নভেম্বরের শহরে পর্ব-০৬ + বোনাস পর্ব

0
1014

#নভেম্বরের_শহরে
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৬

শীতের দিনে বিকেল আর সন্ধ্যার বড় ভাব। কখন মিলে মিশে এক হয়ে যায় প্রকৃতি বুঝে উঠতে পারেনা। ঝাকিয়ে কুয়াশা পড়েছে। গাছের পাতা গুলোও নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে কুয়াশা থেকে বাঁচতে। সামিন গাড়ির উপরে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে মুখে কুয়াশা ছুয়ে দিচ্ছে। শীতল একটা শিহরণ থেমে থেমে শরীর ছুয়ে চলে যাচ্ছে। শীত প্রধান দেশে এতো বছর কাটিয়ে আসলেও দেশের শীতটা যেন অন্যরকম। কি একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। ঠাণ্ডা বাতাস। ঝরা পাতার ছন্দে বাতাসে যে সঙ্গীত তৈরি করে সেটা বোধহয় অন্য কোন দেশে পাওয়া যায়না। ফোনের উচ্চশব্দে তার ধ্যান ভাঙ্গে। একটু বিরক্ত হয় সে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে নেয়। তার বন্ধু ফোন করেছে। ফোনটা ধরে কিছুক্ষন কথা বলে এদিক সেদিক তাকাল। রাস্তাটা বেশ ফাঁকা। মাঝে মাঝে দুই একজন করে যাওয়া আসা করছে। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে উপর থেকে নেমে গাড়ির ভিতরে ঢুকে বসলো। কালো জানালার কাঁচটা লাগিয়ে দিতেই ফুটপাতের উপরে চোখ পড়ল তার। হঠাৎ করেই অচেনা অনুভুতি গাড় হয়ে উঠলো। অতি কাঙ্ক্ষিত কিছুর জানান দিতেই সিটটা এলিয়ে দিয়ে তাতে হেলানি দিয়ে তাকাল সেই দিকে।

সেই নভেম্বরি নিজের খেয়াল মতো হেটেই চলেছে। দৃষ্টি তার নিচের দিকে। সাদা মাটা পোশাকে কোন মানুষকে এতো সুন্দর মানায় সেটার ধারনা মাত্র হল সামিনের। কাধে ব্যাগ ঝুলানো। হাতে ঘড়ি। সবুজ রঙের একটা কামিজ পরনে। ওড়নাটা মাথায় টেনে দেয়া বড় করে। খয়েরি রঙের একটা চাদর গায়ে জড়ানো। সেদিনের মতো আজও ঢেউ খেলানো চুল অজত্নে কানের পাশে ঘাড় অব্দি ঝুলছে। সন্ধ্যা বেলা রাস্তার আলোয় তার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সামিন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। কিছু তো একটা আছে এই মেয়েটার মাঝে যা সহজেই আকর্ষণ করে।

হঠাৎ করেই মেয়েটির পা একটা বাড়ির সামনে এসে আটকে গেলো। সামিন প্রথমে ভেবেছিল এটাই তার বাড়ি। কিন্তু তার ধারনা ভুল প্রমান করে বাড়ির সামনে সারি সারি চন্দ্রমল্লিকার গাছের নিচে পড়ে থাকা একটা ফুল তুলে নিলো মেয়েটি। ফুলটা হাতে নিয়ে সেটার দিকে গভির ভাবে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে তাকাল। কাউকে খুজছিল কিনা কে জানে। একটু এগিয়ে এসে ফুটপাতের উপরেই দাড়িয়ে গাড়ির জানালার দিকে তাকাল। কালো গ্লাস হওয়ায় ভেতরে কেউ আদৌ আছে কিনা সেটা দেখা সম্ভব হল না। তাই কেউ নেই ধরে নিয়েই একটু ঝুকে মাথা থেকে ওড়নাটা ফেলে দিলো। অর্ধ চুপসে যাওয়া চন্দ্রমল্লিকাটা অতি জত্নে কানে গুঁজে দিলো। সামিন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক আটকে গেলো তার। কয়কবার হার্ট বিটও মিস করলো মনে হয়। বুকের ভেতরে কেমন এক অনুভুতি চাড়া দিয়ে উঠলো। মেয়েটি ভালো করে এদিক সেদিক ফিরে নিজেকে পরখ করছে। ঠিক কেমন লাগছে তাকে দেখতে। কিন্তু ফুটপাত ধরে এক পথচারীকে আসতে দেখে তড়িঘড়ি করে মাথার ওড়নাটা টেনে দিলো। নিজের কাপড় ঠিক করে আবারো হাটা ধরল। সামিনের ধ্যন ভাঙল। মনে হল এতক্ষন শ্বাস নিচ্ছিল কিনা সেটাও ঠিক মতো বুঝতে পারছে না। দৃষ্টি মেলে কিছু একটা ভেবে পকেট হাতড়িয়ে কাগজ আর কলম বের করলো। নিজের মনের মতো কিছু একটা লিখল। গাড়ি থেকে বের হয়ে এদিক সেদিক তাকাল। একটা ছোট মেয়ে চোখে পড়তেই তাকে হাত ইশারা করে ডাকল। মেয়েটা তার কাছে এসে দাঁড়ালো। ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো
–কিছু কইবেন?

সামিন হেসে বলল
–তোমার নাম কি?

–আলেয়া।

সামিন নিজের পকেট হাতড়িয়ে একটা চকলেট খুজে পেলো। মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল
–তোমাকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে। করতে পারবে?

মেয়েটি চোখ পিটপিট করে তাকাল। বলল
–কি কাজ?

সামিন সামনে ইশারা করে বলল
–ঐ যে যাচ্ছে। ঐ আপুটার হাতে এই কাগজটা দিবে।

মেয়েটি কিছুক্ষন ভাবল। তারপর মিষ্টি হেসে বলল
–ঐ আপারে দিতে হইব?

সামিন হেসে মাথা নাড়াল। মেয়েটি প্রশস্ত হাসল। হেসেই এক দৌড় দিলো। সামিন তার হাসির অর্থ বুঝতে পারলো না। কি বুঝল কে জানে?

আলেয়া মেয়েটির কাছে গিয়ে ডাকল। মেয়েটি ঘুরে তাকাতেই একটা চমৎকার হাসি দিলো আলেয়া। মেয়েটি ভীষণ অবাক হল। একটু ঝুকে আলেয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
–কি হয়েছে? কিছু বলবে?

আলেয়া হেসে বলল
–আপু আপনার জন্য এইটা।

মেয়েটি ভ্রু কুচকে তাকাল। বলল
–কি এটা?

আলেয়া তার মুখের মিষ্টি হাসিটা ধরেই রেখেছে। বলল
–জানিনা।

মেয়েটি ভীষণ অবাক সরে বলল
–কে দিয়েছে?

–একটা ভাইয়া।

বলেই আলেয়া আঙ্গুল তাক করে দেখাল। সেদিকে উকিঝুকি মেরে দেখল মেয়েটা কেউ নেই। শুধু একটা গাড়ি দাড়িয়ে আছে। আলেয়া আর অপেক্ষা করলো না। এক দৌড়ে আবার কোথায় মিলিয়ে গেলো। মেয়েটি কাগজটা খুলে দেখল।

“প্রিয় নভেম্বরী
তোমার ঐ ঢেউ খেলানো চুলের ভাঁজে জত্নে গুঁজে থাকা ফুলটার উপরে ভীষণ রকম হিংসে হচ্ছে। কেন আমার আগে তোমার চুলের ঘ্রাণ নিলো সে। তোমার চোখের সাথে লেপটে থাকা কাজলের উপরে রাগ হচ্ছে খুব। কেন সে তোমার মায়াবি চোখ ছুয়ে দিলো। তোমাকে ছুয়ে দেয়া সকল কিছুর উপরে আজ আমার এক সমুদ্র অভিমান। কেন নির্দ্বিধায় তারা তোমাকে এভাবে ছুয়ে দেয়। অথচ আমি পারিনা। কিন্তু সেই তুমিটা তো আজ এই আমিটার হওয়ার কথা ছিল। তাহলে কেন এই দূরত্ব?
ইতি
তোমার নভেম্বরের_শহরে আমন্ত্রিত একমাত্র অতিথি।”

কাগজটা পড়ে ভীষণ রকম অবাক হল মেয়েটি। এরকম কথা তাকে কে বলতে পারে। আশে পাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। গাড়িটির দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকাতেই সামিন দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। ভীষণ সুন্দর হাসি তার ঠোটে। মেয়েটি তার চেহারা দেখেই চিনে ফেলল। দ্রুত পা ফেলে ধ্বংসাত্মক রুপে এগিয়ে গেলো সেদিকে। সামনে এসে কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে দিলো। সামিন নিরবে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। কোন কথা বলল না। মেয়েটি হাত গুজে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–আপনি কেন আমার পিছু নিয়েছেন? সেদিন থেকেই যেখানে যাই আপনাকে দেখতে পাই। কেন?

সামিন চোখ তুলে তাকাল। ঘোরটা কেটে উঠতে পারছে না কিছুতেই। জতবার তাকায় মুগ্ধ হয়ে যায়। চুপসে যাওয়া ফুলটাও যেন প্রনবন্ত হয়ে উঠেছে। মেয়েটি বিরক্তি নিয়ে বলল
–আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি?

সামিনের ঘোর এবার কেটে গেলো। মৃদু সরে বলল
–জি?

মেয়েটি বিরক্তিকর শ্বাস ছাড়ল। এতক্ষন তার কোন কথাই সামিন শুনতে পায়নি। তাই আবারো বলল
–কেন আমার পিছু নিয়েছেন? আপনার উদ্দেশ্য কি?

আবারো মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে নির্বোধের মতো বলল
–জানিনা।

–জানেন টা কি? আশ্চর্য!

একটু জোরেই চেচিয়ে কথাটা বলল মেয়েটি। সামিন অগোছালো দৃষ্টি ফেলে বলল
–মানে আসলে আমি আপনার…।

কথা শেষ করার আগেই ক্ষিপ্ত বাঘিনির মতো ঝাপিয়ে পড়ল মেয়েটি। তীব্র অসন্তুষ্টি নিয়ে বলল
–আমার নাম জানতে চান তাই তো? কিন্তু আমি আপনাকে আমার নাম কোনভাবেই জানাতে বাধ্য না। দেখুন আপনাকে দেখে যথেষ্ট ভদ্র লোক বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এরকম কাজ কর্ম কোন ভদ্রতার পরিচয় হতে পারেনা। রাস্তায় এভাবে একটা মেয়েকে বিরক্ত করা কোন ভদ্র লোকের কাজ না। আমি আপনার উপরে খুব বিরক্ত। আপনি প্লিজ এভাবে আমার পিছু নিয়ে যেখানে সেখানে যাবেন না। এই শহরে আমার অনেক পরিচিত লোক আছে। এভাবে দেখলে অনেকেই অনেক কিছু ভেবে বসবে। আমি চাইনা আমার সম্পর্কে কেউ খারাপ কিছু ভাবতে বাধ্য হোক। আর একটা কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই।

থেমে নিজের অনামিকা আঙ্গুলে জ্বলজ্বল করা আংটিটা তুলে ধরে বলল
–আই এম অলরেডি এঙ্গেজড।

সামিনকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত পা ফেলে চলে গেলো মেয়েটি। সামিন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। আজও তাকে কোন কথা বলার সুযোগ দিলো না। দিলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো?

—————–
বেশ রাত হয়েছে। আসিফ অফিস থেকে এসে বাসায় ঢুকেই ছেলেকে দেখে মনটা ভালো হয়ে গেলো। কানে হেডফোন গুঁজে মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে। আসিফ তার পাশে গিয়ে বসতেই কান থেকে হেডফোন খুলে বলল
–কখন এলে বাবা?

আসিফ নিজের কোর্ট খুলতে খুলতে বলল
–এই তো। তুমি কি করছ?

–কিছু না। গান শুনছিলাম।

সামিনের আওয়াজ বেশ নিষ্প্রাণ শোনালো। আসিফ কোর্ট খুলে রেখে তার দিকে তাকাল। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
–কি হয়েছে মাই সান? আর ইউ আপসেট?

সামিন ঠোট ভাজ করে মাথা নাড়াল। আসিফ বুঝতে পারলো সে কিছুই বলতে চাচ্ছে না। তাই এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল
–তোমার মা কোথায়?

–মা একটু বাইরে গেছে। ঐ হসপিটালে।

সামিনের কথা শুনে আসিফের প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
–তোমার মায়ের পছন্দ কেমন? আই মিন তোমার কি আদৌ ভালো লেগেছে?

সামিন মৃদু হেসে বলল
–দেখিনি তো। কিভাবে বলবো?

আসিফ ভ্রু উঁচিয়ে বিস্ময় নিয়ে তাকাল। বলল
–দেখনি মানে?

–এখনও তো দেখিনি বাবা। মাই দেখেছে।

–হোয়াট ডিড ইউ সে? তুমি এখনও দেখনি। ডোন্ট টেল মি দ্যাট তোমার মায়ের পছন্দই শেষ পছন্দ। আর তুমি বিদেশে বড় হয়েছ। ওরকম মিডিল ক্লাস ফ্যামেলির একটা মেয়ের সাথে কিভাবে সংসার করবে? আমার মনে হয় মায়ের উপরে এভাবে ভরসা না করে তোমার নিজের একটু ভাবা দরকার। অনেস্টলি! আমার কাছে বিষয়টা ভালো লাগেনি। বাকিটা তোমার ডিসিশন। আমি তোমাকে কখনও না বলিনি।

বাবার এমন কথা শুনে সামিন হাসল। আসিফ ভ্রু কুচকে তাকাল। ছেলের এমন আচরনে বেশ বিরক্ত হল সে। এভাবে হাসার মতো কোন কথা বলেনি। সামিন হাসি থামিয়ে বলল
–আমি অনেক জায়গায় ঘুরেছি বাবা। অনেক মেয়ে দেখেছি। আমার কাছে মনে হয় এই মিডিল ক্লাস ফ্যামেলির মেয়েরা বউ হিসেবে অনেক ভালো হয়। তাছাড়াও মায়ের পছন্দ খারাপ হবে এটা ভাবা নিঃসন্দেহে বোকামি। মা মানুষ খুব ভালো চেনে বাবা।

আসিফ গুরুত্ব দিলেন না। উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললেন
–এজ ইউর উইশ! আমি তোমাকে কোন কিছুতেই কখনও না বলিনি। তবুও একবার ভেবে দেখা উচিৎ। তোমার মাও মানুষ। মানুষ মাত্রই ভুল। যাই হোক। আই এম সো মাচ টায়ার্ড!

সামিন একটু হেসে বাবাকে বিদায় দিলো। সে আবারো ফোনের দিকে তাকাতেই বেজে উঠলো। মা ফোন করেছে। সামিন ফোনটা ধরতেই ব্যস্ত কণ্ঠে ওপাশ থেকে রেহানা বলল
–সামিন তোমার বাবা এসেছে?

–জি মা। তুমি কখন আসবে?

সামিনের কথা শেষ হতেই রেহানা বলল
–এক কাজ করো। তুমি একটু গাড়িটা নিয়ে হাসপাতালে আসো। আমার গাড়ি গ্যারেজে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।

–ওকে মা আমি আসছি।

মায়ের কথা শেষ না হতেই সামিন উঠে রেডি হতে গেলো। রেডি হয়ে বাইরে বেরিয়েই গলা তুলে ডাকল
–সেলিম দাদু।

সেলিম দৌড়ে এসে দাঁড়ালো। বাড়ির অনেক পুরাতন কাজের লোক। পারিবারিক কাজের লোক বললেই চলে। সেই আসিফের বাবার সময় থেকে কাজ করে। তাকে দেখে সামিন বলল
–দাদু আমি মাকে আনতে যাচ্ছি। বাবাকে খেয়ে নিতে বোলো। কখন ফিরব জানিনা।

সেলিম মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই সামিন আর দেরি করলো না। বের হয়ে গেলো।

হাসপাতালে পৌঁছেই সিঁড়ি বেয়ে উঠলো তড়িঘড়ি করে। উঠেই মাকে দেখতে পেলো। রেহানা সামিনকে দেখে এগিয়ে এসে বললেন
–তুমি এসেছ। আসলে আমার গাড়ি গ্যারেজে। আর আজকে তোমার আনটিকে ডিসচার্জ করে দেবেন। তাই তোমাকে এভাবে আসতে বললাম।

সামিন ছোট্ট করে ‘ওহ’ বলল। রেহানা নুহার আত্মীয় সজনদের সাথে সামিনের কথা বলে দিলো। সবার সাথে কথা বলা শেষ করে রেহানা সামিনকে হাত ধরে টেনে একটু এগিয়ে নিয়ে গেলেন। একটা মেয়ে পিছন ঘুরে কার সাথে যেন কথা বলছিল। রেহানা মৃদু সরে ডাকলেন
–নুহা মামনি আমার ছেলে সামিন!

চলবে…………

#নভেম্বরের_শহরে
লেখক – এ রহমান
বোনাস পর্ব

বাইরে ঝুম বৃষ্টি। ভেতর থেকে পানির টুপটাপ আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। চারিদিকে শুভ্রতায় ঘেরা। সাদা আলোর সাথে সাদা পর্দা গুলো ফরফরিয়ে উড়ছে। নুহা আর সামিন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের দৃষ্টি দুজনের দিকেই স্থির। রেহানা একটু দূরে দাঁড়িয়ে আনিসের সাথে কথা বলছেন। সামিন এর দৃষ্টি শান্ত। কিন্তু নুহার দৃষ্টি ঠিক বোঝার উপায় নেই।

— নুহা কার নাম?

নার্সের কথায় ঘাড় বেঁকিয়ে সামিন এর পিছনে তাকাল নুহা। মৃদু সরে বলল
— জি আমি।

— আপনাকে আপনার মা ডাকছেন।

— আসছি।

মৃদু সরে বলেই নুহা একবার সামিন এর দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে চলে গেলো। সামিন তার যাওয়ার দিকে তাকিয়েই থাকলো। খানিকবাদে সামিন এর ফোন বেজে উঠলো। ফোন ধরেই বলল

— হ্যা বল।

ফোনের ওপর পাশ থেকে শেফা বলল
— কি করছিস ভাইয়া?

— এই তো হাসপাতালে।

হাসপাতালের কথা শুনে শেফা হকচকিয়ে গেল। চিন্তিত গলায় বলল
— হাসপাতাল? কার কি হয়েছে ভাইয়া? খালু খালামণি ঠিক আছে তো।

— সবাই ঠিক আছে। চিন্তা করার কিছু নেই। আমার হবু শাশুড়ি অসুস্থ। তাই এসেছি।

শেফা কিছুক্ষণ থেমে কথাটা মাথায় ঢুকতেই হু হা করে হেসে উঠলো। তার হাসি দেখে সামিন ও হাসলো। সামিন আরো কিছুক্ষণ কথা বলল ফোনে। কথা বলতে বলতে কেবিনের দরজায় হেলান দিয়ে দাড়ালো। বাইরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো সামিন। নুহা কেবিন থেকে বাইরে বের হবে। সামিন পুরো দরজা জুড়ে দাড়িয়ে আছে। বের হওয়া অসম্ভব। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে অপেক্ষা করলো সরে যাওয়ার। কিন্তু কোনভাবেই সরছে না। নুহাকে বাইরে যেতেই হবে। সে একটু বিরক্ত হয়ে বলল

— এক্সকিউজ মি!

