নভেম্বরের শহরে পর্ব-১১

0
922

#নভেম্বরের_শহরে
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১১

গায়ে চাদর জড়িয়ে যবুথবু হয়ে সোফায় বসে পড়ছে মৌ। মাঝে মাঝে ঠাণ্ডায় কাঁপছে। নুহার গায়ে কোন শীতের কাপড় নেই। সে এদিক সেদিক দৌড়ে কাজ করছে তাই খুব একটা শীত লাগছে না। খাবার গরম করে টেবিলে সাজিয়ে রাখল। মৌয়ের দিকে একবার তাকিয়ে বলল
–খেতে আয়।

মৌ ঘাড় বেকিয়ে পিছনে তাকাল। নুহা সাধারন একটা কামিজ পরে এই ঠাণ্ডায় কিভাবে কাজ করছে সেটাই মাথায় ঢুকছে না তার। কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো
–তোমার ঠাণ্ডা লাগেনা আপা? শীতের কাপড় পরনি কেন?

নুহা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। খাবার প্লেটে বাড়তে বাড়তে বলল
–কাজ করলে ঠাণ্ডা লাগে না। অমন করে বসে থাকলে ঠাণ্ডা তো লাগবেই।

মৌ বই বন্ধ করে নুহার কাছে এসে দাঁড়ালো। বলল
–কি কাজ করলে ঠাণ্ডা লাগবে না সেটাই করবো।

নুহা উঠে ঝাড়ু এনে মৌয়ের হাতে দিয়ে বলল
–সারা বাড়ি ঝাড়ু দে। তাহলেই আর ঠাণ্ডা লাগবে না। দেখবি গরমে সব শীতের কাপড় খুলে ফেলতে মন চাবে।

নুহা মুচকি হেসে উঠে রান্না ঘরে গেলো। মৌ ঝাড়ু নিয়ে সেটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। একটু ভেবে বোনের কথার সত্যতা প্রমান করতেই লেগে পড়ল ঝাড়ু দিতে। পাক্কা আধা ঘণ্টা সময় লাগলো পুরো বাড়ির কোণায় কোণায় ঝাড়ু দিতে। হাপিয়ে উঠেছে মৌ। ঝাড়ু ফেলে সমস্ত শীতের কাপড় খুলে টেবিলে গিয়ে বসলো। জোরে জোরে শ্বাস টেনে এক গ্লাস পানি খেলো। নুহা এসে বলল
–ঠিক আছে এবার?

মৌ মাথা নাড়াল। দুইবোনেই হেসে দিলো। নুহা খাবার বেড়ে বলল
–তুই মাকে নিয়ে আয়। একসাথে খাবো।

মৌ উঠে ঘরে গেলো। সালেহা কম্বল উড়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। মৌ পাশে দাড়িয়ে বলল
–মা উঠো। আমরা খাবো। আপা ডাকতেছে।

সালেহা কোন উত্তর দিলো না। মৌ ভাবল সে বুঝি ঘুমিয়ে গেছে। পাশে বসে হাত নাড়িয়ে বলল
–মা ও মা। উঠো না। খেয়ে তারপর আবার ঘুমাও।

তারপরেও কোন সাড়া না পাওয়ায় এবার মৌয়ের কেমন খটকা লাগলো। মৌ সালেহার সারা মুখে হাত ছোঁয়াল। শরীর ঝাকিয়ে ডাকল। কোন সাড়া পেলো না। ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো কিন্তু তবুও কোন হেলদোল দেখতে না পেয়ে চিৎকার করে বলল
–আপা তাড়াতাড়ি আসো।

নুহা পানি ঢালছিল গ্লাসে। মৌয়ের আওয়াজ কানে আসতেই প্রচণ্ড বেগে সেদিকে দৌড়ে গেলো। নুহাকে দেখে মৌ বলল
–মা কথা বলছে না আপা।

নুহার পায়ের মাটি মনে হয় সরে গেলো। এখন কি করবে সে। বাড়িতে তারা তিনজন ছাড়া আর কেউ নেই। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো তার। এখন তো চাচাদেরকে ফোন করলে তারা আসতেও অনেক সময় লাগবে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। এদিকে মৌ মায়ের হাত পা ঘোষছে আর কাঁদছে। নুহা আর কোন উপায় দেখল না। দিক্বিদিক ভুলে ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে সামিনের নাম্বারে ডায়াল করলো। প্রথমবার রিং হয়ে ফোনটা কেটে গেলো। নুহা এবার আবারো আকাশ সম চিন্তায় পড়ে গেলো। ভাবতে ভাবতেই উচ্চ শব্দে ফোন বেজে উঠলো তার। চমকে ফোনের দিকে তাকাল। সামিনের নাম্বার দেখে সামান্য স্বস্তি পেলো। তড়িঘড়ি করে ফোনটা ধরে ফেলল। সামিন ফোন ধরে বলল
–কি হল নুহা। সব ঠিক আছে তো?

নুহা কাদতে কাদতে বলল
–মা ভীষণ অসুস্থ।

–কি বলছেন? কি হয়েছে আনটির?

নুহা ফিকরে ফিকরে কাদতে কাদতে বলল
–জানিনা। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি একটু আসবেন?

–হ্যা হ্যা। আমি আসছি। আমি মাকে নিয়ে আসছি। আপনি একদম চিন্তা করবেন না।

ফোনটা কেটে দিলো সামিন। নুহা দৌড়ে রান্না ঘর থেকে সরিষার তেল এনে মায়ের হাতে পায়ে মালিশ করতে লাগলো। দুইবোনের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। সন্ধ্যা থেকেই তো সুস্থ ছিল। হঠাৎ করে কি এমন হল যে এতো অসুস্থ হয়ে গেলো। নুহার মনে তীব্র ভয় দেখা দিলো। উঠে মাথার কাছে বসলো। কাপা কাপা হাত নাকের কাছে রাখল। শ্বাস পড়ছে ঠিক মতো। একটু স্বস্তি পেলো সে। অন্তত মানুষটা বেঁচে আছে। আবারো ডাকল।
–মা শুনতে পাচ্ছ। দেখ না মা।

এবারো কোন আওয়াজ আসলো না। কিন্তু একটু নড়েচড়ে উঠলো। মৌ হাতে তেল মালিশ করছিলো। একটু নড়ে উঠতেই বিচলিত হয়ে বলল
–আপা মা নড়ছে।

নুহা অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। কিছুক্ষনের মধ্যেই কলিং বেল বাজতেই নুহা দৌড়ে গেলো দরজা খুলতে। দরজা খুলেই রেহানা আর সামিন কে দাড়িয়ে থাকতে দেখল। তাদেরকে দেখে এতক্ষনের চাপা কষ্টটা আচমকাই নাড়া দিয়ে উঠলো। ডুকরে কেদে উঠলো সে। মুখে আচল চেপে চোখের পানি ফেলল। রেহানা ভেতরে ঢুকেই তাকে ঝাপটে ধরে বলল
–কেদনা ঠিক হয়ে যাবে। কোথায় তোমার মা?

নুহা ভিতরে ইশারা করলো। সামিন আর তার সাথে একজন লোক ভিতরে ঢুকল। রেহানা লোকটাকে নিয়ে ঘরের ভিতরে গেলো। আর সামিন বাইরে বসলো। নুহা তাদের পিছনে পিছনে ঘরে গেলো। ডাক্তার বেশ কিছুক্ষন তার মাকে পরিক্ষা করে বলল
–অতিরিক্ত টেনশনের কারনে সেন্সলেস হয়ে গেছে। ওনার প্রচুর রেস্ট দরকার। ঠিক মতো রেস্ট না নিলে ওনার জন্য কিন্তু বিপদ হয়ে যাবে।

ডাক্তার ঠিক মতো দেখে বাইরে চলে এলো। রেহানা সামিন কে বলল
–আঙ্কেলকে পৌঁছে দিয়ে আসো।

ডাক্তার রেহানার আচরনে তুষ্ট হয়েই বললেন
–না না। লাগবে না। আমি চলে যেতে পারবো। আপনারা বরং এখানেই থাকেন। আপনাদের এখানে খুব দরকার।

রেহানা মাথা নাড়ল। ডাক্তার চলে গেলো। সালেহা কে ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে। নুহা তাড়াতাড়ি করে সালেহাকে হালকা খাইয়ে দিলো। তারপর শুয়ে দিলো। তিনি এতটাই দুর্বল যে কথা বলার মতো অবস্থাতেও ছিলেন না। শুধু চোখের পানি ফেলছিলেন। সামিন আর তার মা সোফায় বসে আছে। নিজেদের মতো কিছু একটা আলোচনা করছে। মৌ মায়ের পাশে বসে ছিল। কৌতূহল বসতো চাপা সরে বলল
–আপা ওনারা কি নিয়ে গল্প করছেন?

নুহা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–বলেছিনা বড়দের নিয়ে মাথা ঘামাবিনা। এটা খারাপ অভ্যাস।

নুহা প্লেট নিয়ে উঠে বাইরে যেতে যেতে বলল
–খেতে আয়।

রান্না ঘরে গিয়ে প্লেট রেখে হাত ধুয়ে বাইরে এলো। রেহানার সামনে দাড়িয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল
–আনটি খেতে আসেন।

রেহানা মৃদু হাসল। বলল
–বাসায় গিয়ে খাবো। তুমি ভেবনা। আর তোমরা দুজন খেয়ে নাও।

নুহা এক পলক সামিনের দিকে তাকাল। নিস্পলক তার দিকে তাকিয়ে আছে সে। চোখ নামিয়ে পলক ফেলে বলল
–তা হয়না। আপনাদেরকে খেয়েই যেতে হবে। আপনারা না খেলে আমরা কিভাবে খাই।

রেহানা হাসল। বুঝতে পারলো মেয়েটা না খেলে কিছুতেই ছাড়বে না। তাই আর কথা না বাড়িয়ে সামিন কে বলল
–খেতেই যখন হবে তখন আর দেরি করে কি লাভ। হাত মুখ ধুয়ে এসো।

রেহানা উঠে গেলো টেবিলে। নুহা প্লেটে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। সামিন বেসিনে হাত ধুয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। মৌ রেহানার পাশে বসে ছিল। নুহা সবাইকে খাবার দিয়ে দাড়িয়ে থাকলো। রেহানা বলল
–তুমিও বস।

নুহাও মাথা নাড়িয়ে প্লেটে খাবার নিয়ে বসলো। সামিনের পাশের চেয়ারে। নুহা এতক্ষন খেয়াল করেনি। কয়েকবার খাবার মুখে তুলে সামিন কৌতূহল বসতো জিজ্ঞেস করলো
–রান্নাটা কে করেছে? চমৎকার হয়েছে কিন্তু।

নুহা এবার একটু চমকে গেলো। আড় চোখে তাকাল। মৌ উত্তর দিলো
–আপা রান্না করেছে।

রেহানা বলল
–বাহ! তোমার রান্নার হাত বেশ ভালো। তোমার মাও কি এমন রান্না করে?

নুহা মাথা নাড়াল। গম্ভীর পরিবেশে এমন প্রশংসা লাজুক আভা এনে দিলো নুহার মুখে। সামিন হালকা ঝুকে ফিসফিস করে বলল
–বিয়ের পর কিন্তু আমি আপনার হাতের রান্না খাবো। মনে থাকবে?

নুহার লজ্জা আরও বেড়ে গেলো। লজ্জায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেলো কপালে। খাবার গিলতেও তার কষ্ট হচ্ছে। কোন রকমে খাবার খেয়ে উঠে গেলো। সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে চা বানাল। সামিন আর রেহানা সোফায় বসে তাদের লোণ নিয়ে কথা বলছিলেন। নুহা চা নিয়ে তাদের কাছে যেতেই রেহানা তাকে বসতে বলল। নুহা বসলো। রেহানা একটু চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো
–তোমাদের কিছু সমাধান হল? মানে তোমার চাচারা কি এসব বিষয়ে কিছু জানেন?

নুহা মাথা নাড়াল। পরের দিনেই তাদেরকে সে সবটা জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তারা নুহাকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে না করেছে। রেহানা আবারো জিজ্ঞেস করলো
–কি বলেছে তোমার চাচারা?

নুহা আমতা আমতা করে বলল
–এখনও কিছু বলেনি।

–আচ্ছা তোমার বাবার দোকানটা এখন কি অবস্থায় আছে?

রেহানা জিজ্ঞেস করতেই নুহার মুখে বিষাদের ছাপ পড়ে গেলো। ধরা গলায় বলল
–বিক্রি করে দিয়েছে।

রেহানা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। নুহার কাছে নিজের বিস্ময়ের বিষয়টা লুকিয়ে রেখে বলল
–বিক্রি করার কি দরকার ছিল? ভাড়া দিলেই তো হতো। আচ্ছা বিক্রি করার পর যে টাকা গুলো পেয়েছে সেগুলা কি তোমরা বুঝে পেয়েছ?

নুহা মাথা নাড়ল। বলল
–পেয়েছি। কিন্তু বড় আব্বু সেগুলা একটা ব্যাংকে ফিক্সড করে রেখেছে ৭ বছরের জন্য।

রেহানার কপালে ভাজ পড়ে গেলো। কিছু সময় ভাবলেন তিনি। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। এতক্ষন সামিন তাদের সব কথা শুনছিল চুপ করে। অনেকটা সময় নিরব থাকলেন সবাই। চুপ থেকে সামিন খানিকবাদে বলে উঠলো
–আচ্ছা মা এই লোণের টাকাটা যদি আমরা দেই? তাহলে তো অন্তত একটা সমস্যা থেকে মুক্তি হবে।

সামিনের কথা শুনে রেহানা আর নুহা দুজনেই স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। সামিন তাদের দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পারলো না।

চলবে…………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে