#নভেম্বরের_শহরে
লেখক – এ রহমান
পর্ব ৭
নুহা মাথা নিচু করে বসে আছে। এই মুহূর্তে তার নিজের অনুভূতিটাই সে বুঝে উঠতে পারছে না। সে কি কথা শুনতে চায় নাকি চলে যেতে চায়।
— আপনি এভাবে চুপ করে বসে থাকলে কিন্তু দেরি হয়ে যাবে। আমি যে অপেক্ষা করছি।
নুহা নিজেকে সাভাবিক করে নিলো। মৃদু কন্ঠে বলল
— জি বলুন।
সামিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
— আপনার সাথে আমার দেখা হওয়া টা কাকতালীয় ব্যাপার হলেও সবটা কিন্তু সেরকম কিছু ছিলনা। আমি মায়ের ফোনে আপনার ছবি দেখেছিলাম। কিন্তু সেটা কাউকে জানাইনি। কারণ মা চেয়েছিল বিয়ের আগে আপনার সাথে আমার দেখা টা পরিবারের পক্ষ থেকেই হোক। বিয়ের আগে আপনার ও ছেলেকে দেখার একটা সুযোগ দেয়া হোক। কিন্তু তার আগেই আপনি আমার সামনে চলে আসেন। আর আপনাকে দেখেই আমি চিনে ফেলি। কিন্তু আমি সত্যিই তখন আপনার নাম জানতাম না। আমি দেশে আসার পর মার সাথেও কখনো সেভাবে আপনাকে নিয়ে কথা হয়নি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি যে আপনি আমাকে কোন কথা বলার সুযোগ দেন নি। এমন কি আজও দিচ্ছেন না। আমি জোর করে নিয়েছি। এটা কিন্তু আমার সাথে বেশ অন্যায়।
নুহা কিছুক্ষণ ভাবলো। কেনোজানি মানুষটাকে তার বিশ্বাস করতে মন চাইছে। মনে হলনা মানুষটার মাঝে কোন ছলনা আছে। নুহা বেশ সাভাবিক ভাবেই বলল
— এভাবে অচেনা একজন ছেলের সাথে কথা বলাটা কিভাবে শোভা পায়? তাছাড়া আপনি তো নিজের পরিচয়টাও দেন নি। আমিই বা অপরিচিত কাউকে কিভাবে বিশ্বাস করবো।
— সে সুযোগটা কি আপনি আমাকে দিয়েছেন?
নুহা এবার নিজের কাজেই বেশ লজ্জিত হলো। কিন্তু তারই বা কি করার। এসব ব্যাপার অনেক বড় রূপ ধারণ করে। মানুষ এসব নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে। তাই সে এরকম ব্যাবহার করেছে। সামিন আবারও বলল
— আপনি মনে হয় বিরক্ত হচ্ছেন আমার উপরে। তাই না?
— আপনি কিন্তু আমাকে এবার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলছেন। আমি যদি আপনার সাথে মিসবিহেব করে থাকি তাহলে সেটা কিন্তু আপনার কথা ভেবেই করেছি। আর আপনার এতে খুশি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ব্যাপার টা তো উল্টা হয়ে গেলো।
নুহা একটু বিরক্ত কণ্ঠে কথাটা বলতেই সামিন বলল
— এক্সকিউজ মী? আমার কথা ভেবে না। আপনার উড বির কথা ভেবে।
নুহা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। বলল
— একদম ঠিক। আর দুর্ভাগ্য বসত দুটো ব্যক্তিই আপনি। এখানে আমার দোষ আছে কিনা সেটাই এখন ভাবার বিষয়।
সামিন মৃদু হেসে বলল
— আপনারও কিন্তু খুশি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আপনিও হতে পারেন নি।
নুহা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বলল
— কোন বিষয়ে?
সামিন একটু ঝুঁকে বলল
— আপনাকে প্রথম দেখাতেই আমার ভালো লেগেছে।
নুহা নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। সামিন একটু হেসে আবারও বলল
— বড়ো বড়ো কবি সাহিত্যিকরা বলে একটা সময় পর মানুষ আর কোন রূপের মোহে পড়ে না। মনুষ্যত্বের প্রেমে পড়ে। মানে বোঝেন?
নুহা উত্তর দিলনা। সামিন ও অপেক্ষা করলো না উত্তরের জন্য। নিজে থেকেই বলল
— এই যে নভেম্বরী আমার কল্পনার রাজ্যের প্রয়নিয়ী। যার ভালোবাসা আমার কাছে সর্গ সুখের প্রাপ্তির মতো। আর নুহা তার বাস্তব রুপ। কিন্তু সবটা মিলেই সেই মানুষটা যে আমার সামনে বসে আছে। হোক সে নভেম্বরী কিংবা নুহা আমি যে তার রূপের মোহে নয় কথার অনলে দগ্ধ হওয়ার আকাঙ্খা রাখি। সেই মানুষটাকে আমি আমার ভাবী। তাহলে আপনার এতো আক্ষেপ কেনো?
নুহা হঠাৎ করেই চোখ তুলে তাকাল। কাপা কাপা কণ্ঠে বলল
— যদি নভেম্বরী আর নুহা দুজন আলাদা মানুষ হতো?
সামিন হেসে ফেললো। হাসি থামিয়ে বলল
— আপনি ভীষন রকম আনরোমান্টিক। এখানে কতো প্রেমময় অনুভূতি আদান প্রদান হচ্ছে। আর আপনি কষ্টের সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এতো কঠিন ভাবে ভাবার কোন প্রয়োজন নেই। প্রতিটা মানুষের কল্পনার একজন থাকে। আপনারও আছে। সেই মানুষটার সাথে আমার কতটুকু মিল আছে সেটা আমি জানি না। মিল না থাকলে কি আপনি আমাকে মাঝ পথেই ছেড়ে দিবেন নুহা? নাকি আমার মধ্যে সে মানুষটাকে খুজে নেয়ার চেষ্টা করবেন? আমরা কল্পনার মানুষটা কে ভাবতে ভালোবাসি। আর বাস্তবে তাকে পেয়ে গেলে তো কথাই নেই। কিন্তু যদি সেরকম কিছু না হয় তাহলে চেষ্টা করি বাস্তবতার মাঝেই কল্পনাকে খুজে নেয়ার। এদিক দিয়ে আমার ভাগ্য প্রসন্ন বলে হয়তো আমি পেয়ে গেছি। কিন্তু আপনিও যে পাবেন তা তো না। তাই বলে কি আপনি এখানেই সমাপ্তি ঘোষণা করবেন?
নুহা উত্তর দিলো না। কিন্তু কথা গুলো তাকে ভীষন ভাবে আকর্ষণ করলো। সামিন থেমে যাওয়ায় তার মন খারাপ হয়ে গেল। আরো কিছুক্ষণ বলতে থাকলে কি খুব ক্ষতি হতো। আরো কিছু কথা তাকে শোনালে কি কথার ঝুড়ি শেষ হয়ে যেতো। হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল
— আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। সময় মতো বাসায় না গেলে মা চিন্তা করবে।
সামিন ঘড়ি দেখে বলল
— চলুন।
দুজনেই বেরিয়ে গেলো। গাড়িতে উঠে কিছুদূর যেতেই সামিন বলল
— দুঃখিত আপনার দেরি করানোর জন্য। আমি আপনাকে ওখানেই এসব কথা বলতে পারতাম। কিন্তু আপনার অসস্তি হতো। বাইরে আপনি এভাবে কথা বলতে মোটেই কমফোর্ট না। তাই এভাবে জোর করে আনতে হলো। আই অ্যাম রিয়েলি সরি ফর দ্যাট।
নুহা মৃদু সরে বলল
— না ঠিক আছে।
সামিন সামনে তাকিয়েই বলল
— ঠিক আছে মানে আমি কোন ভুল করিনি তাই তো?
আচমকাই লজ্জা ঘিরে ফেললো নুহাকে। চোখের পাতা পিটপিট করে লজ্জা লুকাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু লাভ হলো না। সামিন বুঝেই গেলো। ঠোঁট চেপে হাসলো। নুহার বাড়ির সামনে এসে গাড়ি দাড়ালো। সামিন বের হয়ে নুহার দরজা খুলে দিলো। নুহা গাড়ি থেকে নেমে প্রশস্ত হাসলো। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। সামিন গাড়িতে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে বলল
— এই হাসিটার অর্থ কি আমি নিজের মতোই ধরে নিবো?
নুহা ঘুরে তাকালো। সন্দিহান কণ্ঠে বলল
— মানে?
— মানে আমি কি ধরে নেবো যে আপনি আমার সাধিকারে নিজেকে হস্তান্তর করে ফেললেন।
নুহা কথার মানে না বুঝলেও মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলো। এতো চমৎকার কথা সে আগে কখনো শুনেনি। সামিন নুহার চাহুনি দেখেই বুঝে গেলো সে তার কথা বুঝেনি। শব্দ করে হেসে ফেললো। বলল
— এখনি নিজের মস্তিষ্কে এতো চাপ দেয়ার দরকার নেই। সময় হলে তো সবই বুঝবেন। আপনার নাম্বারটা পেতে পারি। যদি কোন সমস্যা না থাকে।
নুহা মৃদু হেসে বলল
— সমস্যা থাকলে?
— জোর করবো না।
নুহা হেসে ফেললো। সামিন মুগ্ধ চোখে তার হাসির দিকে তাকিয়ে আছে।
————–
রেহানা নিজের ঘরে বসে ফোনে কথা বলছে হেসে হেসে। আসিফ ঘরে ঢুকেই রেহানাকে এভাবে উৎফুল্ল দেখে বিরক্তি নিয়ে নিজের গলার টাই টা ঢিলে করে আয়নার সামনে দাড়ালো। রেহানা আসিফ কে এক পলক দেখে ফোন কেটে দিলো। আসিফ হাতের ঘড়িটা খুলতে খুলতে সাভাবিক ভাবেই বলল
— বাসায় কি হয় কিছুই তো আজ কাল জানানোর প্রয়োজন মনে কর না।
রেহানা কোন জবাব দিলনা। আসিফ এবার ঘুরে তার দিকে তাকাল। বলল
— শুনলাম মেয়েটার বাবা নাকি পালিয়েছে?
রেহানা তিক্ত গলায় বলল
— পালায় নি। হারিয়ে গেছে।
আসিফ মৃদু হেসে বলল
— কতটুকু জানো তুমি রুহি? এই কয়দিনে আমার থেকে বেশি মানুষ তুমি চিনে ফেললে? আমি শত শত এমপ্লই খাটাই। আর ওই মিডিল ক্লাস পরিবার আমার কখনোই পছন্দ ছিলনা। মেয়ের বিয়ের আগে বাবা হারিয়ে যায়। কি অদ্ভুত!
রেহানা ঝাঁঝালো গলায় বলল
— মেয়ের বাবাকে দিয়ে কি হবে। বাকি সবাই আর যায় হোক সেসব দিয়ে কোন কাজ নাই। আমি মেয়েকে পছন্দ করেছি কারণ মেয়েটা অনেক ভালো। মেয়েটার অনেক গুণ আছে।
— গুণ না ছাই। রক্ত তো শরীরে একই। বাবার জিন মেয়ের মাঝেও যে থাকবে না সেটা কিভাবে বলছো।
রেহানা ঘুরে তাকাল। তাচ্ছিল্য করে বলল
— সব বাবার জিন যে বাচ্চাদের মাঝে থাকেনা তার উপযুক্ত উদাহরণ তোমার ছেলে।
আসিফ ঘুরে তাকাল। সেই চাহুনি দেখেই রেহানার বুকের ভেতরে কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি। কোন আগ্রাসী ভাব নেই। চোখের মাঝে আছে অসহায়ত্ব। বুক ভরা কষ্ট।
চলবে………