নভেম্বরের শহরে পর্ব-১২

0
883

#নভেম্বরের_শহরে
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১২

রেহানা ছেলের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালেন। তার চাহুনি স্পষ্টই বলে দিচ্ছে সামিনের কথা তার পছন্দ হয়নি। সামিন আবারো বলল
–আমরা চাইলেই তো দিতে পারি তাই না?

রেহানা কোন উত্তর দিলো না। কিন্তু নুহা নত দৃষ্টিতে তীব্র প্রতিবাদী সরে বলল
–কিছু মনে করবেন না। এই বিষয়ে আমার আপত্তি আছে। আমি চাইনা আপনারা আমাদেরকে এই বিষয়ে সাহায্য করেন।

মা ছেলে দুজনেই তার দিকে তাকাল। সামিন একটু আশ্চর্য হলেও রেহানা মোটেই আশ্চর্য হল না। যেন সে জানতো নুহা এমন কিছুই বলবে। সামিন তীক্ষ্ণ চোখে নুহার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল
–আপত্তির কারণটা জানতে পারি?

নুহা নত দৃষ্টিতেই কণ্ঠে কাঠিন্য ভাব রেখে বলল
–আপনারা এমনিতেই আমাদের বিপদে সব সময় এগিয়ে এসেছেন। সময়ে অসময়ে না চাইতেও আপনাদের সাহায্য পেয়েছি। প্রয়জনে বিরক্তউ করেছি। এই ঋণ শোধ করার মতো ক্ষমতাই আমাদের নাই। দয়া করে আরও উপকার আমরা করে আমাদেরকে আর ঋণী করবেন না।

সামিন রেহানা কেউ কোন কথা বলল না। চুপচাপ নুহার দিকে তাকিয়ে থাকলো। নুহা নিচের দিকে তাকিয়ে দুই ফোটা চোখের পানি ফেলে বলল
–এখন হয়তো আমাদের কাছে এতো টাকা নেই। কিন্তু এক সময় ঠিকই টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তখন আমরা ঠিক সব শোধ করে দিবো। মানুষের বিপদ তো আর সব সময় থাকেনা। একদিন না একদিন এসবের সমাধান হবেই। ঠিক একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

নুহার কথা শেষ হতেই সামিন বলল
–ব্যবস্থা হওয়ার আগেই যদি এই বাড়ি নিলামে তোলা হয়। তখন কি করবেন?

নুহা একটু ভয় পেয়ে গেলো। তার কাছে এই কথার কোন উত্তর নেই। মুখের জোরে বলে তো দিলো একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু এতটা সহজ নয়ত। অল্প টাকা হলে হয়তো কিছু একটা ব্যবস্থা করতো। কিন্তু ১০ লাখ টাকা। জীবনে চোখেও দেখেনি সে। সামিন নুহাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে বলল
–কি ভাবছেন? কিভাবে সামলাবেন? আর আনটির কথা কি একবারও ভেবেছেন? ওনার এসব অসুস্থতার এক মাত্র কারন কিন্তু এই চিন্তা। এসবের কারনে এভাবে অসুস্থ হতে থাকলে কি হবে সেটা কি ভেবে দেখেছেন একবারও?

নুহা চোখের পানি ফেলল। সেসব ভাবা তার শেষ। কিন্তু সে যে নিরুপায়। মৃদু কণ্ঠে বলল
–আমার জায়গায় মা থাকলেও এই উপকারটা নিতে রাজি হতো না।

সামিন বলল
–আমি কিন্তু এখনও বুঝতে পারলাম না সমস্যাটা ঠিক কোথায়? আপনি কিন্তু আপনার উত্তর স্পষ্ট করে দিতে পারেন নি নুহা।

নুহা কঠিন গলায় বলল
–কি হিসেবে আপনার কাছে টাকাটা নেব বলতে পারেন?