সামিন ঘুরে তাকাল। নূহাকে দেখে ফোনটা কেটে দিলো। কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকলো। নুহা মিনমিনে কণ্ঠে বলল
— আমি বাইরে যাবো।

সামিন ঘুরে হাত গুঁজে দাড়ালো। নুহা নিচের দিকে তাকিয়ে ভাবছে সে যাবে কিনা। কারণ সামিন সরবে না। আর এই অবস্থায় বাইরে যেতে হলে সামিন এর শরীরে ছোঁয়া লাগবে। আর সামিন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নুহার বেশ অসস্তি হচ্ছে। কোন উপায় না দেখে নুহা ধির পায়ে এগিয়ে গেলো। সামিন তার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেছে। যা ভেবেছিল তাই। নুহা দরজার কাছে যেতেই সামিন এর সুগন্ধির তীব্র ঘ্রাণ নাকে এসে লাগল। সেটা কোন রকমে সামলে নিলো। কিন্তু সামিন এর অমন গভীর দৃষ্টি আর শরীরের হালকা স্পর্শে অসস্তিতে গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো তার। নুহা পার হয়ে চলে গেলো। সামিন তাকিয়েই আছে। সামিন ওভাবেই দাড়িয়ে থাকলো। খানিকবাদে নুহা ফিরে এলো। কিন্তু সামিন কে আগের জায়গায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে আর ভেতরে ঢুকলো না। রেহানা এসে নুহা কে বলল
— দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোমার মাকে বের করে আনো।

সামিন সরে গেল। নুহা তার মাকে ধরে বের করে আনলো। তিনি বাইরে আসতেই রেহানা এগিয়ে গেলেন। ছেলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ কথা বলে নুহা সালেহা কে ধরে বের করে নিয়ে গেলো। সামিন আগেই নিচে নেমে গাড়ির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। রেহানা আর নুহা ধরে সালেহা কে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। নুহা মায়ের কাছেই বসলো। সামিন আর রেহানা সামনে বসলো। সামিন সামনের গ্লাসটা নুহার দিকে তাক করলো। নুহা চোখ তুলে তাকাতেই সামিন এর চোখে চোখ পড়ল। চোখ নামিয়ে নিলো সে।

বেশ কিছুক্ষণ ড্রাইভ করে তারা বাড়ি পৌঁছালো। গাড়ি থেকে নেমেই দেখলো মৌ দাড়িয়ে তাদের অপেক্ষা করছে। মাকে নামতে দেখেই দৌড়ে গিয়ে ধরলো। রেহানা আর মৌ সালেহা কে ধরে নিয়ে গেলো ভিতরে। সালেহা বাড়িতে ঢোকার আগে ক্লান্ত গলায় বলল
— ভেতরে এসো বাবা।

সামিন আপত্তি জানাল কিন্তু কোন লাভ হলো না। সালেহা জেদের কাছে হার মেনে গেলো। নুহা দাড়িয়ে ছিলো এতক্ষণ। ঘুরে দরজার দিকে যেতেই সামিন মৃদু কন্ঠে বলল
— একটু দাড়াবেন?

নুহা ফিরে তাকালো। কঠিন গলায় বলল
— কেনো ডাকছেন আজকে জানেন তো। নাকি বরাবরের মতো জানিনা বলবেন।

সামিন একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল
— আজকে জানি।

নুহা আবারও কঠিন গলায় বলল
— কেনো? আজ পরিচয় পেয়েছেন বলে? এতদিন অচেনা কেউ ছিলাম তাই কি বলবেন জানতেন না। আজ পরিচয় পেয়েছেন বলে সব জেনে গেলেন। বাহ!

সামিন অসহায় গলায় বলল
— আপনি কিন্তু আমাকে ভুল বুঝছেন। যেমনটা ভাবছেন তেমন কিছুই না।

নুহা তাচ্ছিল্য করে বলল
— আমি কিছু ভাবিনি। আপনি যা করেছেন তাই বললাম।

এর মাঝেই মৌ এসে বলল
— আপা তোমাদেরকে ডাকছে।

নুহা আর কোন কথা না বলেই চলে গেলো। সামিন অসহায়ের মতো একটা শ্বাস ছেড়ে পিছনে পিছনে গেলো। কিন্তু বেশ বিরক্ত হলো। নুহা কোনভাবেই সামিন এর কথা শুনেনা। আজও তাই করলো।

—————

প্রতিদিনের মতো সামিন আজও সেই রাস্তায় দাড়িয়ে আছে নুহার অপেক্ষায়। সন্ধ্যা বেয়ে যাচ্ছে কিন্তু নুহার কোন খবর নেই। বেশ খানিক বাদে নুহা ফুটপাত ধরে হেঁটে আসছে। নুহাকে দেখে সামিন এগিয়ে তার সামনে গিয়ে দাড়ালো। হঠাত এমন হওয়ায় নুহা বেশ ভয় পেয়ে গেলো। চোখ তুলে তাকাল। সামিন কে দেখে ভয়টা কেটে গেলেও বিরক্ত হলো। চোখ বন্ধ করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল
— আপনি?

সামিন গম্ভীর গলায় বলল
— আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো।

— আমার সময় নেই। দেরি হয়ে যাবে।

নুহার এমন কথায় সামিন বুঝে গেলো ভালো করে কথা বলে লাভ নেই। এই মেয়ে এমনি। সোজা কথা বুঝেনা। কঠিন গলায় বলল
— গাড়িতে উঠুন।

নুহা কাধে ঝুলানো ব্যাগের হ্যান্ডেলটা শক্ত করে চেপে ধরলো। বলল
— আমি আপনার সাথে কোথাও যেতে পারবো না। আমাকে এখন বাসায় যেতে হবে।

সামিন কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকলো। তারপর নুহার হাত চেপে ধরলো। টেনে গাড়িতে উঠে বসালো। নিজে বসে গাড়ি স্টার্ট দিতেই নুহা বিচলিত হয়ে বলল
— আমি বলেছি কোথাও যাবো না। আমাকে তবুও কেনো জোর করছেন।

সামিন ধমক দিয়ে বলল
— জাস্ট শাট আপ। নো মোর ওয়ার্ডস!

ধমক শুনে নুহা কেপে উঠলো। আর কোন কথা বলল না। একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে গাড়ি থামলো। সামিন নেমে নুহাকে নামতে বলল। নুহা নেমে দাড়িয়ে থাকলো। সামিন তাকে ইশারায় ভিতরে আসতে বলল। নুহাও কথা না বলে ভিতরে চলে গেলো। কারণ তার কাছে আর কোন উপায় নেই। নুহা আর সামিন একটা টেবিলে বসলো। নুহা চুপ করে বসে আছে। কোন কথা বলছে না। সামিন নুহার হাত টেনে ধরলো। নুহা আসে পাশে তাকিয়ে দেখলো তাদের দিকে কেউ দেখছে না। কিন্তু তার তবুও খুব অসস্তি হচ্ছে। কারণ এই প্রথম একটা ছেলে তার হাত ধরেছে। নুহা হাত টানাটানি করতে করতে বলল
— ছাড়ুন। কেউ দেখলে খারাপ ভাব বে।

সামিন গম্ভীর গলায় বলল
— এভাবে টানাটানি করলে যে কারো চোখে পড়বে। আর ভালো দেখাবে না। আমি কিন্তু কোন বেয়াদবি করছি না।

নুহা চুপ হয়ে গেলো। সামিন হাতের আংটিটা খুলে নিয়ে বলল
— কে দিয়েছে?

নুহা হাত ছাড়িয়ে নিল। মৃদু গলায় বলল
— আপনার মা।

সামিন আবার হাত টেনে নিয়ে নিজেই আংটিটা পরে দিয়ে বলল
— তাহলে আপনি এনগেজড!

নুহা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। বলল
— সেদিন তো বলেছি। সেদিন নিশ্চয় আমার কথা শুনে কষ্ট পেয়েছিলেন। কারণ আপনি তো জানতেন না দুর্ভাগ্য বসত আপনার সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।

সামিন হাসলো। বলল
— আপনি খুব দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছান মিস নভেম্বরী। আমাকেও কিছু কথা বলার সুযোগ দিন।

নুহা তাচ্ছিল্য ভরা দৃষ্টিতে তাকাল। সামিন অনুরোধের সুরে বলল
— আমার কি নিজেকে প্রমাণ করার জন্য সুযোগ পাওয়া উচিত না?

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে