এই জমানায় সুস্মিতার মতো একজন শুদ্ধ নারীকে পেয়ে তাই ভীষণ আবেগী হয়েছিল।
আর আজ,সাইফের আবেগ চুরমার হলো। সুস্মিতা অশুদ্ধ হলো। সাইফ বলবে না,“আমি মুখ দেখাবো কি করে?”
কখন বলবে?
চলমান……
[ আগামী পর্বে গল্পটি শেষ হবে! ]