সামিনের কাছে নুহার কথা এবার স্পষ্ট হল। মেয়েটাকে যত সহজ ভেবেছিল ভেতর থেকে ঠিক ততটাই কঠিন। ততটাই নিষ্ঠুর। নিজের আত্মসম্মানবোধ ধরে রাখতে কারো কাছে মাথা নত করতে রাজি না। এমনকি কারো অনুভুতিতে আঘাত করতেও পিছ পা হয়না। মনের মাঝে অভিমান জমে গেলো সামিনের। বিয়ে হয়তো এখনও হয়নি। কিন্তু হবে তো। তাই বলে এখন কি সত্যিই কোন সম্পর্ক নেই তার সাথে? মেয়েটা তার অনুভুতিকে অপমান করেছে। এটা সে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছে না। আর কথা বাড়াল না। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
–অনেক রাত হয়েছে। আমাদের যেতে হবে।

রেহানা এখনও নিসচুপ। যেন কথা বলতে ভুলে গেছে। যাওয়ার সময় শুধু নুহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
–মায়ের খেয়াল রেখো।

নুহা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়াল। সামিন আগেই গাড়ির সামনে এসে দাড়িয়ে আছে। তার মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ। রেহানা কাছে এসে দাড়াতেই সে উঠে বসলো গাড়িতে। রেহানাও গাড়িতে বসে পড়ল। সামিন ড্রাইভ করতে শুরু করলো। তাকে দেখেই রেহানা বুঝে গেলো সে রেগে আছে। সামিনের দিকে তাকিয়ে বলল
–আমি জানি নুহার ওভাবে কথা বলা তোমার পছন্দ হয়নি। তুমি অনেক হার্ট হয়েছ। একটা বিষয় হয়তো তুমি খেয়াল করেছো যে এই কথাটা আমিও বলতে পারতাম। কিন্তু বলিনি। কারন কি জানো?

সামিনের মাথায় বিষয়টা ঢুকল। আসলেই তাই। রেহানা চাইলেই বলতে পারতো। আর এটাই করা উচিৎ ছিল তার। কিন্তু কেন বলেনি? রেহানা আবারো বলল
–মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকদের সম্পদ না থাকলেও তাদের কাছে সম্মানটাই কিন্তু সব কিছু। আমি জানি এতো গুলো টাকা ওরা কখনই ম্যানেজ করতে পারবে না। প্রয়োজন হলে বাড়ি নিলামে বিক্রি করে দিবে কিন্তু তবুও কারো কাছে হাত পাতবে না।

–কিন্তু মা এই সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে যদি ক্ষতি হয় তাহলে সেই সম্মানের কি দাম। তাছাড়া নুহা যেভাবে বলল সব সম্পর্ক কি সেভাবেই বিচার করা যায়।

সামিনের কথা শুনে রেহানা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন
–তুমি যেভাবে ভাবছ বিষয়টা সেরকম না সামিন। এসব বিষয় তাদের আত্তসম্মানে বাধে। তারা এগুলোকে দয়া হিসেবে দেখে। তাই এই উপকার গুলো নিতে চায়না। আর তার থেকেও বড় কথা হল অল্প কিছু টাকা হলে হয়তো এটা বলতাম যে আপাতত বিপদ দূর করুক। পড়ে যখন তাদের সম্ভব হবে তখন আমাদেরকে ফেরত দেবে। কিন্তু এতো টাকা যে ওরা কখনই ফেরত দিতে পারবে না সেটা জেনেই আর নিতে চাবে না।

–তাহলে এখন কি হবে মা। ওরা কিভাবে ঠিক করবে সব কিছু। আর ওদের পরিবারের লোকজনও তো তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না।

সামিন কথাটা বলতেই রেহানা চিন্তায় ডুবে গেলো। কিছুক্ষন ভেবে বলল
–আমার ভাবনা কতটুকু ঠিক জানিনা। তবে আমি আমার জীবনে যত মানুষ দেখেছি তার থেকে এতোটুকু বলতে পারি মানে আমার মনে হয়েছে যে তাদের পরিবারের ভিতরেই কিছু একটা চলছে। কেউ কেউ চাইছে বাড়িটা নিলামে তোলা হোক। আর আমি তো সবার সাথে কথা বলেছি। আমার অনেক কিছুই একটু অন্যরকম লেগেছে।

সামিন একটু ভাবল। তারপর বলল
–একটা কথা বলবো মা?

–বল।

–বিয়েটা হলে এসব নিয়ে তো আর কোন সমস্যা থাকবে না। তাই আমি চাই তাড়াতাড়ি বিয়েটা করতে।

রেহানা সামিনের দিকে তাকাল। একটু ভেবে বলল
–কিন্তু এই অবস্থায় বিয়ে? এই অবস্থায় নুহাকে তাদের সব থেকে প্রয়োজন। মৌ মেয়েটা বড্ড ছোট। এখনও দায়িত্ব বুঝেই উঠতে পারবে না। নুহা না থাকলে ঐ সংসার কে সামলাবে বল?

সামিন শান্ত সরে বলল
–আমি বলছি না নুহাকে ঐ বাড়ি থেকে এনে এই বাড়িতে রাখবো। শুধু একটা সম্পর্ক তৈরি হবে। একটা নাম। যা নিয়ে ওদের মধ্যে কোন দ্বিধা থাকবে না।

———–
ফজরের আজান কানে আসতেই নুহা উঠে বসলো। আজকাল তার ঘম হয়না রাতে। মাথার মধ্যে রাজ্যের চিন্তা গিজগিজ করে। কিভাবে সব কিছু সমাধান হবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওয়াশ রুমে গেলো। অজু করে বের হয়ে এলো। নামাজ পড়ে রান্না ঘরে গেলো চা বানাতে। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। সকালের আলো ফুটতেই মৌ উঠে যাবে। তার পরিক্ষা চলছে। অনেকদিন হল নুহার পড়ালেখা হয়না ঠিক মতো। সে কোচিং এ যাবার সময়ও পেতনা। কিন্তু পড়ালেখা তো আর বন্ধ করে রাখতে পারে না। তাই বাধ্য হয়েই গ্রাম থেকে তার নানিকে এনে রেখেছে। একটু হলেও স্বস্তি পেয়েছে সে। অন্তত পড়ালেখাটা করতে পারছে। চা নিয়ে সোফায় এসে বসলো। চায়ে চুমুক দিয়ে ভাবছে। বাস্তবতা কত কঠিন। এই বয়সেই তাকে কত কিছু শিখিয়ে দিলো। সবাই মিলে এতো চেষ্টা করেও তার বাবাকে খুজে পেলো না। এবার সে নিজেই খুজবে তার বাবাকে। যেভাবেই হোক খুজে বের করবেই। তার জন্য যা করতে হোক করবে।

সোফায় মাথা এলিয়ে দিতেই সামিনের কথা মনে পড়ল। সেদিন নুহার কঠিন কথায় সামিন যে অভিমান করেছে সেটা সে বুঝতে পারছে। কারন তার পর থেকে রেহানা ফোন করে খোজ নিলেও সামিনের কোন খবর নেই। সে কোনভাবেই নুহার সাথে কথা বলছে না। ফোনও করেনা। এখানে নুহারই বা দোষ কই। এভাবে তাদের কাছ থেকে সাহায্য নিতে পারেনা। অনেকেই অনেক কথা বলবে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের এমনিতেই হাজার দোষ। কিন্তু সামিন কি সেটা বুঝবে?

———–
সকাল থেকে সাড়া বাড়ির কাজ শেষ করলো নুহা। দুপুরে রান্না শেষ করে মা নানিকে খাওয়াল। মৌ পরিক্ষা দিতে গেছে। নুহা নিজেও খেয়ে তার মা আর নানিকে রেখে নিজে বের হয়ে গেলো কোচিং এর উদ্দেশ্যে। কোচিং শেষ করতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেলো। সেখান থেকে কিছু দুরেই ঔষধের দোকানে যেতে হবে মায়ের ঔষধ নিতে। নুহা সেদিকেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো। সব ঔষধ কিনে নিলো। ঔষধ নিতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো। এখন আর বাসায় হেটে যাওয়া সম্ভব না। রিকশায় যেতে হবে। তাই রিক্সশার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। নিজের শরীরটাও খারাপ লাগছে বেশ। প্রচণ্ড ক্লান্ত অনুভুত হচ্ছে। জোরে জোরে শ্বাস টেনে সামনে একটা রিক্সা দেখে সেটাতে উঠে পড়ল। বাসায় পৌঁছে বেল বাজিয়ে কাউকে বিরক্ত করলো না নুহা। নিজের চাবি দিয়ে দরজা খুলে ফেলল। কিন্তু খুলেই যা দেখল তাতে তার সব কিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে গেলো।

চলবে……

(রিচেক করা হয়নি। ভুল থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে