নভেম্বরের শহরে পর্ব-১৪

0
888

#নভেম্বরের_শহরে
লেখক – এ রহমান
পর্ব ১৪

ঘন কুয়াশায় শহর আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। গায়ে চাদর জড়িয়ে বাড়ি থেকে বের হলো নুহা। সামিন গাড়িতে বসে আছে। তাকে নিতে এসেছে। সামিন দের বাড়িতে যাবে সে। রেহানা তাকে ডেকেছে। নুহা গাড়ির সামনে দাঁড়ালে সামিন গাড়ি থেকে নেমে এলো। দরজা খুলে দিলো। নুহা গাড়িতে উঠে বসলো। সামিন ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে নুহার দিকে একবার তাকাল সামিন। সে মাথা নিচু করে বসে আছে। বিদেশ যাওয়ার আগে ঠিক এরকম এক নভেম্বরে নুহাকে দেখেছিল সে। তারই এক বন্ধুর বোনের বান্ধবী ছিলো। সেই বন্ধুর বোনের সাথে দেখা করতে গিয়েই নুহার সাথে দেখা। সে অবশ্য তখন সামিন কে চিনত না। আর দুজনেই তখন ছোট ছিলো। তাই আর এসব নিয়ে কারো সাথে কথা বলেনি। কিছুদিন পরেই নিজের পড়ালেখা শেষ করতে সামিন বিদেশে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়েও সে নুহাকে মাথা থেকে বের করে দিতে পারেনি। মনের মাঝে এক বিশাল জায়গা করে নিয়েছিল তার। সে সেখানে বসেই নুহার খোঁজ খবর রাখতো। পড়ালেখা শেষ হওয়ার সাথে সাথে তাদের ম্যানেজার আফতাব হোসেন কে মায়ের মাথায় নুহার বিষয়টা ঢুকিয়ে দিতে বলে। আর আফাতব হোসেন রেহানা কে নুহার কথা বলে। তারপর তিনি রাস্তায় নুহাকে দেখেন। আর তার ভালো লেগে যায়। তাই আর দেরি না করেই বিয়ের প্রস্তাব দেয়। বিয়ের প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলে রেহানা সামিন কে জানায়। আর সামিন মেয়ে না দেখেই মায়ের কথায় রাজি হয়ে যায়। প্রথমে রেহানা একটু আশ্চর্য হলেও পরে ভাবে ছেলে হয়তো তাকে বিশ্বাস করে রাজি হয়েছে। কিন্তু ভুল ভেংগে যায় বিয়ের দিন। কোন এক কারনে সামিনের ঘরে যায় সে। সেখানে তখন কেউ ছিলো না। টেবিলে পড়ে থাকা সবুজ রঙের ডাইরির উপরে চোখ পড়ে তার। ডাইরির পাতা খুলে লেখা গুলো পড়েই রেহানা সবটা বুঝতে পারে। সেই মুহূর্তে তিনি ছেলেকে কিছু না বললেও পরে এই নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। কারণ এতো বড় একটা ঘটনা ছেলে তার কাছ থেকে লুকিয়ে অন্যায় করেছে। তিনি খুব কষ্ট পেয়েছেন। এই জন্য অবশ্য সামিন মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। রেহানা আবার ছেলেকে খুব ভালোবাসে। যার কারণে রাগ করে থাকতে পারেনি। আজ নুহাকে তাদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার বিশেষ কারণ আছে। আসিফের অফিস থেকে কিছু লোক সামিন এর বউকে দেখতে আসবে। তাই নুহা কে তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নুহা মাথা তুলে এদিক সেদিক তাকাল। মৃদু কন্ঠে বলল
— আমরা কোথায় যাচ্ছি? এটা তো বাড়ির রাস্তা না।

সামিন মৃদু হাসলো। বললো
— ভয় নেই তোমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছি না।

সামিনের কথা শুনে নুহা তার দিকে তাকাল। মৃদু সরে বলল
— আমি তো তা বলিনি। শুধু জিজ্ঞেস করেছি আমরা কোথায় যাচ্ছি।

— আমিও তো সোজা কথা বলেছি। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। হাসবেন্ড আমি তোমার। আমার উপরে বিশ্বাস রাখতে তুমি বাধ্য।

নুহা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো। সামিন এর কথার ধরন কেমন অদ্ভুত। আর এই তুমি সম্বোধন। সব মিলে কেমন দমবন্ধ কর পরিস্থিতি। সামিন একটু হেসে বলল
— মা তোমার জন্য মার্কেটে অপেক্ষা করছে। তোমাকে সোজা সেখানেই নিতে বলেছে।

নুহা ছোট্ট করে ‘ওহ ‘ বলল। শপিং কমপ্লেক্স এর সামনে এসে গাড়ি থামলো। সামিন নেমে নুহা কে দরজা খুলে দিলো। দুজন মিলে ভেতরে গেলো। রেহানা খুব মনোযোগ দিয়ে একটা শাড়ি দেখছে। সামিন আর নুহা পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো।
— মা।

সামিন এর গলার আওয়াজ পেয়ে রেহানা ফিরে তাকাল। দুজনকে একসাথে দেখে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। নুহা সালাম দিতেই রেহানা হাসি মুখে তাকে জড়িয়ে ধরলো। হাতে ধরে রাখা শাড়িটা তার ঘাড়ে ফেলে ভালো করে দেখতে লাগলো। বেগুনি রঙের শাড়ি। বেশ দামী মনে হচ্ছে। নুহা কে মানীয়েছেও ভালো। রেহানার বেশ ভালো লাগলো। সেটাই নুহার জন্য কিনে ফেললো। তার সাথে ম্যাচিং করে আরো কিছু গয়না কিনলো। সব কেনা শেষে তারা বাড়িতে চলে এলো। সন্ধ্যার পর বাইরের সবাই আসবে। তাই রেহানা খুব তাড়াতাড়ি নুহা কে রেডি হতে বলল। কিন্তু নুহা তো শাড়ি পরতে পারেনা। তাই একটু ইতস্তত বোধ করতে লাগলো। শাড়ি ঘরে নিয়ে ঢুকে বসে থাকলো। কোনদিক থেকে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। রেহানা হয়তো বুঝতে পেরেছিল। তাই একজন বয়স্ক মহিলাকে নুহার সাথে পাঠিয়ে দিলো। তিনি খুব যত্ন করে নুহা কে রেডি করে দিলো। ঘর থেকে বেরিয়ে এলো নুহা। সামিন বাইরে বসে ছিলো। নুহা কে দেখে তার দিকে এগিয়ে গেলো। বেগুনি রঙের আচল টা ঘাড় বেয়ে নিচে পড়ছে। চুল গুলো গুছিয়ে খোঁপা করা। নানা রকম গয়না গায়ে জড়ানো। সামিন নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নুহা আচল ঘুরিয়ে মাথায় তুলে দিলো। সৌন্দর্য যেনো কয়েক গুণ আরো বেড়ে গেলো। সামিন গম্ভীর সরে বলল
— শাড়ি পরলে কিন্তু তোমাকে বেশ লাগে। রূপকথার গল্পের মায়াবতীর মতো।

নুহা লজ্জায় মিইয়ে গেল। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো।
রেহানা কাজে ব্যস্ত। মেহমানরা কি খাবে সেসব নিয়েই ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। নুহা সামিন কে পাশ কাটিয়ে রান্না ঘরের দিকে গেলো রেহানার কাছে। রেহানা তাকে দেখে খুব খুশি হলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল
— তোমার এখানে কোন কাজ নেই। তুমি ঘরে যাও।

বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল
— সামিন ওকে পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখাও।

সামিন নুহা কে নিয়ে গেলো ছাদে। ছাদটা অনেক সুন্দর। কিন্তু নুহা শুনেছে ভর সন্ধ্যা বেলা ছাদে উঠতে নেই। তাই মিনমিনে সরে বলল
— এই সময় ছাদে? সন্ধ্যা পার হয়ে যাচ্ছে।

সামিন ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বলল
— সময় ক্ষন দেখে ছাদে উঠে বুঝি? আমার জানা নেই তো।

— ভর সন্ধ্যা বেলা মেয়েদের ছাদে উঠতে নেই। বিপদ হয়।

নুহার কথা শুনে সামিন হাসলো। বলল
— এসব কোন কথা না। সন্ধ্যা বেলা ছাদে উঠলে কিছুই হয়না। মেয়ে ছেলে সবাই উঠতে পারে। আর তোমার বিপদ দূর করতে আমি আছি তো। এতো ভয় পাবে না।

নুহা একটু অপ্রস্তুত হয়ে দাড়িয়ে গেলো। সামিন তার দাড়ানো দেখে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। নুহা অসস্তিতে পড়ে গেলো। সামিন তার অসস্তি বুঝতে পেরে বলল
— আমি তোমার কে হই সেটা কি আবারও মনে করিয়ে দিতে হবে? শুধু হাত ধরেছি তাতেই এত অসস্তি। অদ্ভুত তুমি।

নুহা উপরে তাকিয়ে বলল
— উপরে বেশ ঠাণ্ডা। আপনার ঠাণ্ডা লাগছে না?

সামিন একটু দুষ্টুমি করে বলল
— তুমি আশে পাশে থাকলে আমি তো সব অনুভূতি হারিয়ে ফেলি। ঠাণ্ডা গরম এসব বোঝার সাধ্য কি আমার থাকে?

নুহা উল্টা দিকে ঘুরে দাড়ালো। ঠোঁট চেপে হাসলো। সামিন নুহার অবস্থা বুঝতে পেরে শব্দ করে হেসে ফেললো। নুহা আরো লজ্জা পেলো। খানিকবাদে নীচ থেকে ডাক এলো। মেহমান চলে এসেছে। দুজনে নিচে গেলো। দরজা দিয়ে ঢুকতেই এক মহিলার মুখোমুখি হলো। সামিন সালাম দিয়ে এগিয়ে গেলো। নুহা অকূল পাথারে পড়ে গেলো। সব অপরিচিত লোক। কাউকে চিনে না। কি কথা বলবে কার সাথে। ধির পায়ে সামিন এর পিছনে পিছনে ভিতরে ঢুকলো। সেই মহিলা তার সামনে দাড়ালো। ভদ্রতা বজায় রাখতেই নুহা সালাম দিলো মহিলাকে। সালাম নিয়েই মহিলা পা থেকে মাথা পর্যন্ত নুহা কে দেখছে। নুহার বেশ অসস্তি হচ্ছে। এভাবে দেখার কি আছে। রেহানা এগিয়ে নুহার কাছে গেলো। নুহা কে এনে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। কিছু কথা বলে ভেতরে যেতে বলল। নূহাও সুযোগ বুঝে চলে গেলো ভেতরে। হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেনো। সামিন নুহা কে জোরে জোরে শ্বাস টানতে দেখে বলল
— কি হয়েছে? তোমার কি খারাপ লাগছে? এমন করছো কেনো?

নুহা একটা লম্বা শ্বাস টেনে বলল
— না। খারাপ লাগছে না। ওনারা আমাকে কেমন করে দেখছেন। যেনো আগে কখনো মেয়ে দেখেনি। এভাবে কাউকে দেখে?

নুহার কথা শুনে সামিন হেসে ফেললো। নুহা ভ্রু কুচকে বলল
— হাসার মতো কোন কথা আমি বলিনি। আপনি কেনো হাসছেন?

— ওনারা তোমাকে দেখতেই এসেছে। তাই অভাবে দেখছে।

বলেই আবার হাসতে শুরু করলো। নুহা এবার খুব বিরক্ত হলো। সামিন বুঝতে পেরে বলল
— আচ্ছা সরি আর হাসবো না।

নুহা ঠোঁট চেপে হাসলো। বলল
— আপনি কি সবাইকে এভাবে সরি বলেন?

সামিন ভ্রু কুঁচকে বলল
— কেনো জানতে চাইছো? নিজেকে বিশেষ অনুভব করাতে চাও?

নুহা মিনমিনে কণ্ঠে বলল
— আপনি শুধু উল্টা পাল্টা কথা বলেন।

—————–
মেহমান চলে গেলো বেশ রাতে। খাওয়া দাওয়া শেষ করতেই অনেক সময় পার হয়ে গেলো। সবাই চলে যেতেই নুহা নিজের কাপড় বদলে যেগুলা পরে ছিলো সেগুলা পরে নিলো। বাড়ির সবার খাওয়া পালা এবার। একসাথে খেতে বসলো সবাই। আসিফ নুহা কে দেখে বেশ খুশি হলো। নুহার ভদ্রতা তার মন কেড়ে নিলো। প্রথমবার এসেও সে টেবিলে দাড়িয়ে আছে সবার খাওয়া তদারকি করছে। আসিফ নুহার দিকে তাকিয়ে বলল
— অনেক সার্ভেন্ট আছে বাড়িতে। তুমি বসে পড়ো।

নুহা মাথা নাড়িয়ে বাধ্য মেয়ের মতো বসে পড়লো। খাবার শেষ করে নুহা বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। মায়ের শরীর টা বেশি ভালো না তাই সে থাকবে না। আর সালেহার শরীরের কথা ভেবেই কেউ আর জোর করলো না। সামিন নুহা কে একটু অপেক্ষা করতে বলল। একটু কাজ সেরেই সে বের হবে তাকে নিয়ে। নুহা সোফায় বসে আছে। সামনে টিভি চলছে। কিন্তু তার শরীর টা কেমন যেনো ঝিমঝিম করছে। রাতে ঠিক মত ঘুম না হওয়ার কারণে মাথাটাও ঘুরে যায় মাঝে মাঝে। গলা শুকিয়ে এলো তার। উঠে ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে দাড়ালো। পানি খাওয়ার জন্য গ্লাস হাতে নিতেই মাথা ঘুরে গেল। হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে টুকরো গুলো মেঝেতে বিছিয়ে গেলো। নুহা মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারের হাতলটা ধরতে গেলে ধরতে পারলো না। ক্লান্ত শরীরটা নিচে লুটিয়ে পড়লো। মাথাটা গিয়ে লাগলো চেয়ারে।

চলবে……….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে