নাজমা জামানের বয়স আটত্রিশ বছর। পড়াশোনায় খুবই ভাল ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট থেকে মাস্টার্স শেষ করার পরপরই বিয়ে হয়ে গেল। বেশ কয়েকটা ভাল কোম্পানিতে চাকুরির অফার থাকলেও কোনটাতেই জয়েন করা হলো না। তার স্বামী সদরুল চৌধুরী বেশ বড় কোম্পানীতে চাকরি করেন। দুই বাচ্চা রেহান এবং রিয়ার বয়স এখন ১০ আর ৪। সদরুল খুবই ভাল মানুষ, কখনোই স্ত্রীকে কোন ধরনের যন্ত্রণা দেন নি, অসন্মান করেননি। নাজমাও স্বামী এবং সন্তানদের চাহিদা, আব্দার পূরন করে সাংঘাতিক রকম খুশি।
কিন্ত সবকিছুই এলোমেলো হয়ে গেল যখন সদরুল সাহেব হঠাৎ হার্ট-এটাক করে মারা গেলেন। সপ্তাহখানেক পর আত্মীয়-স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশীদের ভীড় কমতেই নাজমার মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন ভীড় করল
এটা কি কোন দুঃস্বপ্ন নাকি বাস্তব?
আমি সংসার চালাব কিভাবে?
বাচ্চাদের পড়াশোনার কি হবে?
সামনের দিনে টাকা পয়সার প্রয়োজন কিভাবে মিটবে?
আমার স্বামী কি রেখে গেছে আমাদের জন্য?
স্বামীর ব্যাংক-ব্যালান্স, সম্পত্তি সম্পর্কে কোন ধারনাই তার ছিল না আর তার প্রশ্নগুলোর উত্তরও তাকেই বের করতে হবে। নাজমা মনকে শক্ত করলেন, সংসার আর বাচ্চাদের হাল ধরতে হবে। প্রথমেই চিন্তা করলেন সদরুল সাহেবের অফিসে দেখা করবেন, যেখানে তিনি ১৬ বছর কাজ করেছেন। স্বামীর মৃত্যুর ঠিক দশ দিন পর তিনি আসলেন তার অফিসে, এসেই তিনি দেখা করলেন আমার সাথে।
আমি সদরুল সাহেব যে কোম্পানিতে চাকরি করতেন সেই অফিসের এইচ আর হেড। পরিচয় পর্বের পর নাজমাই শুরু করলেন
– আমি আসলে একটা কাজে এসেছিলাম।
– আমি বুঝতে পারছি। সদরুল সাহেব অফিস থেকে কি পাবেন সেটা তো?
– জ্বী। আমি আসলে বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই চিন্তিত। কি পরিমাণ টাকা পয়সা পাওয়া যাবে সেটার উপর আমার অনেক ডিসিশন নিতে হবে।
– দেখুন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুয়িটি, লাইফ ইন্স্যুরেন্স আর অন্যান্য সুবিধা নিয়ে আপনি এককালিন একটা ভাল এমাউন্ট পাবেন কিন্ত সেটা দিয়ে কয়দিন চলবেন আপনি?
– সেই চিন্তা তো আমারও!
– আপনিতো পড়াশোনায় ভাল ছিলেন বললেন, কোন চাকুরি করলেন না কেন?
– প্রয়োজন মনে হয়নি, ভালই তো ছিলাম দশদিন আগেও!
হিসাব করে দেখলাম প্রায় ত্রিশ লাখ টাকা পাবেন তিনি। সবকিছু প্রসেসিং হতে মাসখানেক সময় লাগবে। আমি বললাম কোথাও ইনভেস্ট করতে। শুনেই ভড়কে গেলেন। মেয়েরা ব্যবসা করতে পারে না বলেই তার ধারনা। তিনি ব্যাংকে টাকা রাখবেন বলে আগেই ডিশিসন নিয়ে রেখেছেন। নাজমা চলে গেলেন।
এরকম কত নাজমা আছেন আমাদের দেশে, আমি ভাবছিলাম। নাজমারা সুখি বর্তমান পেয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে দুঃস্বপ্ন মনে করে এড়িয়ে চলেন, শিক্ষাকে কাজে লাগান না, সুযোগকে অবহেলা করেন। নির্ভরতার জন্য কাউকে পেয়ে গেলে আশা করেন, ” জিন্দিগিকি সাথ ভি, জিন্দেগীকি বাদ ভি”। কিন্ত জীবন খাতার সবগুলো পৃষ্ঠাই তো শূন্য। শূন্য পাতাগুলোতে কি কি লিখা হতে পারে সেটার চিন্তাটা কার করা উচিৎ?